মুক্তি যুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বস্তুটি ইদানিং রাজনীতির অঙ্গনে একটি মৃতসঞ্জীবনী বটিকা। এই বটিকাটি খেয়ে চিরঞ্জীব হওয়ার মহা প্রতিযোগিতা চলছে এখন রাজনীতিবিদদের মধ্যে। কিন্তু মুক্তি যুদ্ধের সময় এই চেতনাটির কথা কেহ শুনেছেন বলে আমার মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধ আমরা শুরু করিনি। আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আক্রমন নয়,দেশে বিশেষ কোন ঘটনা ঘটবে এমন একটা ধারনাও কারো ছিলনা। এই তারিখটিতে পাকিস্তানীরা আমাদেরকে আক্রমন করেছিল। বিশ্বয়ে বিমূঢ় জাতি সবাই আমরা যখন দিশেহারা তখন জাতীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নির্দেশনা জাতি হঠাৎ শুনতে পেল এক অপ্রত্যাশিত কণ্ঠ থেকে। আমাদের সবার মতো মেজর জিয়াউর রহমানও সেদিন বিপদে পড়েছিলেন। তিনি আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। আর এর সাথে যুক্ত করে নেন সারা দেশবাসীকে। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে তিনিই প্রথম জাতির প্রতি নির্দেশ দিলেন আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য। শুন্য মাঠে আবেগের আতিশয্যে প্রথমে তিনি নিজকেই নবঘোষিত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান কারো নির্দেশে ঘোষনাটি দিয়ে থাকলে এমনটা হতোনা। আমরা আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জনের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এটাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়মাসের মধ্যে একবারও জাতী শুনতে পায়নি যে শেখ মজিবুর রহমান যুদ্ধের কোন ঘোষনা দিয়েছিলেন। তবে মেজর জিয়াউর রহমান যেমন তার পরবর্তী ঘোষনায় শেখ মজিবুর রহমানকে রাষ্টপ্রতি হিসাবে ঘোষনা করেছিলেন আমরাও তেমনি জাতিকে অনবরত মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসছিলাম এই বলে যে শেখ মজিবুর রহমান গোপন স্থান থেকে জাতিকে যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ বাস্তবিক ভাবে আমাদের নেতা বিশেষ মুহুর্তে আমাদেরকে ত্যাগ (ডিজ্ওউন) করলেও আমরা তাকে ত্যাগ করিনি। আমরা অবলীলায় একটা গনতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু গনতন্ত্রের এই মানষ প্রপৌত্র (!) মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামেই গনতন্ত্রের বাক এ শাল দিয়ে দেশটিকে বাকশালে পরিণত করলেন। আর এই বাকশাল যে ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতা’নামক মুক্তিযুদ্ধের অন্য একটি চেতনার এটা ফসল ছিল তা জাতীর কাছে গোপন ছিল অনেক দিন। ভারতে ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার চেতনার’ ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী একটি বিশেষ অংশের মানুষ যে এই চেতনার ভিত্তিতে যুদ্ধ করেছিল তার খোলস জাতির কাছে উম্মুক্ত হয়েছে সবেমাত্র। মুক্তিযুদ্ধ কালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন সাহেবের ভারতের সাথে প্রণীত সাত দফা গোপন চক্তিটি ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার চেতনা’ না হয়ে কোন ভাবেই ‘আত্মরক্ষা মূলক আত্মনিয়ন্ত্রনের চেতনা’ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ চলা কালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাথে যে সাতদফা গোপন চুক্তি করেছিলেন তার মধ্যে বিশেষ তিনটি দফা হলো

  • (১) ‘বিএসএফের তত্ত্বাবধানে’ স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য একটা ‘বর্ডার গার্ড’ বাহিনী গঠন করা হবে। অর্থাৎ বর্ডারে বিডিআর এর পরিবর্তে বিজিবি থাকবে।

  • (২) বাংলাদেশের নিজের কোন সেনাবাহিনী থাকবে না, ভারত তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।

  • (৩) বাংলাদেশের স্বাধীন কোন পররাষ্ট্রনীতিও থাকবে না।

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এসে উপরের তিনটি চেতনার মধ্যে প্রথমটি ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে। শেষের দুটি চেতনাও প্রায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। (দ্রষ্টব্য:প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের রচিত ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরী’ শীর্ষক লেখাটি)। এই বাস্তবায়নের ক্ষিপ্রতা এখন এতটাই প্রবল যে মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দই এই সাত দফা ভিত্তিক ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ চেতনায় বিশেষ ভাবে অভিসিক্ত। আর কে জানে, দেশ বরেণ্য চলচিত্র কারক বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধা জহির রায়হানকে একারনেই মুক্তিযুদ্ধের পরপর দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়েছিল কিনা। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সাথে প্রণীত তাজউদ্দীন সাহেবের এই সাত দফা চুক্তির কথা যদি তখন জাতি জানতে পারতো তাহলে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি এবং পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তকরনের প্রকৃয়া ভিন্ন রকম হতো। আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও হতো অন্য রকম। মুক্তি যুদ্ধের এরকম দ্বিমুখী চেতনার বিভ্রান্তি থেকে জাতি আজো মুক্তি পায়নি।

এখন মনে হচ্ছে আসলেই মুক্তি যুদ্ধের একটি নয় দু’টি চেতনা রয়েছে। একটির ধারক আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। অপরটির ধারক দেশের আপামর ছাত্র জনতা। আমাদের দেশে ক্ষমতার শীর্ষে যারা অবস্থান করতে চায় ক্ষমতার জন্য তারা ক্ষমতা বিক্রয় করে দিতে পারেন। শত শত বছর আগে মীরজাফর উঁমিচাঁদরা তা’ই করেছিল। আসলে উপমহাদেশে ক্ষমতার শীর্ষে যারা অবস্থান করতে চায় তাদের বেশীর ভাগই মানষিক প্রতিবন্ধী। ক্ষমতা চায় কিন্তু তারা ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সাহস রাখে না। এরা কারো অধীনে মিত্র হয়ে হলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পছন্দ করে। মুক্তির এই চেতনাটির নাম ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার চেতনা’। এই চেতনার ফলশ্র“তিতেই ভারতে লুধি, মোগলরা অনেকদিন রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। এই চেতনার ফলশ্র“তিতেই আমরা দু’শ বছর ইংরেজদের শাসন মেনে নিয়েছিলাম। আর এখন উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিদেশীরা শাসন না করলেও শাসিত হওয়ার জন্য আমরা তৈরী করে নিয়েছি রাজতন্ত্রের আদলে বিভিন্ন শাসক পরিবার। পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এই মানষিকতার উন্মেষ না ঘটলে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যখন ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভাংতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন আসন্ন ইলেকশনে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে মনে করে রাজনীতিবিদরা তাতে বাধ সাধতে পারতেন না। কিন্তু রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দের এই সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও ‘আত্মরক্ষা মূলক আত্মনিয়ন্ত্রনের চেতনায়’ একনিষ্ট ছিল বলেই ছাত্র জনতা সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল। বায়ান্ন থেকে বাহাত্তর পর্যন্ত আন্দোলনের যে ইতিহাস তা ছাত্র জনতার অকুতোভয় সংগ্রামের ইতিহাস। যদিও এর ভেতর এক সময় পূর্বপাকিস্তান সংসদের ডিপুটি স্পিকার সাহেদ আলীকে সংসদ চলাকালীন সময় চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো জঘন্য ঘটনার অবতারনা হয়েছিল। আর এর কিছুদিন পর আগরতলা ষড়যন্ত্রের মতো অপকর্ম ঢুকে গিয়েছিল আমাদের রাজনীতির ভিতর বরেণ্য রাজনীতিবিদদের হাত ধরে। কিন্তু কোন বিভ্রান্তিই সংগ্রামী ছাত্র জনতাকে লক্ষ্যচ্যূত করতে পারেনি। বায়ান্ন সালের ধারাবাহিকতায় একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছি। এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার এই ঘোষনাটিও এসেছিল রাজনীতিবিদের পরিবর্তে ছাত্র জনতার কাছ থেকে। আসলে বায়ান্ন থেকে বাহাত্তর পর্যন্ত ছিল ছাত্র জনতার রাজনীতি। তখন ছাত্ররা নেতাদের পিছনে হাঁটতোনা। বরং নেতারাই হাঁটতো ছাত্র জনতার পেছনে। ছাত্রজনতা নেতা তৈরী করতো এবং নেতার পদন্নোতিও হতো ছাত্রজনতার মাধ্যমে। ২৫ মার্চ কলেজে আমাদের টেষ্ট পরীক্ষা চলছিল; ইয়াহিয়া খানের ঘোষনা শুনে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আমরাই রাজনৈতিক নেতাদেরকে খুঁজে বের করেছিলাম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালে আমাদের রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ যখন ক্ষমতার দর কষাকষি নিয়ে মহাব্যস্ত তখনো ছাত্রজনতা বুঝেগিয়েছিল যে এই দরকষাকষির মাধ্যমে পাকিস্তানিদের সাথে হয়তো একটি দুর্বল সমযোতা হয়ে যাবে কিন্তু দেশ স্বাধীন হবে না। তাই তারা ১ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে ২ মার্চ টিএসসির উম্মুক্ত ময়দানে লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা সুউচ্চ কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে দিয়েছিল। এবং পাতাকা উত্তোলন করে জানান দিয়ে দিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রীত্ব নয় স্বাধীনতাই এই মুহুর্তে গনমানুষের একমাত্র দাবি। না হয় শেষ পর্যন্ত সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে সাময়িক ভাবে পাকিস্তানীদের সাথে হয়তো একটা দুর্বল সমজোতা হয়ে যেতো এবং আমরা এখনো হয়ে থাকতাম পাকিস্তানের একটি অবিবেচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে। ২ মার্চ থেকেই সকল সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ছাত্রজনতার উত্তোলিত পতাকা প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ছাত্র জনতার উত্তোলিত এই পতাকা কোনদিন আর কোথাও অবনমিত হয়নি। ৭ মার্চ মহান নেতার হাতে পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল পতাকার রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভের জন্য। কিন্তু তিনি পতাকা উত্তোলন করেননি, পরিবর্তে তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলেছিলেন ঠিকই, তবে সাথে সাথে এটাও বলে দিয়েছিলেন যে যুদ্ধের হুকুম দিতে পারবেন কিনা তিনি জানেন না।  তাই যারা যুদ্ধ করতে চায় তারা যেন যার যা আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। এই মহান নেতার কথা আমরা তখন নেশা খোরের মতো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। তাই নেতার কথাতেই ২৫ মার্চের পর আর্মি আসছে শুনে বেয়াকুফের মতো আমিও দুই ফুট লম্বা লোহার রড নিয়ে রাস্তায় নেমে ছিলাম ট্যাঙ্কের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। ভাগ্য ভাল ছিল বলেই সত্যিকার ভাবে আমাকে কখনো লোহার রড নিয়ে আর্মির মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু যেখানে মুখোমুখী হতে হয়েছিল সেখানের এই রড সৈনিকদের ভাগ্য মোটেই সুপ্রসন্ন ছিলনা। অনেকে এখন দাবী করে থাকে যে মহান নেতা ২৫ মার্চ আত্মসর্ম্পনের সময় নাকি বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধের ঘোষনা দিয়ে গিয়েছিলেন। এই দাবী যারা করেন তারা প্রকৃতপক্ষে নেতার অসম্মান করে থাকেন। কারন যুদ্ধ ঘোষনা করে কোন সেনাপতি আত্মসর্ম্পন করতে পারে না। আর যদি করে থাকেন তবে এই কাজে একমাত্র তিনিই সেকেন্ড-টু-নান। আসলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের প্রকৃত ঘোষনা তার কাছ থেকেই এসেছিল যিনি আত্মরক্ষার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রনের নিয়ামক খুঁজে পেয়েছিলেন। আমরা নয় মাস আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছি আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জন করার জন্য। কিন্তু আমরা যদি তখন জানতাম যে আমাদের যুদ্ধের সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিল তারা এক গোপন সাত দফা চুক্তি ভিত্তিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ করছে তাহলে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ভিন্ন রকম হতো। এবং যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তরের চেহারাও হতো ভিন্ন রকম। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা অতিমাত্রায় আবেগ প্রবণ। আমরা দেখেও শেখার প্রয়োজন বোধ করিনা। আমাদের অবমিষ্যকারীতার জন্যই গোপন আগরতলা চুক্তি, গোপন সাতদফা চুক্তির মতো আমাদেরকে গোপন আর একটি পঁচিশ বছরের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল যুদ্ধের অব্যবহিত পর। এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে এসে সাতকোটি লোকের বাংলাদেশটি পরিণত হয়ে গিয়েছিল এক নেতার একদেশ। তিনি গনতন্ত্র বাকশালে ঢুকিয়ে ফেললেন, এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা আর নজরুলের বাংলাদেশ হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বেওয়ারিশ লাশ আর তলাহীন ঝুড়ি। ক্ষমতার রাহুগ্রাস কতটা প্রবল হলে গনতন্ত্রের জন্য ত্রিশ বছর ধরে নির্যাতিত একজন নেতা ক্ষমতা পেয়ে একনায়ক হয়ে যেতে পারেন। বাকশাল তৈরীর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেওয়া হলো যে ‘আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রন’ নয় ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ চেতনাতেই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ উত্তর ক্ষমতাসীনদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।’

কিন্তু ভুল করলে ভুলের মাশুল দিতে হয়। পাহাড় পরিমান সাওয়াব সত্ত্বেও অনেককে লঘুপাপে গুরুদন্ড পেতে দেখা যায়। ১৯৭৫ সালে একদিন হঠাৎ করেই আমরা আমাদের মহান নেতাকে হারিয়ে ফেললাম। এবারও যাওয়ার সময় তিনি জাতিকে কোন দিক নির্দেশনা দিয়ে যেতে পারেননি। তিনমাস দেশ এক ক্রান্তিকাল কাটিয়েছিল এই সময়। ক্ষমতার দ্রুত পালাবদলের পরিসমাপ্তি হয়েছিল সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার নাট্যমঞ্চে জিয়াউর রহমানের পুনরাগমনের মধ্য নিয়ে। জিয়াউর রহমান গনতন্ত্রকে বাকশালের ভেতর থেকে বের করে জনগনের চেতনা আবার জনগনের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু এতেও দুই চেতনার দ্বন্দ্ব থেমে থাকেনি। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে বিদায় করে দেওয়া হলো। আর এই বিদায়ের নেতৃত্ব যার হাতে ছিল তিনি পালিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রের দিকে যাওয়ার পথে মারা পড়লেন। যারা ব্যবহৃত হয় তাদেরকে এভাবেই জীবন দিয়ে জীবনের মূল্য দিতে হয়। ব্রিটিশরা যাদেরকে দিয়ে সিরাজকে নিহত করেছিল সে’ই মীরজাফর উমীচাঁদদেরকে তারা দুনিয়াতে থাকতে দেয়নি। রক্ষী বাহিনী যদি সত্যিই শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচাতে চাইতো তাহলে এমন নিষ্ঠুর ভাবে তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হতোনা। তারপরও ২০০৭ সালের ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ ভূতটি অত্যন্ত চুপিসারে আবার আমাদের রাজনীতিতে সওয়ার হয়ে বসলো। কারন যুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব নাকি সাত দফা চুক্তিতে ‘না’ বলেছিলেন, কিন্তু নাই করে দিতে পারেননি। ২০০৮ সালে মনে করা হয়েছিল জাতি এবার হয়তো আত্ম উপলব্দির মাধ্যমে অত্ম¡নিয়ন্ত্রনে সক্ষম হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের রাজনীতি আবার বন্দি হয়ে গিয়েছে পুরনো সেই গোপন চুক্তির বেড়াজালে। কারন ২০১০ সালের দিল্লি চুক্তি যদি আগের মতো ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ চুক্তি না হতো তাহলে তা অবশ্যই গোপন রাখার প্রয়োজন হতো না।

পরিশেষে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবীদার পক্ষদ্বয় দুপক্ষ কেহই তাদের দাবীতে বেঠিক নয়। এর মধ্যে যারা, পুরনো আগরতলা চুক্তি,  মুক্তি যুদ্ধের সময়ের সাত দফা দিল্লি চুক্তি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পঁচিশ বছরের গোপন চুক্তি, পঁচাত্তর সনের এক দফা চুক্তি, আর বর্তমানের অপ্রকাশিত গোপন চুক্তির চেতনায় রাজনীতি করছেন তারা রাজনীতি করছেন তাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রণীত সাতদফা ভিত্তিক ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার চেতনা’ রক্ষার জন্য। আর অপরপক্ষ রাজনীতি করছেন, ভাষা আন্দলন, এগারদফা আন্দলনে, আর ছাত্র জনতার পাতাকা উত্তেলনের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জিয়াউর রহমানের ঘোষিত ‘আত্মরক্ষা মূলক আত্ম নিয়ন্ত্রনের চেতনা’ সংরক্ষিত করার জন্য। মুক্তি যুদ্ধের সময় ভারতের সাথে তৎকালীন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে প্রণীত সাত দফা চুক্তি ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতা চেতনার’ একটি জীবন্ত দলিল। আর এই দলিলটি সংরক্ষণ করার জন্যই  তখন ‘মুজিব বাহিনীর’ জন্ম দেওয়া হয়েছিল তাও ভেবে দেখা দরকার। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও ২০১০ সালে দিল্লিতে গিয়ে ১৯৭১ সালের সেই সাত দফা গোপন চুক্তির লাশটিই হয়তো আবার কবর থেকে তুলে এনেছেন। যদি তা না হতো তাহলে একাত্তরের দিল্লি চুক্তি, অগরতলা চুক্তি, যুদ্ধপরবর্তী ২৫ বছরের গোপন চুক্তির মতো এই চুক্তিটিও গোপন করে রাখা হতোনা। আর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব যে একদফা কয়েম করেছিলেন তা যদি ‘মুক্তিযুদ্ধের অধীনতা মূলক স্বাধীনতার চেতনা, না হয় তাহলে চতুর্থ সংশোধনী বাতিল না হয়ে ৫ম সংশোধনী বাতিল করা হলো কেন? ৫ম সংশোধনী বাতিলের পর ৪র্থ সংশোধনীকে বৈধ করার পাঁয়তারাকে নিশ্চয়ই ‘আত্মরক্ষা মূলক আত্মনিয়ন্ত্রনের চেতনা’ বলে অভিহিত করা যায় না। আর এই চেতনাটির ধারাবাহিকতা রক্ষার অনিবার্য কারনেই হয়তো একদিন অনেকের মতো ‘মুজিব বাহিনী’ মুক্তিযুদ্ধের পর উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল আমাদের মুক্তির মুক্তাঙ্গনে। এবং এই অনিবার্য চেতনার মানদন্ডের ভিত্তিতেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধ না করে অথবা মুক্তি যুদ্ধের বিরুধীতা করেও এখন অনেকেই অলৌকিক ভাবে ম,ুক্তিযুদ্ধা হয়ে যাচ্ছেন ।

অপরদিকে বায়ান্নের ছাত্র জনতা ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতার ঘোষনা ও পতাকা উত্তোলন, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনা, বাহাত্তরে জাসদের গনবাহিনী গঠন, পঁচাত্তরে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ও জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতে আগমন, এসবকিছুই ছিল গনমানুষের ‘আত্মরক্ষা মূলক আত্মনিয়ন্ত্রনের চেতনার’ ফসল। জিয়াউর রহমানগন মুক্তির সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ত্বের ভুমিকায় ছিলেন, আর জাসদের গনবাহিনীর তরুণ ছেলেগুলি ছিল মুক্তি যুদ্ধের অগ্রবর্তী বাহিনী। আর আমরা যারা যুদ্ধে পেছনে থেকে মাঠ ময়দানে মুক্তিযুদ্ধাদেরকে সহায়তা করেছি আমরা সবাই তা করেছি আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জন করার জন্য। এই অধিকার সচেতন মুক্তিযুদ্ধারা মুক্তি যুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধার সার্টিফিকেট চায়নি, চেয়েছিল সামান্য খরপোষের বিনিময়ে স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকার অধিকার। কিন্তু তাদেরকে সে অধিকার দেওয়া হয়নি। বরং রক্ষী বাহিনীর হাতে যে ত্রিশ / চল্লিশ হাজার ছাত্র জনতা নিহত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রকৃত মুক্তি যুদ্ধা। ট্যাঙ্ক কামানের সামনে বাঁশের লাঠি দিয়ে যুদ্ধ করা যায়না। হয়তো ভারত আমাদেরকে ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ ভিত্তিতে স্বাধীন করে দিবে এই নিশ্চয়তা ছিল বলেই যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি না নিয়ে আমাদেরকে যুদ্ধের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এবং এই ফলশ্র“তিতেই হয়তো যুদ্ধোত্তর কালে পাকিস্তানীদের আত্মসর্ম্পনের অনুষ্ঠানে যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানিকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি। আর এখন এই একই কারনেই হয়তো জিয়াউর রহমান ও কাদের সিদ্দিকীর মতো খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধাদেরকেও রাজাকার বলে অভিহিত করা হয়। জেনালের ওসমানির নাম এখন স্বাধীনতার বিশেষ অনুষ্ঠানেও উচ্ছারিত হতে দেখা যায় না। এরকম অকৃতজ্ঞতা অবশ্যই ‘আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনের চেতনার’ বহি:প্রকাশ নয়। জেনারেল ওসমানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। আর সেদিন ১৯৭৫ সালে উত্তর পাড়ায় তিনদিন সাটল বৈঠকের মাধ্যমে তিনিই বিবাদমান জেনারেলদেরকে নিয়ন্ত্রিত করে দেশকে অনিবার্য গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছিলেন। আজ ‘মুক্তিযুদ্ধের আত্মরক্ষা মূলক আত্মনিয়ন্ত্রনের’ এই চেতনাটি হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার ফলশ্র“তিতেই চিরকুমার এই মহান পুরুষটি আজ আমাদের নুতন প্রজন্মের কাছে পরিচয় হারিয়ে ফেলেছেন।

কিন্তু শাক দিয়েতো আর  মাছ ঢেকে রাখা যায় না। বাংলার মানুষ কোনদিন সত্যিকার স্বাধীনতা না পেলেও মানষিক ভাবে কখনো প্রতিবন্দী ছিলনা। মহাত্মা গান্ধী নিজে এসেও এখানের মানুষগুলোকে স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে নিবৃত করতে পারেননি। আজো কেহ পারবে না। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মজিবুর রহমান সাহেবের রেকর্ড করা হলেও যুদ্ধের একটা ঘোষনা প্রচার করা যেতো, অথবা আওয়ামী লীগের যে কেহ একজন ঘোষনাটি দিতে পারতেন। কিন্তু ঘোষনাটি জিয়াউর রহমানকে দিতে হয়েছে এটা কোন তাৎপর্যহীন বিষয় নয়। এটা আমাদের নিয়তির চিরাচরিত বিধানের মতো আর একটি বিধান। তাই ভাষা আন্দোলন, ২ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষনা ও পতাকা উত্তোলন, পঁচাত্তরের গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের এই ঘোষনাটিও ঘটনার ধারাবাহিকতায় অনিবার্য কারনে রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে এসেছিল একটি অখ্যাত কর্নার থেকে। জিয়াউর রহমান আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আমাদেরকে আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনে উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন। বাংলার গনমানুষ এই চেতনাতেই যুদ্ধ করেছে। এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গনমানুষের চেতনা। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের অধীনতা মূলক স্বাধীনতার’ চেতনাটি তাদের যারা আগারতলা ষড়যন্ত্র এবং পঁচাত্তরের একদফার মতো একাত্তরের সাতদফা ভিত্তিক যুদ্ধ করেছে। ১৯৭১ সালে আমরা ‘অধীনতা মূলক স্বাধীনতা’ নয় ‘আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনের’ জন্য যুদ্ধ করেছি। আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রনই গনমানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গনমানুষের এই চেতনা হয়তো কিছুদিনের জন্য অবদমিত করে রাখা যায় কিন্তু কখনো পরাজিত করা যাবে না।

তারপরও পরিশেষের পর কিছু শেষের কথা থেকে যায়। জনতার প্রয়োজনেই জনতা নেতা তৈরী করে থাকে। এবং নেতাকে নেতৃত্ব দিতে হয় উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। আবার এই পরিস্থিতির প্রয়োজনেই অনেক সময় তৃতীয় পক্ষকে এসে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে হয় সময়ের দাবী সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। আমাদের স্বাধীনতার চেতনা সমন্বিত করার জন্য হয়তো এর সবগুলো চেতনারই প্রয়োজন ছিল। ছাত্র জনতার চাহিদা  না থাকলে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না। আর বঙ্গবন্ধু এগিয়ে না দিলে জিয়াউর রহমানের অস্তি^ত্ব খুঁজে পাওয়া যেতোনা রাজনীতির সুবৃহৎ অঙ্গনে। শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান কেহ কাকেও অশ্রদ্ধা করতেন না। আর আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের তাদেরকে শ্রদ্ধা করা উচিত। কারন ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে হাসিনা খালেদা এদেরকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে একজনকে প্রবাস থেকে আর একজনকে গৃহ থেকে টেনে এনে রাজনীতির নেতৃত্বে সমাসীন করেছি। সামনের দিকেও আওয়ামী লীগ বিএনপি না থাকলে আমাদের রাজনীতি অচল হয়ে যাবে। হয়তো ঐ দিনটিও আর বেশী দুর নয় যেদিন আমাদেরকে আমরিকা লন্ডন যেতে হবে জয় আর তারেক কে ফিরিয়ে আনার জন্য। ভারতীয় উপমহাদেশে এটাই রাজনৈতিক চরিত্র। ভারতীয়রা অনেকদিন থেকে রাহুল প্রিয়াঙ্কার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানে বেনজিরের মৃত্যুর পর তার স্বামী বহুলভাবে পরিচিত মি: ১০% কে তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন করেছে। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের জন্য দুটি রাজনৈতিক ধারা তৈরী হয়েছে। আমরা পর্যায় ক্রমে একদলের পরিবর্তে অন্য দলকে ক্ষমতা প্রদান করে থাকি। তাই ক্ষমতা নিয়ে কোন দলের চিন্তায় পড়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু ধৈর্য্য ধরে সততার সহিত মানুষের জন্য কাজ করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান আর জাতিকে বিভক্ত করার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতায় আপনারাই থাকবেন আমাদেরকে শুধু একটু শান্তিতে থাকতে দিন। অপরদিকে এটাও মনে করার কারন নেই যে ৯০% মুসলমানের এইদেশ থেকে ইসলামকে নির্বাসন দেওয়ার জন্য কেহ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তবে সব যুদ্ধের মতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ১০০% বাংলাদেশী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। আর কোন যুদ্ধেই শতকরা একশত ভাগ মানুষ যুদ্ধের পক্ষে থাকে না। অনেকে এদেরকে যুদ্ধের পর দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেন। (আমাদের মুক্তি যুদ্ধের পরও খুব বেশী রাজাকার বেঁচে থাকার সুযোগ পায়নি।) তবে যারা বুদ্ধিমান দেশপ্রেমিক তারা পরাজিত শক্তিকে ক্ষমা করে দেন সামনে এগিয়ে চলার পথ সুপ্রশস্ত করার জন্য। মোহাম্মদ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পর প্রতিশোধ নেননি। নেলসন ম্যান্ডেলা ‘ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ করে সমজোতার পথ বেচে নিয়েছিলেন। আর আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান একজন বড় মাপের নেতা ছিলেন বলেই যুদ্ধের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন। কারন জয়কে পরাজিত শক্তির রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করলে বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। আর জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। আমরা যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের জাতির পিতা বলে অভিহিত করে থাকি তাহলে ‘মুক্তি যুদ্ধের কথিত চেতনার’ নাম করে এমন কিছুই করা উচিত নয় যাতে তার সিদ্ধান্তের অবমাননা করা হয়।

Loading


Comments

মুক্তি যুদ্ধের চেতনা — 4 Comments

  1. মুক্তি যুদ্ধের- চেতনা প্রবন্ধটি ভালই লিখেছেন। আজ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর থেকে এই সব কথা, বিশেষ করে- বিজয় এবং স্বাধীনতার মাস আসলেই, পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব কথা, যুক্তি এবং প্রমাণ দিয়ে পুথি পড়ার মত বলে আসছেন; এবং বলিতে থাকিবেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
    মজার ব্যাপার হচ্ছে মুক্তি যুদ্ধের-চেতনা বা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা বলতে এই উভয়পক্ষ কি বুঝেন বা কি বুঝাতে চান তা তাঁরা নিজেই বুঝেন কি না তা’ই এখন আমরা সাধারণ মানুষের জন্য অবোধ্য বোজা হয় দাঁড়িয়েছে।

    চেতনা শব্দের অর্থ হচ্ছে চৈতন্য; হুঁশ; জ্ঞান; সজ্ঞা; জীবন্ত; জীবিত; সচেতন অবস্থা, জাগ্রত অবস্থা। এখন চেতনা শব্দের সমার্থক শব্দগুলি যদি মুক্তি যুদ্ধের-”চেতনা” বা স্বাধীনতা যুদ্ধের ”চেতনা” বা স্বাধীনতার ”চেতনা” এর জায়গায় বসাই তাহলে অর্থ কি দাঁড়াবে? তা সম্মানিত পাঠকদের বিবেচনার- জন্য ছেড়ে দিলাম। এখন যদি বাক্যে শব্দ প্রয়োগের বিচার করে- চেতনা শব্দের ভাবার্থ ব্যবহার করা হয় তাহলে হয়তঃ বলতে পারি মুক্তি যুদ্ধের-লক্ষ্য; বা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

    স্বাধীনতার অর্থ যদি ইংলিশ -independence – হয় তাহলে তার অর্থ দাড়ায়== free from all kind of dependency; সর্বপ্রকার পর-নির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনির্ভশীলতার নাম হচ্ছে স্বাধীনতা।

    স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে একটি প্রশ্ন যদি উত্থাপন করা হয় যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য কি অর্জিত হয়েছে?

    বিভিন্ন টিভি টকশোয়েতে উভয় পক্ষের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা কথা বলেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য কি অর্জিত হয়েছে? এই প্রশ্ন আসলে সবাই এক বাক্যে মিউ মিউ করে উত্তর দেন; না তা হয় নাই। তার পরই স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার- জন্য শুরু হয়ে যায় একে অন্যকে দোষারোপ করার চিরন্তন কায়দায় পুথিপড়া।

    আমি যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পর মানুষের জীবনের প্রধান প্রধান মৌলিক চাহিদা গুলি কি বাংলাদেশের মানুষ মিটাতে পারছে?

    বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়ার পর একটি শিশু কি একজন উন্নতমানের মানুষ হওয়ার জন্য সর্ব প্রকার সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে?
    বাংলাদেশের মাটিতে কি মানুষের জীবন আপদমুক্ত?

    বাংলাদেশের মানুষ কি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নাই?

    বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ; যে দেশ নদীমাতৃক সে দেশ [নদীর উপর] সেতু-সর্বস্ব দেশও বটে। বাংলাদেশে কি নদীর উপর সেতু নির্মাণে জন্য এখন স্বনির্ভর?

    বাংলাদেশ কি এখন স্বাধীনতা রক্ষায় তার প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভর?

    বাংলাদেশ এখনও কি নিম্নমানের অদক্ষ শ্রমিক ছাড়া দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে সমর্থ হয়েছে?।

    বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষক কে?
    সত্য কথা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য কারো ঘোষণার অপেক্ষা করে- নাই। এহিয়া খান যখন পয়লা মার্চ ১৯৭১, বেলা দুপুর বারটায় ঘোষণা করেছিল যে, ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ ঢাকায় বসবে না; সাথে সাথে গোটা বাংলাদেশ ব্যাপী লাঠি-মিছিল বাহির হয়। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ঢাকাস্থ বিদেশী সকল কূটনৈতিক মিশন সমূহে বাংলাদেশী পতাকা উড়তে খাকে। (কেবল রাশিয়ার এমব্যাসি ছাড়া, কারণ রাশিয়ার এমব্যাসি দুর্ভেদ্য, প্রটেকটেড ছিল, এমব্যাসি কমপাউণ্ডে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না)

    মাওলানা ভাসানীর যে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে-
    লাকুম দ্বীনুকুম- আচ্ছালামু আলাইকুম বলেছিলেন। এসবের মূল্যায়ন কি ভাবে করবেন? না, যেহেতু আমাদের উভয় পক্ষের- দুই নেতার মধ্যে কেউ এসব জাতীয় ঘটনায় জড়িত ছিলেন না, তাই তার মূল্যায়ন করাতো দূরে থাক; ইতিহাসের পাতায় তার স্থানই দেয়া যাবেনা।

    বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কে?
    ১৯৩৬ সালে সুভাস বসুর বড়ভাই (আতুষদ বসু , নাম ভুল হতে পারে)এবং সারওযার্দী মিলে তৎকালীন উভয় বাংলা, বিহার, আসাম, মেগালয়, ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে পৃথক একটি স্বাধীন দেশ যার নাম হবে বাংলাদেশ- প্রস্তাব করেছিলেন, মুসলিম লীগ নেতারা তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজী সহ কংগ্রেস নেতারা তা প্রত্যাখান করায় এ প্রস্তাব নিয়ে আর এগোনো যায় নি। ইতিহাসের এসব ঘটনা সমূহকে কি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?

    যাক ইতিহাস থেকে যেমন কেউ শিক্ষা নেয় না, ইতিহাসকে তেমন মুছে ফেলাও যায় না।

    যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রসঙ্গ! সকল অপরাধের বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার সবচেয়ে বেশী বাঞ্ছনীয়।
    কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলার আগে একটি উদাহরণ দিচ্ছি সহজে বুঝানোর জন্য।

    বাংলাদেশ পানির দেশ। তাই বর্ষার পানি মৌসুম দিয়েই উদাহরণটি বলা শুরু করি।

    পূর্ণ বর্ষা কালে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পরিচিত বহু-লোকজন তাদের- পরিচিত বা আপনজনের গ্রামে গিয়ে ডাকাতি, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ, সকল প্রকার জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধ করলো। প্রতিবেশীদের- সহায়তায় সকল ডাকাত ধরাও পরলো। অপরাধী ডাকাতদেরকে- চিহ্নিত করে- তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হল। এদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করার জন্য বিশেষ আইনও তৈরী করা হল। হঠাৎ করে- একদিন এদের সকলকে ছেড়ে দেয়া হল। এমনকি এসব জঘন্য অপরাধের দোষে গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে শুধু মৌখিক ভাবেও ক্ষমা প্রার্থনা করতে শুনা গেলনা। তার মাত্র তিন বছরের মাথায় ডাকাতদের- বাড়ীতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসলেন যিনি তিনি হচ্ছেন — ঐ ডাকাতদের দ্বারা অত্যাচারিত শারীরিক ভাবে আক্রান্ত, লুণ্ঠিত, ধর্ষিতা ও নিহত সেই ছেলেমেয়েদের স্বয়ং পিতা। শুধু তাই নয়; ডাকাতের বাড়ীতে গিয়ে নিমন্ত্রণ খেয়ে এসে সেই ডাকাতকে নিজের নিজ বাড়ীতে আমন্ত্রণ দিয়ে যথাযথ মর্যাদায় আপ্যায়ন, মেহমানদারী করলেন এই মহান আত্মার পিতা।

    এখন তার চল্লিশ বছর পর নিজ গ্রামের মাঝিদেরকে ধরলেন যারা সেই ডাকাতদের নৌকায় করে নিয়ে এসেছিল। আর এই মাঝিদেরও বিচার হবে সেই আইনে যে আইনে যা করা হয়েছিল তাদের জন্য যারা ডাকাতি করার সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল ।অর্থাৎ সেই ডাকাতদেরকে সসম্মানে মুক্তি দান, আর পাশের বাড়ীর মাঝিদেরে বলিদান!

    কথা হল মাঝিদের- বলিদান করা হোক এতে আমার তেমন আপত্তি নাই। আপত্তি হচ্ছে অন্যত্র। এ জন্য আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন শেইখ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাইদের ১০/১৫ জনকে মানবতা বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের জন্য ধরা হল, এবং নিম্ন আদালত, উচ্চ-আদালত, সর্বোচ্চ আদালতে বিচার করে মাত্র ৬/৭ মাসের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল। ইস্যু ফিনিস।

    কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে রাষ্ট্রীয় তহবীলের কুটি কুটি টাকা খরচ করে এই ইস্যুকে যেভাবে প্রচারণার মাধ্যমে গোটা জাতিকে একটি ইস্যু ভিত্তিক ধ্যানে নিমজ্জিত করে-প্রলম্বিত করা হচ্ছে- তা জাতির জন্য সুখবর নয়। অনুসন্ধানী মন নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার- পর থেকে একটি ইস্যু থেকে আর একটি ইস্যু নিয়েই গোটা জাতিকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ভাবপ্রবণ বাঙ্গালী জাতিকে একটার পর আর একটা ইস্যুর-মধ্যে ভাবপ্রবণাসক্ত করে রাখা হচ্ছে ; যাতে মুক্তিযুদ্ধের- লক্ষ্য অর্জন তথা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে বাঙ্গালীর মনে সুস্থ চিন্তার সুযোগ না আসে। দেখা যাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যু শেষ হলে পরের ইস্যু হবে –বাংলাদেশে তালিবান- বাংলাদেশ এখন আফগান এই ইস্যুটি তুলে বাঙ্গালি জাতিকে দীর্ঘস্থায়ী ভাবাচ্ছন্ন করে রাখা এবং সি জন্য যে সর্ব প্রকার প্রস্তুতি যে চলছে তা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

    পরিশেষে সকল কালরাত্রি পেরিয়ে বাংলাদেশের আকাশে- উন্নয়নের, দেশ গড়ার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার ও সর্বোপরি দেশকে স্বনির্ভরশীল করে তুলার মাধ্যমে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার – সোনালী সূর্য উদয় হোক এই কামনা করি সর্বশক্তিমান প্রভুর দরবারে।

    • মন্তব্যটি আগ্রহের সাথে পড়লাম। এখানে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা এসেছে। বাংলাদেশে (এবং বাইরেও) আজকে “নির্ভয়ে” আলোচনার প্রয়োজন, সকল পক্ষকে তাদের নিজ দলে থাকা সত্ত্বেও, কিছু কিছু বিষয়ে দলীয় মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে মুক্ত মনে আলোচনার প্রয়োজন। স্বাধীনতার বিষয়টি তার পিছনের ইতিহাস ও পর্যায়ক্রমিক চিন্তাধারা বিবেচনা করা উচিৎ।
      আপনার মন্তব্যটি একটি আলাদা পোস্টিঙে আসা দরকার মনে করি।

      ধন্যবাদ।

  2. @M.Ahmed :
    “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে বাঙ্গালীরা অত্যাধিকভাবে personality cultists, যেকারণে ৪০ বৎসর পরেও দেশের ইতিহাসকে ‘জাতীয়’ ইতিহাস হিসেবে দেখার প্রয়াস তেমন হয় নি। যা হয়েছে তা ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইতিহাস, দলীয় ইতিহাস, দলীয় ভিন্নাদর্শিক ইতিহাস –যার উপর ‘জাতীয়’ শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের দুর্বলতা শর্মিলা বোসের Dead Reckoning (২০১১) বইটিতে স্পষ্ট হয়ে এসেছে।”
    কি দারুন এক মন্তব্য করলেন! আমি ১০০ + % সহমত।

  3. ভাবছিলাম দেশের এসব বিষয় নিয়ে মন্তব্য/টন্তব্য করব না, কিন্তু মানবিক ব্যাপারটিই এমন যে মনের চিন্তা সব সময় এক ধারায় চলে না। তাই দুটি দু/তিনটি মন্তব্য করতে যাচ্ছি।

    উদ্ধৃতি: “বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে তিনিই প্রথম জাতির প্রতি নির্দেশ দিলেন আত্মরক্ষা করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। শূন্য মাঠে আবেগের আতিশয্যে প্রথমে তিনি নিজকেই নবঘোষিত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান কারো নির্দেশে ঘোষণাটি দিয়ে থাকলে এমনটা হতোনা।”

    ১। মন্তব্য: বিবিসির প্রাক্তন সাংবাদিক সিরাজুর রহমান সেদিন একথা লিখেছেন যে মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে দাবি করেননি।বিগত দুই বৎসর ধরে আ’লিগের ফ্যাসিষ্টরা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে যতকিছু করে যাচ্ছে তাতে তারা জাতির একাংশ থেকে মুজিবের অবস্থান ক্রমশ দূর থেকে অনেক দূরেই ঠেলে দিচ্ছে। যে অর্থে তারা জিয়াকে ঘোষণার ‘পাঠক’ বলছে সে অর্থে ‘পূর্ণ-স্বাধীনতার’ মূল প্রবক্তা মুজিব নন বরং মাওলানা ভাসানী। একথাটি দিন দিন ফ্যাসিষ্টদের কারণে জোরদার হচ্ছে। সেদিন স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে ড. কর্নেল অলিকেও মুবিজকে উহ্য রেখে ভাসানীর কথাই বলতে দেখেছি। স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে ভাসানীকেই decorate করার কথাও আস্তে আস্তে উঠে আসছে। কিন্তু এসব একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা বিকাশের পথে অন্তরায় হতে পারে এবং এতেও কোন একটি পক্ষের স্বার্থ সাধিত হতে পারে।

    উদ্ধৃতি: “বাস্তবিক ভাবে আমাদের নেতা বিশেষ মুহূর্তে আমাদেরকে ত্যাগ (ডিজ্ওউন) করলেও আমরা তাকে ত্যাগ করিনি। আমরা অবলীলায় একটা গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।”

    ২। মন্তব্য: এখানে disown করার ধারণাটি এভাবে আনা ঠিক হয়েছে বলে মনে হয় না। শেখ মুজিবের সারা জিন্দেগীর অবদান এবং তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হবে, না, না দেয়ার সাথে –এই analysis এর স্থান ভিন্ন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে বাঙ্গালীরা অত্যাধিকভাবে personality cultists, যেকারণে ৪০ বৎসর পরেও দেশের ইতিহাসকে ‘জাতীয়’ ইতিহাস হিসেবে দেখার প্রয়াস তেমন হয় নি। যা হয়েছে তা ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইতিহাস, দলীয় ইতিহাস, দলীয় ভিন্নাদর্শিক ইতিহাস –যার উপর ‘জাতীয়’ শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের দুর্বলতা শর্মিলা বোসের Dead Reckoning (২০১১) বইটিতে স্পষ্ট হয়ে এসেছে।

    উদ্ধৃতি: “এখন মনে হচ্ছে আসলেই মুক্তি যুদ্ধের একটি নয় দু’টি চেতনা রয়েছে।”

    ৩। মন্তব্য: এটাই মনে হয় এই জাতির আগামী দিনের দুটি পথ। এই দুই পথ প্রথমেই ছিল –তবে ফ্যাসিষ্ট জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে গোপন ছিল। যারা ইসলামের কবর বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়েই দিতে বদ্ধ পরিকর ছিল –তাদের প্রয়াস, উদ্যম, এখন সাহসিকতার সাথে বেরিয়ে আসায় –জন সমক্ষে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এখন কোন পক্ষের আর ফিরার পথ নেই। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে ইসলাম নামক যে সত্তা বাংলার মাটিতে ঢুকে পড়েছে তার অবয়ব এমন নয় যে জাতীয়তাবাদের পূজ্য মৃত্তিকায় তাকে কবরস্থ করা যাবে।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *