শুধু ট্রাইব্যুনাল নয়, পুরা বিচার বিভাগই মুখথুবড়ে পড়েছে

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্ট্রাইব্যুনালের মুখথুবড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে মূলত পুরা বিচার বিভাগই মুখথুবড়ে পড়েছে। বিচার বিভাগ যে আসলে ভেঙে পড়ছে তার লক্ষন অনেক দিন আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শরীরে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা মারাত্মক ব্যাধি এখন সামনে উপদংশের মত বেরিয়ে পড়ল। আসলে বিচারব্যবস্থার সঙ্কটকে সামগ্রিক ভাবে আমাদের বুঝতে হবে।

প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা আর বিচার ও ইনসাফ কায়েমের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, তাকেও মনে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের আবেগ সাধারণ মানুষ হিশাবে আমাদের অন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগকে সেই কুয়াশা থকে মুক্ত রাখা দরকার ছিল। সেটা হয় নি। আদালতের দায় শুধু আমাদের প্রতি নয়, বাংলাদেশের নাগরিক হিশাবে অভিযুক্তের প্রতিও রয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে বাংলাদেশের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখবার কোন সুযোগ নাই। নাগরিকদের দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা অবশ্য আদালত অনেক আগেই খুইয়েছে। আদালত দুর্নীতির জায়গা, গরিব এখানে বিচার পায় না। এই অবস্থান থেকে ক্রমে ক্রমে আমরা দেখছি আদালতের কাছে সুবিচার পাবে সেটা সাধারণ মানুষ আর বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাস সমাজে কিভাবে নিষ্ঠুর হত্যার যজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ স্পষ্ট। ছিনতাইকারী বা ডাকাত সন্দেহে প্তি জনগণ এখন মানুষ পিটিয়ে মারে। আদালত বা বিচারের অপো করে না। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। বিচারব্যবস্থার ব্যাধি বা য়ে এখন পুরা সমাজ আক্রান্ত। জনগণের মধ্যে পিটিয়ে হত্যার যে মানসিকতা দেখি, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিও একই মানসিকতা দেখা যায়। যারা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক নেটওয়ার্ক সফর করেন, তারা জানেন যে ‘বিচার’ কথাটা নিছকই কথার কথা হিশাবে বলা হয়। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াকেই ‘বিচার’ বলা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। অভিযুক্ত আদৌ দোষী নাকি নির্দোষ বা দোষী হলেও তার অপরাধের মাত্রা কী এই সব মোটেও বিবেচ্য নয়।

 দ্বিতীয়ত, আদালত ক্ষমতাসীনদেরÑ সেটা নির্বাচিত রাজনৈতিক দল হোক কিংবা হোক সেনাবাহিনীÑ যে যখন আসে তার ভাড়া খেটেছে বিভিন্ন সময়। এই ইতিহাসই প্রতিষ্ঠান হিশাবে আদালতের অন্তর্গত চরিত্র হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন নয় যে, প্রতিষ্ঠান মানে কিছু বিল্ডিং যেখানে বিচারকরা বিচার বসান। এ জন্য পণ্ডিতরা বলেন, আদালত বা বিচারব্যবস্থার ইতিহাসের মধ্যে রাষ্ট্রের আত্মজীবনীর সারাংশ লেখা থাকে। প্রতিষ্ঠান হিশাবে বিচার বিভাগের চরিত্র সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বিচার বিভাগ নিজের কর্মকাণ্ড দিয়েই তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। সম্প্রতি বিচারকদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা দ্রুত মন্দ হতে শুরু করেছে। এর কারণ আছে। বিচারকরা নাগরিকদের মৌলিক সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার রা করার পরিবর্তে নিজেরাই তা লঙ্ঘন করতে শুরু করেছেন। যেমন, জামিনযোগ্য অপরাধের জন্য জামিন না দেওয়া, অভিযুক্তকে নির্যাতন করে তার অপরাধের জন্য স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য রিমান্ডে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। পুলিশের নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে বিচারকদের সামনে দাঁড়াবার পরেও আবার রিমান্ডে অভিযুক্তকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার মত অমানবিক কাজ করা, ইত্যাদি। বিচারকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচারব্যবস্থার ভয়াবহ অবয়কেই নির্দেশ করে। আজ বিষফোঁড়ার মত তা ফেটে বেরিয়ে এসেছে মাত্র। জনগণ দেখেছে বিচার বিভাগ পত্রিকার সম্পাদকদের আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, নাগরিকদের আদালতে এনে তাদের সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছে। এমনকি ২০০৯ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে আদালত অবমাননার জন্য সাজা দিয়েছে আদালত। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝেছিল কী ঘটছে। আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব জয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ এবং এ দেশের বিচার বিভাগের সার্বিক অবয়ের কাহিনী প্রকাশ করবার কারণেই দৈনিক আমার দেশ সরকারের রোষানলে পড়েছিল। মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেবার এই অর্থই সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। অর্থাৎ বিচার বিভাগের ভাঙনের লণ দেখা গিয়েছিল দীর্ঘদিন আগে থেকেই। পচন চলছিল অনেক দিন ধরে। এখন সেই পচনের দুর্গন্ধ নিয়েই ট্রাইব্যুনাল মুখথুবড়ে পড়ল।

৩.
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোন সমালোচনা আমলে নেয় নি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ দেশে এবং বিদেশে করা হয়েছে তার মূল সুর হচ্ছে ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এই ব্যর্থতার পরিণতি সম্পর্কে বারবার সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু কর্মকাণ্ডে এটাই মনে হয়েছে যে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি ও যুদ্ধাপরাধের বিচার-সংক্রান্ত গতবারের নির্বাচনী ঘোষণা যেকোন ভাবে বাস্তবায়ন করতে ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করছে মতাসীনরা। অভিযোগ হচ্ছে, আসলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারের ছলনা করছে। মতাসীনদের নির্দেশে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়াই এর কাজ। বিচার নয়। কাউকে ঘৃণা করি বলে তাকে শাস্তি দেওয়া এক জিনিস, আর কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে স্যা-প্রমাণ দেখে সে দোষী না নির্দোষ বিচার করা ভিন্ন জিনিস। এই সকল অভিযোগকে ট্রাইব্যুনাল কখনোই আমলে নেয় নি। মতাসীনরা ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে এসেছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এই প্রচারের আড়ালে তারা নিজেদের নিরাপদ ভেবেছে। বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ব্যবস্থার দিক ছাড়াও দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীন বিচারকদের সংখ্যাও কম নয়। বিচার বিভাগের দলীয়করণ আরেকটি দিক। এই সব নিয়ে লেখালিখি-কথাবার্তা হয় প্রচুর। কিন্তু সেই সব লেখালিখি কথাবার্তা অধিকাংশই একদেশদর্শী। আওয়ামীবাজ প এর জন্য বিএনপিকে আর বিএনপি মার্কা পত্রিকা ও বুদ্ধিজীবীরা এর জন্য আওয়ামী লীগকে অভিযোগ করে আসছে। আর যারা অতি চতুরÑ নিজেদের নিউট্রাল প্রমাণ করতে ব্যস্তÑ তারা দুই দলকেই দায়ী করে। এই অবস্থান নেবার কারণে তাদের উপসংহার দাঁড়ায়Ñ রাজনীতি মাত্রই খারাপ, একমাত্র সমাধান তখন হয়ে ওঠে দেশকে রাজনীতিমুক্ত করা। দলবাজিতার চেয়ে বিরাজনীতিকরণের এই সুশীলতা আরো ভয়ঙ্কর।

৪. কী করতে হবে :

বিচার বিভাগীয় তদন্ত এটা পরিষ্কার যে মতাসীনরা মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ পত্রিকার ওপর প্তি হয়ে উঠবে। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা, শাস্তি দেওয়া, আমার দেশ বন্ধ করাÑ ইত্যাদি যেকোন পদপে নিতে তারা দ্বিধা করবে না। ফলে নাগরিক হিশাবে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছেÑ আমার দেশ পত্রিকার ভূমিকা সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা। এই ধরনের হামলা এলে এই পত্রিকার পাশে দাঁড়ানো। আমার দেশ পত্রিকা বিচারব্যবস্থার অধঃপতনের বিরুদ্ধে লড়ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই লড়াই করতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান জেলেও থেকেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। ফলে ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারকের অনৈতিক ও অপরাধমূলক ভূমিকা ফাঁস করে দেওয়া তাঁর লড়াইয়ের ধারাবাহিকতারই অংশ। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ নয়, বরং যেন স্বচ্ছ হয় তার জন্যই এই লড়াই। এই লড়াই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। যে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ মতাসীনদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার না হয়ে নাগরিকদের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার রা করবে। মনে রাখা দরকার মতাসীনরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে না, করছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে এমন একটি বিচারব্যবস্থাÑ যা সরকার ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগও জাতীয় সংসদ থেকে ‘পৃথক’ বা ‘আলাদা’ ভাবে কাজ করে। ‘পৃথক’ ও ‘আলাদা’ ভাবে কাজ করার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দুই বিভাগ থেকে পৃথক বা আলাদা ভাবে কাজ করার অর্থ বিচার বিভাগের ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না। বিচার বিভাগ কখনোই জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ঊর্ধ্বে বা বাইরের ‘স্বাধীন’ কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অধীন। যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র হিশাবে জনগণ প্রণয়ন করে। বিচার বিভাগের জন্ম বা গঠনও এই দলিলের ভিত্তিতেই ঘটে। জনগণের অধীনস্থতাÑ অর্থাৎ জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রার দায় পালনের মধ্য দিয়েই বিচার বিভাগ নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করে। বিচারক আদালতে বসেন ঠিকই, তিনি নির্বাচিত নন, কিন্তু জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার মধ্য দিয়েই তিনি গণতন্ত্রের পাহারাদার হয়ে ওঠেন। এই পাহারাদারি বাদ দিয়ে বিচারব্যবস্থা যখন মতাসীনদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়, বিচারকে যখন প্রহসনে পরিণত করা হয়Ñ তখন সেই ব্যবস্থাকে উৎখাত করে বিচার বিভাগকে নতুন গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। এই সকল মৌলিক প্রশ্ন বাদ দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে বিচারের নামে বিচারকদের স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠা করা। তার কাফফারা এখন আমাদের গুনতে হচ্ছে। তবে অবিলম্বে যে কাজ করা দরকার তা হচ্ছে এই ঘটনার পূর্ণ বিচার বিভাগীয় তদন্ত। এর সঙ্গে আর কে বা কারা জড়িত আছে তা পুরাপুরি জানা দরকার। বিচারপ্রক্রিয়াকে সত্যিকার অর্থে ‘বিচার’-প্রক্রিয়া করে তুলতে হলে বিচার বিভাগকে অবশ্যই দায়দায়িত্ব নিতে হবে। পদত্যাগী বিচারক আগামিতে হাইকোর্ট বেঞ্চে কিভাবে বসেন, সেই বিষয়েরও ফয়সালা হওয়া দরকার। পদত্যাগেই ঘটনার ইতি হতে পারে না। এই ধরনের সমস্যা রোধ কিম্বা বিচারপ্রক্রিয়াকে এভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা বন্ধ করবার কার্যকর উপায় খুঁজতে হবে।

(পূর্ব প্রকাশিত সুত্র :নয়াদিগন্ত, ১৩/১২/২০১২)

Loading


Comments

শুধু ট্রাইব্যুনাল নয়, পুরা বিচার বিভাগই মুখথুবড়ে পড়েছে — 1 Comment

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *