বাংলাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাঃ অনিয়ম ও প্রতিকার (তৃতীয় পর্ব)

তৃতীয় পর্ব উপস্থাপনের শুরুতেই আমার পাঠকদের প্রতি অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন। আপনারা ধৈর্য ধরে পূর্বেকার দু’টি পর্ব পড়ে থাকলে তৃতীয় পর্ব পাঠে সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন যে বর্ণীত তিন পর্বে সমাপ্য লেখায় আমি কি বিষয়বস্তু তুলে ধরতে চেয়েছি। এবার আর ভূমিকা নয়; সরাসরি আলোচনায় আসি। অসমাপ্ত সমস্যাগুলো আলোচনা পূর্বক সম্ভাব্য সমাধানের পথগুলো খুঁজে দেখিঃ

আন্ডারপাস/ফুটওভারব্রীজের ভুল ডিজাইন ও ব্যবহারের সমস্যাঃ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল যে ক’টি আন্ডারপাস/ফুটওভারব্রীজ আছে তার বৃহৎ অংশ হকার, ভাসমান পতিতা ও ভিখারীদের দখলে। এখানে পথচারীদের গাদাগাদি করে চলতে হয়, রাতে প্রায়শঃই লাইট থাকেনা। ফলে সেগুলো পকেটমার ও ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। তাছাড়া এত অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত ফুটওভারব্রীজগুলোর ডিজাইনে মারাত্নক ভুল রয়েছে; বিশেষ করে উঠা নামার সিঁড়ি দু’টি। এমন অবৈজ্ঞানীক পদ্ধতিতে ঘুরিয়ে এনে ব্রীজের ঠিক নীচে মাত্র পাঁচ ছয় ফুট ব্যবধানে মুখোমুখী নামিয়েছে যা শুধুই প্রকৌশলীর ব্যর্থতা নয়; এটা সজ্ঞান অপরাধও বটে। কেননা একজন বিজ্ঞ প্রকৌশলী কখনো একের পর এক ভুল ডিজাইন করে সমস্যা কমানোর পরিবর্তে বাড়াতে পারেন না। এমন অযোগ্যতার অপরাধে ডিজাইনারের শাস্তি হওয়া উচিৎ। এই পাঁচ ছয় ফুট জায়গার মধ্যে হাজার হাজার পথচারীকে গাদাগাদি করে উঠানামা করতে হয় যার একদিকে সীমানা প্রাচীর অন্যদিকে দ্রুত ধাবমান যানবাহন চলাচলকারী বড় রাস্তার ঢাল। তাই গাদাগাদি করা পথচারীর জন্য জায়গাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। উপরন্তু অনেক দূর থেকে ঘুরে এসে এখানে ঢুকে ব্রীজে উঠতে হয় এবং একই স্থানে নামতেও হয়। ফলে মহিলা বৃদ্ধ ও শিশুসহ অনেকেই ওভারব্রীজ ব্যবহার না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নীচের অরক্ষিত আইল্যান্ড দিয়ে রাস্তা পারাপারে উদ্যোগ নেয়। এত টাকা ব্যয় করে ওভারব্রীজ তৈরী করা হলেও এর নীচের রোড ডিভাইডার কোন বেরিয়ার বা গ্রীল দিয়ে আটকানো হয়না অথবা থাকলেও তা এতই ঠুকনো যে টোকাই ও দূর্বৃত্তকারীরা তা অনায়াসেই ভেঙ্গে ফেলে। ফলে পথচারীগণ সেই ডিভাইডার ডিঙ্গিয়ে রাস্তা পাড় হওয়াকে বেশী স্বচ্ছন্দের বলে মনে করেন।

অথচ এই ওভারব্রীজের সিঁড়ি দু’টি যদি বিপরীতমূখী দুই দিকে অন্ততঃ একশ’ থেকে দেড়শ’ ফুট করে দূরে নিয়ে নামিয়ে দেয়া হয় (দুই/এক জায়গায় তেমনটি আছেও) তাহলে ওভারব্রীজের দুই দিকের অন্ততঃ ২০০/৩০০ ফুটের মধ্যে চলাচলকারী পথচারী পায়ের কাছে সিঁড়ি পেয়ে ওভারব্রীজে উঠতে বেশী উৎসাহিত হত। এই পদ্ধতিতে সিঁড়ি নামালে ব্রীজ যত দূরেই থাকুক না কেন পথচারীর মনে হবে; এইত ওভারব্রীজ, তা ব্যবহার করি না কেন! পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ফুট ওভারব্রীজের একই প্রান্তে দুইয়ের অধিক সিঁড়ি নানান দিকে নেমেছে। নানান বিপনীবিতান, রেলস্টেশন, টার্মিনাল বা প্রেক্ষাগৃহ এমন কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথেও লিঙ্ক করে রাখা আছে যেন, সেখান থেকেই পথচারীরা ওভারব্রীজ ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওভারব্রীজ করেছি অথচ পথচারীদের সুবিধা-অসুবিধা ঝোক (ট্রেন্ড) বা রুচির কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করিনি। আবার সেসবের ব্যবহারও নিশ্চিত করিনি। আর এই থেকেই বুঝা যায় যে কর্তৃপক্ষ কতটা অযোগ্য এবং বেখেয়াল। এমন অযোগ্য কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীতে একদিকে যেমন জাতীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে ওভারব্রীজের নীচ দিয়ে রাস্তা পারাপারের দরুণ যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে ও প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনা ঘটছে। ফলে ওভারব্রীজগুলো জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সুশৃংখল ট্রাফিকিং এ কোন ভূমিকাই রাখতে পারছেনা। জনস্বার্থে এই অবস্থার আশু নিরশন প্রয়োজন। ওভারব্রীজের দু’দিকের ল্যান্ডিং যতদূর সম্ভব বিস্মৃত করা ও বহুমূখী করা প্রয়োজন।

বহুমূখী রাস্তার মোড়ে অবস্থিত স্থাপনাগুলো অপরিকল্পিত ভাবে ডিজাইন করাঃ নগর পরিকল্পনাবিদ, পূর্ত ও ইমারত নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলেই বহুমূখী রাস্তার মোড়ের স্থাপনাগুলো কন্ট্রোল করতে পারেন। তিন বা চার রাস্তার সংযোগ স্থলের কোণায় অবস্থিত প্লটসমূহের সকল ইমারত বা স্থাপনার জন্য নির্মাণ বিধি প্রণয়নে নিয়োজিত সংস্থাসমূহকে এমন বিধি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে যেন সেইসব ইমারত বা স্থাপনা রাস্তার সংযোগ কোণ থেকে বেশ দূরে থাকে। যেন প্রয়োজনে রাস্তা পরিবর্ধণ ও বাম গন্তেব্যের জন্য অর্ধ বৃত্তাকার বাইপাস লেন অনায়াসে তৈরী করা যায়। উল্লেখ্য যে, বড় বড় রাস্তার ওই সব কোণগুলোতে অবস্থিত বেশীর ভাগ স্থাপনা ও প্লটগুলোই কোন না কোন সরকারী সংস্থার মালিকানায় রয়েছে। কাজেই সেসব কোণে অনায়াসেই বাম গন্তেব্যের জন্য বাইপাস লেন তৈরী করা যায়। ছোট রাস্তার মোড়ে অবস্থিত যেসব ব্যক্তি মালিকানায় প্লট ও স্থাপনা রয়েছে সেসব প্লটে নতুন স্থাপনা তৈরীর ক্ষেত্রেও রাজউক বা তদ্রুপ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কঠোর বিধি নিষেধ থাকা চাই।

বহুমূখী রাস্তার মোড়ে যানবাহনে যাত্রী উঠানামা/যাত্রীর অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকাঃ রহিত করতে হবে। এমন বিধি থাকা চাই যেন রাস্তার মোড় থেকে অন্ততঃ একশ’ গজ আগে বা পরে যাত্রী উঠানামার জন্য ‘বাস-বে’ এবং রিকশা/ট্যাক্সির জন্য আলাদা স্ট্যান্ড থাকবে। নির্দিষ্ট জায়গা ব্যতীত যানবাহন দাঁড়াতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, সেই পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তান আমলেও ঢাকা শহরে এই ব্যবস্থা চালু ছিল অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হয়েও একমাত্র সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ম্যাগাসিটি ঢাকা আজ ভাগাড়ে পরিণত হতে চলেছে। অথচ ট্রাফিক পুলিশ একটু আন্তরীক ও কঠোর হলেই এই অব্যবস্থাপনা/নৈরাজ্য বন্ধ হতে পারে।

বহুমূখী রাস্তার মোড়ে ঝাঁকিয়ে বসা দোকানপাট ও অবৈধ স্থাপনাঃ উচ্ছেদ করতে হবে। একান্ত প্রয়োজনে তাদের পূনর্বাসন করতে চাইলে একমাত্র চওড়া রাস্তার পাশে অন্তর্মূখী লেন তৈরী করে দিতে হবে। যেন কোনক্রমেই তারা ফুটপাথ বা যান চলাচলের রাস্তা দখল করে দোকানপাট স্থাপন করতে না পারেন। অথবা বিদেশের মত বানিজ্যিক এলাকাগুলোতে অফিস সময়ের পরে ‘নাইট মার্কেটে’র ব্যবস্থা করা যেতে পরে। দোকান মালিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই প্রাইভেট সিকিউরিটিজ বা কমিউনিটি পুলিশিং এর মাধ্যমে এলাকার নিরাপত্তা বিধান করতে বাধ্য থাকবেন।

ফুটপাথের সংস্কার ও বর্ধিতকরণঃ জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুপাতে সংর্কীর্ণ এবং ভাঙ্গাচোরা ফুটপাথগুলোকে চওড়া করে পথচারীর নির্ভীঘ্ন চলাফেরার উপযোগী করে তুলতে হবে। ফুটপাতে হাঁটাকে আনন্দদায়ক করতে হবে।

ট্রাফিক পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণ, সততা, দক্ষতা ও সহিঞ্চুতাঃ বৃদ্ধির জন্য বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহন করা চাই। বর্তমানে ট্রাফিক ব্যবস্থা ডিজিটালাইড করা হলেও সময়ের সাথে তাল মিলেয়ে ট্রাফিক পুলিশের আধূনিকায়ণ হয়নি। একদিকে জাতীয় সম্পদের অপচয় ঘটিয়ে সৌখিন ডিজিটাল ট্রাফিক সিগনাল বসানো হচ্ছে অথচ ট্রাফিক পুলিশ বাঁশি ফুঁকে দৌড়ঝাঁপ করে হাত দিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতেই গলদঘর্ম হচ্ছে। কোথাও আবার বাঁশ বা দড়ি ঝুলিয়ে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে! বলা হয়ে থাকে; কষ্টকর সার্ভিসের তূলনায় ট্রাফিক পুলিশের বেতন ভাতা কম। তাই নাকি তারা অনৈতিক রোজগারের ধান্ধা করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেতন যা পান তা নেহায়েত কমও নয়। বর্তমানে সাধারণ পুলিশের চেয়ে তারা ৩০ শতাংশ বেশী ভাতা পান। পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু মাত্র ১১৫ টাকার রেশনে সারা মাসের চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনির সংস্থান হয়। চাকরী শেষে আকর্ষনীয় পেনশন তো আছেই। প্রয়োজনে ভাতা আরো বাড়িয়ে তাদের অনৈতিক অর্থোপার্জনের পথ বন্ধ করা হোক। তারা একটু সৎ দক্ষ ও আন্তরীক হলেই রাস্তার যানবাহনের শৃখলা ফিরে আসবে, যানজট অনেক কমে যাবে। রাস্তায় আর অবৈধ গাড়িও নামতে পারবে না। সেই সাথে বিআরটিএকে আরো সততা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে।

গুরুত্বহীন ‘রোডমার্কিং’ ও সাইন অমান্য করাঃ ‘রোডমার্কিং’ ও সাইন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হয়ে তবেই বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার বিধান আছে বটে। অথচ আমাদের দেশে খুব কম গাড়ি চালকই এসব মনে রাখেন অথবা এর গুরুত্ব বুঝেন বা মেনে চলেন। প্রায় প্রতিটি যানবাহনই তা অগ্রাহ্য করে থাকে অথচ এর জন্য কখনো তাদের কোন দন্ডও দিতে হয়না। কোন ট্রাফিক পুলিশ বা সার্জনকে কখনো এবিষয়ে তৎপর হতে দেখিনা? অথচ এর জন্য প্রতিদিন কত দূর্ঘটনা ঘটছে আর বিশৃংখলা বাড়ছে তার ইয়ত্বা নেই। একদিকে ‘রোডমার্কিং’ সম্পর্কে যেমন রয়েছে চালকদের অজ্ঞতা তেমনি রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ মার্কিং ব্যবস্থা। সঠিক ‘জেব্রামার্কিং’ তো আজকাল চোখেই পড়েনা? ‘নেভিগেশন মার্কিং’ তো এক বিমানবন্দর ছাড়া আর কোথাও চোখেই পড়ে না? রোড মার্কিংএ হলুদ রঙের কোন ব্যবহারই নেই। রাস্তায় যে ‘নেভিগেশন মার্কিং’ গাড়ি চালককে ‘টার্নিং পয়েন্টে’র অনেক আগে থেকেই তার গন্তব্য ও লেন ডিভাইডেশন সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে এটা বোধহয় আমাদের দেশে কেউ জানেনই না। খোদ কর্তৃপক্ষও জানেন বলে মনে হয়। তাহলে তার কিছু প্রয়োগ থাকত। একমাত্র ট্রাফিক সাইন ও রোডমার্কিং অনুসরণ করেই একজন অচেনা চালকও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই অজানা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে অনায়াসে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন। বিষয়টা কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।

শেষ কথা: আধূনিক সভ্যতায় অনেক দেশই দৈনন্দিন চলাচলকারী জনগোষ্ঠীকে কৌশলে মাটির নীচের ‘মাস ট্রানজিটে’ স্থানান্তর করে শহরকে জনসংখ্যার ভারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের এশিয়াতেই চীন জাপানের জনবহুল বড় শহরগুলোতে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দৈনন্দিন চলাচলকারী যাত্রী সাধারণকে কী কৌশলেই না মাটির নীচে ঠাঁই করে দিয়েছে? তাই এত জনবহুল শহরেও আমাদের মত এমন ঠাসাঠাসি করে চলতে হয়না। মাটির উপরিভাগের মানুষের চাপ বেশীর ভাগই ভূ-গর্ভস্থ এমটিআর বা সাবওয়েতে স্থানান্তর করে শহরকে তারা ভারমুক্ত করেছেন। আমাদের মত জনসংখ্যা ঘনত্বের দেশকেও সে বিষয়টা অবশ্যি ভাবতে হবে। পত্রিকান্তরে জানতে পাই, ঢাকার যানজট নিরসনে মনোরেল স্থাপনের জন্য জাপানী সংস্থা ‘জাইকা’র সাথে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল প্রায় ২০ কি: মি: দীর্ঘ ‘মনোরেল রুট’ তৈরী হবে। সবকিছু ঠিক মত চললে ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালে শেষ হবে। এটা কতটা যৌক্তিক তা ভাববার অবকাশ রয়েছে। শহরের ভুমি দখল করে নির্মিতব্য এই প্রকল্প হবে খুবই ব্যয়বহুল, সময়ক্ষেপনকারী ও দীর্ঘদিন জনদূর্ভোগ সৃষ্টিকারী। বিনিময়ে ছয় বছরে পাব মাত্র ২০ কি:মি: রাস্তা!

দেশের প্রথম ‘মাস ট্রানজিট’ হিসেবে জনগন এতে আশান্বি্ত হতেই পারে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নকথা বলে। সময়ের বাস্তবতায় আজ থেকে ৮ বছর পর যা পাব তা অনেকটাই স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতই ভেসে যাবে। ২০২১ সালের সম্ভাব্য অর্জনের এই পরিতৃপ্তি তখন কতটা উপকারে আসবে তা আজই ভাবতে হবে। কারণ জনসংখ্যার ভারে নূজ্জ্য ঢাকার জন্য ভূমির উপরে নির্মিত ‘মনোরেল’ ব্যবস্থা কতটা পরিবেশ বান্ধব ও কার্যকর হবে তা করার আগে আর একবার ভাবা দরকার। তার চে’ যদি অধিক মাত্রায় ফ্লাইওভার ও ডাইভার্শন রোড করে শহরের উপর চাপ কমানো যায় এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মাস ট্রানজিট সাবওয়ে (এমটিআর) নির্মাণ করা যায় তা অনেক বেশী কার্যকরী হবে। কারণ তাতে ভূ-উপরিভাগের জায়গার পরিবর্তে ভূ-গর্ভস্থ জায়গার ব্যবহার হবে। এর নির্মাণ ব্যায় বেশী হলেও অপচয়, অবচয় ও মেনটিন্যান্স খরচ খুবই কম। দৈনন্দিন চলাচলকারী জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে কৌশলে মাটির নীচের (এমআরটি) রাস্তায় চলাচলে অভ্যস্থ করলে শহরের বুকে জনসংখ্যার চাপ অনেকাংশেই কমে যাবে।

উপসংহারঃ মাথা ব্যথা হলেই মাথা কেটে ফেলতে হয়না। কাজেই ট্রাফিক জ্যাম কমাতে শহরের সীমিত জায়গার অপচয় করে একরে পর এক রাস্তা বাড়ালে আর গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলেই সমস্যার সমাধান হবেনা। মাস ট্রানজিট সিস্টেম (তা হোক অনেক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বাস ট্রেন কিংবা ট্রাম) এই ক্ষেত্রে ব্যপক ভূমিকা রাখতে পারে। মাস ট্রানজিট সিস্টেমের মূল কথাই হল কম খরচে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দময় ভ্রমণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একমাত্র ভূ-গর্ভস্থ মাস ট্রানজিট সিস্টেমই (এমটিআর) সবচে বেশী উপযোগী। কেউ যদি বিশ টাকায় ৩০/৪০ মিনিটেই উত্তরা থেকে মতিঝিল আসতে পারেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে অকারণ তার প্রাইভেট কার চালিয়ে (অনেক টাকার তেল ড্রাইভার ব্যবহার করে) মতিঝিল আসেন? মাস ট্রানজিট সিস্টেম চালু হলে আপনা থেকেই প্রাইভেট কারের ব্যবহারও কমে যাবে। ট্রাফক জ্যাম কমাতে তখন আর এত রাস্তাঘাট বাড়ানোর চিন্তাও করতে হবেনা। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতির পাশাপাশি সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে তাই পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্পও সরকার নিজ উদ্যোগে করতে যাচ্ছে। সরকার আন্তরীক হলে ক্রমে ক্রমে তা সরকারই করতে পারে। অন্যথায় দেশী/বিদেশী কোন উদ্যোক্তার মাধ্যমে পিপিপি’র আওতায় অমন স্কীম নিলে দীর্ঘ মেয়াদে হলেও ট্রাফিক ব্যবস্থায় কিছুটা শৃংখলা ফিরে আসবে বলেই ভোক্তভোগী মহলের বিশ্বাস।

দীর্ঘ বয়ানে লেখা পর্বগুলো ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য পাঠকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর এই লেখা থেকে যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছুটা হলেও বোধোদয় হয় ও তার কিছু বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনূভব করেন তাহলে দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। তখন আমার লেখাও স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব। সাবাইকে আবারো ধন্যবাদ।
প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে – “এখানে ক্লিক করুনঃ”
দ্বিতীয় পর্বের লেখা পড়তে – “এখানে ক্লিক করুনঃ”

Loading

অনিরুদ্ধ বুলবুল

About অনিরুদ্ধ বুলবুল

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। আমি সেই সমাজেরই অংশ। যে সমাজে বাস করছি সেই সমাজের উন্নয়ন আমার স্বপ্ন। সমাজের যেকোন অনিয়ম অসংগতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ইচ্ছা হয়; সুযোগ পেলে সমাজটাকে বদলিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলি। সমাজের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের কিছু ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও মতামত উপস্থাপন করে সমমনা পাঠকেদের সাথে তা শেয়ার করার মানসে মাঝে মাঝে কিছু লিখি। তাতে সমাজের সামান্যতম উপকার হলেও নিজেকে ধন্য মনে করি।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *