র‌্যাব : বিশেষণবিহীন!

 আজকের লেখাটি একটু ব্যতিক্রমীই হবে। কারণ আজকের লেখাটি জনগুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে। ২০১৩ সালে যে কয়জন র‌্যাব সদস্য বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) অথবা প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পেয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, যিনি অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত র‌্যাব ১১-এর অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, যিনি প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (সেবা) পেয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই একজন দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ, দেশপ্রেমিক নাগরিক তথা সরকারি কর্মকর্তা হবেন এটাই স্বাভাবিক কল্পনা এবং অনুমান। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হয়েছে বিধায় আমি নামটা নিলাম। নামটা নেয়ার পেছনে পরিপ্রেতি নি¤œরূপ। ২৭ এপ্রিল ২০১৪ নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছাকাছি এলাকা থেকে সাতজন ব্যক্তি অপহরণ হয়েছিল এবং দুই দিন পর শীতল্যা নদীতে ওই সাতজনেরই মৃতদেহ আবিষ্কার করা হয়। ওই সাতজনকেই নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বিভিন্ন কায়দায় কাটাকাটি করে ও রশি দিয়ে বাঁধাবাঁধি করে লাশগুলো শীতল্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লাশগুলো যেকোনো কারণেই হোক না কেন, নদীর তলদেশে ডুবে না থেকে অথবা স্রোতের সাথে ভাটির দিকে ভেসে না গিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরেরই কাছাকাছি এলাকায় শীতল্যা নদীতে ভেসে ওঠে। ইংল্যান্ড তথা যুক্তরাজ্যের অন্যতম শিল্পশহর ড্যান্ডি। ওই ড্যান্ডির প্রতীকী নামের অনুকরণে নারায়ণগঞ্জ শহরকে বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি। কারণ, ইংল্যান্ডের ড্যান্ডির মতো নারায়ণগঞ্জ শহরও ছিল নদীর তীরে জেগে ওঠা ও বিকশিত শিল্পশহর, বিশেষত পাট শিল্পের শহর। শীতল্যা নদী ছিল নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণ। সেই শীতল্যার পানিতেই ভেসে উঠেছিল সাতটি লাশ। লাশ ভেসে ওঠার পর হাজার হাজার মানুষ অকুস্থলে জমায়েত হয়। লাশ শনাক্ত করে আত্মীয়স্বজন। তারপর আর বিষয়টি তিগ্রস্ত পরিবারের পারিবারিক বিষয় থাকেনি, এমনকি নারায়ণগঞ্জ শহরের অধিবাসীদের একান্ত বিষয় হিসেবেও থাকেনি; এটা হয়ে গেছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়। যেই সাতজন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ছয়জনই স্বীকৃতভাবে আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী। আরেকজন অ্যাডভোকেট চন্দন। ছয়জন ব্যক্তি নিহত হওয়ার কারণে তো আছেই, বিশেষ করে নিজেদেরই একজন সহকর্মী অ্যাডভোকেট চন্দন নিহত হওয়ার কারণে নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী সম্প্রদায় বিশেষভাবে মর্মাহত ও বিুব্ধ। এই সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প থেকে মামলা হয়েছে; সেখানে অনেককে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক মামলার বাইরে, পরিস্থিতি নিয়ে ও হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে অনেক বিুব্ধ বা সংুব্ধ ব্যক্তি জাতির সামনে অনেক নালিশ বা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাদের বক্তব্য বা নালিশের অন্যতম ‘আইটেম’ হচ্ছে র‌্যাব ১১-এর অধিনায়ক ও তার অধীনস্থ অন্য দুইজন সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ। অভিযোগের সারমর্ম হচ্ছে, নূর হোসেন স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং যুগপৎ আইনানুগ ও বেআইনানুগ ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে র‌্যাবের অফিসারদের মাধ্যমে বা র‌্যাবের অফিসারদের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এইরূপ অভিযোগ উপস্থাপিত হওয়ার অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই কর্তৃপ র‌্যাবের তিনজন অফিসারকে র‌্যাব থেকে প্রত্যাহার করে বা ফিরতি-বদলি করে যথাক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে স্থাপন করে। এর পরপরই এ তিনজন অফিসারকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনাকারী আইন মোতাবেক অকালীন বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ এখন থেকে ১০ দিন আগে বাধ্যতামূলক অবসর পান। অপর দিকে আকাশে-বাতাসে যখনই র‌্যাবের অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উচ্চারিত হতে থাকে, তখনই দাবি উঠতে থাকে এই তিনজন সামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করার জন্য। কেউ বলবেন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে, কেউ বলবেন অনেক পানি ঘোলা করার পর, কেউ বলবেন জনগণের চাপের মুখে নতিস্বীকার করে, কেউ বলবেন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীদের উত্তাল দাবির পরিপ্রেেিত ১৬-১৭ মে সেনাবাহিনীর দুইজন (সাবেক র‌্যাব) কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শহরের উপযুক্ত পুলিশ কর্তৃপরে হেফাজতে আছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন চাকরিরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, মহাদোর্দণ্ড প্রতাপশালী একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর কন্যার স্বামী তারেক সাঈদ মোহাম্মদ গ্রেফতার হয়েছেন, এটা বিভিন্ন কারণেই একটা সংবাদ বটে। সেজন্যই এই কলামের শুরুতে নামটা নিয়েছি। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ একা গ্রেফতার হননি। তার অধীনস্থ কর্মকর্তা মেজর আরিফও গ্রেফতার হয়েছেন। দুই দিন পর তার আরেক অধীনস্থ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানাও গ্রেফতার হয়েছেন। মিডিয়া দেশবাসীকে জানিয়েছিল, রানাকে গ্রেফতারের জন্য ঠিকানা মোতাবেক পাওয়া যায়নি। অতএব, রানা স্বেচ্ছায় পুলিশ বা আদালতের কাছে নিজেকে উপস্থিত করে আইনি প্রক্রিয়াকে সহায়তা করেছেন বলতে হবে। এই তিনজন সামরিক কর্মকর্তা আইনের প্রয়োজনে বা পরিস্থিতির কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। যেহেতু ঘটনার তিন-চার দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ওই তিনজন সামরিক কর্মকর্তাকে সর্বপ্রকারের আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য সুযোগ সুবিধাসহ বাধ্যতামূলক বা অকালীন অবসরে পাঠিয়েছিল, সেহেতু ধরেই নেয়া হয়েছিল বা হয়েছে যে, প্রাথমিকভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু দোষের ব্যাপ্তি অজানা। কিছুটা জানা হওয়ার পর তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো। আরিক অর্থে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, গ্রেফতার কর্মটিকে সহজ করার জন্য ও আইনানুগ করার জন্য তাদেরকে অবসরে পাঠানো হয়েছিল। আমি এই কলামটি লিখছি সোমবার মাগরিবের নামাজের পর। পাঠক কলামটি পড়বেন আরো ৩৬ ঘণ্টা পর, ২১ মে ২০১৪ বুধবার। সেনাবাহিনীর অফিসারগণ বাধ্যতামূলক অবসরে যান, এটা মারাত্মক সংবাদ নয়। মারাত্মক সংবাদ হলো সেনাবাহিনীর অফিসারগণ প্রত্যভাবে গ্রেফতার হলেন, আদালতের অনুমতিক্রমে তারা রিমান্ডে গেলেন। আরেকটু খোলাসা করে বলি এখন থেকে তিন সপ্তাহ আগেও লেফটেন্যান্ট তারেক সাঈদ মোহাম্মদ নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত মতাধর কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের ভাষায় র‌্যাবের সিও। আনুষ্ঠানিক হোক বা অনানুষ্ঠানিক হোক, জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশ প্রশাসন র‌্যাবের সিও-কে হিসাবের মধ্যে রেখে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। সেই র‌্যাবের সিও এখন ওই নারায়ণগঞ্জ শহরের পুলিশের হেফাজতে রিমান্ডে আছেন। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মানুষের কাছ থেকে শোনা, ছোট-বড় কিল-ঘুষি খেতে হয়, ছোট-বড় অত্যাচার সহ্য করতে হয় তথা শরীরের ওপরে বিভিন্ন প্রকৃতির ও মেজাজের ‘আদরযতœ’ প্রয়োগ করা হলে সেটা ‘উপভোগ’ করতে হয়। কী করতে হয় বা না হয় সেটা কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার বা র‌্যাব অফিসারদের থেকে বেশি কেউ জানবেন না। ব্যক্তি হিসেবে তিনজন সামরিক কর্মকর্তার বর্তমান অবস্থান নিয়ে আমার আফসোস নেই। আমার আফসোস তাদের পরিচয় নিয়ে। দেড় বছর আগে একবার দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম যখন একজন সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের নাম ডেসটিনির আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির সাথে জড়িত করে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। আবার মর্মাহত হলাম এই তিন র‌্যাব কর্মকর্তার পরিচয় বারবার যখন মিডিয়ায় আসছে দিনের পর দিন। আমার মর্মাহত হওয়ার অতিরিক্ত কারণ আছে। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে আমি মেজর জেনারেল র‌্যাংকে প্রমোশন পেয়ে যশোর সেনানিবাসের ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং তথা জিওসি হয়েছিলাম এবং যুগপৎ বাংলাদেশের দণি-পশ্চিম অংশের জন্য এরিয়া কমান্ডার ছিলাম। তার আগে ১৯৯৩ সালের মে মাস থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০ কিলোমিটার উত্তরে ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) কমান্ড্যান্ট ছিলাম। আমার হাত ধরে ৯টি ‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি লং কোর্স’ তথা বিএমএ লং কোর্স, ভাটিয়ারির কঠিন প্রশিণ শেষ করেছিল। তবে কোনো কোনো কোর্স আমার সময়ে কমিশন পেয়েছে, অন্যরা পরে কমিশন পেয়েছে। তাদের কমান্ড্যান্ট হিসেবে, কেউ আমাকে ছয় সপ্তাহ পেয়েছে, কেউ ছয় মাস পেয়েছে, কেউ এক বছর পেয়েছে, কেউ দেড় বছর পেয়েছে এবং কেউ দুই বছর পেয়েছে। কমান্ড্যান্ট এবং ক্যাডেটগণের মধ্যে পিতাপুত্রের মতো আত্মিক সম্পর্ক। কমান্ড্যান্টকে অনেক সময়ই কঠোর হতে হয়, অপ্রিয় হতে হয়; কিন্তু সব কিছুই সার্বিক মঙ্গলের জন্য। মঙ্গল বা কল্যাণের গ্রাহক দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের গ্রাহক হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, যারা অফিসার পায়। দ্বিতীয় প্রকারের গ্রাহক হচ্ছে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসাররা ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা। দু’টিতেই কমান্ড্যান্ট উৎকণ্ঠিত থাকেন, গ্রাহকরা যেন ভালো বস্তু পান, প্রশংসনীয় বস্তু পান, উপকারী বস্তু পান। আমি ছিলাম ১১তম কমান্ড্যান্ট। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর আমলে অস্থায়ী ভিত্তিতে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির যাত্রা শুরু। সেই সময় কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বের অতিরিক্ত, বিএমএ-এর কমান্ড্যান্টের দায়িত্বও পালন করেন। এক বছর পর সরকারের হুকুমে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে নতুনভাবে বিএমএ-কে স্থাপন করা হয়। আজ অবধি বিএমএ সেই ভাটিয়ারিতেই আছে এবং সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়েছে। কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার পর প্রথম মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট ছিলাম আমি (ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক)। আমার দুই বছর সাত মাস মেয়াদ, দৈর্ঘ্যে এখন পর্যন্ত দীর্ঘতম। সেই সুবাদেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের সূতিকাগারের একজন সেবক হিসেবে বা কেয়ারটেকার হিসেবে তরুণ অফিসারদের ভালো-মন্দে আমার মন প্রভাবান্বিত হয়। শুধু আমি নই, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির সর্বস্তরের প্রশিকরা যথা টার্ম কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার, একামেডিক টার্ম কমান্ডার, একাডেমিক ইন্সট্রাক্টর, ওয়েপন ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টর, জেসিও এনসিও ড্রিল-পিটি ইন্সট্রাক্টর সবাই তরুণ অফিসারদের ভালো-মন্দের অদৃশ্য অপ্রকাশিত ভাগীদার হন। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ২০১৪ সালে তরুণ অফিসার নন, কিন্তু অফিসার তো বটে। আমার মন খারাপ হওয়ার কারণটি হলো, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ কেন এমন কাজটি করলেন, যার কারণে তাকে গ্রেফতার হয়ে পুলিশের রিমান্ডে যেতে হলো? প্রশ্নটি এমনও হতে পারে, তারেক সাঈদ দোষনীয় কিছুই করলেন না, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে দোষী হিসেবে সারা পৃথিবীর সামনে সাব্যস্ত করে দিলো; তাহলে সেই পরিবেশ পরিস্থিতিটা কী? তার অজ্ঞাতে যদি কোনো দোষ বা সীমালঙ্ঘন হয়ে থাকত তাহলে আমাদের এক রকম অনুভূতি হতো, কিন্তু এখন অনুভূতি অন্য রকম। প্রচুরসংখ্যক ব্যক্তি আপে করে অথবা বিদ্রƒপ করে এমনটি বলেনÑ ‘আর্মি অফিসারদের ঠিক-ঠিকানা নেই। এরাও টাকা পেলে সব করে।’ অথবা বলেনÑ ‘টাকায় কথা বলে, আর্মি-টার্মি কোনো কিছু না, মাল ঢালো কাম হবে।’ অথবা বলেন ‘র‌্যাবে গেলে ভালো মানুষ আর ভালো থাকে না, ওপর থেকে দূষণ, সাইড থেকে দূষণ এবং নিচের থেকে স্রোতের টান। দূষণসমুদ্রের অতলগহ্বরে এরা হারিয়ে যায়।’ অথবা বলেন ‘এরা রাজনৈতিক সরকারের হাতিয়ার, সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলে, সরকার যেমন চালায় তেমন চলে।’ অথবা বলেন ‘নারায়ণগঞ্জের র‌্যাবের কী করার আছে, ওপরের থেকে যেমন হুকুম আসে তেমনই এরা করল!’ সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রসঙ্গে মানুষের এই যে ঢালাও মন্তব্য, এটা সাবেক সেনাকর্মকর্তাদেরকে এবং সাবেক সৈনিকদেরকে মর্মাহত করে। চাকরিরত সেনাকর্মকর্তা বা চাকরিরত সৈনিকদের অনুভূতির ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই, কারণ সেটা আমার আওতার বাইরে। সব মানুষই যে টিপ্পনি কাটছে বা খোঁচাখুঁচি করছে, এমন মোটেই নয়। যারা কাটছে না, তারাই মেজরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তারা সাইলেন্ট বা নীরব। সেজন্য যারা টিপ্পনি কাটছে বা খোঁচাখুঁচি করছে, তাদের আওয়াজ অনেক বড় মনে হয়। সব কিছুর শুরু র‌্যাবে যাওয়া নিয়ে। র‌্যাবের বয়স ১০ বছর শেষ হয়েছে ২৬ মার্চ ২০১৪ তারিখে। র‌্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়ন বা ইউনিট আছে। র‌্যাব-১, র‌্যাব-২, র‌্যাব-৩, র‌্যাব-৪ এবং র‌্যাব-১০ ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েনরত ও দায়িত্বরত আছে। র‌্যাব-৫ রাজশাহী, র‌্যাব-৬ খুলনা, র‌্যাব-৭ চট্টগ্রাম, র‌্যাব-৮ বরিশাল, র‌্যাব-৯ সিলেট, র‌্যাব-১২ সিরাজগঞ্জ, র‌্যাব-১৩ রংপুর, এবং র‌্যাব-১৪ ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত ও চতুষ্পার্শ্বের এলাকার জন্য দায়ী। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত অধুনা বিখ্যাত র‌্যাব-১১ এবং তাদের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা, মুন্সীগঞ্জ জেলা, নরসিংদী জেলা, লক্ষ্মীপুর জেলা, নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলা, চাঁদপুর জেলা এবং ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার থানা। সবগুলো র‌্যাব বিগত সময় ব্যস্ত থেকেছে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবিরোধী অভিযান, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ-বিস্ফোরক উদ্ধার অভিযান, মাদকবিরোধী অভিযান, অবৈধ ভিওআইপি রহিতকরণ অভিযান, অপহরণকৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে দেয়ার অভিযান, ভুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের গ্রেফতার অভিযান, জলদস্যু ও বনদস্যুবিরোধী অভিযান, চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা-ভিডিও পাইরেসি-বিরোধী অভিযান, ভেজালবিরোধী মোবাইল কোর্ট অভিযান এবং চরমপন্থী-বিরোধী অভিযান ইত্যাদি র‌্যাব নামক বাহিনীকে ব্যস্ত রেখেছে। র‌্যাব এসব কাজে প্রচুর সাফল্যও পেয়েছে, ১০ বছর আগে হোক বা পাঁচ বছর আগে হোক বা পাঁচ মাস আগে হোক; তাদের অনেক বদনামও হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সব কিছু ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে র‌্যাব শব্দটি ও র‌্যাব নামে প্রতিষ্ঠানটি মানুষের মানসপটে জড়িত হয়ে পড়েছে গুম হয়ে যাওয়া মানুষের প্রসঙ্গে, অপহরণ হয়ে যাওয়া মানুুষের প্রসঙ্গে, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নামে ঘটনায় মানুষ নিহত হওয়া প্রসঙ্গে। মানুষের ধারণা তথ্যের ওপর নির্ভর করে না। যেমনÑ নারায়ণগঞ্জের সাত খুন এবং পারিপার্শ্বিক আরো চার খুন র‌্যাব নামে শব্দটিকে মানুষের মানসপটে এমন নেতিবাচকভাবে স্থাপন করেছে যে, সেখান থেকে উদ্ধার পেতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃপ র‌্যাবকে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে, দমন-নিপীড়নের কাজে ব্যবহার করেছে। এই ব্যবহারের ফলে র‌্যাবের সুনাম বা বদনাম কী হবে বা হবে না অথবা সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সুনাম বা বদনাম হবে কি হবে না, এটা রাজনৈতিক কর্র্তৃপ গণনার মধ্যে রাখেনি। ফলে র‌্যাব হয়ে গেছে ‘ডাস্টার’-এর মতো। প্রাইমারি স্কুলে বা হাইস্কুলে কালো রঙের বোর্ডের ওপর শিকরা সাদা চক দিয়ে লেখেন। ওইটা মোছার জন্য ডাস্টার ব্যবহৃত হয়। ঘন ঘন বা ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে ব্ল্যাকবোর্ড পরিষ্কার থেকে অধিকতর পরিষ্কার হতে থাকে, কিন্তু ডাস্টার ময়লা থেকে অধিকতর ময়লাযুক্ত হতে থাকে। পরিষ্কার ব্ল্যাকবোর্ডকে কেউ ফেলে দেয় না, কিন্তু ময়লাযুক্ত ডাস্টারকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়। ওই উপমা থেকে উপযুক্ত উপসংহার টানা যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি সুনামধারী একটি প্রতিষ্ঠান। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ নামটিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকরা প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং এখনো করেই যাচ্ছেন। তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরে গিনেস বুকে রেকর্ড গড়ার জন্য পতাকা গঠন, বা লাখো লোকের কণ্ঠে জাতীয়সঙ্গীত গাওয়া ইত্যাদিসহ এমন কোনো সেবামূলক কাজ নেই, যেটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশবাসীর খেদমতে করেনি। কিন্তু এক জগ দুধের মধ্যে একটি তেঁতুলের দানা পড়লে যেমন হবে, তেমনই সব কিছু ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে র‌্যাবের এই তিন অফিসারের ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে। র‌্যাবে কিন্তু শুধু সামরিক বাহিনীর অফিসার নন, পুলিশ বাহিনীর অফিসারও বিদ্যমান। বস্তুত র‌্যাব নামে সংগঠনটি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অন্তর্ভ্ক্তু একটি সংগঠন। র‌্যাবের প্রধান (মহাপরিচালক) হচ্ছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা, যার পদবি অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বা অ্যাডিশনাল আইজি। কিন্তু গত ১০ বছরেই কদাচিৎ পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে না সু-আলোচনা বা না সমালোচনা, কোনোটার মুখে পড়তে হয়েছে। এটা কি ঘটনাচক্রে হয়েছে, নাকি কাজের পরিবেশটাই ওই রকম, আমি সেকথা বলতে পারব না। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দেশের খেদমত করতে গিয়ে র‌্যাবে কর্মরত সামরিক কর্মকর্তারা যদি নিজেদের নাম, পরিবারের নাম, আত্মীয়স্বজনের নাম, বাহিনীর নাম ইত্যাদিতে কালিমা লেপন করেন; তাহলে সেই খেদমত করে লাভ কী? র‌্যাব নামে প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়েছিল ১০ বছর আগে কিছু ল্যবস্তু নিয়ে। ১০ বছর ধরে ভালো-মন্দ কর্ম করতে করতে আজ ২০১৪ সালের মে মাসে র‌্যাবের সুনাম তো বটেই, অস্তিত্বই প্রশ্নের সম্মুখীন। অতএব, যথার্থভাবেই একটি তদন্ত কাম্য। একটি উচ্চ মতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কাম্য। তারা বলতে পারবে, কী কী কারণে র‌্যাবের এই দশা। তাদেরকে দুই মাস কিংবা তিন মাস সময় দেয়া যেতে পারে। কিন্তু দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে, আমাদের ইজ্জত রার স্বার্থে এ রকম একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত এখন সময়ের দাবি।

পূর্ব প্রকাশিত : নয়াদিগন্ত

Loading

Comments are closed.