যখন যেদিকে চাই দেখি চুরি আর দুর্নীতি

বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ুং কিম তার প্রতিষ্ঠানে কিছু সংস্কার করতে চান। সে লক্ষ্যে আগে থেকেই টোকিওতে একটা বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সে বৈঠক হবে ১১ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত। বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা আছে তারা অবশ্যই জানেন—এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নতুন প্রধান কর্মকর্তা তার নিজস্ব স্টাইলে প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে চান, সে প্রতিষ্ঠানের ওপর তার স্বকীয়তার ছাপ রেখে যেতে চান। বিবিসিতে ৩৪ বছরের কর্মজীবনে এ ব্যাপারটা বহুবার লক্ষ্য করেছি। নতুন মহাপরিচালক কিছু রদবদল ও পরিবর্তন করেন। সবচেয়ে মারাত্মক পরিবর্তন দেখেছি আশির দশকে, যখন মার্গারেট থ্যাচারের সরকার জন বার্টকে (বর্তমানে লর্ড বার্ট) বিবিসির মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। বার্টের কর্মজীবন ও অভিজ্ঞতা ছিল হিসাব রক্ষকের (অ্যাকাউন্ট্যান্ট)। কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেল, বার্ট বিভিন্ন পদে, এমনকি নতুন পদ সৃষ্টি করেও নতুন নতুন হিসাবরক্ষককে চাকরি দিচ্ছেন। এরা নিজেদের অস্তিত্বের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্য নিত্যনতুন উদ্ভট পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।  তার আগে পর্যন্ত আমাদের একমাত্র বিবেচনা ছিল অনু্ষ্ঠানের গুণগতমান উন্নত করা। হঠাত্ করে দেখা গেল সেটা আর বড় বিবেচনা নয়, বড় বিবেচনা হচ্ছে অনুষ্ঠানের ব্যয়ের খুঁটিনাটি হিসাবরক্ষণ। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার জন্য আমি কত সময় নিচ্ছি, আফিসের কতটুকু জায়গা আমি তখন দখল করে ছিলাম, তার ভাড়া কত ইত্যাদিও অনুষ্ঠানের বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করতে হতো। আমার মনে আছে, এক বৈঠকে চটে গিয়ে আমি বলেছিলাম ডান দিকের পকেটের টাকা বাম দিকের পকেটে, তারপর বুক পকেটে, এরকম চালাচালি করতে হচ্ছে, আর সে চালাচালির হিসাব রাখার জন্য নিত্যনতুন হিসাবরক্ষক আনা হচ্ছে। বিবিসির বেশকিছু কর্মকর্তা ক্ষোভে-দুঃখে তখন সময় হওয়ার আগেই অবসর নিয়েছিলেন। তাদের একজন ছিলেন আমার সহকর্মী (স্যার) মার্ক টালি।  বলছি না যে বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ুং কিমও এরকম উদ্ভট কিছু কাণ্ড-কারখানা করতে যাচ্ছেন বরং এটাই বলতে চাইছি, বড় প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা তার নিজের স্টাইলে সে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা করতে চান—এটাই স্বাভাবিক।  মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার দাবি করেছিলেন। তার কারণ শুধু আমরাই নই, গোটা বিশ্বের মানুষ এখন জেনে গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে হাতে-নাতে ধরে ফেলা কতগুলো দুর্নীতির প্রতিকার দাবি করে বিশ্বব্যাংক সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বেকায়দায় পড়েছেন। বিশ্বব্যাংকের শনাক্ত করা দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে গেলে নিজের এবং নিজের সরকারের গায়ে হাত পড়ে। এ অবস্থায় হাসিনা তার স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, পাল্টা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। জাতিসংঘের বক্তৃতায় সংস্কারের দাবি তুলে তিনি গায়ের ঝাল মিটিয়েছেন মাত্র।

ঝড়ে গাছ পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে
আমি মোটামুটি ধরে নিয়েছিলাম বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সংস্কার প্রস্তাবে হাসিনা আহ্লাদে আস্ফাালন করবেন, বলবেন যে তার দাবিতেই বিশ্বব্যাংকের সংস্কার হতে যাচ্ছে। আমরা তো জানি, ‘ঝড়ে গাছ পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে‘। সকালে যে সূর্য ওঠে হয়তো একদিন হাসিনা সে জন্যও কৃতিত্ব দাবি করে বসবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রগলভ প্রধানমন্ত্রী এবার অযথা আত্মতৃপ্তির সুযোগ পেলেন না। কারণটা হচ্ছে, নতুন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের আরেকটা সিদ্ধান্ত।  গত মাসের ২৫ তারিখে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত ও অন্য কোনো কোনো মন্ত্রী দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো পূরণ করেছে সুতরাং আর কোনো অন্তরায় রইল না, ব্যাংক এবার পদ্মা সেতু নির্মাণের টাকা দেবে। পত্রপাঠ তার জবাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বলেছে, সরকার সত্যি সত্যি তাদের শর্তগুলো পূরণ করেছে কিনা খতিয়ে দেখার জন্য এবং ভবিষ্যতে সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার খবরদারি করার জন্য তারা একটা আন্তর্জাতিক কমিটি নিয়োগ করবে। সে কমিটি গঠিত হয়েছে গত শুক্রবার (৫ অক্টোবর)। বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করেছে, সে কমিটির নেতা হবেন দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুইস মোরেনো ওকাম্পো।  বাংলাদেশ সরকারের ২৫ সেপ্টেম্বরের অনুরোধ বিবেচনার জন্য গত সোমবার (১ অক্টোবর) ঢাকায় অর্থায়কদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের প্রতিনিধিরা সে বৈঠকে যোগদানের জন্য তার আগেই ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি সেদিন ঢাকায় আসেননি। পরে বলা হয়েছিল, বৈঠক হবে অক্টোবরের মাঝামাঝি এবং ব্যাংকের প্রতিনিধিও আসবেন তখন। এখন আর বুঝতে বাকি নেই, মি. ওকাম্পোর কমিটি গঠনের জন্য ব্যাংক সময় নিচ্ছিল। এই বিবর্তনগুলোয় হাসিনা এবং তার সরকার খুশি হবে মনে করার কোনো কারণ নেই।  এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক প্রকৃতই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে চায়। কিন্তু সেতু নির্মাণের টাকা যাতে কুমিরে খেতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করতে চায় ব্যাংক। কথা হচ্ছে, এখন কি আর সেতু নির্মাণের আগ্রহ শেখ হাসিনার আছে? আসলে নির্মাণে তার সত্যিকারের আগ্রহ কখনোই ছিল না। তিনি শুধু ইমারত ও স্থাপনাগুলোর কপালে তার পরিবারের সদস্যদের নাম এঁকে দিতে পারলেই খুশি। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে তৈরি যমুনা সেতুর কপালে তিনি বাপের নাম লিখে দিয়েছিলেন। আশা করছিলেন পদ্মার ওপর সেতু তৈরি হলে তার কপালে মায়ের নাম লিখে দেবেন। কিন্তু তার পরিবার-পরিজন এবং মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা যদি আর্থিক লাভবান না হলো তাহলে সেতু তৈরি করে কী লাভ? তাছাড়া সেতু তৈরি করতে হলে বিশ্বব্যাংক আরও তদন্ত করবে, দুর্নীতির নোংরা কাপড় আবারও প্রকাশ্যে ঝাড়াঝুড়ি হবে। সে জন্যই মালয়েশিয়ার অর্থে কিংবা দেশি টাকায় সেতু নির্মাণের কথাও প্রধানমন্ত্রী আর মুখে আনছেন না।

দুর্নীতি এখন দেশ ও সরকারের স্বরূপ
 বাংলাদেশের মানুষের এখন আর বুঝতে বাকি নেই, বর্তমান সরকারের ভিত্তি হলো দুর্নীতি আর সে দুর্নীতির ‘গড মাদার‘ হলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। দুর্নীতিবাজ বলে বিশ্বব্যাংক শনাক্ত করেছে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং নামোল্লেখ না করে ‘শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ‘ আরও কাউকে কাউকে। বহু ধানাই-পানাই করে আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলেও তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মচারীকে হাসিনা মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন এবং বলেছেন, দেশপ্রেমের কারণেই আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন। সচিব মোশাররফ হোসেনকে ছুটি দেয়া হয়েছে। উপদেষ্টা মসিউর রহমান কোনো অবস্থায় ঝুলছেন কে জানে। এগুলো যে লোক-দেখানো সাজানো ব্যাপার নয়, সেটাও নিশ্চিত করতে চায় বিশ্বব্যাংক।

যে কোনো বাংলাদেশী আপনাকে বলে দেবে বিগত পৌনে চার বছরে বাংলাদেশের চরিত্র আমূল বদলে গেছে। এদেশে যখন যেদিকে চাইবেন দেখবেন চুরি আর দুর্নীতি। বর্তমান সরকারের চরিত্র এমন যে চুরি আর দুর্নীতির মধ্যে তারা দোষের কিছু দেখে না। সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দান মাত্র একটা দৃষ্টান্ত। আরেকটা দৃষ্টান্ত সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গত ৯ এপ্রিল গভীর রাতে সুরঞ্জিতের এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) ওমর ফারুকের গাড়ি ঝিগাতলায় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। গাড়িতে ফারুক ছাড়াও আরও ছিলেন রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা ও তার নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনামুল হক। বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ঝিগাতলা গেটের কাছে এসে গাড়ির চালক আজম খান অকস্মাত্ গাড়িটি বিজিবির গেটের ভেতর ঢুকিয়ে দেন এবং বিজিবি সে গাড়ির ভেতর থেকে নগদ ৭৪ লাখ টাকা উদ্ধার করে।  ওমর ফারুক ও ইউসুফ আলী মৃধা তখন মিডিয়াকে বলেছিলেন, তারা রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেল মন্ত্রণালয়ে তার অধীনস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে একটা ‘তদন্ত কমিটি‘ গঠন করেন। মিডিয়ায় এবং সর্বত্র সমালোচনা কর্ণবিদারি হয়ে উঠলে সুরঞ্জিত পদত্যাগ করেন। কিন্তু দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রাতের আঁধারে আবার সুরঞ্জিতকে মন্ত্রী সভায় ফেরত তলব করেন, তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। সুরঞ্জিতের নিযুক্ত তদন্ত কমিটি তাকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। তাতে কেউ বিস্মিত হয়নি, যেমন কেউ বিস্মিত হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বক্তব্যে। দেশে-বিদেশে এখন সবাই মনে করে দুদক হচ্ছে শেখ হাসিনার একান্ত রাবার স্ট্যাম্প—হাসিনার অভিপ্রায় অনুযায়ী পাপিকে পুণ্যবান আর মহাদুর্নীতিবাজকেও ধোয়া তুলসীপাতার মতো পূত-পবিত্র ঘোষণা করাই দুদকের একমাত্র কাজ। দুদক তখন বলেছিল ওমর ফারুকের গাড়ির চালক আজম খান নিরুদ্দেশ আছে, তার বক্তব্য না শুনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যাপারে রায় দেয়া যাবে না।

দুদকের নতুন সমস্যা
কোনো সন্দেহ নেই, দুদক এখন মহাসমস্যায় পড়বে। ওমর ফারুকের গাড়ির চালক আজম খান এতদিন নিরাপত্তার ভয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। তিনি এখন টেলিভিশনে সাক্ষাত্কারে বলেছেন, সেই ৭৪ লাখ টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতেই যাচ্ছিল। আজম খান আর বলেন, রেলওয়েতে নিয়োগ-বাণিজ্যের (যে সম্পর্কে আগেও মিডিয়ায় এবং অন্যত্র ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল) সঙ্গে মেজর মশিউর রহমান নামক এক ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রীকে ১০ কোটি টাকা দিয়ে ৬০০ লোককে রেলওয়েতে নিয়োগ দেয়া হবে বলে তিনি গাড়িতে (যাত্রীদের মধ্যে) আলোচনা শুনেছেন। তিনি আরও বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্যের বখরা দিয়েই সুরঞ্জিতের পুত্র তার টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় শুরু করেছেন।  আজম খান তার নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেছেন। সন্দেহ নেই, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে তিনি দুদকের কাছেও সাক্ষী দিতে রাজি হবেন। কিন্তু সে নিশ্চয়তা তাকে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা যে তার নিকটজনদের দুর্নীতির দায় থেকে সংরক্ষণ দেন, সেটা এখন সবার জানা হয়ে গেছে। সুরঞ্জিত নিজেকে নিরীহ-নির্দোষ বলে বিবৃতি দিতে শুরু করেছেন। সন্দেহ নেই, যত লজ্জাকরভাবেই হোক হাসিনাও তাকে সংরক্ষণ দেবেন। বর্তমান বাংলাদেশের এবং বর্তমান সরকারের এই হচ্ছে অবস্থা। খালেদা জিয়া এ সরকারকে বিশ্বচোর খেতাব দিয়েছেন। তার মধ্যে কিছু সত্যতা অবশ্যই আছে। লন্ডন, ০৭.১০.১২) (আমার দেশ, ১০/১০/২০১২)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *