বিবেকের তাড়নায় একজন আমেরিকানের স্বীকারোক্তি !

ন্যায়পরায়ণ বিশ্বব্যবস্থার কেন অভাব তা নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করেন তাদেরকে জন পার্কিনসের রচিত ৩৬২ পৃষ্ঠার দি নিউ কনফেশন অফ ইকোনমিক হিটম্যান বইটি অবশ্যই পড়া উচিত ।

বর্তমান বিশ্বের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে বিশেষকরে কর্পোরেট বিশ্বের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে তথাকথিত মূলস্রোতের মিডিয়া প্রচারণায় যে উপলব্ধি (perception) সৃষ্টি করা হয় এবং সে উদ্দেশ্যে যে মিথ্যা নেরেটিভ আমাদেরকে দেয়া হয় তার মোকাবিলায় আসল অবস্থার পর্যালোচনা করে সঠিক ও সত্যকে অনুধাবন করতে এ পুস্তকের তথ্যগুলো সাধারণ মানুষের সামনে আসা দরকার। আশাকরি যারা ন্যায় ভিত্তিক, মানবিক, কল্যাণমুখী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশা করেন তারা আমার সাথে একমত হবেন।

নিচের ভিডিওটি একটু মনযোগ দিয়ে শুনার পরামর্শ রইল। যদিও কারো কাছে এসব অনেক কথা জানা থাকতে পারে ভিন্ন সূত্রে তবে জন পার্কিনসের মত একজন পেশাগত ইকোনমিক হিটম্যানের স্বীকারোক্তিতে এ বাস্তব যে এক নতুন রূপ নিয়েছে তা বলা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে এই ইকনোমিক হিটম্যান কারা? জন পার্কিনস নিজে একসময় এ পেশায় ছিলেন। তাই তারই ভাষায় জানা যাক। তিনি লিখেছেন,

“Economic hit men (EHMs) are highly paid professionals who cheat countries around the globe out of trillions of dollars. They funnel money from the World Bank, the U.S. Agency for International Development (USAID), and other foreign “aid” organizations into the coffers of huge corporations and the pockets of a few wealthy families who control the planet’s natural resources. Their tools include fraudulent financial reports, rigged elections, payoffs, extortion, sex, and murder. They play a game as old as empire, but one that has taken on new and terrifying dimensions during this time of globalization. I should know; I was an EHM.

– অর্থাৎ – “ইকোনমিক হিটম্যান (ইএইচএম) হচ্ছেন অত্যন্ত উচ্চ বেতন প্রাপ্ত বা অর্থ উপার্জনকারী পেশাদার ব্যক্তিরা যারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা দেশের সাথে প্রতারণা করে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশী আর্থের ব্যবসায় জড়িত। এরা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং অন্যান্য বিদেশী “সাহায্যকারী সংস্থা” দ্বারা বিরাট অংকের অর্থ ফাঁদ তৈরি করে তা বড় বড় কর্পোরেশনের খাতায় এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি ধনী পরিবারের পকেটে ঢোকাবার জন্য অর্থ চুরিতে ব্যস্ত! তাদের সরঞ্জাম হচ্ছে প্রতারণাপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন, একতরফা বা জঘন্য নির্বাচন, প্রয়োজনে সামরিক বিদ্রোহ (Military Coup), অর্থ প্রদান, চাঁদাবাজি, যৌনতা এবং গুম খুনের অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদীর খেলা খেলে যা কিনা বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এক নতুন এবং ভয়ঙ্কর মাত্রা গ্রহণ করেছে। আমার জানা উচিত ছিল; আমি ছিলাম একজন ইএইচএম।”

বইয়ের ভুমিকার শুরুতে লিখেছেন, “বিবেকের তাড়না আমাকে আজ প্রতিদিন এক ভৌতিক অনুভুতি দিচ্ছে যে, একজন প্রাক্তন ইকোনমিক হিটম্যান (ইএইচএম) হিসাবে আমি কি করেছি? অতীতে বিশ্ব ব্যন্কের স্বার্থে আমি কি মিথ্যা প্রতিবেদন সৃষ্টিতে ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এবং বিশ্বজুড়ে আমেরিকার বড় বড় কর্পোরেশনের স্বার্থ সিদ্ধির ক্যান্সার বিস্তারে কি করেছি? ……”

জন পারকিনস এ বইয়ে তাঁর নিজের অভ্যন্তরীণ যাত্রা সম্পর্কে বর্ণণা দেন কিভাবে তিনি আমেরিকার সাম্রাজ্যেবাদী শক্তির দাস হয়ে কাজ করার ইচ্ছা থেকে নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য অনুভূতিদায়ক সমর্থনকারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি দ্বারা নিখুতভাবে নিযুক্ত হয়ে একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা সংস্থার বেতন-ভাতা নিয়ে তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেন – ইন্দোনেশিয়া, পানামা, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, সৌদি আরব, ইরান এবং অন্যান্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলিতে কাজ করেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ আদায়ে।

জন পার্কিনসের মতে এ স্বার্থ আদায়ে:

  •  প্রথমে, ইকনোমিক হিট ম্যানকে পাঠানো হয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিকে অবকাঠামোকে অকার্যকর করতে অনুন্নত দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও রাজা বাদশাহদেরকে বাধ্য করা হয় রাষ্ট্রের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকল্পগুলের জন্য জালিয়াতি অর্থনৈতিক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসের উপর ভিত্তি করে বড় বড় ঋণ নিতে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং অন্যান্য বিদেশী “সাহায্যকারী সংস্থা” থেকে। যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো মুলত আমেরিকার বড় বড় কর্পোরেশন এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি ধনী পরিবারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  •  দ্বিতীয়ত স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যদি সে প্রস্তাব গ্রহণ করতে আপত্তি করে এবং নিজেদেরকে বিদেশী স্বার্থে বিক্রি করতে কিংবা নিজেকে দূর্নীতিগ্রস্ত হতে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তাদেরকে হত্যা করতে পেশাদার হত্যাকারী দলগুলিকে পাঠানো হয়। আর সে সব রাজনীতিবিদরা আসলে নিজেদের ‘আত্মহত্যার’ পথই তখন বেছে নেয়।

যদি প্রথম ও দ্বিতীয় পদ্ধতি ব্যর্থ হয়, তাহলে সেনা পাঠাতে হবে। একটি যুদ্ধ শুরু করতে হবে।

বইটি পড়লে জানা যায় সামাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষায় ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি কিভাবে কাজ করে। লেখক তার নিজের কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কাহিনী দিয়ে যে চিত্রবত বর্ণনা দিয়েছেন তা সত্যিই বিবেকবান মানুষের পড়ার দাবী রাখে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ন্যায় ভিত্তিক, মানবিক, কল্যাণমুখী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার পিছনে যে এই সামাজ্যবাদী স্বার্থ বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে তার এক প্রাণবন্ত বর্ণনা মিলে।

জন পার্কিনসের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় সাক্ষাত্কার এখানে শুনতে পাবেন। জানতে পাবেন কিভাবে আমেরিকান সাম্রাজ্যের অভিজাত শাসক গোষ্টি বিশ্বেকে তাদের দখলে রাখে?

তবে জন পার্কিনস শুধু এসব কাহিনী বর্ণনা করে ক্ষান্ত হন নাই তিনি এসবের প্রতিকারের জন্য আন্দোলন করতেও উদ্যোগ নিয়েছেন। সে লক্ষ্যে তিনি ” The Secret History of the American Empire” পুস্তকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা রেখেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনার ও টিভি সাক্ষাত্কারে বক্তব্য দিয়ে আমেরিকার জনকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছেন। জন পার্কিনসের প্রদত্ত তথ্য তার কর্মজীবনের বাস্তব ঘটনার ভিত্তে লিখা তাই এঘলোকে কেউ ষড়যন্ত্র তথ্য বলে উড়িয়ে দিতে পারবেনা। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের বিপক্ষে জন পার্কিনসের এ প্রচেষ্টা তার জীবনকে অবশ্যই ঝুকির মুখে ফেলে দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তবে পার্কিনসের কথা হচ্ছে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় একমাত্র দুর্দান্ত মানুষের (desperate people) দ্বারা এবং কেউ একজন শুরু করলে তখন অন্যরা দেখতে পাবে ও এগিয়ে আসবে।

নিচের ভিডিওটি শুনলে এব্যপারে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

Comments are closed.