শেষ বেলার কবিতা; সুন্দর পৃথিবী এঁকে দাও

আমার ছয় বয়সী মেয়ে, তার খাতা আর পেনসিল আমার সামনে ধরে আবদার করে- বাবা, আমাকে একটা পাখি এঁকে দাওনা ?
আঁকলাম…. সে তা দেখে অবাক , চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানায়… বাবা, আমি না তোমাকে পাখি আঁকতে বলেছি…. কিন্তু বাবা….তুমি যে খাঁচা আঁকলে?…. তুমি কি জাননা কেমন করে পাখি আঁকতে হয়?…..

বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি, বললাম- মাফ করো আমায় মা মনি…. সত্যি আঁকতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছি পাখির এনাটমি….

আবার মেয়েটি এগিয়ে দিলো ওর ড্রয়িং বুক, বলল- বাবা… আমাকে একটা ধানের গোছা এঁকে দাওতো….!

পেনসিল দিয়ে ধানের গোছা আঁকতে গিয়ে এঁকে ফেলি কাস্তে!

আমার অক্ষমতা দেখে, মেয়েটি হতাশ হয়ে পড়ে, বলে…. বাবা, তুমি কি বুঝনা… এক গোছা ধান আর কাস্তের মধ্যে কি ব্যবধান ?

বললাম- মা মনি… এক সময় ছিল আমিও জানতাম ধানের এনাটমি… জানতাম গমের এনাটমি…. জানতাম গোলাপের এনাটমি……

কিন্তু আজকের এই সময় বনের অবোধ বৃক্ষরা হয়ে গেছে অস্ত্র মানব….. বাগানের গোলাপও হয়ে গেছে অবসাদ গ্রন্থ মানব…. এই সময়ে ধানও অস্ত্র…. পাখিরাও অস্ত্র ….. সংস্কৃতিও অস্ত্র …. ধর্মও অস্ত্র …..রাজনীতিও অস্ত্র, সমাজনীতিও অস্ত্র, সভ্যতাও অস্ত্র হয়ে গেছে….. তুমি এক মুঠি ভাতও পাবেনা যদি তোমার হাতে না থাকে একটি অস্ত্র….. তুমি বাগান থেকে একটি গোলাপও আনতে পারবেনা যদিনা হাতে থাকে চাকু …. তুমি তোমার স্কুলের একটি বইও কিনে দিতে পারবো না যদি না আমার আঙ্গুল গুলি সশব্দে বিদীর্ণ হয়….

জানিনা সোনামণি, আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছে কিনা কিন্তু আরও কাছে এসে বসলো আমার বিছানার প্রান্তে…। বলল—

তুমি যখন পাখি আর ধানের ছবি এঁকেই দিলেনা তখন আমাকে একটি কবিতা শুনাও!!!
কি কবিতা শুনাবো তাকে, শিশুদের জন্য আমাদের কবিরা তো কিছু কবিতা লিখে যায় নাই….. এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে নামছিলো আমার গাল বেয়ে……

মেয়েটি তার ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো আমার অশ্রু… আবাক কন্ঠে বলল, বাবা…. এ..তো অশ্রু ? এ তো কোন কবিতা নয়!…..

বললাম- মা মনি, যখন তুমি বড়ো হবে… তখন তুমি পড়বে, আবিষ্কার করবে আমার জীবন কবিতা …. তখন তোমারও দু’চোখ ভরে ঝরবে অশ্রু…… বুঝবে এই আমার জীবন কবিতা গুলি লিখা হয়েছিলো অশ্রু ভেজা আঙ্গুল দিয়ে….

মেয়েটি আবারও ওর রঙ্গিন পেনসিল গুলি আমার সম্মুখে রেখে বলল- বাবা আমার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী এঁকে দাও…… আমি আমার মেয়ের জন্য সুন্দর পৃথিবী আঁকতে চাই !! কিন্তু পেনসিল গুলি বার বার হাত থেকে পিছলে, পিছলে যাছে ….. আর আমি ……তলিয়ে…. যাচ্ছি অশ্রুর বন্যায়…

Loading

মুনিম সিদ্দিকী

About মুনিম সিদ্দিকী

ব্লগে দেখছি অন্য সহ ব্লগাররা তাদের আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন নিজ নিজ ব্লগে! কুঁজো লোকের যেমন চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছা জাগে তেমন করে আমারও ইচ্ছা জাগে আমি আমার আত্মপরিচয় তুলে ধরি! কিন্তু সত্য যে কথা তা হচ্ছে শুধু জন্মদাতা পিতা কর্তৃক আমার নাম আর পরিবারের পদবী ছাড়া আমার পরিচয় দেবার মত কিছু নেই! আমি এক বন্ধ্যা মাটি যেখানে কোন চাষবাস হয় নাই। যাক আমি একটি গান শুনিয়ে আত্মপ্রতারণা বর্ণনা শেষ করছি- কত শহর বন্দরও পেরিয়ে চলেছি অজানা পথে - কালেরও নিঠুর টানে- আমার চলার শেষ কোন সাগরে তা তো জানা নাই! ধন্যবাদ।

Comments

শেষ বেলার কবিতা; সুন্দর পৃথিবী এঁকে দাও — 4 Comments

  1. এই কবিতা যদি সংলাপ ব্লগের সেরা কবিতার তালিকায় স্থান না পায় তা’হলে কবিতা সংজ্ঞা বদলে ফেলতে হবে। এত চমৎকার করে, এত সাবলীল ভাবে, আটাসাটো করে স্বল্প পরিসরে কত গল্প বলা হয়ে গেল ছোট্ট একটা কবিতায়! একেবারে মর্মমূলে যেয়ে ঘা দেওয়ার মত কবিতা!! চমৎকার, আবারও বলি চমৎকার!!

    • কবিতা লেখক প্রচুর হলেও মনে হচ্ছে এক কবি অন্য কবির লেখা কবিতা পড়েন না! আর পড়লেও অন্য কবির কবিতায় ১/২টি কথার কমেন্ট করতে কৃপণতা করে থাকেন। আপনাকে ধন্যবাদ।

  2. ধন্যবাদ আপনার মনের করুন অনুভুতি শেয়ার করার জন্য।
    “এই সময়ে ধানও অস্ত্র…. পাখিরাও অস্ত্র ….. সংস্কৃতিও অস্ত্র …. ধর্মও অস্ত্র …..রাজনীতিও অস্ত্র, সমাজনীতিও অস্ত্র, সভ্যতাও অস্ত্র হয়ে গেছে….. তুমি এক মুঠি ভাতও পাবেনা যদি তোমার হাতে না থাকে একটি অস্ত্র…”
    একেবারে খাটি কথা। আর এ সবই হয়েছে এজন্য যে এ পৃথিবীর মানুষগুলা বদলে গেছে! মানুষ ছুটে চলছে তাদের নিজের স্বার্থে।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *