মুজিববাদ, এরশাদ এবং মার্কোস

বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। কঠিন এই কারণে যে, দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি, জনগণের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি এবং বিদেশনীতি বা পররাষ্ট্র নীতিতে বাংলাদেশ কোন রেখা বা পথ অবলম্বন করবে সব কিছুই এই ক্রান্তিকালে দিকনির্দেশনার অপোয় আছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেই অবস্থা বিরাজমান, সেই অবস্থাকে সাংবিধানিক সঙ্কটও বলা যায়, রাজনৈতিক সঙ্কটও বলা যায়, শাসন বা ইংরেজি পরিভাষায় গভর্নেন্সের সঙ্কটও বলা যায় এবং যেই নামেই ডাকি না কেন, বিদ্যমান সঙ্কট থেকে আরো অনেক শাখা-প্রশাখা বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের বা বিদেশের অঙ্গনে সম্পূর্ণ অপরিচিত বা অভাবিত নয়। সচেতন জনগণ নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তা করছেন। অভিজ্ঞতার দু’টি ভাগ অন্তত আছে, একটি দূর বা নিকট অতীত এবং অপরটি অতি সাম্প্রতিক।
বয়সের কারণে অভিজ্ঞতার তারতম্য হয়
চার বছর আগে বাংলাদেশে আদমশুমারি হয়েছে। আদমশুমারির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে কিছু দিন পর। জনসংখ্যার বিশ্লেষণ করলে বের হয়ে আসে বয়সভিত্তিক বিন্যাস। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগই ৩০ বছরের নিচে বয়স; অর্থাৎ নিখাদ টগবগে তরুণ। তারা ভোট দেন এবং ভোট দেয়ার যে শিহরণমূলক অনুভূতি এটা একমাত্র তাদেরই সৌভাগ্য। অনেক তরুণের কাছে অতীত গৌণ, বর্তমানই মুখ্য। অনেক তরুণের কাছে অতীতই মুখ্য, বর্তমান হচ্ছে সাধারণ বিষয়।
অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রোপটে বিশেষত সব ধর্মের শান্তি ও ইনসাফের মূল্যবোধের অতীত ঐতিহ্য এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্য, যেকোনো অবস্থাতেই মুখ্য বিষয়, কোনো মতেই গৌণ নয়। অতীতের জ্ঞান বর্তমানকে প্রভাবান্বিত করে এবং বর্তমান ভবিষ্যতের রূপরেখা অঙ্কন করে। তাই, অতীতের ওপরে (অর্থাৎ ইতিহাস) মানুষ প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। যা হোক, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অতীতের কিছু জ্ঞান অবশ্যই প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
‘মুজিববাদ’ নামক একটি বই
বাংলাদেশের তরুণসমাজের মধ্যে কত শতাংশ একটি বইয়ের নাম জানেন? বইটির নাম ‘মুজিববাদ’। বইটির পরিচয় তুলে ধরি। (১) লেখক : বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধ লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। (২) প্রকাশক : মাজেদা খোন্দকার, ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, ৩৯২, উত্তর শাহজাহানপুর, ঢাকা। (৩) প্রথম সংস্করণের তারিখ : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। (৪) বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩০ টাকা। (৫) পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৮৭। আমি বইটি কিনেছিলাম ১১ নভেম্বর ১৯৭৩ মোতাবেক ২৫ কার্তিক ১৩৮০ বঙ্গাব্দে। তখন আমি একজন অতি তরুণ মেজর এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে (সংেেপ যাকে সেনাসদর বলা হয়) সামরিক সচিবের শাখায় চাকরি করতাম। আমি ধরেই নিচ্ছি যে, যাদের বয়স ৪০-এর নিচে তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই বইটি সম্পর্কে পরিচিত নন। তাই আমি মুজিববাদ নামক বইটিকে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তবে এটাও উল্লেখ করতে চাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বইটি লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বা প্রেরণা দিয়েছিলেন এমন কোনো তথ্য আজো পাইনি। লেখকের মূল ল্যবস্তু ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাচেতনাকে তথা রাজনৈতিক আশা-আকাক্সা এবং পুরো আলোচনাকে একটিমাত্র বাংলা শব্দের ছত্রছায়ায় লিপিবদ্ধ করা, যথা ‘মুজিববাদ’।
এই বইটির সম্ভাব্য-পাঠকদের সুবিধার্থে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনাকে ইতিহাসের প্রোপটে স্থাপন করার জন্য (ইংরেজি পরিভাষায় : প্লেইসিং ইন হিস্টোরিক্যাল কনটেক্সট), বইটির লেখক, ইতিহাসে উল্লিখিত যেসব ‘বাদ’ (ইংরেজি পরিভাষায় ‘ইজম’) আলোচনা করেছেন, আমি সেগুলোর নাম এখানে উল্লেখ করছি : (১) কমিউনিজম বা সোস্যালিজমের অন্যতম জন্মদাতা তাত্ত্বিক কার্ল মার্কস-এর প্রসঙ্গে ‘মার্কসবাদ’, (২) রাশিয়ায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক ভøাদিমির লেনিন-এর প্রসঙ্গে ‘লেনিনবাদ’, (৩) চীনে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার পিতৃপুরুষ মাও-জে-তুং-এর প্রসঙ্গে ‘মাওবাদ’, (৪) ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী-এর প্রসঙ্গে ‘গান্ধীবাদ’, (৫) বর্তমান পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বা তাদের ভাষায় কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-এর প্রসঙ্গে ‘জিন্নাহবাদ’, (৬) যেই দর্শন বা তত্ত্বের ফলে পৃথিবীর একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত সেই দর্শন প্রসঙ্গে ‘ইহুদিবাদ’, (৭) আধুনিক মিসরের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ, এককালীন মিসরীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল এবং পরবর্তী সময়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের-এর প্রসঙ্গে ‘নাসেরবাদ’, (৮) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে, নিজ দেশের অন্যতম জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ও নেতা এবং যুদ্ধের পরে স্বাধীন কমিউনিস্টপন্থী যুগোস্লাভিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটো-এর প্রসঙ্গে ‘টিটোবাদ’।
‘মুজিববাদ’ নামক বইটির শেষের তিন ভাগের এক ভাগ হলো, বাংলাদেশের মুজিববাদের ব্যাখ্যা এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা। ওই ব্যাখ্যা ও রূপরেখার সাথে, বঙ্গবন্ধু একমত ছিলেন এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।
‘মুজিববাদ’ তখন এবং এখন
সম্মানিত পাঠকের বয়সে যদি কুলায় তাহলে তিনি মুজিববাদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ের বাংলাদেশকে বিবেচনা করতে পারেন; বিশেষ করে জুন ১৯৭৪ থেকে মধ্য আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত। আরো যদি বিশেষ উল্লেখ করতে হয়, তাহলে জানুয়ারি ১৯৭৫-এ ‘বাকশাল’-এর জন্মদিন থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত। সম্মানিত পাঠকের বয়সে যদি না কুলায় তাহলে তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে তথ্য ও ছবি আহরণ করেই মাত্র নিজের ধারণা গঠন করতে হবে। বাস্তবতা বলে দিচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিরোধানের সাথে সাথেই ‘মুজিববাদ’ তিরোহিত হয়ে যায়। কেন তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল? সেই আলোচনায় এখানে যাবো না। বরং অন্য একটি প্রশ্ন এখানে উপস্থাপন করছি। প্রশ্নটি হলো, বঙ্গবন্ধুর আমলে যেই মুজিববাদ প্রয়োগ হতে পারেনি বা বাংলার মাটিতে শিকড় গাড়তে পারেনি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কি ভিন্ন পন্থায়, সময় নিয়ে, ‘মুজিববাদ’ শব্দটি বা নামটি উচ্চারণ না করে, মুজিববাদ নামক দর্শন বা তত্ত্ব বাংলার মাটিতে আবার বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন? আমার মন বলছে, মাননীয় শেখ হাসিনা একই নাম ব্যবহার না করে বা এমনকি কোনো নামই ব্যবহার না করে, মুজিববাদ নামক দর্শন বা তত্ত্ব বাংলার মাটিতে আবার প্রয়োগ, বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। আমার মনে এইরূপ ধারণা হওয়ার সমর্থনে যুক্তিগুলো আমি অবশ্যই উপস্থাপন করতে পারি কিন্তু এই কলামটি দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে বিধায় আজকের এই কলামে উপস্থাপন করছি না। তবে এতটুকু উল্লেখ করতে চাই যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭৩-৭৪-৭৫ সালের মতোই গুমোট, অস্থির-অনিশ্চিত অবস্থায় আছে। তবে ১৯৭৩-৭৪ সালে যেরূপ বিশ্ব পরিস্থিতি ছিল, সেরূপ এখন নেই; কালের বিবর্তনে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ নিয়েছে। যেই পরিবেশ বা পরিস্থিতিই হোক না কেন, অনিশ্চয়তা ও হতাশায় নিমজ্জিত বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ, পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়।
দেশে দেশে মুক্তি-আন্দোলনের অভিজ্ঞতা
এরূপ মুক্তি পাওয়ার ঘটনা ও প্রক্রিয়া পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে, এখন থেকে দুই বছর আগে পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন দেশে হয়েছে যথা- মিসর, ইরাক, পূর্ব পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি। সম্মানিত পাঠক, যত দেশের অভিজ্ঞতার কথা আমি উল্লেখ করলাম, এসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই ক্ষুদ্র কলামে দেয়া সম্ভব নয়। তাই দু-একটি অভিজ্ঞতার সারসংপে মাত্র উল্লেখ করব।
ফিলিপাইনের ‘মার্কোস’-এর বয়ান
১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মতাসীন লিবারেল পার্টিকে পরাজিত করে, জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে ফার্দিনান্দ মার্কোস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও নির্বাচনে দুর্নীতি ও কারচুপির অভিযোগ ছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে, মার্কোস রাষ্ট্রপরিচালনায় যতটুকু সময় ও মেধা ব্যয় করেন, তার থেকে বেশি সময় ও মেধা ব্যয় করেন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ আহরণে। দুর্নীতির পথে তার কর্মকাণ্ডে অন্যতম প্রেরণা ও উৎসাহদাতা ছিলেন তার স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস। ফিলিপাইনের সংবিধান মোতাবেক মার্কোস-এর তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল না। সেই জন্য, ১৯৭৩ সালে তৃতীয় দফা নির্বাচন হওয়ার আগেই, মার্কোস নিজের ভবিষ্যৎ সুরতি করার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করেন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করান। সামরিক শাসনে, সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার জন্য, সর্বপ্রকারের প্রত্য ও পরো পন্থায় সামরিক বাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুশি রাখার পদপে গ্রহণ করেন। এই প্রোপটে মার্কোসের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের দশক। কিন্তু, সততার পে ও স্বচ্ছতার পে নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্রমান্বয়ে সোচ্চার হতে থাকেন। একপর্যায়ে অন্যতম বিখ্যাত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা ‘বেনিগনো একুইনো’ যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ছিলেন, তিনি দেশে ফিরে আসেন।
২১ আগস্ট ১৯৮৩ তারিখে একুইনো ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বের হয়ে মাটিতে পা রাখা মাত্রই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তদন্তে বের হয়ে আসে যে, সরকারি ইচ্ছায় সামরিক গোয়েন্দা কর্তৃক নিযুক্ত আততায়ী এই কাজটি করেছিল। এই প্রোপটে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে এবং আমেরিকাসহ অন্য মিত্র দেশগুলোর অপ্রকাশ্য চাপে, নতুনভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষিত হয়।
মার্কোসবিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব
৭ ফেব্র“য়ারি ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রচণ্ড দুর্নীতি ও কারচুপির ঘটনা ঘটে। সরকারি চাপে ইলেকশন কমিশন মার্কোসকেই বিজয়ী ঘোষণা করে। ব্যাপক গণ-অসন্তোষ শুরু হয়। নিহত রাজনৈতিক নেতা বেনিগনো একুইনোর স্ত্রী ‘কোরাজন একুইনো’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শুরু করেন। এই আন্দোলন ইতিহাসে ‘পিপল পাওয়ার রিভুলিউশন’ (অর্থাৎ জনগণের মতায় বিদ্রোহ) নামে খ্যাত হয়ে আছে। মার্কোসপন্থীদের মালিকানাধীন বা পরিচালনাধীন মিডিয়া, ব্যাংক, বীমা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, পরিবহন সংস্থা ইত্যাদির সাথে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। সরকারি কর্মকাণ্ডের সাথে অসহযোগিতা তো ছিলই। মার্কোস ফিলিপাইনের প্রতিরা বাহিনীগুলো এবং আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকেও দূষিত করে ফেলেছিলেন। সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণ ও দূষিতকরণ-এর প্রোপটে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনীতে অফিসারদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল ‘রিফর্ম দি আর্মড ফোর্সেস মুভমেন্ট’। এই মুভমেন্টের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ বা উপপ্রধান জেনারেল রামোসের কাছে নালিশ দাখিল করেন। জেনারেল রামোস ভিন্নমতাবলম্বী কর্মকর্তা ও প্রতিবাদী জনগণের প নেন। ইতোমধ্যে ফিলিপাইনের ক্যাথলিক চার্চের সবচেয়ে বড় নেতা দেশব্যাপী চার্চের নেতাদের সম্মেলন ডাকেন এবং বলেন যে, অত্যাচারী মার্কোসের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনগণকে সান্ত্ব—না দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই প্রোপটেই ফিলিপাইনের জনগণ একটি গণ-অভ্যুত্থান গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৮৬ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি থেকে জনগণের সাথে সরকারি বাহিনীর প্রচণ্ড রক্তয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। জনগণের সাংগঠনিক শক্তি সীমিত হলেও মনোবল ছিল অদম্য। কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কোসের পতন ঘটে। মার্কোসের দীর্ঘ দিনের পৃষ্ঠপোষক মার্কিনিরা নিজেদের হেলিকপ্টার প্রদান করে মার্কোস ও তার পরিবারকে গোপনে ম্যানিলা ত্যাগে সাহায্য করেন।
১৯৮৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৭২ বছর বয়সে, এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও দুর্নীতিবাজ ফিলিপাইনি ডিক্টেটর বা একনায়ক মার্কোস শুধু পারিবারিক পরিবেশে হাওয়াই দ্বীপে মৃত্যুবরণ করেন। ফিলিপাইনের মাটিতে তাকে কবর দিতে দেয়নি জনগণ। দুর্নীতির মাধ্যমে যেই সম্পদ, হীরা-জহরত ও মণিমুক্তা মার্কোস সংগ্রহ করেছিলেন এবং সাথে করে হাওয়াই পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন, সেইগুলো হাওয়াই দ্বীপে তার কবরে জমা দেয়া সম্ভব হয়নি। মার্কোসের বয়ান এবং পরবর্তী দু’টি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের এরশাদের বয়ান, একটার পর একটা পড়ার পর সম্মানিত পাঠক কিছু না কিছু মিল খুঁজে পাবেন বলে আশা করি।
জেনারেল এরশাদ-এর বয়ান
বিষয়টি স্পর্শকাতর কারণ সাম্প্রতিক ঘটনাবলির বর্ণনা বা ইংরেজি পরিভাষায় মোস্ট কনটেম্পোরারি হিস্টরি। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসের ২৪ তারিখে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারকে বঙ্গভবন থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। তার ৯ বছর আমলে আমি বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে জ্বলন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং একই সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য আমার সহকর্মীদের নিয়ে প্রাণান্তকর ও অকান্ত এবং বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দৃষ্টিভঙ্গি, দিকনির্দেশনা ও আমাদের কর্মকাণ্ডগুলোর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা আমি প্রশংসার সাথে স্মরণ করি।
১৯৯০ সালের মধ্য ফেব্র“য়ারিতে জানতে পারি যে, আমাকে সেনাবাহিনীর সদর দফতরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিযুক্তি (সামরিক পরিভাষায় : ‘এপয়েন্টমেন্ট’) ‘ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস’ (সংেেপ ডিএমও) নিযুক্ত করা হয়েছে। ২৬ জুন ১৯৯০ সালে আমি সামরিক অপারেশনস পরিচালক বা ডিএমও-এর দায়িত্বভার গ্রহণ করি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা ছয় মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট এরশাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। দেশের জন্যও বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। কিন্তু তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল প্রচুর। সরকারবিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগও ছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি অগণতান্ত্রিকভাবে মতা দখল করেছেন এবং মতা ভোগ করছেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৯০ সালে জনগণ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও মনোভাব প্রকাশ করা শুরু করেছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবিরের দাবি ছিল : মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে। ওই আমলের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব
ক্রমান্বয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন কঠোর হতে থাকে। নব্বইয়ের শেষাংশে গুরুতরভাবে গড়ে উঠতে থাকে। ১৮ অক্টোবর ১৯৯০ তারিখে আন্দোলন নবজন্ম লাভ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা চিন্তা করতে থাকেন : ‘আমাদের করণীয় কী?’ নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রায়ই উদ্ভাসিত হয়ে যায় যে, সেনাবাহিনী এরশাদকে আর সমর্থন করবে না। আরো কথা স্থাপিত হয় যথা : সেনাবাহিনী যেন প্রেসিডেন্ট এরশাদকে বাঁচানোর জন্য আবারো কোনো প্রকার মার্শাল-ল বা সামরিক আইন জারি না করে। ২৭ নভেম্বর ১৯৯০ তারিখে ডাক্তার মিলন নিহত হন। আন্দোলন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে; গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আন্দোলন দমনের কাজে পুলিশকে সাহায্য করার জন্য বিডিআর ও সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়। ঢাকা মহানগরে যেসব সেনাবাহিনীর ইউনিট মোতায়েন হয়েছিল, তাদের ওপর চারজন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন; আমি ছিলাম পঞ্চম ব্রিগেডিয়ার।
আমরা পাঁচজন রাতভর ঢাকা মহানগরে ঘুরে বেড়াতাম পরিস্থিতি পর্যবেণ ও মূল্যায়নের জন্য। আমরা মোতায়েনকৃত সৈনিক-বিডিআর-পুলিশ সদস্য এবং সামনে যেসব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে পেতাম, তাদের সাথে কথা বলে তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করতাম। আমার ইমিডিয়েট বা তাৎণিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আবদুস সালাম; তার ওপরে ছিলেন চিফ অব আর্মি স্টাফ বা সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ নূরুদ্দীন খান। আল্লাহর রহমতে উভয়ে এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছেন। জেনারেল এরশাদ নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে সৌজন্যমূলক চায়ের আসরে অফিসারদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি অফিসারদের মনোভাব যাচাই করে নিয়েছিলেন। অফিসাররা প্রকাশ করেছিলেন অনেকটা এ রকম : ‘যথেষ্ট হয়েছে; আর্মিকে নিয়ে টানাটানি না করাই ভালো এবং আপনিও আপনার ইজ্জত রা হয় এ রকম একটা সমাধান বের করে নিলে ভালো’।
জেনারেল নুরুদ্দীন এবং জেনারেল সালাম ভদ্র ও সংযত ভাষায়, জেনারেল এরশাদের প্রতি সেনাবাহিনীর প থেকে অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। পরের ঘটনাবলি, সম্মানিত পাঠকদের বেশির ভাগেরই জানা। আজ বুধবার ১৪ জানুয়ারি ২০১৫। এখন থেকে ছয় সাত আট বা নয় মাস আগে একবার একুশে টিভিতে এবং আরেকবার চ্যানেল আইতে জেনারেল এরশাদ ইন্টারভিউ দিয়েছেন (একক টকশো)। তিনি বলেছেন অনেকটা এ রকম : ‘গণ-আন্দোলনের মুখে আমি পদত্যাগ করিনি, আমি পদত্যাগ করেছিলাম এ জন্য যে, সেনাবাহিনী আমার ওপর থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছিল।’
সব কিছুর পরেও জেনারেল এরশাদ তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তাদের পেশাদারিত্ব ও দেশপ্রেমের জন্য। আমিও সেই আমলের সহকর্মী অফিসারদের প্রতি অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। মে ১৯৯৬-তে একটি সামরিক-রাজনৈতিক দুর্ঘটনার প্রোপটে আমি অবসরে চলে গিয়েছিলাম, ওই বছরের জুন মাসে। ১৯৯৬ সালের মার্চ এপ্রিল মে মাসের কথা, কয়েক দিন পরে বলব।

বর্তমানের মূল্যায়ন
প্রবাদবাক্য ধার করে বলতে চাই, ‘এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই’। অর্থাৎ : আমরা ১৯৮৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় বাস করছি না; ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসের ঢাকা মহানগরেও বাস করছি না। বরং ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আছি। একই শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে যেকোনো একজন বক্তা, একই জোক বা একই কৌতুক যেমন দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার বললে শ্রোতৃমণ্ডলী হাসবে না; তেমনই রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য পদপেগুলোও অভিনব না হলে বা সময়োপযোগী না হলে ফল দিলেও গুরুত্বপূর্ণ ফল দেবে না। ঘোষিতভাবেই এখন ‘ডিজিটাল’ যুগ। অতএব সরকারকে রাজনৈতিক দাবি মানায় বাধ্য করার জন্য ডিজিটাল আন্দোলন প্রয়োজন!! ডিজিটাল আন্দোলন কত প্রকার ও কী কী, সেটা কোনো ডিকশনারি বা পাঠ্যবইয়ে নেই। তাই যারা রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ, মেধাবী, পরিশ্রমী, আগ্রহী তাদেরই এর রূপরেখা স্থাপন করতে হবে। ওই রূপরেখায়, (১) কেউ শ্রম দেবেন, (২) কেউ মেধা দেবেন, (৩) কেউ সময় দেবেন, (৪) কেউ অর্থ দেবেন এবং (৫) কেউ লোকবল দেবেন।
আমরা যারা তারুণ্য পার করে ফেলেছি, অথবা আমরা যারা ছোট রাজনৈতিক দলের কর্মী, আমাদের জন্য পাঁচটা উপাত্তই দেয়া সম্ভব নয়। একটি বা একাধিক উপাত্ত দেয়া সম্ভব এবং তাই দিচ্ছি। বর্তমানের আন্দোলনের ল্যবস্তু হচ্ছে সরকারকে জনগণের দাবি মানতে বাধ্য করা। দাবির সারমর্ম : জনমনে শান্তি, জনপদে শান্তি, জনগণের ভোটের অধিকার। জনগণকে সম্পৃক্ত করে, জনগণের মনে ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে আস্থা সৃষ্টি করে, জনগণের মনোবল চাঙ্গা রেখে, জনগণের কষ্টের মাত্রা ন্যূনতম পর্যায়ে রেখে, রাজনৈতিক কর্মীদের কষ্টকেই সর্বোচ্চ মাত্রায় স্থাপন করে এই আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন ওই দিকেই এগোচ্ছে। আন্দোলনের বিরুদ্ধে বা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিরোধ আসবে, তবুও আন্দোলন যেন শান্তিপূর্ণ হয় সেই চেষ্টা থাকবে।

(পূর্ব প্রকাশিত ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় )

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *