যে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না!

উত্তর আমেরিকার আধুনিক ইসলামিক স্কলারদের বই পুস্তক যারা পড়েন তাদের কাছে এহিয়া ইমেরিকের নাম অপরিচিত হওয়ার কথা নয়। তিনি ইসলামের উপর অনেক মানসম্মত বই পুস্তক লিখেছেন। সে দিন  তাঁর লিখা “হাওটু টেল আদ্যরস এবাউট ইসলাম” বইটি পড়ার সুযোগ হওয়ায় আজকে আমার এ লিখাটি লিখতে ইচ্ছা হল।

ভুমিকা:
যখন কোন জনগোষ্টি বা সমাজ থেকে ন্যায় নীতি ও নৈতিকতার উৎসাহ উদ্দীপনা বা  অনুপ্রেরণা চলে যায় তখন সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য যা সর্বজন স্বীকৃত। মুসলিম সম্প্রদায় বা সমাজেও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। আর এজন্যই  মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সমাজে ন্যায় নীতি ও নৈতিকতার উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার প্রচেষ্টা বজায় রাখা। । যেহেতু একজন মুসলিমের প্রধান কনসার্ন বা উদ্বেগ হচ্ছে আল্লাহর হুকুম পালন করা এবং রাসুলের অনুসরণ তাই শুধু মাত্র ব্যক্তিগত আনুষ্ঠানিক এবাদত বন্দেগীর মাঝে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখে এবং  রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গাফিল থাকার মানে হচ্ছে চরম স্বার্থপরতা ও সেই সাথে আল্লাহ হুকুম ও রাসুলের আদর্শ অমান্য করার সমান অপরাধী। মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্ব হল সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করতে এগিয়ে আসা এবং তা সফল করতে হলে  সমষ্টিগত প্রচেষ্টার সাথে ব্যক্তিগত পর্য্যায়েও ইসলামের বানী প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে। সে লক্ষ্যে একজন মুসলিমকে সবসময় ইসলামের দায়ী তথা (Preacher)  প্রচারকের ভূমিকা পালন করতেই হবে। আর এ দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ হল  আল্লাহ বলেন। 

“ইহা তো শুধু বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ,

তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলিতে চাহে তাহার জন্য” (৮১: ২৭-২৮)

অন্য এক আয়াতে অন্যায় প্রতিরোধে মুসলমানের দায়বদ্ধতা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُون

তোমাদের মধ্যে এমন একদল হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম।”

মানুষকে এ পৃথিবীতে তার জীবনদর্শনের সিদ্ধান্ত নিবার স্বাধীনতা দিয়ে আল্লাহ ছেড়ে দিয়েছেন। Our life is  filled with choice.   একটি নির্দিষ্ট সময়ের এ জীবনে আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর এবাদতের তথা আমাদের স্রষ্টার হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার যে কোন একটি পন্থা গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন। চারিদিকে একটু খেয়াল করে দেখেন কত মানুষ আছে তারা আল্লার প্রতি আত্মসমর্পণের এ কর্তব্যকে কবর দিয়েছে অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় রাজনৈতিক স্বার্থে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে।  এরা নিজেরা অনেক সময় নিজেদেরকে ধর্মে বিশ্বাসী দাবী করলেও বাস্তবে ধর্মের বিরুদ্ধে নিজেরা চলে এবং অন্যকেও চলতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা হচ্ছে তার বান্দাকে তার  স্মরণে থাকার সম্পূর্ণ সুযোগ দেয়া যাতে সে তার নিজের ইচ্ছায় সঠিক প্রকৃতিতে ফিরে আসতে পারে। অতএব যাদের মাঝে এ সর্তকতা আছে এবং যারা জানে যে তাদের কর্তব্য হচ্ছে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদেরকে জাগানো। আর একেই ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় দা’ওয়া।    

আল্লাহ বলেন, “আমি তোমাদেরকে একটি মধ্য-পন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাহাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হইবে।”

এখন দেখি আমাদের প্রাণ প্রিয় নবীর উপর আল্লাহর অর্পিত ক্ষমতার প্রক্ষিতে রাসুল (স:) কি বলেন দা’ওয়া সম্পর্কে?

“বাল্লিগু আন্নি ওলাও আয়া” এমনকি একটি আয়ত (বাক্য) হলেও এ বার্তা বহন কর  Convey (the message) from me; even if only one verse .” (Sahih Bukhari)

“তোমরা ইসলামের জরুরী  ইলম অর্জন কর এবং অন্যকে শিক্ষা দাও কেননা আমি চিরদিন থাকবনা” (বোখারি)

অতএব ইসলামের প্রচার ও প্রসার করা তথা দা’ওয়াকাজ যে প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলামী স্কলাররা বলেন এখানে “বাল্লিগু” বলে রাসুলের অনুসারীকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে. ইসলামের বার্তা প্রচার করতেই হবে। অতএব নবীর আদেশ অমান্য করলে কি পরিণতি হবে তা আমাদেরকে ভাবতে হবে।

আমরা যদি নিজেদের চাকুরী,  নিজেদের পরিবার ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য সময় ব্যয় করা জরুরী মনে করতে পারি তাহলে এ মহা বিশ্বের মালিক ও পরিচালকের খেদমতে নিজেদের সময় দেয়া এবং যা অনুসরণে  মানব জাতির কল্যাণ ও উন্নয়ন হবে সে দিকে মানুষকে আহ্বান করা কি কম গুরুত্বপূর্ণ ?

তবে অনেকের কাছে এ কাজ পাহাড় সমতুল্য  বিশাল কঠিন মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু সে রকম নয়। ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে তা অনুশীলন করে ঈমানী চেতনাকে উজ্জীবিত করতে পারলে এ কাজকে কঠিন মনে হবে না বরং এর জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও কষ্ট হবে না। তখন নিজের ঈমান, বিশ্বাসকে খুশী মনে অন্যের সাথে বুদ্ধিমত্তার সহিত শেয়ার করতে মন চাইবে।

 

দা’ওয়ার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় উপাদান:

 “কোথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান কর, সৎকর্ম করে এবং বল আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (সুরা ৪১: ৩৩)

ইসলাম এমন এক ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা যে এখানে প্রতিটি মুসলিম নিজের কাছে নিজেই ধর্মযাজক (Priest) এবং প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের ন্যায় এখানে (Priesthood) পৌরোহিত্যর কোন স্থান নাই। প্রতিটি মুসলিমের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তার স্রষ্টার এবাদতে এবং তার চাওয়া পাওয়ার ঠিকানা সরাসরি আল্লার কাছে , তার  মুক্তি, পরিত্রাণ ও পাপ মোচনের  জন্য নিজেকেই নিজের প্রচেষ্টায় আল্লাহর অনুগ্রহে সফলকাম হতে হবে। আর আল্লাহর  অনুমতি ব্যতীত কারো সুপারিশও  কোন কাজে আসবে না (মানঝাল লাঝি ইয়াশফাহু ..) ।

অতএব যারা সত্যিকার অর্থে আন্তরিকভাবে সঠিক পথ অবলম্বন করতে বদ্ধপরিকর তারাই অন্যকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন হল  এটা কিভাবে সম্ভব কেউ যদি নিজেকে মুসলিম দাবী করে কিন্তু মদ পান করে, মিথ্যাচার করে, নিজেকে অবৈধ অর্থ ও দুর্নীতির পিছনে মগ্ন রাখে, ক্ষমতার জন্য দেশের মানুষকে হত্যা করে রাজনৈতিক বিরুধীতার কারণে তাদের ঘরবাড়ী বুলডেজার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়? এরা কি নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে দাবী করতে পারে?  এরা নিজেকে অন্যের কাছে শুধু হীন ও খারাপ হিসাবেই পরিচিত হবে না বরং এরা ইসলামের জন্যও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে।

তাই আল্লাহ বলেন: হে বিশ্বাসীগন! তোমরা যাহা করনা তা হা কেন বল? (৬১:২)

তাছাড়া  ইসলামের নির্দেশ অনুসরণে প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য হল নিজেদের জীবনে ধৈর্য্য, ন্যয় বিচার বিবেচনা, অন্যের প্রতি সম্মান, ভদ্রতা এবং সহনশীলতার গুণাবলীর চর্চা করা। তবে এ সব গুণাবলী শুধু কোন বই পড়ে বা কারো বক্তৃতা শুনে অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং তা আসে ইসলামী আদর্শে নিজেকে বাস্তবে পরিচালিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

তবে এর মানে কি  একজন মুসলিম  নিজেকে সম্পূর্ণ নিখুঁত না করতে পারলে  সে কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিতে পারবেনা? অবশ্যই না!   ভুল ত্রুটি মানুষের মাঝে থাকা স্বাভাবিক । কোন মুসলিমই নিজেকে নিখুঁত  বলতে পারবে না কেননা জীবনটাই হচ্ছে একটি ক্রমাগত উন্নতির প্রক্রিয়া।

আপনি ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দিয়ে নিজের ঈমানী শক্তিকে শাণ দিয়ে নিজের জীবনে সে আদর্শ অনুসরণ করে অন্যকেও তা জানাবার ও বুঝানের চেষ্টাই অনুপ্রাণিত করবে ইসলাম সম্পর্কে আরো শিখতে। এটা একটি প্রবহমাণ ক্রমবর্ধমান বৃত্তের মত। নিচের হাদিসটি দেখেন অন্যতম এক সাহাবী আনাস (রা:) বর্ণনা করেছেন,

 ” একদিন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর নবী আমরা কি অন্যদেরকে ভাল কাজের প্রতি আহ্বান করতে বিরত থাকবনা যতদিন আমরা সকল ভাল কাজ নিজেরা করতে সক্ষম না হই এবং অন্যদেরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে বারণ করবনা যতদিন আমরা সকল মন্দ কাজ নিজেরা পরিহার না করি?

 জবাবে বললেন রাসুল (স:), “না,  তোমাদের উচিত অন্যকে ভাল কাজের প্রতি আহ্বান করা যদিও তোমরা সকল ভাল কাজ করতে না পার এবং উচিত মন্দ কাজের নিষেধ করা যদিও তার সব থেকে নিজেরা বিরত হতে সক্ষম না হও।” (আল তাবারানি)

দা’ওয়া দেয়ার প্রথম পদক্ষেপ হল নিজেকে দা’ওয়া দেয়া অর্থাৎ মুসলিমকে সর্বপ্রথম নিজের  হৃদয়ে ইসলামের উদ্দীপনা জাগানো। যাতে হৃদয়কে কলুষিত মুক্ত করে ন্যায় অন্যায় বুঝার মানসিকতা গড়ার ও  খোলা মনে নির্মোহভাবে ইতিহাস বিচার করতে শিখতে পারে।  অবশ্যই এটা বলা যতেষ্ট নয় যে “এটা পড় ওটা পড়” বরং  আত্মসমর্পণের জন্য জ্ঞান অর্জনে হৃদয়ে ইসলামের  অনুরক্তি  নিজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে বপন করাই হচ্ছে বড় কাজ যা অবশ্যই একটি কঠিন কাজ। তবে সঠিক জ্ঞাণ অর্জনের মাধ্যমে ইসলামে স্বচ্ছ ধারণা হলেই কেবল এ কাজ সহজ হতে পারে।

তবে দা’য়ী যখন সত্যিকার অর্থে ইসলামের আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে মাঠে নামবে তখন কায়েমী স্বার্থবাদী, রিপুপুজারি জড়বাদী, নাস্তিক ও  অবিশ্বাসী কাফেররা বাধা দিতে আসবেই এটা স্বাভাবিক যা রাসুল (স:) জীবনেও  হয়েছে এর পরবর্তী যুগেও হয়েছে এখনও হবে এবং ভবিষ্যতেও হবে। সবাই এ বার্তা গ্রহন করবে না তবুও কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন,

“কোন ব্যক্তিকে তাহার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরন করাইয়া দেয়ার পর সে যদি উহা হইতে মুখ ফিরাইয়া নেয় এবং তাহার কৃতকর্মসমুহ ভুলিয়া যায় তবে তাহার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আমি নিশ্চয় উহাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়াছি যেন উহারা কোরআন বুঝিতে না পারে এবং উহাদের কানে বধিরতা আঁটিয়া দিয়াছি। তুমি উহাদেরকে সৎপথে আহ্বান করিলেও উহারা কখনও সৎপথে আসিবেনা। (সুরা ১৮:৫৭) 

উপসহারে বলতে চাই, আজ বাংলাদেশের  ইসলামের পক্ষে ও বিপক্ষের মাঝে বিদ্যমান সংঘাতের অবস্থা বিবেচনা করলে দা’য়ী হবার গুরুত্ব যে কত অধিক তা বলার আপেক্ষা রাখে না। আর  যখন পবিত্র কোরআনের সে আয়াত কেউ পাঠ করবে যেখানে আল্লাহ বলছেন,

“ফির’আওন দেশে পরাক্রামশালী হইয়াছিল এবং সেখানকার অধিবাসীবৃন্দকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া উহাদের একটি শ্রেণীকে  হীনবল করিয়াছিল; উহাদের পুত্রগণকে সে হত্যা করিত এবং নারীগনকে জীবিত থাকিতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।” 

তখন হয়তো তার মনে হবে কেন জানি কোথায় যেন আজ এত বছর পর তার মিল দেখি আমাদের মাতুভুমিতেও।

বি:দ্র: পম্চিমা বিশ্বে দা’ওযার এপ্রোচ কীভাবে হওয়া উচিত সে সর্ম্পকে ড: তারিক রামাদানের বক্তব্য শুনুন নিচের অডিও ক্লিপে:

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *