ভুল বৃদ্ধ, ভুল প্রৌঢ়, ভুল তরুণ— বাংলাদেশের তারুণ্য নিয়ে রাজনীতির রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৪০-৪৫ বছরের ধারেকাছের ব্যক্তিদের বলা হয় তরুণ প্রজন্ম। অথচ এ বয়সের ব্যক্তিরা মধ্যবয়সে চলে গেছেন। একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে আজীবন তরুণ থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের গায়ে তারুণ্যের তকমা লাগিয়ে রাখার কারণ তাদের তারুণ্য ধরে রাখার অবিনশ্বর ক্ষমতা নয়; বরং কারণটা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরতরুণ একটা প্রজন্ম আছে, যারা স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও ক্ষমতার ওপর দখল ছাড়তে রাজি নন। ফলে পরে যেসব প্রজন্ম রাজনীতিতে এসেছে, তরুণ নামের তকমা লাগিয়ে যুবদল বা তরুণ দল ধরনের পরিচিতি রেখে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের।

বাংলাদেশের রাজনীতি সব চেয়ে যুগান্তকারী দুটি ঘটনা ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরে ১৯৯১ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন।
বাংলাদেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দল যেমন— আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে দেখতে পাবেন, যুদ্ধের সময় ভূমিকা রেখেছেন, কমবেশি তারাই এখনো রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থান দখল করে রেখেছেন।
বাংলাদেশের পলিটিক্সের রথী-মহারথী সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী দশকে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, এইচ টি ইমাম এবং আরো অনেকের নাম সরকারি দলের নেয়া যাবে এই জেনারেশনের। বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির অধিকাংশ ব্যক্তি স্বাধীনতার দশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আজম থেকে শুরু করে মতিউর রহমান নিজামী এবং অন্য শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতে ইসলামের শীর্ষপর্যায়ে ছিলেন।
এমনকি মূলধারার বাইরের দলগুলো যেমন— ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বাম দলগুলোর শীর্ষ নেতারা এই জেনারেশনের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সে সময়ে কিন্তু এই নেতারাই তরুণ ছিলেন। তার মানে তারা তরুণ বয়সেই সংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ধরে নিতে পারি, তাদের বয়স তখন ছিল ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তার মানে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এখন তাদের বয়স ৬৭ থেকে ৮৩ বছর বা গড়পড়তা করে বলা যায়, তারা এখন ৭০ ঊর্ধ্বো। এবং এই নেতারা ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন, নতুন প্রজন্মকে সুযোগ দেননি।
সুযোগ কিছুটা পেয়েছিলেন নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। এ আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশকিছু নেতার জন্ম দিয়েছে। এ সময়ে তারা ছাত্রনেতা ছিলেন। কারণ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো, এ সময়ের নেতাদের মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে মাত্র অল্প কয়েকজনকে পাবেন।
এ সময়ের অনেক অনেক প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল নেতার নাম বলা যাবে, যারা প্রতিভা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ’৭১ প্রজন্ম স্থান ছেড়ে না দেয়ায় সামনে আসতে পারেননি, হারিয়ে গেছেন।
তাও এ প্রজন্মের ভাগ্য ভালো। কারণ এর পরের বছরগুলো থেকে বলতে গেলে শীর্ষপর্যায়ে উঠে এসেছেন এমন দু-একটা নাম পাওয়া যাবে না।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ধরে নেয়া যায়, তাদের বয়স ছিল ২২ থেকে ২৭। কারণ এ সময়ে অধিকাংশ ছাত্রনেতা মূলত ছাত্র ছিলেন। ফলে ’৯০ থেকে ২৩ বছর গত হওয়ার পর এখন তাদের বয়স ৪৫ থেকে ৫১। চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নেতাদের অনেককেই এখনো তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের বয়স যদি হয় ৪৫ থেকে ৫০ বছর, তাহলে প্রকৃত যারা তরুণ, যাদের বয়স ২৪ থেকে ৩৫, তাদের কী হবে? বাংলাদেশের রাজনীতি এদেরকে ধরে নেয়া হয়, নাবালক। কিন্তু এই প্রকৃত তরুণদের কি কিছু দেয়ার নেই, বলার নেই?
তাদের ভাষা, তাদের ক্ষোভ, তাদের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটাবে কে? যদিও প্রতিটা দলের মধ্যেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের কিছু সন্তান এবং কিছু খাতিরের লোক এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন; কিন্তু লক্ষ রাখার বিষয়, তারা কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নেতা হননি। কোনো একটা অভিজাত পরিবেশের সুযোগে বা ঘটনাচক্রে কিংবা দু- তিনজন তরুণ কোটা পূরণ করার জন্য তারা শীর্ষে আসার সুযোগ পেয়েছেন, যার জ্বলজ্বলে উদাহরণ দুই রাজপুত্র।
এমনটি হওয়ার কথা নয়। আপনি যদি ব্রিটেন বা ইউরোপের দেশগুলো দেখেন, যেখানে দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হন; সেখানে সরকারি ও বিরোধী দলের অধিকাংশ নেতার বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর। যাদেরকে বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। ইউকেতে ডেভিড ক্যামেরন ও ডেভিড মিলিব্যান্ড উভয়ের বয়স ৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে। বারাক ওবামার বয়স ৫০ থেকে ৫৫-এর ভেতরে। কিন্তু এ সময়েই তারা সরকার বা বিরোধী দলের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছেন।
বৃদ্ধ প্রজন্ম তাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। এটা ছাড়তে হয়। কারণ রাষ্ট্র একটা গতিশীল অস্তিত্ব। বিশেষত বিগত ২০ বছরে সারা বিশ্বে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের যে বিপ্লব ঘটে গেছে, তার রেশ সারা পৃথিবীতেই পুরনো সব নিয়ম, ব্যবসা, চিন্তা, সমাজ, সম্পর্কে ওলটপালট হয়ে গেছে। এ পরিবর্তনগুলো যারা করেছেন, তাদের অনেকের বয়স এখনো ৩০-এর কোঠায়। এটা তারুণ্যের ধর্ম। তারুণ্য নতুনকে বরণ করে নেয়, প্রথাকে প্রশ্ন করে এবং পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। কিন্তু পুরনোরা পুরাতনকে ধরে রাখেন, পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখেন। আমাদের দেশের সমাজে, রাষ্ট্রে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি, এটা তার অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের বৃদ্ধ প্রজন্ম তাদের অবস্থান ছেড়ে দেয়নি।
অথচ এই বৃদ্ধ প্রজন্মই যখন তরুণ ছিল, তারা পাকিস্তানি সাম্রাজ্যের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের স্বাধীনতা এনেছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা সিঙ্গাপুরে গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগের দিন পর্যন্ত নেতা থাকেন বা তার আগে তাদের সন্তানকে স্থলাভিষিক্ত করে যান। উভয়টাই খারাপ।
এ থেকে বোঝা যায়, দেশে গণতন্ত্র নেই। আছে দুই পরিবারের রাজতন্ত্রের হাত ধরে কিছু সামন্ত বাহিনীর হাতে একটা মিনি সামন্ততন্ত্র। সামন্ত প্রভুরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন এবং মৃত্যুর পরে তাদের পরিবার অভিষিক্ত হয়।
আমাদের গণতন্ত্রের এটা এক বড় দুর্বলতা। প্রকৃত তরুণদের ক্ষমতার কাছে আসার এ ব্যর্থতাই আমাদের প্রধান দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার সব চেয়ে বড় প্রমাণ। কারণ এ দলগুলোর ভেতরে সাংগঠনিকভাবে যোগ্যতা দেখিয়ে শীর্ষে ওঠার কোনো মাধ্যম নেই। ফলে সামন্ত প্রভু এবং তাদের সন্তানরা যুগে যুগে রাষ্ট্রের শীর্ষক্ষমতা দখল করে রাখেন এবং ১৬ কোটি জনগণের ভাগ্যের নিয়ন্তা হন।
বাংলাদেশের জনগণ আজকে একটা মানসিক অভ্যস্ততায় পৌঁছে গেছে যে, এই দ্বিদলীয় শাসন আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু এ বাস্তবতার মধ্যে মানুষকে বুঝতে হবে, দ্বিদলীয় শাসনের মধ্যেই পরিবর্তনের জন্য দাবি তুলতে হবে। তার মধ্যে একটা দাবি হতে পারে, এই দল দুটির ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, যার মাধ্যমে মেধাবী তরুণরা সামনে আসার এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। এবং যাদের অনেক বয়স হয়েছে, তারা যেন ধীরে ধীরে অবসর নিয়ে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রস্তুতি নেন এবং নতুন প্রজন্মকে স্থান ছেড়ে দেন।

পূর্ব প্রকাশিত 

শনিবার মে ৩১, ২০১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৭, ১৪২১

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *