ভালোই তো, ভালো না?

তথ্য মন্ত্রণালয় তথ্য চায়। তাদের কাছে তথ্য নাই যে তা না, তবু তারা তথ্য চায়। আজব ব্যাপার! তথ্য মন্ত্রণালয় তথ্য চেয়েছে ‘অধিকার’ ও ‘টিআইবি’র কাছে। দৈনিক জনকণ্ঠে বিভাষ বাড়ৈ রিপোর্ট করেছেন, “শাপলা চত্বরের মৃত্যুর বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিপাকে ‘অধিকার’ (১৪ জুলাই ২০১৩)”। ভালো তো, ভালো না? পড়ুক অধিকার বিপাকে। আসলে কেউই মারা যায়নি।

জাতীয় সংসদেও সরকারদলীয় নেতৃস্থানীয় সংসদ সদস্যরা বলেছেন, ৫ মে রাতে হেফাজতের সমাবেশে কোনো প্রাণহানির ঘটনাই ঘটেনি। আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ১৯ জুন জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তৃতায় বলেন, ‘৫ মে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর কোনো গুলিবর্ষণ করা হয়নি বরং হেফাজতের কর্মীরা লাল রঙ লাগিয়ে মৃতের অভিনয় করেছে। হেফাজতের কর্মীরা গায়ে লাল রঙ মেখে রাস্তায় শুয়ে ছিল। পরে পুলিশ এলে তারা ভয়ে দৌড়ে পালায়।’ খুবই সুন্দর ব্যাখ্যা। ২৬ জুন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘হেফাজতের সমাবেশে কোনো গুলি হয়নি। কোনো হত্যাকাণ্ড হয়নি। যদি বিরোধী দল একজন নিহত হয়েছে এমন প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব।’

এমনকি পুলিশ কর্মকর্তারাও আমাদের নিশ্চিত করেছেন, ৫ মে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ ৮ মে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, ‘রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দিতে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এই অভিযানে কোনো মরণঘাতী অস্ত্রেরও ব্যবহার করা হয়নি।’  ভালো তো, ভালো না! তারপরও তথ্যের কী দরকার!

অধিকার সম্প্রতি ‘হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ও মানবাধিকার লংঘন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। টিআইবি প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১৩’। বোঝা যাচ্ছে দুটো প্রতিবেদনই সরকারকে বেশ ক্ষিপ্ত করেছে। দুটো প্রতিবেদনের চরিত্র এক নয়। আমরা বিষয়ের পার্থক্যের কথা বলছি না, তাদের তথ্যানুসন্ধানভিত্তিক প্রতিবেদনের পদ্ধতির দিক থেকে বলছি। ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন বাস্তবে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের ওপর সরকার যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সেক্ষেত্রে বাস্তবে কী ঘটেছে, নানা সাক্ষীসাবুদের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদন। তবে চলমান।

অধিকার বলছে, ৫ মে দিবাগত রাতে নিরস্ত্র ও ঘুমিয়ে থাকা মানুষের ওপর সরকারের সশস্ত্র ও সহিংস হামলায় যারা শহীদ হয়েছেন তারা তার একটা তালিকা তৈরি করেছে। রিপোর্ট প্রকাশ করার দিন অবধি তারা ৬১ জন বাংলাদেশের নাগরিকের শহীদ হওয়ার একটি প্রাথমিক কিন্তু অসম্পূর্ণ তালিকা পেশ করেছে। এই অনুসন্ধান চলমান, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তারা যা পেয়েছে তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারকে বোঝানো, এ কাজটা সরকারের নিজেরই করা উচিত। হেফাজতে ইসলামের ওপর যে অকথ্য দমন-নিপীড়ন চলছে, তার ফলে তাদের পক্ষে অবিলম্বে কোনো তালিকা হাজির করা সহজ নয়।

তাছাড়া গ্যারান্টি কী যে সরকার নাম-ঠিকানা-পরিচয়সহ তালিকা পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করবে না? পদ্ধতির দিক থেকে দেখলে ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন হচ্ছে আসলে কী ঘটেছে তার ওপর সরেজমিন তদন্ত করে তৈরি করা রিপোর্ট। টিআইবি দুর্নীতির যে ব্যারোমিটার প্রকাশ করেছে, সেটা আসলে ব্যারোমিটারই বটে। সরকার আসলে দুর্নীতি করছে কি-না, তার ওপর সরেজমিন তদন্ত করে তৈরি করা রিপোর্ট এটা নয়। তবে দুর্নীতিকে সাধারণ মানুষ কিভাবে উপলব্ধি করে, সেই উপলব্ধির মাত্রা জরিপ করে তৈরি করা রিপোর্ট। টিআইবির রিপোর্ট দুর্নীতির বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সরেজমিন গবেষণা করে তৈরি করা রিপোর্ট নয়। দুর্নীতি সম্পর্কে মানুষের অনুভূতি বা উপলব্ধির মাত্রা নির্ণয় করার জরিপ। সরকারকে জনগণ কিভাবে দেখে ও কিভাবে বিচার করে তার একটা ইঙ্গিত টিআইবি রিপোর্টে মেলে। কিন্তু ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট সেটা নয়।

সরকার কয়েক লাখ লোক মেরে ফেললেও জনগণ মনে করতেই পারে যে কাজটি খারাপ হয়নি। তারা বলবে, ভালো না? ভালোই তো! মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ ও আরও নানা গুণাবলী সংবলিত হেফাজতিদের এভাবে আরশোলার মতো মেরে ফেলাই উচিত। নইলে সভ্যতা বলে কিছু টিকবে না, থাকবে না। কিন্তু ‘অধিকার’ মানবাধিকার সংগঠন হওয়ার কারণে পড়েছে বিপদে। যদি আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলি গণ্য করি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ইত্যাদি বস্তা বস্তা গালগল্পে বিশ্বাস করি, তাহলে হেফাজতে ইসলামের সদস্য ও সমর্থকদের এদেশের নাগরিক বলে স্বীকার করতে হবে। উপায় নাই। আরশোলা গণ্য করে মেরে ফেলা যাবে না।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সুনির্দিষ্ট আইন ও বিচার ব্যবস্থার নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু শেষরাতে ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে পরিকল্পিতভাবে ব্ল্যাক আউটের অন্ধকার শামিয়ানার অধীনে টিভি ও সংবাদপত্রের কর্মীদের সরিয়ে দিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের একটি নির্বাচিত সরকার যেভাবে হত্যার উš§াদনায় মেতে উঠেছিল, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এই ইতিহাসের জন্য যারা দায়ী, তাদের তো একদিন না একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। অতএব আসলে কী ঘটেছে, সততার সঙ্গে সেই ঘটনাবলী নথিভুক্ত করে রাখা দরকার। এটা ‘অধিকার’-এর কাজ নয়, সব নাগরিকেরই দায়।

এমনকি শুধু হেফাজতে ইসলামের একার কর্তব্যের মধ্যেও এই দায় পড়ে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে নাগরিকদের মানবাধিকার অলংঘনীয়। এখানে কোনো আপস চলবে না। হেফাজতের তেরো দফা দাবি তোলা ও প্রচারের যেমন অধিকার আছে, তা বাতিল করার অধিকারও যে কোনো নাগরিকের আছে। হেফাজতের ঈমান-আকিদা এবং বিশ্বাসের ঘোর বিরোধী হলেও তাদের হত্যা করার অধিকার রাষ্ট্র বা সরকারের থাকতে পারে না। ধর্ম কিংবা আলেম-ওলামাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক- সবাই নাগরিক, প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক অধিকার রাষ্ট্রকে রক্ষা করতেই হবে।

কিন্তু অধিকার ‘বিপাকে’ কেন? দৈনিক জনকণ্ঠের বিভাস বাড়ৈ বলছেন, ‘‘৫ মে হেফাজত-জামায়াতের ভয়াবহতার পর রাতের অবস্থান সরাতে চালানো অভিযান নিয়ে দেশে-বিদেশে দফায় দফায় হত্যার কাল্পনিক তথ্য ছড়িয়ে এবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে মানবাধিকার সংগঠনের নামে সক্রিয় গ্র“প ‘অধিকার’। দিনের পর দিন সংগঠনটি রীতিমতো হেফাজত-জামায়াতের ভাষায় ৬২ জনকে হত্যা ও কয়েকশ’ নিখোঁজের জন্য সরকারকে দায়ী করে রিপোর্ট প্রকাশ করে চললেও এখন সেই তথ্য স্পষ্ট করতে পারছে না। মানবাধিকারের ধোয়া তুলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতসহ উগ্রবাদীদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিয়ে অধিকার এখন তাদের আবিষ্কৃত ‘নিহত’দের নাম, পিতার নাম, গ্রামের বাড়িসহ ঠিকানার তথ্য দিতে ব্যর্থ।

তথ্য মন্ত্রণালয় নিহতদের পরিচয় চাইলেও চলছে লুকোচুরি। এদিকে কেবল অধিকার নয়, মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের পুঁজি করে ফায়দা লুটতে তিন হাজার নিহত ও কয়েক হাজার নিখোঁজের দাবি করে চুপসে গেছে বিএনপি-জামায়াতের øেহধন্য হেফাজত। দুই মাসেও হেফাজত তিন হাজার তো দূরের কথা নিহতের কোনো তালিকাই প্রকাশ করতে পারেনি।’’ বোঝা যাচ্ছে সরকার ও তার সমর্থকদের ‘রঙ মেখে শুয়ে থাকা’ তত্ত্বের জায়গা থেকে কথাগুলো বলা হচ্ছে। খুনি ও মানবাধিকার লংঘনকারী সরকার ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের প্রতি নির্বিচার পক্ষপাতে দুষ্ট এ লেখা। উপেক্ষাই করা উচিত। তবে কিছু আমোদের খোরাক হলে ক্ষতি কী?

১. অধিকার ‘রীতিমতো হেফাজত-জামায়াতের ভাষায়’ কথা বলে। তার মানে হেফাজত-জামায়াত নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ভাষায় কথা বলে, কারণ এটাই ‘অধিকার’-এর ভাষা, আদর্শ ও রাজনীতি। ভালো তো, ভালো না?  ২. দুই মাসেও হেফাজত নিহতদের তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। বিলকুল ঠিক। কিন্তু ভালো তো, ভালো না? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি একাত্তর সালে। ইতিমধ্যে ৪২ বছর চলে গেছে। তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এ দেশের যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতার শহীদদের তালিকা ৪২ বছরে করা সম্ভব হয়নি, আর হেফাজত দুই মাসে তাদের নিহত-আহতদের তালিকা প্রকাশ করে ফেলবে? এতে তো আমরাই বিপদে পড়ে যাব। তাতে কি আমরা এই অভিযোগ সহ্য করব, আমাদের তিরিশ লাখ শহীদের সংখ্যার তথ্য ‘আবিষ্কৃত’। অথবা আমরা অযোগ্য। অথবা মুক্তিযুদ্ধ ও তার শহীদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এই তথ্য লুকিয়ে রেখেছি। অথচ হেফাজতে ইসলামকে এই অতিকথনগুলো সহ্য করতে হচ্ছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময় খুনি পাকিস্তানি সরকার ও সেনাবাহিনীও বারবার বলেছিল, গণহত্যার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল সেসব মিথ্যা। শেখ হাসিনার সরকারের মতো দাবি করেছিল যারা নিহত হয়েছে তাদের নাম-ঠিকানার তালিকা সরকারের কাছে জমা দেয়ার। উদ্দেশ্য, সেই তালিকা মোতাবেক শহীদের পরিবারকে ধরা এবং তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো। শেখ হাসিনার সরকারও এজন্যই তালিকা চায়। হেফাজতের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়ন চালানোর জন্য। হেফাজতের নেতারা মনে হচ্ছে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তারা টের পেয়েছে, পাকিস্তানি সরকারের ভূত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে এখন বাংলাদেশ শাসন করছে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার ও রাষ্ট্র কায়েম হোক, তখন তারা সেই গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে তালিকা দেবে।

৩. অধিকার তাদের ‘আবিষ্কৃত নিহতদের নাম, পিতার নাম, গ্রামের বাড়িসহ ঠিকানার তথ্য দিতে ব্যর্থ’! ভালোই তো, ভালো না? কেন ‘অধিকার’ হেফাজতের ওপর আরও দমন-পীড়ন চালানোর জন্য সরকারের হাতে তালিকা ধরিয়ে দেবে? সরকারের কি গোয়েন্দা বিভাগ নাই? প্রশাসনিক লোকবলের কি অভাব পড়েছে নাকি সরকারের? ফলে ‘অধিকার’-এর তালিকা না দেয়াই মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে একমাত্র যুক্তিপূর্ণ কাজ। নাগরিকদের ওপর সরকার ও রাষ্ট্র দমন-পীড়ন জেলজুলুম হত্যা রক্তপাত চালাক, সেটা কি আমরা চাই? সেটা দৈনিক জনকণ্ঠ কিংবা বিভাষ বাড়ৈয়ের নীতি হতে পারে। সে নীতি হতে পারে সেসব টিভিওয়ালা ও সংবাদপত্রের, যারা হেফাজত তালিকা তৈরি করতে পারছে না ও প্রকাশ করছে না ইত্যাদি কোলাহলে দীর্ঘদিন আমাদের কান ঝালাপালা করে রেখেছে। কিন্তু এটা তো মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর নীতি হতে পারে না।

কিন্তু ‘অধিকার’-এর যুক্তি আর হেফাজতের যুক্তি এক হবে না। এটা আন্দাজ করতে পারি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে ‘অধিকার’ কী বলেছে সেটা এখন জানা যাচ্ছে। এই সত্য কেউই অস্বীকার করছে না যে বিপুলসংখ্যক আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ৫ মে রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে অনাকাক্সিক্ষত ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে হেফাজতিদের তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেউই মারা যায়নি, হতাহত হয়নি। শুধু রঙ মেখে দুষ্ট হেফাজতিরা শুয়ে ছিল। সে রাতে মানুষকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার ভিডিও ও ছবি আমরা ফেসবুকে দেখলেও সেসব তাহলে বানোয়াট। ফটোশপের কারসাজি।

দেখা যাচ্ছে, সরকার যা বলছে আর ‘অধিকার’ একই কথা বলছে না। দেশে ও বিদেশের আরও অনেক মানবাধিকার সংগঠনের মতো ‘অধিকার’-এর চোখে সরকার তার নিজের দেশের নাগরিকদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। কিন্তু অভিযুক্ত এ ঘটনার কোনো নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত দূরে থাকুক, উল্টা তার অপরাধ ও দায় অস্বীকার করছে। অথচ শুধু নিজ দেশের জনগণের কাছে নয়, সরকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও বিধিবিধানের মানদণ্ডে অপরাধী বলে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারকে এই দায়েই দায়ী করছে। তারপরও সে রাতে কিছুই ঘটেনি বা কোনো প্রাণহানি হয়নি দাবি করে সরকার প্রমাণ করছে, এ ঘটনা সম্পর্কে অনুসন্ধান ও নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জনগণকে জানানোর বিষয়ে সরকার একদমই আন্তরিক নয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে তালিকা সরবরাহ করা বিপজ্জনক।

তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও পরবর্তী দমনপীড়নের কারণে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ভীতসন্ত্রস্ত। মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে এদের প্রতি ‘অধিকার’-এর দায় আছে। গত ৫ মে’র ঘটনায় অন্তত এক লাখ তেত্রিশ হাজার পাঁচশ’ জন (১,৩৩,৫০০) অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে ২৩টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। সরকার দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক যেহেতু ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো আইন বাংলাদেশে নাই। অথচ মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে ভিকটিমদের নিরাপত্তা বিধান ‘অধিকার’-এর কর্তব্য।

এ পরিস্থিতিতে ‘অধিকার’ কী করতে পারে। অধিকার সরকারকে অবশ্যই সহযোগিতা করতে চায়। কিন্তু সরকারকে তিনটি শর্ত দিয়েছে ভিকটিমদের পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে।

১. নিহতদের তালিকা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেসব মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অবিলম্বে সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা। ২. তথ্য প্রদানকারী, ভিকটিম/তাদের পরিবার ও সাক্ষীদের জন্য সুরক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিশ্র“তি দেয়া এবং সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।  ৩. এই তথ্য প্রদানকারী, ভিকটিম/তাদের পরিবার ও সাক্ষীদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া।  দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যাপারটা এক অদ্ভুত জিনিস। সমাজ যেখানে দুই পক্ষে বিভক্ত এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষকে শত্র“ মনে করে, মানুষের ভালো-মন্দ হুঁশজ্ঞান আর থাকে না, তখন মানবাধিকার কর্মীদের বিরাট ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। খুবই বিনয়ের সঙ্গে ভেজা ও মিনমিনে গলায় মানবাধিকার কর্মীকে বোঝাতে হয়, আরশোলা তুমি মারলে মারতে পার, তবে মুশকিল হচ্ছে আরশোলা তো একটি প্রাণী। যে আরশোলা মারবে বলেই পণ করে বসে আছে, তার হিংস্র ও বদ্ধমূল সংকল্প থেকে তাকে সরিয়ে আনা যাবে কি-না সেটা আগাম বলা যাবে না।

কিন্তু কাউকে না কাউকে বলে যেতেই হবে। হেফাজতে ইসলামের আদর্শ, রাজনীতি, কর্মপদ্ধতি- সবই কারও বিবেচনায় মন্দ হতে পারে, কিন্তু তারা দেশের নাগরিক। তাদের কথা বলার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। তারপরও শেখ হাসিনা বলবেন, তারা রঙ মেখে শুয়ে ছিল, সাড়া পেয়ে পালিয়েছে। এই রেকর্ড বাজবে। কিছু করার নাই। কিন্তু কেউ যদি নিজেকে মানবাধিকার কর্মী বলে দাবি করেন, তাকে তার কথাগুলো বলে যেতে হবে। সে কাজ তখন মানবাধিকার রক্ষার লড়াই নয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াই। কিন্তু বিভাস বাড়ৈরা বলবেন, গণতন্ত্র, নাগরিক ও মানবিক অধিকার হচ্ছে জামায়াতি আর হেফাজতিদের ভাষা। ‘অধিকার’ তাদের ভাষাতেই কথা বলছে।  ভালোই তো, ভালো না!

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *