দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্য

স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ এবং মানুষেরাই সৃষ্টি করে সমাজ। আর যে কোন সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় সেই সমাজের মানুষের চরিত্র ও কর্মে। ভাল মানুষের সমাজ ভাল হয় আর খারাপ মানুষের সমাজ খারাপই হয় এটাই বাস্তবতা।
পবিত্র কোরআনের সুরা তীন পড়লে দেখা যায় মহান আল্লাহ বলেন

“আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।
অতঃপর আমি তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে (অস্ ফালা ছাফিলিন) পরিণত করি।
কিন্তু তাহাদিগকে নহে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে (মুমিন) ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে অশেষ পুরস্কার।”(সুরা ৯৫:৪-৬)

আজ চিন্তা করলে দেখা যায় জাতি হিসাবে আমরা “অস্ ফালা ছাফিলিন” অর্থাৎ হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পতিত হয়েছি! বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে যে কোন সুস্থ মানুষ ডানে বামে যে দিকেই তাকাবে দেখতে পাবে সন্ত্রাসী জঙ্গি ও দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে পুরা দেশ! তাই বাংলাদেশের দুর্নীতির অবস্থা দেখলে যে কোন বিবেকবান মানুষ চিন্তিত ও বিচলিত না হয়ে পারেনা। তবে বাংলাদেশের দুর্নীতির ভিত্তি কীভাবে গড়ে উঠেছে বুঝতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা যাদের হাতে এসেছে তাদের জীবনদর্শন, চিন্তাভাবনা, চলাফেরা ও কাজকর্ম এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কি ছিল এবং এখন কি পর্যায়ে আছে তা বুঝতে হবে। আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা এ পর্যন্ত যাদের হাতে এসেছে তাদের কোন নৈতিক মূল্যবোধ বা আদর্শিক মানসিকতা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদিও ভক্তরা বাস্তবতা উপেক্ষা করে আবেগ দিয়ে অনেক অন্যায় অবিচার ও অপরাধের বৈধতা দেবার চেষ্টা করে থাকেন। বস্তুত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন এক শাসক শ্রেণী ক্ষমতায় এসে নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছেন এবং এমন এক সম্পর্ক সমাজে তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রশাসন সহ সর্বত্র দুর্নীতির ভিত্তি স্থাপন হয়েছে। এই শ্রেণী শাসন তৈরি হয়েছে ব্যক্তিপূজা, পৌত্তলিকতা ও মাত্রাতিরিক্ত অর্থ লিপ্সা তথা বস্তুবাদী ভোগবিলাসী জীবন দর্শনে। দেশের কল্যাণ, দেশপ্রেম, সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নেয়ার দূরদৃষ্টি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার কোন ইচ্ছা তাদের ছিলনা। কাজেই যতদিন পর্যন্ত এই শ্রেণী শাসন আছে, ততদিন কোনোভাবে এদেশ দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই যতই আমরা আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি আর বিএনপির বদলে আওয়ামী লীগের প্রেমে পাগল হয়ে দেশ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদের মাধ্যমে দেশোদ্ধারের স্বপ্নে বিভুর থাকি না কেন তাতে কোন লাভ হবে না। ব্যক্তিপূজা, পৌত্তলিকতা ও মাত্রাতিরিক্ত অর্থলুভি ভোগ্যবাদী যে শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তা উভয় দলে সমান। অন্যায় অবিচার বা জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওযা কিংবা আইনের শাসনকে অগ্রাহ্য করে সবার সামনে বুক ফুলিয়ে চলা বাংলাদেশে কোন ব্যাপারই নয়।
আসলে মানুষের বৈষয়িক কিছু দাবী আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ বড় নেতা বা নেত্রী হতে পারে কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর কোন আদর্শিক চিন্তাধারার মানুষ না হলে তার পক্ষে দুর্নীতি, দলীয় পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠা খুবই কঠিন। অতএব এ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার অনিবার্য শর্ত হল, দেশ থেকে এই শ্রেণীর শাসন উচ্ছেদ করা। সেই সাথে সুস্থ চিন্তার মানুষকে এগিয়ে আসা ।

জনতার ব্যর্থতা:
বাংলাদেশ পৃথিবী ২য় বৃহত্তর মুসলিম দেশ হিসাবে গর্ব করতে শুনেছি আমাদের জাতীয় নেতাদের কণ্ঠে। কিন্তু মুসলিম হিসাবে আজকের ব্যর্থতাটাও কি কম? সে ব্যর্থতাটি ঘটেছে দুর্বৃত্তদের সৃষ্ট দেশজুড়ে দুর্নীতির আগুন নেভানোর কাজে। একজন ঈমানদারের কর্তব্য হল সে মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক সৈনিক। আল্লাহর এ সৈনিকদের উপর এ জন্যই মহান আল্লাহর হুকুমটি শুধু নামায-রোযা,হজ-যাকাত পালন নিয়ে নয়,বরং সেটি “আমিরু বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। সুফি,সাধক,ফকির,দরবেশ হওয়াতেও এ দায়িত্ব পালন হয় না। তাকে ফেরেশতা হলেও চলে না। কারণ সুফি,সাধক,ফকির,দরবেশ বা ফেরেশতারা তো দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসন হাতে নেয় না। মু’মিনকে তাই নবীজী (সাঃ)র সুন্নত ধরতে হয় এবং রাজনীতি ও প্রশাসনকে নিজ হাতে নিতে হয়। মুমিনদের কাজ হল এ দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়া। আর সেজন্য তার বড় দায়িত্ব হল দেশব্যাপী শান্তি শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সমাজের অসৎ শ্রেণী শাসনের কবল থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া। এক কথায় আল্লাহর দ্বীনের পরিপূর্ণ বিজয় আনা। এছাড়া মু’মিনের ধর্মপালন হয় না। নবীজী (সাঃ) তাই শুধু নামায-রোযা,হজ-যাকাতই পালন করেননি, রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকাও পালন করেছেন এবং ইসলামকে ধ্বংস করতে আসা দুষমনদের আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল হিসাবে এসবই হল তাঁর সুন্নত। সাহাবায়ে কেয়াম ও নবীজী (সাঃ)র সে সুন্নতকে সারা জীবন পালন করেছেন। তাদের কেউ খলিফা রূপে রাষ্ট্র নায়ক হয়েছেন,কেউ বা প্রদেশের গভর্নর হয়েছেন,কেউ বা নগরের প্রশাসক,বিচারক,রাজস্ব সংগ্রাহক হয়েছেন। কেউবা সেনাপতি বা সিপাহী হয়েছেন। তাই দেখা যায় ইসলামের ২য় খলিফা হজরত ওমর (রা) দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা যাতে ক্রেতাদেরকে শোষণ করতে না পারে যে জন্য মুসলিম মহিলাদের একজনকে বাজার তদারকের দায়িত্বেও নিযোজিত করেছিলেন। এক কথায় নারী পুরুষ সবাই সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত থাকাই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। তাই যার মধ্যে নামায-রোযা ও হজ-যাকাত আছে অথচ সমাজ থেকে পাপাচারে নির্মূলে কোন ভাবনা নেই, ভাবনা থাকলেও রাষ্ট্রের প্রশাসনের ইসলামের বিজয়ের চেষ্টা নেই এবং শয়তানি শক্তির নির্মূলে কোন প্রচেষ্টাও নেই -তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে আল্লাহর হুকুমের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণও নেই। এবং ধর্ম পালনে নবীজী(সাঃ)র সূন্নতও নাই। এমন মুসলিম শত কোটি হলেও তাতে ইসলামের বিজয় আসে না এবং মানুষের কল্যাণও হয় না। বাংলাদেশের মুসলিমদের এখানেই বড় ব্যর্থতা। বাংলাদেশের একটি জেলায় যত মুসলিমদের বসবাস,খোলাফায়ে রাশেদার সময় সমগ্র রাষ্ট্রে তার অর্ধেকও ছিল না। অথচ সে সময় মুসলিমরা আবির্ভূত হয়েছিল সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি রূপে। এবং সেটি তৎকালীন দুই ব্শ্বিশক্তির রোমান ও ইরানীদের পরাজিত করে।

দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্য:
যে রাষ্ট্রে প্রতিমাসে শত শত মানুষ প্রকাশ্যে খুন হয়, অফিসারদের চোখের সামনে চুরি হয় ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘুরে সন্ত্রাসীরা –তখন কি গোপন থাকে যে সমাজ কতটা আসুস্থ ও সুস্থ নেতৃত্ব শূন্য ও দুর্বত্তকবলিত?
নৈতিকতা যে বাংলাদেশে প্রকাশ্য লোকালয়ে কতটা যে ব্যাপক ভাবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে তার একটি চোখে-দেখা চিত্র ছেপেছে দৈনিক মানব জমিন তার ১২/০৯/১২ তারিখের এক প্রতিবেদনে। সেটি এরূপ:

“ডিঙ্গি বা খোলা নৌকা নয়।ছাউনি দেয়া। দু’পাশ কাপড় দিয়ে মোড়ানো নৌকা। ভেতরে চটের বিছানা। নির্জনে সময় কাটানোর জন্য এ আবরণ নয়। ভেতরে চলছে অশ্লীলতা। প্রিয় মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য উঠতি বয়সী অনেকেই বেছে নেয় এ নৌকা। এ সুযোগে নৌকার মাঝিরাও মেতে ওঠে অনৈতিক ব্যবসায়। নিত্যদিনের এ চিত্র মিরপুর বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে থাকা শুকিয়ে যাওয়া জীর্ণ নদীর বুকে। আর এ অবস্থায় এলাকাবাসী এর নাম দিয়েছে ডেটিং স্পট। গতকাল সরজমিনে এ এলাকা ঘুরে দেখা যায় প্রকাশ্যেই চলছে এসব অনৈতিক ও অশ্লীল কার্যক্রম। মিরপুর বেড়িবাঁধের চটবাড়ি বটতলায় নবাবের বাগ ঘাটে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই ব্যবসা। প্রেমিক যুগলেরা নির্জনে সময় কাটানোর জন্য বেছে নেয় নৌকা। সেখানে মাঝিরা ফেঁদে বসেছে অন্য রকম ব্যবসা। তারা যুবকদের নারী সাপ্লাই দিচ্ছে। সরবরাহ করছে নানা ধরনের মাদক। আর এ ব্যবসা পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। নৌকা ভাড়া নেয়া হয় ঘণ্টা হিসাব করে।…”

দৈনিক মানব জমিনের এ রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, দু্র্বৃত্তরা কতটা বেপরোয়া এবং প্রশাসন কতটা দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত। দেশের প্রশাসন এসব দুর্বৃত্তদের শুধু প্রতিনিধিত্বই করেনা,বরং পরিণত হয়েছে তাদেরই অবিচ্ছেদ্য অংশে। দেশের চলমান দুর্বৃত্তিতে তাদের রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক স্বার্থ। রিপোর্ট মোতাবেক মীরপুরের নদীর পাড় থেকেই প্রতিমাসে স্থানীয় থানা উপার্জন করে ২ লাখ টাকা। বিনাশ্রমে যেখানে বিপুল অর্থলাভ,সেখানে থানা যে এমন পাপাচারের নির্মূল চাইবে না সেটিই স্বাভাবিক। কারণ তাতে বাড়বে তাদের অর্থপ্রাপ্তি। এখানে তাদের প্রতিপক্ষ জনগণ।
পতিতাবৃত্তির ন্যায় পাপকে ভারত জুড়ে ব্যবসা রূপে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ অতীতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ফন্দি এঁটেছিল।
১).ভারতীয়দের চরিত্র বিনাশ,
২).বিনাশ্রমে অর্থপ্রাপ্তি।

ব্রিটিশ শাসনের আজ বিলুপ্তি ঘটলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত পাপাচারের বাণিজ্যটি লুপ্ত হয়নি। এবং গুরুত্ব হারায়নি চরিত্র ধ্বংসের সে শয়তানি প্রজেক্ট। বরং তাদের সেক্যুলারিস্ট প্রতিনিধিরা একই রূপ দ্বিমুখী স্বার্থে সে পাপাচারকে পতিতা পল্লি থেকে উঠিয়ে নদীর তীর,গাছের ছায়া,নাট্যশালা,মদ্যশালা,পার্ক ও হোটেলে টেনে এনেছে। যে পাপ একসময় পতিতা পল্লিতে সীমাবদ্ধ ছিল,সেটিই এখন পার্ক,বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, হোটেল কক্ষ, শ্রেণীকক্ষ, নদীর তীরে ও নদীর বক্ষে নেমে এসেছে। যে দুর্বৃত্তরা নদীবক্ষ,পার্ক, মহল্লা, রাস্তা ও ক্যাম্পাসের উপর দখল জমিয়েছে তারা সুযোগ পেলে যে ভদ্র লোকের গৃহেও ঢুকবে তাতে কি সন্দেহ আছে?
দেশের সর্বস্তরে যে সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এরা সবাই এখন দুনিয়ার পার্থিব বস্তু লোভে এত অন্ধ হয়ে গেছে যে, তাদের বিবেক বলে কিছু আছে বলে মনে হয়না। তাদের শুধু একই ধান্ধা তা হল কমিশন খাওয়া। গত ১৩ই অক্টোবরের একটি খবরে প্রকাশ “রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, নষ্ট হচ্ছে। দেশের উপজেলা, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের অকেজো যন্ত্রপাতির হিসাব কারও কাছে নেই। তবে ব্যবহারের চেয়ে যন্ত্রপাতি কেনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত তিন অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, প্রতিবছর শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা এক জরিপ বলছে, এসব যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় না। অন্যদিকে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে সরবরাহ করা ৩০ শতাংশ যন্ত্রপাতি প্রতিষ্ঠানে থাকে না।“ (বিস্তারিত এখানে পড়ুন)

যে অপরাধ জনগণের
সুস্থ সাবালক মানুষের সামনে কোন শিশু পানিতে পড়লে সাবালক ব্যক্তিটির দায়িত্ব হয় তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। বাঁচানোর চেষ্টা না করলে এমন মানুষটি যে শুধু মানবতাশূণ্য তা নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধী। ডুবন্ত শিশুর ন্যায় বাংলাদেশও আজ দুর্নীতির সাগরে ডুবে মরণাপন্ন। কিন্তু দেশটির উদ্ধারে জনগণের ভূমিকা কই? আর ভূমিকা না থাকাই কি অপরাধ নয়? দেশকে ডুবাতে দুর্বৃত্ত শত্রুরা যেভাবে দেশের রাজনীতি,অর্থনীতি,প্রশাসন,শিক্ষা-সংস্কৃতি,কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়,ব্যাংক-বীমা ও আইন-আদালতের উপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রচেষ্টা কই? এমন নীরবতায় কি দেশ বাঁচে? এমন নীরব জনগণকে কি নিরপরাধ বলা যায়? বিবেকবান যে কোন মানুষই স্বীকার করবে যে মানুষকে তার মানবিক পরিচয়ের জন্য পানাহারের বাইরে বহু কিছু করতে হয়। তাকে শুধু নিজের জন্য বাঁচলে চলে না। পরিবার,সমাজ দেশ -এমনকি বিশ্ববাসীর জন্যও কিছু জিম্মাদারি নিয়ে বাঁচতে হয়। সে দায়িত্ব পালন শুধু রাজস্ব দিলে হয় না। ভোট দিলেও হয় না। অর্থ,শ্রম,মেধা,রক্তের সাথে অনেক সময় প্রাণও দিতে হয়। যে সমাজে এমন মানুষের অভাব সে সমাজে মানুষের সংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়লেও সেখানে উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয় না। আর সভ্যতার অর্থ কি শুধু প্রযুক্তির আবিষ্কার? এর অর্থ কি নিছক গৃহ নির্মাণ, নগর নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও কলকারখানা নির্মাণ? সভ্যতার নির্মাণে তো আর বহু কিছু বিচার হয়। এর অর্থ স্রেফ শক্তিশালী সাম্রাজ্য নির্মাণ নয়। বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবিক গুণে সমৃদ্ধি আনা। বিশাল সাম্রাজ্য তো অতীতে চেঙ্গিস খানের মত বহু নৃশংস বর্বর শাসকও প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরাও। কিন্তু তাতে কি মানবতা বৃদ্ধি পেয়েছে? বরং তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে বেড়েছে এথনিং ক্লিনজিং,বেড়েছে অর্থনৈতিক শোষণ,গণহত্যা ও নৃশংস নিপীড়ন। এক্ষেত্রে সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সফলতা ইসলামের। অন্য ধর্মের মানুষেরা যেখানে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, শ্রেণিভেদ, জাতিভেদ ও ইথনিক ক্লিনজিংয়ের ন্যায় বেদনাদায়ক ইতিহাস গড়েছে,মুসলমানগণ সেখানে গড়েছে মানব গুণে সমৃদ্ধ মানবিক সভ্যতা। বিলুপ্ত করেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা,বর্ণ ও ভূগোল ভিত্তিক সীমারেখা এবং গড়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব।

বন্ধ করতে হবে এ বিদ্রোহ।
মুসলিম রাষ্ট্রে দুর্নীতি নির্মূল না হয়ে যদি দিন দিন বাড়তে থাকে,তখন বুঝতে হবে দেশের নাগরিকদের মুসলিম হওয়াতেই বিরাট সমস্যা রয়ে গেছে। গভীর সমস্যা রয়ে গেছে কোরআন,হাদীস ও নবীজী (সাঃ)র জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করায়। অতীতে উচ্চতর মানব সভ্যতার নির্মাণে ইসলামের যে বিস্ময়কর সাফল্য, তার মূল কারণটি হল আল্লাহর দ্বীনকে বুঝতে তারা ভুল করেননি এবং গাফলতি করেনি আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যে। মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ হল,আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহ ঘটছে অন্যায়ের নির্মূলে মহান আল্লাহর হুকুম ও তার রাসুলে দেখানো পথ থেকে দূরে সরায়। আর সে বিদ্রোহ আজ যেমন বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তেমনি চলছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। ভিতরের পরিবর্তনের প্রাধান্য ছেড়ে কিছুই হচ্ছেনা বাহিরের বেশ বদলায়ে। ফলে আসল আর নকলকে চিনতে না পারায় সবাই পড়েছি বিভ্রান্ত আর অজ্ঞতায় ! এমন বিদ্রোহে জড়িত বহু নামাযী ও রোজাদার মানুষও। এর মূলে তাদের অজ্ঞতা।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

” আল্লাহ ইমানদারদের বন্ধু তিনি তাদেরকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে যান।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৭)।
সে আলোর উৎস হল পবিত্র কোরআন। অপর দিকে শয়তানের মিশন হল,“মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারে নেয়া।” -(সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৭)।

তাই দেশ যখন দুর্বৃত্ত শয়তানি শক্তির হাতে অধিকৃত হয় তখন আলোর বদলে দেশে অন্ধকার নেমে আসে। রাতের আঁধারে যেমন পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তেমনি অজ্ঞতার আঁধারে ডুবে থাকলে একটা জাতি হয়ে পড়ে দিশে হারা।

মুক্তির পথ।
স্রষ্টা যেমন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তেমনি বলে দিয়েছেন মুক্তির পথ কোনটি? সে নির্দেশিত পথে বাঁচাটাই মুসলমানের জীবনে মিশন। সিরাতুল মোস্তাকীমে চলার অর্থ হল সে মিশন নিয়ে বাঁচা। সেটি “আমিরু বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের হুকুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

“তোমাদের মধ্যে একটি উম্মত অবশ্যই থাকবে হবে যারা (মানবকে)কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায় কাজে নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪)।

মুসলিমের কর্তব্য এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব নেয়া। যা আল্লাহ কোরআনে বলেছেন অথচ মুসলিমরা আজ আল্লাহ প্রতিনিধিত্ব ছেড়ে প্রতিনিধি হয়েছে আধিপত্য-বাদের, ফ্যাসিবাদের, সাম্রাজ্যবাদের আর প্রগতির নামে নৈতিকতা বিহীন ভোগবিলাসের ও নৈরাজ্যের। আল্লাহর বিদ্রুহিদের প্রতিহত করার পরিবর্তে নিজেরাই শামিল হয়েছে সে বিদ্রোহে। মুসলিমের মিশন হচ্ছে দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের শিকড় সুদ্ধ নির্মূল করা অর্থাৎ সমাজের বর্জ্য নির্মূল। কীভাবে এটা সম্ভব সে ভাবনা ও সে চিন্তা করার ইচ্ছা আমাদের সবার মনে জাগার কামনা করে ইতি টানছি।

Loading


Comments

দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্য — 2 Comments

  1. মহী ভাই! চমৎকার একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময় এরকম অবস্থাই ছিল। মোহাম্মদ (সঃ) একা এই অবস্থা পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথমে তিনি তাদের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আল-আমিন আল-সাদিক হিসাবে। পরবর্তীতে ইসলাম এই নিষ্ঠুর আরবদেরকে এমন পরিবর্তন করেছিল যে তারা যুদ্ধের ময়দানেও নামাজ পড়তেন এবং প্রয়োজনে যৎসামান্য রুটিও শেয়ার করতেন একে অন্যের সাথে। আমরা এখন সারা পৃথিবীতে প্রায় দেড় বিলিয়ন মুসলমান রয়েছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে ষোলকোটি। আপনি যে বিষয়গুলো আপনার লেখায় উল্লেখ করেছেন বলতে পারেন কত লোক তার সাথে জড়িত? ষোল’শ? ষোল হাজার? আর না হয় ষোল লাখ? আর বাকী সবাই আমরা সহ্য করছি। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, সবাই আমরা সমান ভাবে দোষী। ঘৃনা করা ঈমানের সর্ব নিম্নস্তর। বলতে পারবেন পৃথিবীতে এখন কতজন মুসলমান ঈমানের এই স্তরটি হোল্ড করে আছে? আমাদের দেশে মসজিদ মাদ্রাসার কমতি নেই। ওয়াজ-নসিহত হচ্ছে অনবরত। নামজ পড়তে গেলে মসজিদে স্থান পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা যে ইসলাম পালন করছি তা যদি সত্যিকার ইসলাম হতো তাহলে দেশটা এমন ভাবে অনাচারে ভর্তি হয়ে যেতোনা। বাংলাদেশে দুই ডজনের বেশী ইসলামী দল রয়েছে। সবাই একে অন্যকে বেঠিক বলে অভিহিত করে থাকে। আসলে আমরা সম্ভবতঃ কেহই ঠিক নেই। আসুন প্রথমে আমরা কোর’আন-সূন্নাহ্ চর্চা করি। এবং নিজে তা অনুসরণ করি এবং অন্যকে অনুসরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করি। শত্র“পক্ষ যত শক্তিশালী হোক না কেন, ভিতর থেকে অনুপ্রাণিত থাকলে কেহ কাকেও বিভ্রান্ত করতে পারে না। কিন্তু যার ভিতরটা খালি তাকে শত চেষ্টা করেও সব সময় ধরে রাখা যায় না। মনে রাখবেন, আল্লাহ্ মানুষকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন তাই তিনি করো ইচ্ছাকে কন্ট্রোল করেন না। রসূল (সাঃ)কে তিনি ফোর্স করতে নিষেধ করেছেন। এবং আমাদেরকে বলেছেন “লা একরাহা ফিদ্দীন”। ধর্মের ব্যাপারে জবরদস্তি করার অধিকার আল্লাহ্ আমাদেরকে দেননি। রসূল (সাঃ) প্রথমে মানুষ গড়েছেন। আর এই মানুষরাই একদিন দেশ সৃষ্টি করেছেন। যে দেশের বিস্তৃতি লাভ করেছিল মরক্কো থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত। কিন্তু আমরা এখন ষোল কোটি মুসলমানের এই দেশটিতে নিজ দেশে পরবাসী। দেশকে অনাচার মুক্ত করতে চান? আগে মানুষ গড়তে হবে। তাহলে দেখবেন দেশ অটমেটিক্যালি অনাচার মুক্ত হয়ে যাবে।

  2. আসলেই দেশটা এখন দুর্নীতির সাগরে ডুবে মরণাপন্ন।
    তবে আমি হতাশ না। প্রার্থনা করি আল্লাহ আমাদেরকে দুর্নীতির অভিশাপ রক্ষা করুন।
    সে দিন হয়তবা দূরে নয় যখন মানুষের মনে আত্মসচেনতা জাগবে দেশের জন্য কিছু করতে।।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *