এক. ‘কৃতজ্ঞতা’ বলে একটা শব্দ আছে বাংলা অভিধানে। ডক্টর মোহাম্মদ এনামুল হক ও শিব প্রসন্ন লাহিড়ী প্রণীত ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ এর অর্থ করা হয়েছে : কৃতজ্ঞ, যে উপকারীর উপকার স্বীকার করে, যে উপকারীর নিকট ঋণী মনে করে, যে উপকারীর প্রত্যুপকারের চেষ্টা করে এমন। বি. কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞচিত্ত, কৃতজ্ঞ হৃদয়। কৃতজ্ঞতাপূর্ণ মন, যাহার চিত্ত কৃতজ্ঞতায় ভরা। আবার ভারতের সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত অশোক মুখোপাধ্যায় ও সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ সমার্থবোধক শব্দ কোষ’-এ কৃতজ্ঞতাকে বলা হয়েছে, উপকার স্বীকার, উপকার স্মরণ, উপকারীর উপকার স্মরণ, দায় স্বীকার, ঋণ স্বীকার, নিমকহালালী, ইমানদারী, বিশ্বস্ততা, অকৃতঘ্নতা, অকৃতঘ্নত্ব। ধন্যবাদ জানানো। কৃতজ্ঞতাবোধ। বিন. কৃতজ্ঞতাবদ্ধ, কৃতজ্ঞ (থাকা), সকৃতজ্ঞ, নিমকহালাল, ধন্য (হ), বাধিত (হ), অনুগৃহিত (হ), কৃতার্থ, বিশ্বস্ত, ঋণী। কৃতজ্ঞচিত্ত, কৃতজ্ঞমন, অকৃতঘ্ন। কৃতজ্ঞতাপূর্ণ। ক্রি-বিন-কৃতজ্ঞচিত্তে, কৃতজ্ঞ মনে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। এই কৃতজ্ঞতার ব্যাপারে সিনেকা বলেছেন, ‘একটি কৃতজ্ঞ হৃদয়ের চেয়ে সম্মানজনক জিনিস আর কিছু নেই।’ এমনও বলা হয়েছে, তুমি যে সেতুর উপর দিয়ে হাঁটছো সেই সেতুর প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা মানুষের কাছ থেকে উপকার পেয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, তারা আল্লাহর প্রতিও অকৃতজ্ঞ।’ তবে মনীষী জনসন বলে রেখেছেন, ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ক্ষমতা সহজে হয় না। বাজে লোকদের কাছ থেকে তা প্রত্যাশা করা অন্যায়।’ এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে আর. এইচ. বারহাম বলেছেন, ‘যাদের লজ্জা কম, তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধও কম।’ সেজন্য হজরত আলী নিষেধ করে দিয়েছেন, ‘যার বুদ্ধি নাই তার কৃতজ্ঞতা আশা করো না।’ আমেরিকার জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এ ব্যাপারে উপসংহার টেনে বলেছেন, ‘মোটকথা, মানুষের মধ্যে যদি কৃতজ্ঞতাবোধের অভাব থাকে তবে সে মানুষ হিসাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।’
দুই. এই যে নানাভাবে ‘কৃতজ্ঞতা’কে দেখা, এই দেখা ও বিচার-বিশ্লেষণে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্থান ইতিহাস কোথায় নির্ণয় করে রেখেছে তা আমরা জানি না। তবে নিন্দুকেরা বলেন যে, তার অভিধানে ওই শব্দটি নাকি একেবারেই নেই। নিন্দুকদের এসব কথার সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করতে আরও সময় লাগবে। বিশেষ করে যতদিন মূল কেন্দ্রে তিনি অধিষ্ঠিত থাকবেন, অথবা ক্ষমতা তাকে ঘিরে আবর্তিত হবে, আর একজন এই ধরনের কথা বলে পার পেয়ে যাবে—তা হতেই পারে না। সেজন্য নিরাপদ দূরত্ব ও সময় দরকার। তো নিন্দুকদের কথা যদি সত্য ধরি, তাহলে বলতে হবে খালি কৃতজ্ঞতাবোধই বা কেন, দায়িত্বশীল কথাবার্তাও তো তার অভিধান থেকে ছুটি নিয়েছে। সে কথায় পরে আসছি। আগে কৃতজ্ঞতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন যে মানুষটির জন্য, সেই জিয়াউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তো দূরের কথা, তার নামই শুনতে পারেন না। মরহুম মুজিব আওয়ামী লীগকে হত্যা করে, দাফন করে, সে কবরের ওপর গড়ে তুলেছিলেন ‘বাকশালী’ বালাখানা বা গ্যাস চেম্বার। সেই আওয়ামী লীগকে কবর থেকে তুলে তার মধ্যে রুহ ফুঁকে যিনি দ্বিতীয়বার জীবনদান করেছিলেন, তিনি জিয়া। সেই জিয়ার বিরুদ্ধে কুত্সা ও বিষোদ্গার উদগিরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদরা সর্বদাই সচেষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভগ্ন, বিপন্ন-বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি যিনি বানিয়েছিলেন, দলের সভাপতি করে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ যিনি খুলে দিয়েছিলেন, তিনি ড. কামাল হোসেন। কামাল হোসেনের হাত ধরেই তিনি দিল্লির ‘দাওয়াত কাম নির্বাসন’ পর্ব শেষ করে বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছিলেন। ফিরে এসেছিলেন ঢাকায়। তার কাছ থেকেই নিয়েছেন রাজনীতির ছবক। নিয়েছেন দল গড়ার ট্রেনিং। হয়ে উঠেছেন জননেত্রী। সেই কামাল হোসেনকে তিনি গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের কোনো ‘বীর’ ঘর থেকে বের হননি। নাসিম সাহেবরা তো পালিয়ে ছিলেন ভারতে। মাত্র একজন মানুষ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন, তিনি কাদের সিদ্দিকী। মুজিব ও মুজিব পরিবারের জন্য তার মমতা অনেকাংশে প্রশ্নাতীত। সেই কাদের সিদ্দিকীকে তিনি সম্মানিত করার বদলে অপমানজনকভাবে বের করে দিয়েছেন দল থেকে। তাকে নানাভাবে হেনস্তা করেছেন। ভোট ডাকাতি করে তাকে এমপি হতে দেননি। তাকে ‘রাজাকার’ পর্যন্ত বানিয়েছেন। ড. কামাল ও কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বদলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুই কাক দুই জায়গায় কা কা করছে। কাক কর্কশ কণ্ঠে কা কা করলে সেটা অশুভ লক্ষণ। তাই সবাই সতর্ক থাকুন।—কামাল হোসেন সম্পর্কে চরম অশ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি বলেছেন, এরশাদের যেমন আসম রবের মতো গৃহপালিত একজন ছিল, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও তেমন একজন গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা জোগাড় হয়ে গেছে। তিনি হচ্ছেন আমাদের ঘরভাঙা কামাল হোসেন। কাদের সিদ্দিকীর প্রতি ‘অশেষ কৃতজ্ঞতা’ পেশ করে বলেছেন, ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমাফিক পা না মেলানোর কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদকে বিশ্বাসঘাতক গাল দিতেও কৃপণতা করেননি। মইন-উ ও ফখরুদ্দীনের ১/১১-এর সময় কারাবন্দি শেখ হাসিনার পাশে এসে যিনি সব ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে আইনি শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন, তিনি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি সে সময় বেগম খালেদা জিয়ারও আইনজীবী ছিলেন। নিতান্ত অন্ধ, বধির, বিবেকহীন না হলে যে কেউ বলবে, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক ঋণ। সেই ব্যারিস্টার রফিকউল হককে ধন্যবাদ জানানোর বদলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, তা দেখে পুরো দেশবাসীর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, এই লোক কার খালু? প্রবীণ এই আইনজীবী প্রধানমন্ত্রীর এসব হৃদয়হীন আঘাত নীরবেই সহ্য করেছেন। করে বেঁচে গেছেন। নইলে তাকে হয়তো আরও গালি শুনতে হতো।
তিন. এরকম ভূরি ভূরি নজির আছে। তালিকা বাড়িয়ে কাজ নেই। কৃতজ্ঞতার প্রসঙ্গ থাক। দায়িত্বহীন বেফাঁস কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী আল্লাহ চাহেত এক নম্বরে আছেন সর্বদা। তিনি কিংবা তার মরহুম পিতা নোবেল পুরনাকার কেন পাননি, তার জবাব দিতে পারে একমাত্র নোবেল পুরস্কার কমিটি। কিন্তু সেই কমিটিকে গুষ্ঠি তুলে গালাগাল করলে হয়তো আম ও ছালা দুটোই যেতে পারে ভেবে, অর্থাত্ বর্তমানের মতো ভবিষ্যত্ নষ্ট হয়ে যেতে পারে—এ চিন্তা থেকেই বোধ করি ওই কমিটিকে রেহাই দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ চড়াও হয়েছেন নিরীহ-নিরপরাধ প্রফেসর ইউনূসের ওপর। ইউনূসের অপরাধ তিনি কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন? ইউনূসের অপরাধ তিনি কেন শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় নোবেল পুরস্কার পেলেন? ইউনূসের অপরাধ মরহুম মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা যে পুরস্কার জোটাতে পারেননি, তিনি কেন সেই পুরস্কার পেলেন? মহীউদ্দীন খান আলমগীরের শত চেষ্টায় হাজার হাজার লাখ লাখ মাইল বিমান ভ্রমণ করে যেখানে ১০টি ডক্টরেট জোগাড় করা হলো, সেখানে সেগুলোকে কেউ পাত্তাই দিল না। মনের দুঃখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একবার তো বলেও ছিলেন, আমি একটার পর একটা ডক্টরেট ডিগ্রি পেলাম। আপনারা তো কেউ ধন্যবাদও দিলেন না। কেউ সার্টিফিকেটটাও দেখতে চাইলেন না। এ পর্যন্ত ৯টি ডিগ্রি পেয়েছি। আরও বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে ডিগ্রি দিতে চাচ্ছে, সময় দিতে পারছি না। অথচ ড. ইউনূসের একটা মাত্র পুরস্কার নিয়ে বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ! পৃথিবীর এমন কোনো শ্রেষ্ঠ সম্মাননা নেই যা ইউনূস পাননি। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সেগুলোর কাছে পৌঁছতে পারেননি। ড. ইউনূসের অপরাধ হলো, শেখ হাসিনা কিংবা শেখ মুজিবের নামে নয়, বহির্বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে চেনে ড. ইউনূসের দেশ হিসেবে? ড. ইউনূসের অপরাধ তিনি নিজেকে কোনোদিন ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ বলে পরিচয় দেননি। এমনকি আওয়ামী লীগও কোনোদিন করেননি। ফলে এহেন বিশ্ববিশ্রুত, বিশ্বজুড়ে সম্মানিত মনীষীকে সম্মানিত করার বদলে, তার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দেশের ইমেজ উজ্জ্বল করার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ বাদ দিয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘রক্তচোষা’, ‘সুদখোর’, ‘ঘুষখোর’ ইত্যাদি রুচিহীন ভাষায় আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে আছেন। পা-চাটা পত্রিকা ও চ্যানেল দিয়ে ড. ইউনূসের ভাবমূর্তি বিনাশের জন্য চলছে হাজার কোশেশ। তার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে মামলার পর মামলা। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকার ও সরকারদলীয় নানা স্তরের লাঠিয়ালরা হরদম অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এই মানুষটির বিরুদ্ধে। তাকে উত্খাত করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। এখন তার নোবেল বিজয়ী এই অসাধারণ প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করে টুকরো টুকরো করার বদ মতলব নিয়ে গোঁয়াড়ের মতো এগোচ্ছে সরকার। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে তীব্র নিন্দার ঝড় উঠলে তারা কিঞ্চিত বিরতি দিয়ে এখন আবার শুরু করেছে অপপ্রচার। সরকারের এসব লাগামছাড়া অপপ্রচার ও অপকর্মের প্রতিবাদ করে বলে ইউনূস সেন্টারকে চরম হুশিয়ারি দিয়েছে সরকার। অর্থাত্ আমরা যা ইচ্ছে বলব, করব; কিন্তু তোমরা এর বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে টুঁটি চেপে ধরব। এখানেই শেষ নয়, এখন ড. ইউনূসের ভাবমূর্তি ধ্বংস ও ভবিষ্যতে তাকে শায়েস্তা করার পথ সুগম করার জন্য, গোটা জাতিকে বিস্মিত করে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মাঠে লাগিয়ে দিয়েছে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। ড. ইউনূস কোথায় ভাত খেয়েছেন, কোথায় প্রেম করেছেন, কোথায় মল ত্যাগ করেছেন ইত্যাদি খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলোই তার বিরুদ্ধে পাটকেল হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছে আমাদের কর্তাদের। আক্কেলের অবস্থা বুঝুন সরকারের। ড. ইউনূসের ঘুম হারাম করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার দুর্বুদ্ধি যদি রাষ্ট্রের কর্ণধারের মাথায় থাকে তাহলে আম পাবলিকের উপায় কি? অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বগলের দু’পাশে চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, কালো বিড়ালসহ কত কী? কত অপকর্ম তাদের। তার মন্ত্রী, এমপি, মেয়রদের মধ্যে। নেতাকর্মীদের আগে সম্পদ কত ছিল আর এখন কত হয়েছে, সে হিসাবটুকু নেয়া যে জাতির জন্য জরুরি— তার খবর কে নেবে। আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর জন্মের রাগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। সত্যনিষ্ঠ-বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দায়ে আজ এই মানুষটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রোষকষায়িত চোখে পড়ে কারাগারে পচে মরছেন। এর আগেও তার ওপর চালানো হয়েছে অবর্ণনীয় অত্যাচার। জেলে পচতে হয়েছে দশ মাস। তারপরও রাগ কমছে না প্রধানমন্ত্রীর। এবার তিনি আচমকা সবাইকে অপার কৌতূহলে ভাসিয়ে বাণী দিয়েছেন, মাহমুদুর রহমান নাকি শ্বশুরের তত্ত্ব পাচার করে দিয়েছেন সালমান মিয়ার কাছে। সংশ্লিষ্টদের কথা জানি না, তবে দেশসুদ্ধ লোক প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই বালখিল্য উচ্চারণ শুনে মুখ টিপে হেসেছে। হেফাজতে ইসলামের সম্মানিত আলেম ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও চরম বিরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিন্দুকেরা বলে, তারা যেহেতু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার প্রদত্ত ৫০ সিটের টোপ গিলেনি, সেজন্যই নতুন করে গোস্বায় ফেটে পড়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হেফাজতের কর্মীরা মতিঝিল শাপলা চত্বরের চারপাশে রং মেখে শুয়ে ছিল। পুলিশ দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। সুরঞ্জিত বলেছেন খালি পালানো নয়, কান ধরে সুবহানাল্লাহ বলতে বলতে ভেগেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অশাসন, কুশাসন, অপশাসন, ব্যর্থ শাসনে জর্জরিত দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা কোটাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার কোটা পদ্ধতি নামীয় অনিয়মের বিরুদ্ধে দেশের তরুণ-তরুণীরা পথে নেমেছে। তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে, তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যেখানে সমস্যার সমাধান করা যেত; সেখানে তা না করে তাদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হলো ছাত্রলীগের ক্যাডার, পুলিশ ও র্যাবকে। পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হলো দেশের ভবিষ্যেক। লাগিয়ে দেয়া হলো মামলা। আর গতকাল খোদ প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যার সমাধানের বদলে এসব মেধাবী ছেলেমেয়ের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছেন ক্রুদ্ধ মন্তব্য। তিনি বলেছেন, কোটাবিরোধী ভাংচুরকারীরা চাকরি পাবে না। ছবি সংগ্রহ করে পিএসসিতে পাঠানো হয়েছে। ছবি দেখে দেখে ভাইভা নেয়া হবে। এই কোটাবিরোধীদের কোথাও নেয়া হবে না। এই মেধাবী ছেলেমেয়েদের অপরাধ তারা সরকারের চালাকি-চাতুর্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অর্থাত্ আওয়ামী স্বার্থের জায়গায় আঘাত করেছে। অতএব তারা মেধাবী হোক আর যাই হোক, তাদের দাবি ন্যায্য হোক আর যাই হোক, তাদের ক্ষমা নেই।
চার. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষেপে গেছেন দেশের জনগণের প্রতিও। কারণ চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৬টিতেই গোহারা হেরেছেন আওয়ামী লীগের ‘মহানায়ক’রা। জনগণ আওয়ামী লীগকে যেমন প্রত্যাখ্যান করেছে, তেমনি প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের প্রার্থীদের। জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে অন্যায় ও অন্যায্য শাসনকে। জুলুম ও নির্যাতনকে। মিথ্যাচারকে। সন্ত্রাসকে। দুর্নীতিকে। জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের হোতাদের। জনগণ ‘না’ বলেছে কুশাসনকে, দুর্নীতিকে। ‘না’ বলেছে সন্ত্রাসকে, জুলুমকে। ‘না’ বলেছে প্রতিহিংসাকে, জিঘাংসাকে, বিভেদ ও হানাহানিকে। ‘না’ বলেছে আধিপত্যবাদের দালালিকে। তারা ‘না’ বলেছে মাদককে। খুন ও ধর্ষণকে। ‘না’ বলেছে দাম্ভিকতা ও পাগলামিকে। ‘না’ বলেছে অন্ধত্ব ও চোয়ালবাজিকে। ‘না’ বলেছে ধর্মবিদ্বেষকে। ধর্মের অবমাননাকারীদের। ‘না’ বলেছে রসুল (স)-এর বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্যকারীদের শাস্তি না দেয়াকে। না বলেছে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি জঘন্য মন্তব্যকারীদের। ‘না’ বলেছে শাহবাগের বখাটেদের। তাদের পৃষ্ঠপোষকদের। সঙ্গত কারণেই ক্ষেপে আগুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি এবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সর্বোচ্চ কাঠামোটিতে বসে, সেই জনগণকে গালমন্দ করছেন কষে। বলছেন, জনগণ অসত্ লোকদের ভোট দিয়েছে। এই জনগণকে তিনি শিক্ষা দিতে চান। তাদের জন্য উন্নয়ন কাজ করে লাভ কী? তারা আওয়ামী লীগের চোয়ালসর্বস্ব স্লোগানকে পাত্তা না দিয়ে জাত শত্রু বিএনপিকে ভোট দিয়ে কবিরা গুনাহ করেছে। তাদের বিদ্যুত্ বন্ধ করে দেব। ইত্যাদি। অর্থাত্ জনমতের প্রতিও তার বিন্দুমাত্র সম্মানবোধ বা শ্রদ্ধাবোধ নেই। অথচ এরাই হলো সেই জনগণ যারা তাকে দু-দু’বার প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। সেই জনগণের প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধও নেই। ভালোবাসাও নেই। যা কিছু আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, যা কিছু আমাদের গৌরবের—তার সব ক’টিতেই তিনি কালি মাখিয়ে দিতে চান। কিন্তু নিজের, নিজেদের চামুণ্ডাদের ব্যাপারে তিনি অন্ধ। তাদের কোনো ভুল-ত্রুটি তিনি দেখতে পান না। গত টার্মেও তিনি অনেক অমৃতবাণী জাতির উদ্দেশে বর্ষণ করেছিলেন। তবে তখন মেরুদণ্ড শক্ত, দায়িত্বশীল কর্তব্যবোধে অটল উচ্চ আদালত ছিল। সুপ্রিমকোর্ট ফুল বেঞ্চ সে সময় প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে দিয়েছিল, ‘আদালত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অধিকতর বোধশক্তি, বিচক্ষণতা, বিবেচনাবোধ ও সতর্কতা আশা করে।’ কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই দিন তো এখন নেই। এখন আর অন্যের ওপর ভরসা করে গাঙ পার হওয়ার আশা করা যায় না। এখন দেশটা যাদের, সেই জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। সব ধরনের অপশাসন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সরকারি ও সরকারের দালালদের লুণ্ঠন ও চোয়ালবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে। মুক্ত কণ্ঠে বলতে হবে, মা জননী অনেক হয়েছে। এবার আপনি বিদায় হোন। নিষ্ক্রান্ত হোন। বহিষ্কৃত হোন। আপনি যদি স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজগুলো করেন, তাহলে আপনিও বাঁচেন, দেশটাও রেহাই পায়।
(পূর্ব প্রকাশিত, আমার দেশ)