মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সময়ের প্রধান ইস্যুগুলো

আমার কাছে মুসলিম উম্মাহর জন্য কতকগুলো বিষয়কে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এর মধ্যে একটি ইস্যুকে আগে এত বড় ইস্যু হিসেবে দেখিনি। সেটি হলো নব্য সাম্রাজ্যবাদ।

এ সাম্রাজ্যবাদীরা কারা, তা আমরা সবাই জানি। আজ তারা চাচ্ছে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বিশ্বকে শাসন করতে। তারা চায় তাদের আদেশ নিষেধকেই মেনে চলতে হবে, তাদের মতো চলতে হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমেও এ রকম ডিকটেশন আসতে পারে।

নব্য সাম্রাজ্যবাদের পর মুসলিম বিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান ইস্যু হলো শিক্ষা। এ বিষয়টি আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। Islamisation of Knowledge-এর লেখক ড. ইসমাইল রাজি আল ফারুকীর দৃষ্টিতে, শিক্ষা উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

একটু আগে যে চ্যালেঞ্জের (আমেরিকান ডিক্টেটরশিপ, আমেরিকান চ্যালেঞ্জ, পশ্চিমা চ্যালেঞ্জ) কথা বললাম, তা মোকাবেলার জন্য আমাদের একটি উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ, সেটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক যেটিই হোক এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের একটি ভালো শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। সভ্যতার দ্বন্দ্বে ইসলাম জয়ী হবে নামে হোক বেনামে হোক, যদি আমাদের একটি ভালো শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভালো শিক্ষিত জনশক্তি (পুরুষ ও নারী উভয়ই) থাকে। কিংবা যদি আমরা তা গড়তে পারি, তবেই তা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

এখানে শিক্ষার কয়েকটি জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। একটি হলো, এর সংজ্ঞাগত বিষয়। ইসলামি শিক্ষার ক্ষেত্রে কতকগুলো সংজ্ঞাগত বিষয় রয়েছে। ‘ইসলামি শিক্ষা কী?

এটি কি শুধু কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকাহর জ্ঞান, নাকি এটি সব প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের ইসলামি মূল্যবোধ, জ্ঞানের ইসলামীকরণ আন্দোলনের সমন্বয়? মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ প্রভৃতি দেশে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। সেটি হলো- সব শিক্ষাই ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করবে, ইসলামি শিক্ষার আওতার মধ্যে পরিচালিত হবে, মূল্যবোধভিত্তিক হবে অথবা এর আওতাবহির্ভূত হবে না। এটি মেনে নেয়া হয়েছে যে, শুধু কুরআন পড়া, হাদিস পড়া, ফিকাহ পড়া, আরবি পড়া ইসলামি শিক্ষা নয়। যদি আমাদের ছেলেরা কম্পিউটার সায়েন্স, ফিজিক্স ও অন্যান্য সায়েন্স পড়ে তাও ইসলামি শিক্ষার আওতার মধ্যে হবে। কাজেই বলা যায়, যেকোনোভাবেই হোক, বর্তমানে সংজ্ঞাগত সমস্যাটি নেই; কিন্তু হতে পারে যারা দুনিয়া সম্পর্কে জানে না, তারা বিতর্ক করতে পারে।

আমাদের স্কুল সিস্টেম সম্পর্কে বলতে চাই। স্কুলের ওপর অনেক কাজ হয়েছে। বিশেষভাবে পাকিস্তান, ইরান, সুদানে। সৌদি আরবে স্কুল সিস্টেমে ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার দারুণ সমন্বয় ঘটেছে। সুতরাং বলা যায়, আজ আমাদের নাগালের মধ্যে স্কুল শিক্ষার যথেষ্ট কারিকুলাম আছে যা আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আজ আমরা যে পর্যায়ে এসেছি, তার ফলে এখানে ইসলামি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় গড়ে ওঠা সম্ভব।

বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বকে মালয়েশিয়া বা ইসলামাবাদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ভিত্তিতে শিক্ষার প্রোগ্রাম সাজাতে হবে। এ মডেলকে প্রয়োজন মনে করলে একটু সংশোধন করে, প্লাস-মাইনাস করে আমরা সেটি নিতে পারি। এটি মুসলিম বিশ্বে উচ্চশিক্ষার ইসলামীকরণে মডেল হতে পারে।

এখানে একটি কথা বলা দরকার, অমুসলিমদের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প খোলা রাখতে হবে। এটি আমাদের মনে রাখতে হবে এবং যদি কেউ নাও করে থাকে তবু আমাদের তা করতে হবে। ইসলামের ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ ও ‘জাস্টিসের’ যে স্পিরিট তা সামনে রাখতে হবে। ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ ও ‘জাস্টিস’-এর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একে সামনে রেখে অমুসলিমদের জন্য প্রচুর অপশন (যেখানে যে রকম প্রয়োজন) দেয়া উচিত। এখানে কোনো আন্দোলন সৃষ্টি করা, কারও দাবির সুযোগ সৃষ্টি করা অথবা পত্রিকায় ওঠার পর ব্যবস্থা নেয়া যেন না হয়। এটি ইসলামের জাস্টিসের দাবি এবং এটিই আমাদের জন্য কল্যাণকর।

এখানে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি মাদরাসাকে শুধু আলেম তৈরি করার জন্যই চাচ্ছি? এর উদ্দেশ্য কী? নাকি শিক্ষার একটি মূলধারা করতে চাচ্ছি? প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি শুধু আলেম তৈরি করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তো এত মাদরাসার দরকার নেই। এত কওমি কিংবা এত আলিয়া মাদরাসার তাহলে প্রয়োজন কী? যদি আমরা চাই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা একটি মূলধারা হবে, তাহলে মৌলিক পরিবর্তন করতে হবে। এ পরিবর্তনটি কী? আমাদের দেশে কামিল মাদরাসার চারটি কোর্স আছে- আদব, তাফসির, ফিকাহ ও হাদিস। আমি সংক্ষেপে বলব, আরো কয়েকটি কামিল কোর্স তাতে যোগ করতে হবে। কামিল ইকনোমিকস, কামিল পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং অন্য কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে কামিল কোর্স খুলতে হবে। চারটির জায়গায় ছয়টি, আটটি বা দশটি করতে হবে। তাতে বর্তমান কোর্সটি আলিম, ফাজিল পর্যন্ত মোটামুটি এক থাকতে পারে। ফাজিল পর্যন্ত ঠিক রেখে আমাদেরও আরো চারটি, ছয়টি কোর্স যোগ করতে হবে। সেই সাথে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কওমি মাদরাসার ক্ষেত্রেও একই কথা।

যদি মসজিদ আর মাদরাসার জন্যই শুধু আলেম তৈরি করা মাদরাসার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এত হাজার হাজার কওমি মাদরাসার দরকার নেই; কিন্তু তাদের যদি উদ্দেশ্য থাকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করা, তাহলে তাদেরও নতুন নতুন বিভাগ খুলতে হবে। এখন কেবল দাওরায়ে হাদিস আছে। তাদের শেষের চার বছরের কোর্স পরিবর্তন করতে হবে। এখানে দাওরায়ে অর্থনীতির মতো আরো তিন-চারটি ‘দাওরা’ বাড়াতে হবে যাতে তারা সমাজ, জাতি এবং অর্থনীতি, প্রশাসনের জন্য যোগ্য লোক তৈরি করতে পারেন। এ ধরনের সংস্কার করলেই কওমি এবং আলিয়া মাদরাসা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দু’টি মূল শাখা হিসেবে টিকে থাকবে এবং জাতির জন্য অবদান রাখতে পারবে।

ইসলামের ইতিহাসে একটি বিষয় হলো, বিভিন্ন রকম চরমপন্থা ইসলামকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যারা চরমপন্থী তাদের অবস্থান কারো হয় এ পাশে নয় ওই পাশে, যেকোনো এক প্রান্তে। ফলে তারা কখনো সমন্বয় করতে জানে না। সমন্বয় করা তাদের পে সম্ভব নয়; কিন্তু সমন্বয় করা তখনই সম্ভব যখন মানুষ মডারেট হয়, মধ্যপন্থা অবলম্বন করে; যখন তারা একে অন্যের সাথে কথা বলে, আলাপ করে, একজন আরেকজনের কথা শোনে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েই কাজ করে; কিন্তু কট্টরপন্থা হলো, উম্মতের মধ্যে এমন অবস্থান সৃষ্টি করা যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে না পারে। চরমপন্থীদের উদাহরণ বোকো হারাম ও ইরাকের খিলাফত দাবিদারেরা।

এরপর ইসলামের যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি তা হলো জেন্ডার ইস্যু। এটি ইসলামের নারী-পুরুষের স্থান এবং পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়। ড. সাঈদ রামাদান, যাকে লিটল হাসান আল বান্না বলা হতো, তিনি উম্মতের তিনটি সমস্যার কথা বলেছিলেন। একটি হলো শরিয়াহ এবং ফিকহর মধ্যে পার্থক্য করতে না পারা। কুরআন-সুন্নাহর বাধ্যতামূলক প্রকৃতির (binding nature) সাথে ফিকহর বাধ্যতামূলক নয় এমন প্রকৃতির পার্থক্য করতে না পারা এবং উভয়কে এক করে ফেলা।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো, মুসলিম নারীর দুর্দশা। এ কথাগুলো তিনি বলেছিলেন ১৯৬৫ সালের দিকে। আজ থেকে অনেক আগেই তিনি এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এটি বর্তমানে যেমন ড. ইউসুফ আল কারজাভির উপলব্ধি, তেমনি মুহাম্মদ আল গাজ্জালির মতো বিখ্যাত আলেমরাও একই কথা বলে গেছেন। তৃতীয় সমস্যা হলো, শাসকদের আনুগত্য সম্পর্কে ভুল ধারণা। নারীদের যথাযোগ্য স্থান ও মর্যাদা দিতে হবে। তাদের মানবিক মর্যাদায় সমান মানুষ মনে করতে হবে। তাদের সব অধিকার দিতে হবে। (দ্রষ্টব্য : ইসলামের সামাজিক বিধান, ড. জামাল আল বাদাবি, ২. রাসূলের যুগে নারী স্বাধীনতা, আল্লামা আবদুল হালিম আবু শুক্কাহ এবং ৩. দ্য স্ট্যাটাস অব মুসলিম উইমেন, ড. ইউসুফ আল কারজাভি)।

এরপর যে সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তা হলো, গণতন্ত্রের অভাব। স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্র মুসলিম বিশ্বে আছে। এটি পাশ্চাত্যের কাছে মুসলমানদের খারাপ ইমেজই তুলে ধরে। তাদের কাছে মনে হয়, মুসলমানদের স্বভাবই হলো এমন। দোষ হলো আমাদের আর তারা মনে করছে ইসলামই এমন। এর খারাপ প্রভাবটিই মুসলমানদের ওপর পড়ে কিন্তু এর সমাধান কী? এ সম্পর্কে এক লেখায় বলেছিলাম, ইসলামি আইনের আওতায় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি বহু আগেই স্বীকৃত হয়ে গেছে। ১৯৪৮ সালে যখন নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধান হয় সেখানে democracy, freedom, equality, social justice as enunciated by Islam shall be fully observed বলে একটি ধারাই আমাদের পরামর্শে যোগ করা হয়। লক্ষ্য করেছি, মাওলানা মওদুদী ডেমোক্র্যাসি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সেখানে তিনি The Democracy শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ‘ডেমোক্র্যাসি’ শব্দটি পরিহার করেননি। আল্লামা ইকবালও ‘গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই’ বলেছেন। ড. ইউসুফ আল কারজাভি Islamic Movement, Political Freedom and Democracy শীর্ষক লেখায় বলেছেন, এটিই ইসলামের নিকটতম পন্থা। জনগণের সার্বভৌমত্ব, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, যারা সন্দেহ করে এ ধারণার কী হবে? এ উত্তরে তিনি বলেছেন- আপনারা যদি এতই ভয় পান তাহলে সংবিধানের একটি ধারায় লিখে দিন, কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা যাবে না, তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে।

কাজেই গণতন্ত্র সম্পর্কে যারা বেশি ভয় পান তারা যদি ‘গণতন্ত্র’ না বলতে চান তাহলে ‘ইসলামি গণতন্ত্র’ শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। অনেকে খেলাফত শব্দ ব্যবহার করতে চান; কিন্তু প্রত্যেকটি ইসলামি রাষ্ট্রকে আলাদা আলাদা খেলাফত বলবেন কি না তা সুস্পষ্ট করতে হবে। যে রাষ্ট্রশাসক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং যে রাষ্ট্র ইসলাম মোতাবেক চলে সেটাই খেলাফত। তবে তাকে ইসলামি রাষ্ট্র বলাই অধিক সঙ্গত। ইমাম আল মাওয়ার্দি বলেছেন, একের অধিক খেলাফত হতে পারে।

আমাদের সমস্যার আরেকটি দিক হলো, কুরআন ও সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা। এমন এক সময় ছিল যখন কুরআন ও হাদিসের পর্যাপ্ত অনুবাদ ছিল না। এখন অনেক অনুবাদ হওয়ায় সমস্যা হয়েছে যে, প্রত্যেকে হাদিস পড়ে তার একটি ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেন, কিন্তু তারা জানেন না হাদিস কত ধরনের। তারা জানেন না হাদিসের মধ্যে যদি সঙ্ঘাত দেখা দেয় তাহলে তা কিভাবে দূর করতে হবে। আবার কুরআনের সাথে হাদিসের যদি বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা কিভাবে দূর করতে হবে। এর ব্যাখ্যার পদ্ধতি না জেনেই তা করতে থাকেন। কিভাবে ‘তারুদ’ (বিরোধ) দূর করতে হবে? হুকুমের মূল্য কী? সব হুকুমই কি ফরজ? না মুস্তাহাব মাত্র? আমল হলেই কি ফরজ হয়ে যায়? এখন যারা শব্দের বিভিন্ন শ্রেণী (যেমন আম, খাস, হাকিকি, মাজাফি ইত্যাদি) সম্পর্কে জানবেন না, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পদ্ধতি জানবেন না, উসুল আল ফিকহ পড়বেন না তারা যদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তাহলে তা ভুল হবে। এ জন্য উসুলের জ্ঞান থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লেখক: সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *