যুক্তি ও সম্মিলিত আহ্বানে সাড়া দিন

সূর্যের চতুর্পাশে যেমন গ্রহমণ্ডলী ঘোরে, জোটের প্রধান শক্তিকে কেন্দ্র করেই জোটের অন্য দলগুলো ঘোরে। সম্মিলিতভাবেই সূর্য ও গ্রহমণ্ডলী মিলেই যেমন সৌরজগৎ, তেমনি প্রধান একটি দল এবং মাঝারি ও ুদ্র দলগুলো মিলেই একটি জোট। এ উপমাটি মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোটের জন্য শতভাগ না হলেও বহুলাংশে সত্য। বিগত ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যেই সরকার মতায় ছিল সেটাকে বিএনপি সরকারও বলা হয় আবার চারদলীয় জোট সরকারও বলা হয় অথবা অতি সংেেপ শুধু জোট সরকারও বলা হয়। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর চারদলীয় জোট আবার ক্রমেই সক্রিয় হতে থাকে। ২০১১ সালের জুন মাসে বর্তমান মহাজোট সরকার, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ পঞ্চদশ সংশোধনী আনল। অর্থাৎ ওই সময়ে সংবিধানে বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করা হয়। বাতিল করার সময় অজুহাত দেয়া হয় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়। এ প্রসঙ্গে গত দুই-আড়াই বছরে এত লেখালেখি ও বলাবলি হয়েছে যে, আমি আর নতুন করে কিছু লিখছি না বা বলছি না। কিন্তু এই বাতিল করার তাৎপর্য ওই সময় মানুষ বুঝতে পারলেও এর প্রতিবাদ, তাৎণিকভাবে সর্বপ্রকারের আঙ্গিকে করে ওঠা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিকভাবে যে প্রতিবাদ করতেই হবে এবং ওই ‘বাতিল’কে আবার বাতিল করতে হবে, সেটা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন। বিএনপি এবং ওই সময়কার চারদলীয় জোট অবশ্যই বুঝতে পেরেছিল। তারা মহাজোট সরকারের ওই অন্যায় কর্মের প্রতিবাদ তখন থেকে করা শুরু করেন। তারা রাজনৈতিভাবে এর বিরোধিতা শুরু করেন এবং প্রতিকারের জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। নির্দলীয় ও নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনর্বহালের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। তখন একপর্যায়ে তারা অর্থাৎ চারদলীয় জোট সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা জোটকে সম্প্রসারিত করবে। ওই সময় আসলে জোটটির নাম চারদলীয় হলেও দল ছিল পাঁচটি, শীর্ষ নেতা ছিলেন পাঁচজন এবং ওই পাঁচজনের মধ্যেই একজন ছিলেন জোটনেত্রী। পাঁচটি দল ছিল নিম্নরূপ : ১. বিএনপি, (২. বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার আমির ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী ও ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ, ৩. বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বিজেপি, যার চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি, ৪. খেলাফত মজলিশ, যার আমির অধ্য মোহাম্মদ ইসহাক এবং ৫. ইসলামী ঐক্যজোট, যার চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী। জোটনেত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জোটের প থেকে প্রধানতম দল বিএনপির প্রতিনিধিদল অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি গমন করেন এবং নির্দলীয় ও নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনর্বহালের আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এই ধারাবাহিকতায় ২৭ আগস্ট ২০১১ তারিখে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান কার্যালয়ে আসেন এবং এ আহ্বান জানান। এ রাজনৈতিক ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, চারদলীয় (অথবা পাঁচদলীয়) জোটের সাথে পথচলা শুরু করে। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮ দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করে। পুরনো পাঁচটি দলের পর, নতুনভাবে যুক্ত হয় (ষষ্ঠ) কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম এমপির নেতৃত্বাধীন এলডিপি; (সপ্তম) শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাগপা; (অষ্টম) মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি; (নবম) জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ প্রভৃতি দল। সেই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনে, সুখে-দুঃখে সব কিছুতে একসাথে পথ চলতে থাকে। অবশ্যম্ভাবীভাবেই জোটের প্রধানতম শক্তি বিএনপি ও জোটের ধ্র“বতারা হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। এ মুহূর্তে জোটের সব রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডের ফোকাস একটিমাত্র ল্যবস্তুতে কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী। কেন কেন্দ্রীভূত এবং কেন শক্তিশালী, এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দেয়ার আগে সাধারণ পদার্থবিজ্ঞান থেকে, দৈনন্দিন জীবনে ঘটে এমন বিষয় দিয়ে বোঝা যায় ওই রকম একটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ছোটকালে বন্ধুরা দিনেদুপুরে রোদের মধ্যে খেলা করতাম। দিয়াশলাইয়ের কাঠি রাখতাম রোদে, একটা অথবা দু-তিনটি একসাথে। এমনভাবে কাচ ধরতাম যেন সূর্যের আলোটি কাচে এসে পড়ে, প্রতিফলিত হয়ে দিয়াশলাইয়ের আগায় বারুদের ওপর যায়। তখন দিয়াশলাইয়ের কাঠির আগায় বারুদে ফুস করে আগুন জ্বলে উঠত। সাধারণ কাচ যেটি দেখে মানুষ চুল আঁচড়ায় বা চেহারা দেখে, ওই রকম কাচ হলে কাজটি করতে কষ্ট হতো। যদি একটি ভাঙা কাচের টুকরা পেতাম তাহলে কাজটা সহজতর হতো। তবে যদি ম্যাগনিফাইং গ্লাস পাওয়া যেত তাহলে কাজটা আরো সহজ বা সহজতম হতো। তখন সূর্য ও দিয়াশলাইয়ের কাঠির মাঝখানে ম্যাগনিফাইং গ্লাসকে ধরতাম; সূর্যের অনেক রশ্মি পুরো আয়তন জুড়ে প্রবেশ করত কিন্তু একীভূত হয়ে, সূক্ষ্ম হয়ে, একটি মোটা আলোর ধারা হয়ে বারুদের ওপর গিয়ে পড়ত। তখন ওই আলোর কারণে দিয়াশলাইয়ের আগায় বারুদে আগুন লাগত। ম্যাগনিফাইং গ্লাসের এক দিকে কনকেইভ (বাংলা অর্থ : ধনুকের মতো ভেতর দিকে বক্রতাযুক্ত, অবতল) এবং এক দিকে কনভেক্স (বাংলা অর্থ : বৃত্তবৎ ক্রমোন্নত তলবিশিষ্ট, উত্তল) হয়, যে কারণে সূর্যের আলোর রশ্মি কেন্দ্রীভূত হয়। ম্যাগনিফাইং গ্লাসকে বাংলায় আতশি কাচ বলা হয়। অর্থাৎ সূর্যের কিরণ কেন্দ্রীভূত করে অগ্নি উৎপাদনকারী কাচ। স্কুলের সব ছাত্রের কাছে ম্যাগনিফাইং গ্লাস থাকার কথা নয়; যারা বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্র হতো, তাদের কাছে থাকত এবং অনেক অগ্রগামী ছাত্র নিজেদের ব্যাগে এ রকম একটি আতশি কাচ রাখত। আমার উদাহরণের বর্ণনা এখানে শেষ। ২০১১ সালের জুলাই-আগস্ট থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে হতে এখন এমন একটি মাত্রায় এসেছে যে, আতশি কাচের মতো তার শক্তি এবং সেই শক্তির আহ্বান একটি বিন্দুতে বা একটি পয়েন্টে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা এখন উপস্থাপন করছি। ২১ আগস্ট ২০১৩ তারিখ থেকে শুরু করে যত টকশোতে আমি অংশ নিয়েছি এবং যত কলাম লিখেছি, এর বেশির ভাগগুলোতেই একটি যুক্তি উপস্থাপন করেছি। রংপুরে, ঘটনাক্রমে বেগম খালেদা জিয়ার সামনে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হওয়ায়, তার সামনেও যুক্তিটি উপস্থাপন করেছি। জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, নিজের নিয়মে উভয় জায়গায় নিজের বক্তৃতায় তিনিও ওই যুক্তিটি আরো দৃঢ়ভাবে, আরো সুন্দরভাবে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। যুক্তিটির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ : ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিদায়ের কিছু দিন আগেই আলোচনায় চলে এসেছিল বিদায়-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের বিষয়টি। তৎকালে বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার কথা ছিল সেই সময়ের সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। কিন্তু সেই সময়ের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এতে বিরোধিতা করে। ওই বিরোধিতার কারণ ছিল এই যে, আওয়ামী লীগের মতে, ২০০৬ সাল থেকে পেছনের দিকে ২৫-৩০ বছর আগে বিচারপতি কে এম হাসান বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অর্থাৎ ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের গায়ে, আওয়ামী লীগের মতে বিএনপির গন্ধ ছিল। যদিও এই ২৫-৩০ বছরের মাঝখানে তিনি অ্যাডভোকেট প্র্যাকটিস করেছেন, হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছেন। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগের অভিযোগ মতে, বিচারপতি কে এম হাসানের গায়ে বিএনপির গন্ধ থেকে গেছে। অতএব কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। একজন ব্যক্তির গায়ে যদি মিথ্যাভাবে ২৫ বছর আগের গন্ধ আরোপ করা যায়, এবং সেই কারণে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মানা না যায়, তাহলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করছেন, যিনি আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং নির্বাচনের সময়েও দেশ শাসন করবেন বলে গর্বের সাথে ঘোষণা করছেন, যার গায়ে আপাদমস্তকই আওয়ামী লীগের গন্ধ রয়েছে, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তাহলে বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে? এ প্রশ্নটি বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর বিবেকের সামনে এবং বিশ্বের মানুষের বিবেকের সামনে উপস্থাপন করেন। এর উত্তর কী আসতে পারে সেটি সহজেই অনুমেয়। বিরোধী শিবির নির্বাচনকালে যে সরকার চায়, যেই সরকারের জন্য আন্দোলন করছে, সেখানে তিনটি শব্দ জড়িত যথা তত্ত্বাবধায়ক, নিরপে ও নির্দলীয়। প্রতিটি শব্দের অনেক ব্যাখ্যা, তাৎপর্য, অর্থ ও দ্যোতনা আছে। আমরা বিস্তারিত লিখছি না। কিন্তু সরকারি রাজনৈতিক শিবির ও বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য ও দাবিদাওয়ার মধ্যে যদি কোনো ধরনের সমঝোতা স্থাপন করতে হয়, তাহলে এ তিনটি শব্দের ব্যাখ্যা, তাৎপর্য, অর্থ ও দ্যোতনা আলোচনা করতেই হবে। এ কলামে স্থানাভাবে করব না। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে উভয় রাজনৈতিক শিবিরের প্রতিনিধিরা করুন বা না করুন, কোনো-না-কোনো জায়গায়, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে অবশ্যই কেউ-না-কেউ আলোচনা করতেই হবে। বস্তুত আলোচনা অবশ্যই করা হচ্ছে। একটু একটু করে, খণ্ড খণ্ডভাবে এবং হয় নির্মোহভাবে অথবা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, বিভিন্ন টেলিভিশন টকশোতে, বিভিন্ন পত্রিকার কলামে, দূতাবাসের পার্টিতে, কারো-না-কারো ড্রয়িংরুমে ইত্যাদি। এবং এ ধরনের আলোচনায় একটি সারমর্ম আসতেই হয়। ওই রূপ সারমর্ম দেশের প্রধানতম রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়ার প থেকে উচ্চারিত হয়েছে গত তিনটি বিশাল জনসভায়। যথা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ নরসিংদীতে, ১৫ সেপ্টেম্বর রংপুরে ও ১৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে। জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে, আমি তিনটিতে অংশ নিয়েছি এবং রংপুর ও রাজশাহীতে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছি। মঞ্চে থাকার সুবাদে, কাছ থেকেই সব বক্তার বক্তব্য এবং প্রধান অতিথির বক্তব্য নিবিড়ভাবে শ্রবণ করার সুযোগ পেয়েছি। ওই আলোকে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সারাংশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ কলামের একটু ওপরে তুলে ধরেছি। ওই আলোকেই এ কলামের পরবর্তী অংশ। জনসভাগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে জনমত সৃষ্টি। বিভিন্ন বক্তারা তাদের বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণের মতামত গ্রহণের চেষ্টা করেন এবং জনগণকেও নিজেদের মতামতকে জানান। জনসভার বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তারা জনগণের কাছ থেকে জানতে চান, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন, নাকি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে প্রতিহত করবেন? লাখ লাখ জনতা সমস্বরে হাত উঁচিয়ে উচ্চ কণ্ঠে জবাব দেনÑ না, আমরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাব না। প্রয়োজন হলে আমরা রাজপথে আন্দোলনে নামব। তবুও নির্দলীয় ও নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে দেবো না। সরকারের যেকোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। সেই সাথে জনগণ ১৮ দলীয় জোটের প্রতি দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করেন। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ১৮ দলীয় জোটের বিভিন্ন মহাসমাবেশগুলোতে এ চিত্রই আমি দেখেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকার যদি নির্দলীয় ও নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনোভাবেই আপস না করে, তাহলে জনগণ সেটি মেনে নেবে না। সুতরাং দেশ এক কঠিন অরাজকতার মধ্যে পতিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের সামনে একটাই প্রশ্নÑ সেটি হচ্ছে আগামী চার-পাঁচ সপ্তাহের সময়টি কিভাবে অতিবাহিত হবে সেটি? কারণ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বলেছে অক্টোবরের ২৪ তারিখ থেকে শুরু করে জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ সময়ের মধ্যে তারা যেকোনোভাবে তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেই। এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা মিডিয়ায় বিভিন্ন প্রকারে বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তবে সব ধরনের বক্তব্যের মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়Ñ সেটি হচ্ছে তারা নির্বাচন করবেনই। অর্থাৎ সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী। সরকার বলতে শুধু আওয়ামী লীগকেই বোঝানো হচ্ছে। কেননা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকারের যে মহাজোট সেই মহাজোটে অনৈক্যের সুর বেজে উঠেছে। মহাজোটের ও ১৪ দলীয় জোটের অনেক শরিক দলই বলছে, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। পার্লামেন্টকে বহাল রেখে নির্বাচন করলে তারা সে নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া এখনো স্পষ্ট নয়। মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টি এক থেকে দেড় বছর ধরে বলে আসছে তারা এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে সাম্প্রতিক কালে তাদের বক্তব্য শক্তিশালী করেছে। তারা এই নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল মনে করে এবং তারা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়। সুতরাং এমন একটি ধারণা যথা : আওয়ামী লীগ একাই নির্বাচন অনুষ্ঠান করল এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অবস্থান নিলো… এটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াচ্ছে না। অতএব ১৯৮৬ সালে আওয়ামী বনাম জাতীয় পার্টির মধ্যে যেই নাটকীয়তা হয়েছিল ওই রকম নাটকীয়তার পুনরাবৃত্তি হতেও পারে, না-ও হতে পারে! হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে দেন। আলোচনা বা বক্তৃতায় প্রকাশ পায় যে, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফোরাম বা বিএনএফ নামে একটি দল বা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। জানা যায়, তারা নাকি তাদের দলীয় মার্কা হিসেবে গমের শীষ চেয়েছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির দলীয় মার্কা হচ্ছে ধানের শীষ। ধানের শীষ ও গমের শীষ, যখন কাগজে ছাপা হয় তখন দেখতে অনেকটা এক রকম লাগে। ব্যালট পেপারে যখন ছাপানো হবে তখন দেখতে একই রকম লাগবে। ভোটারেরা বিভ্রান্ত হয়ে ধানের শীষ মনে করে গমের শীষে সিল মারবে বা ভোট দেবে। এ রকম একটি অর্বাচীন কল্পনা থেকেই বিএনএফ নামক দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে। এ দলকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগপন্থী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও দলছুট রাজনীতিবিদ পরিশ্রম করছেন কিছু দিন ধরে। তাদের সর্বপ্রকারের খরচ সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী জোগান দিচ্ছেন বলে বাজারে রটনা আছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন দেয়ার জন্য এক কদম পেছায় তো দুই কদম আগায় এ রকম একটি অবস্থানে আছে বলে পত্রিকা রিপোর্ট মারফত জানা যায়। বেগম খালেদা জিয়া এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সাবধান করে সর্বশেষ কথা বলেন যে, এটি কোনো মামার বাড়ির আবদার না! এ কলামের একদম শেষ বক্তব্য। আমরা শান্তি চাই কিন্তু সম্মানমিশ্রিত শান্তি চাই। কবরের অভ্যন্তরেও শান্তি থাকে। আমরা জীবিতাবস্থায় কবরের শান্তি চাই না। এ বাংলাদেশকে স্বাধীন করায় আমাদের এবং এখন পৃথিবীতে নেই এমন অনেকেরই অবদান আছে। আমরাও পৃথিবীতে থাকব না। আগামী দিনের বাংলাদেশ যেন শান্তিপূর্ণ হয় সেটি আমাদের বয়সীদের থেকেও, যারা তরুণ তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শান্তির ল্েয শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রয়োজন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে হলে জিদ করা বাদ দিতে হবে এবং মানুষকে ভালোবেসে মানুষের আবেগ ও আকাক্সার প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। হয়তো বা, বর্তমানের সরকারি রাজনৈতিক শিবিরের সম্মানজনক অবস্থান, সম্মানজনক রাজনৈতিক প্রস্থান এসব বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচ্য?

পুর্ব প্রকাশিত শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩, দৈনিক নয়াদিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *