মায়ের অনুমতি

২০১১ এর প্রথম দিকে আমার মা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন । বছরের শেষ দিকে তাঁর অবস্থা যখন মরণাপন্ন তখন আমার বড় ভাই মারা যান । তারপর থেকে কখনো একটু সুস্থ, কখনো একটু অসুস্থ এভাবেই মায়ের দিন কাটছিলো । এ অবস্থায়, ২০১৩ এর প্রথম দিকে আমি মায়ের কাছে হজ্বে যাবার অনুমতি চাইলাম । মা খুশি মনে আমাকে অনুমতি দিলেন । আমি তাঁর অনুমতি পেয়ে হজ্বে যাবার সকল ব্যবন্থা  চুড়ান্ত করে যাবার দিন গুনছি ।

যখন আমার হজ্বে যাবার সময় এলো তখন আমার মমতাময়ী মা শয্যাশায়ী, মরণাপন্ন । তাঁর জবান বন্ধ । সব কিছু শুনেন । কিন্তু কিছু বলতে পারেন না । চিবিয়ে খেতে হয় এমন কোন খাবার খেতে পারেন না । ছোট্ট চামচ দিয়ে পানি বা জুস জাতীয় খাবার মুখে দিলে যৎসামান্য গিলেন । আমরা বুঝতে পারলাম তাঁর পরপারে যাবার সময় সমাগত, আজরাইল দুয়ারে কড়া নাড়ছে । আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হজ্বে যাবো কি যাবো না বুঝতে পারছি না । আমার ছোট ভাইয়েরা, আমার আত্মীয় স্বজন, আমার স্ত্রী, আমার একান্ত শুভাকামীগণ পরামর্শ দিলেন-মায়ের কাছে অনুমতি চান । আমি তাদের বললাম-মা তো কথা বলতে পারেন না । কিভাবে অনুমতি দেবেন? তারা বলেন-চেষ্টা করে দেখুন । চেষ্টা করতে দোষ কি ।

আমার ফ্লাইট ডেট ছিলো ২৮ সেপ্টেম্বর । সবার কথা মতো ২৬ সেপ্টেম্বর আমি মায়ের অনুমতি চাইতে ছোট ভাইয়ের বাড়ি গেলাম । সেখানে মা অবস্থান করছিলেন ।

মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শী, কয়েকজন আলেম । দেখলাম কয়েকজন খানিকটা দূরে কোরাণ শরীফ তেলওয়াত করছেন । কয়েকজন তসবীহ হাতে দোয়া দরুদ পড়ছেন । আমার ছোট ভাই মায়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে কলেমা পড়ছেন-লা-ই-লাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ । আমি মায়ের পাশে বসলাম । মা চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন । মনে হলো দুনিয়াদারীর খোঁজ খবর, ভাল মন্দ কিছুই তাঁকে স্পর্শ করছে না । মনে হলো ইহজগতে তিনি নেই । হারিয়ে গেছেন কোন এক অজানা দেশে । আমি মায়ের কপালে হাত রাখলাম । মায়ের একটা হাত ধরলাম । তারপর ডাকলাম-মা, মা । আমি মফিজ । আপনার ছেলে । সবাইকে অবাক করে দিয়ে মা আমার জবাব দিলেন-অউ (আমাদের গ্রাম এলাকায় সন্তান মাকে ডাকলে মা ‘অউ’ শব্দে জবাব দেয়) । আমি বললাম-মা, আমি হজ্বে যাওয়ার নিয়ত করেছিলাম । যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করা হয়েছে । আগামী পরশু আমার ফ্লাইট । আপনার এই অবস্থায় আমি কি করবো? আমি কি হজ্বে যাবো? আমার মমতাময়ী মা সাথে সাথে জবাব দিলেন-যাও ।

যে মায়ের জবান বন্ধ, যে মা কথা বলতে পারছেন না কয়েকদিন যাবত, সেই মা আমার ডাকে সাড়া দিলেন-অউ, অনুমতি দিলেন-যাও । আল্লাহর কি অপরিসীম কুদরত, কি তার লীলা খেলা । মা আমাকে অনুমতি দিলেন । আমি যথাসময়ে হজ্বে গেলাম ।

Loading

About মফিজুল ইসলাম খান

মফিজুল ইসলাম খান পিতা-মৃত আব্দুল মন্নাফ খান । মাতা-সাফিয়া খাতুন । জন্ম- ০৪-০৯-১৯৫৪ । জন্মস্থান-ঘিলাতলী, বিবির বাজার, কুমিল্লা। শিক্ষাগত যোগ্যতা-এমকম,এলএলবি । একটি জাতীয়করণকৃত ব্যাংকের ডিজিএম (অবঃ)। বর্তমানে আইনজীবী । বসবাস-ঢাকায় । ইতিপূর্বে প্রকাশিত কবিতার বই-আন্দোলিত প্রান্তরে আহত চিৎকার, জোসনার ফুল, যন্ত্রণার অনুলিপি । ছড়ার বই-তাক ডুমাডুম ঢোল বাজে । ছড়া-কবিতার বই-আবোল তাবোল । উপন্যাস-মিসকল মফিজ । যৌথ- কবিতার বই-কোমল গান্ধার । যৌথ শিশুতোষ গ্রন্থ-খেঁকশিয়াল ফুলপরী ও বাজপাখীর গল্প ।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *