বিচিত্র বৈপরীত্য


ছোট্ট ছেলেটির কতইবা বয়েস তখন। হতে পারে চার কিংবা পাঁচ বছর। সে বয়সেই সারা পাড়া চষে বেড়ায় একা একা। তার দূরন্তপনায় অস্থির গাঁয়ের মানুষ। একাই ছেলেটি একশ’ জনের দুষ্টুমি করে সকলকে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলতে পারে। এতে তার কোন রকম আলসেমি নেই, নেই কোন অনীহা। অপরের বিরক্তি আর রাগ তার কাছে বড়ই উপভোগ্য। বইয়ের উপরে তার বড্ড বেশি বিতৃষ্ণা। বাড়ির কাছের স্কুলে যেতে আপত্তি নেই তার কোন, বরং আগ্রহের পাল্লাই যেন ভারী। তবে প্রতিদিন তার চাই নতুন বই। রোজ সকালে মায়ের কাছে পয়সার জন্য বায়না ধরে, আদায়ও করে। দোকান থেকে এক আনা দিয়ে একটা বই কিনে নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুল ছুটি হলে বইখানা টুকরা টুকরা করে ছিড়তে ছিড়তে বাড়ি ফেরে। ছেড়া বইয়ের শেষ টুকরাটি যত্ন করে এনে দেয় মায়ের কাছে, বই যে কেনা হয়েছিল তার প্রমাণস্বরূপ। বই ছিড়ে ফেলে দেবার যুক্তি হিসেবে সে দেখায় যে, যেটুকু পড়া হয়ে গেছে তা তার মনে আছে, কাজেই বই তো আর দরকার নেই! আর যে অংশ পড়া হয়নি, সেটুকু তো সে পড়তেই পারে না, যা পড়তে পারা যায় না তা রেখে লাভ কী!! মা হাসবে না কাঁদবে তা বুঝতে না পেরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে নানান ভাবে বই না ছিড়বার মন্ত্রণা দিতে থাকে।

দুষ্টের চূড়ামনি ছেলেটি শান্তও থাকে মাঝে মাঝে। যেমন, পিঁপড়ার সারি দেখে চুপচাপ কাটিয়ে দিতে পারে বেলা। ফড়িং বা প্রজাপতি ধরে সুতা বেঁধে টানাটানি করে নিয়ে বেড়ানোতে কোন ক্লান্তি না থাকলেও কবুতরের বাকবাকুম আর দূর আকাশে চিলের ডানা মেলে উড়ার রহস্য তাকে উন্মনা করে তোলে। বাঁদরের খেলা দেখতে যেয়ে খুঁচাখুঁচি করে উত্যাক্ত করা আর ফলস্বরূপ তার কামড় খেয়ে নির্জলা চোখে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি তাকে কোন কিছু থেকেই নিবৃত করতে পারে না। অথচ সে ছেলেই আবার তেঁতুলের বীজ থেকে কেমন করে চারা গজায় তা দেখবার জন্য দিনের  পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে।

এই আগ্রহই তাকে টেনে নিয়ে যায় মাঝে মাঝেই নানান বিপত্তির অভ্যন্তরে। এমন কী জীবন হানিকর হতে পারে, এমন কিছুর প্রতিও তার আগ্রহের কমতি দেখা যায় না। এমনই একটা ঘটনা বলি। এক বিষণ্ন দুপুরে একা একা ঘুরতে ঘুরতে সে চলে গেলো আর এক পাড়ায়। গ্রামের ছায়া ঢাকা পথ, নির্জন। পথের দু’পাশে বাঁশের ঝাড়, আম-কাঁঠালের বাগান। বাগান তো নয়, যেন গভীর অরণ্য! একা ছেলেটি মনের আনন্দে সেই নির্জনতায় দেখা পেলো তার চেয়েও ছোট্ট একটা প্রাণীর। বাঁশ ঝাড় থেকে কেটে নিয়ে যাওয়া বাঁশের গোড়ায় যে ছোট্ট বাটির মত তৈরী হয়, সেখানে বসে আছে ছোট স প্রানীটি নিজের গায়ের সাথে নিজেকে পেঁচিয়ে। মাথার দিকে কিছু অংশ মুক্ত, শরীর থেকে সোজা উপরের দিকে মাথা তুলে ছোট্ট ফনা মেলে জিহ্বা বের করছে আপন মনে। সাপের বাচ্চার এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অবুঝ সেই বালক তার সাথে খেলতে শুরু করলো। সে জানে না যে ছোট সাপেরও বিষ কম নয় মোটেও। একটা মাত্র ছোবলেই তার প্রাণ সংহার হতে পারে এ ধারণা তার নেই। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া এক টুকরো কাঠি দিয়ে ছেলেটি যতবার সাপের বাচ্চাটির ফনায় আলতো করে ছোঁয়ায়, ততবার এটা ফোঁস করে সেই কাঠিতে ছোবল মারে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সর্প ছানাটি তার অবস্থান ত্যাগ করে বনের ভেতরে চলে গেলে খেলার অবসান হয়। ছেলেটি মন খারাপ করে ফিরে আসে বাড়িতে। এ কাহিনী সে কাউকে কোনদিন বলেনি, কিন্তু ভুলতেও পারেনি।

সাপের কথা যখন এলোই, তখন আর একদিনের কাহিনী বলি। এবারের ঘটনার ছেলেটি আর ছোট্টটি নেই, এবার সামনে তার ডিগ্রী টেস্ট পরীক্ষা। এবারে আর ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম নয়, একেবারে ঢাকা শহরের ঘটনা। এবারের ঘটনা বিষণ্ন দ্বিপ্রহরের নয়, রাত দুপুরের। আর মাত্র ক’দিন পরেই পরীক্ষা, রাত জেগে পড়তে হচ্ছে, পড়া আর শেষ হচ্ছে না। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দু’চোখ, তবু পড়া শেষ না করে ঘুমানো চলবে না কিছুতেই। সিগারেট খেলে ঘুম পালায়, এমন আপ্ত বাক্য মনে পড়াই সিগারেটের জন্য প্রাণ আঁইঢাই করা শুরু করলো। রাত বাজে পৌণে বারোটা। দোকান একটা খোলা থাকে হাতির পুলে। ভুতের গলি থেকে হাতির পুল কতটা আর দূরে? সুতরাং ব্যাটারি শেষ হয়ে আসা টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকার ঠেলে ঘর থেকে বের হল ছেলেটি। অর্ধেক রাস্তায় যাবার পরে চারটা কুকুর তার পথ আটকালো। কুকুরগুলো কাছে আসে না, তাড়া করে না, শুধুই চিৎকার করে। দুপুর রাতে কুকুরের এহেন আচরণে ছেলেটি ক্ষুব্ধ হয় মনে মনে, কিছুটা ভয়ও পায় – আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ এসে যদি চোর বলে আটক করে?

কুকুরের চিৎকার থামাবার কোন কৌশল ছেলেটির জানা নেই। ফিরে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। ‘এই সর, সর, সরে যা, সরে যা’ বলা ছাড়া আর কীইবা করার আছে! শেষ চেষ্টা হিসেবে কুকুরের চোখে টর্চের আলো ফেলে ওদের বিদায় করার কথা মাথায় এলো তার। সে মতো আলো ফেললো কুকুরের চোখ বরাবর। কুকুরের মাথার ছায়া পড়লো রাস্তার উপরে। ছায়া সত্ত্বেও কিছুটা আলোকিত হলো পিচঢালা রাস্তা। সে আলোতে সে দেখতে পেলো লম্বা, প্রায় পুরো রাস্তা জুড়ে থাকা মোটা দড়ির মত একটা প্রাণী। প্রাণীটা রাস্তার একদিক থেকে অন্য দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরম আলস্যে। তার একপাশে দু’টো কুকুর, বাকী দুটো আর একপাশে। প্রায় দশ ফুট দৈর্ঘের সাপটা রাস্তা পার হয়ে চলে যাবার পরে কুকুরগুলো, যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে যার যার গন্তব্যে রওনা হয়ে গেল! ছেলেটি হাতির পুলের পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান মালিককে যখন এ কাহিনী বলছি্ল, তখনও সে জানে না কী সাংঘাতিক বিপদ থেকে কুকুরগুলো তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে!

সিগারেটের আশায় রাত দুপুরে জীবন হারাবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। তবু সে সিগারেট তাকে কোন দিন ত্যাগ করে নি। আগামীকাল ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস, এই দিবসের আহবান তার জীবনে এসেছে বহুবার। কখনও সাড়া দেবার কথা মনেও আসেনি। এবারেও যে সাড়া দেবে তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। পঞ্চাশ বছর, বা তারও অধিক কাল যার সাথে সখ্য, তা কী এত অবলীলায় ছাড়া যায়। তামাককে সে ঘৃণা করে, ধুমপায়ী বা অন্য কোন ভাবে যারা তামাক গ্রহণ করে, তাদের প্রতি তার আহবান এই অভ্যাস পরিত্যাগ করার। অথচ নিজেকে সে মুক্ত করতে পারে না তামাকের দাসত্ব হতে। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।

Loading


Comments

বিচিত্র বৈপরীত্য — 4 Comments

  1. ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম। সাথে আছি। চালিয়ে যান।

    • আপনার ভালো লাগা আমার চলার পথে উৎসাহ যোগাবে।
      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    • ধন্যবাদ ভাই।
      আশা করি এমন করে সব সময় সাথে পাবো।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *