ফারাক্কায় বাঁধ দেয়া হলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসক আয়ূব খাঁন । ফলে যতদিন পাকিস্তান টিকে ছিল ততদিন ইন্ডিয়া এই শুভ কাজটিতে হাত দিতে সাহস করে নি। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।
এই ধরনের অপ্রিয় কথাগুলি স্মরণ করা স্বাধীনতার চেতনার জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয় । তারপরেও গোলাম মাওলা রনি অনেক সাহস করে বিষয়টির কিয়দংশ উল্লেখ করেছেন।
আমাদের ইতিহাসের এক ভিলেইন সেদিন ফারাক্কা বাধের বিরুদ্ধে যে হুমকি দিয়েছিলেন , আজকের অনেক নায়কগণ সেই সাহসটি দেখাতে পারছেন না। এটাকেই বলে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।
১৯৭১ এর যুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ হলেও ইন্ডিয়ার কাছে ছিল এটা শতাব্দীর সেরা সুযোগ। শেখ মুজিব কেন তাজউদ্দীনের পরামর্শ মতো স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন না, কেন তিনি আত্মগোপনে না গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করেছিলেন তা উপরের বাস্তবতার নিরিখে ব্যাখ্যা করতে পারলে শেখ মুজিবের স্থান আরো অনেক উপরে ওঠে যেতো।
এই আওয়ামীলীগই (যদি টিকে থাকে) আজ থেকে ত্রিশ বছর পর হয়তো ভিন্ন ভাবে এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করবে। তখন বলা হবে যে ইন্ডিয়ার অনুকম্পায় তিনি এই দেশটি স্বাধীন করতে চাননি বলেই এভাবে গ্রেফতারবরন করেছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রফেসর গোলাম আজমের চিন্তার মধ্যে খুব বেশি ফারাক ছিল না। এই ভাবনা এখন আওয়ামীলীগের জন্যে অস্বস্তিকর হলেও আজ থেকে ত্রিশ বছর পর পরম স্বস্তিদায়ক হতে পারে।
কারন ভারত যেভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে, তাতে ৩০ বছরের মধ্যে দেশের ৬০ ভাগ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ এস আই খান। শনিবার সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক গোলটেবিল বৈঠকে এস আই খান এ মন্তব্য করেন।
আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এস আই খান বলেন, ‘ভারত অভিন্ন নদীর উজানে যেসব বাঁধ দিয়েছে এবং দিচ্ছে, এর সবগুলো রাজনৈতিক বাঁধ। এর মাধ্যমে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, ধ্বংস করতে চায়। ‘
ফারাক্কা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি দৈনিক প্রথম আলোতে দেখে একটু অবাক হয়েছি।
আমরা এখন সবই বুঝি কিন্তু আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অন্ডকোষটি ইতিমধ্যেই অন্যের হাতের মুঠিতে সোপর্দ করে দিয়েছি। সামান্য একটা প্রমোশন, একটি চেয়ার কিংবা গুটিকয় নোটের বিনিময়ে জাতির এই সর্বনাশটি করেছি, এখনও তা করে যাচ্ছি।
ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া ছাত্রের সমপরিমাণ ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান নেই এমন গর্দভ প্রকৃতির মানুষগুলিকে বানিয়েছি নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং একই বিবেচনায় নেহায়েত নাবালক কিংবা নাবালিকাদের বানিয়েছি রাষ্ট্রনায়ক ! এরা না চাইতেই প্রতিবেশীকে সবকিছু দেয়ার জন্যে উতলা হয়ে পড়ে। এই সর্বনাশা চেতনার আড়ালে এমন রাজনৈতিক দর্শন বিস্তার লাভ করেছে যে একটি কলেজের অধ্যক্ষ এবং আওয়ামীলীগের প্রাক্তন উপজেলা সভাপতি মরুকরনের উপকারিতা বয়ান শুরু করেছেন । সেই উপজেলার নেতারা তিস্তা পানি চুক্তি না করার জন্যে মানববন্ধন করে, সংবাদ সম্মেলন করে। সর্বনাশা এই চেতনার সংক্রমণ কতটুকু মারাত্মক ও ভয়াবহ তা সহেজই অনুমেয়।
আমাদের এই চেতনার আফিম খাইয়ে প্রথমেই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী এবং নব্বই হাজার সৈন্যকে নিজের জিম্মায় নিয়ে নেয় আমাদের এই বড়দা । এদের বিনিময়ে কত টাকা তারা ক্ষতিপূরণ হিসাবে আদায় করেছে সেই হিসাবটিও মজুদ আছে তাদের ওয়ার আর্কাইভে। প্রতিটি বাংলাদেশীর এই খবরটি জানা অতি জরুরী। যে কেউ নিচের সাইটটিতে গিয়ে সেই দলিলটি দেখতে পারেন।
www.bharat-rakshak.com/LAND-FORCES/Army/History/1971War/PDF/1971Appendix.pdf
সেই দলিলে
ক্ষতিপূরণের তালিকাটি নিম্নরূপ (পৃষ্ঠা নং ৮২২ ও ৮২৩) :
১. যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ও খোওয়া যাওয়া অস্ত্র, যন্ত্রপাতি,যানবাহন প্রভৃতির দাম বাবদ ৫০,০০,০০,০০০-০০ রুপি
২. যুদ্ধের সময় রেলপথে সৈন্য, মালামাল এবং অস্ত্রপাতির আনা নেয়া বাবদ – ৭,০৫,৩৬,৭২৬-০০ রপি
৩. ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের ১৪দিনের যুদ্ধবাবদ খরচ – ৫৫,৭১,০০,০০০-০০ রুপি
৪. ১৯৭১ এর যুদ্ধে ইন্ডিয়ান নেভির খরচ – ৩৪,৯৮,৮২,৪৪০-৫৬ রুপি
৫. তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আসা শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ভারত সরকারের খরচ বাবদ সাকুল্যে – ৩২৬,০০,০০,০০০-০০ রুপি
৬. যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে শস্যের ক্ষতি বাবদ –
ক) রাজস্থান – ৭,১৪,০০০-০০ রুপি
খ) পাঞ্জাব – ৩৬,৬৪,০০০-রুপি
গ)জে এন্ড কে – ৯,০৫,০০০ রুপি
৭. ইন্ডিয়ার নাগরিক যারা বসতভাটি ছাড়া হয়েছিলেন তাদের সাহায্য ও পুণর্বাসন বাবদ খরচ –
ক) পাঞ্জাব – ৭,৭৬,০২,০০০-০০ রুপি
খ) জে এন্ড কে -২,৫৪,৭৩,০০০-০০রুপি
গ) রাজস্থান – ৯৯,৭১,০০০-০০ রুপি
ঘ) গুজরাট- ৫,৯০০-০০ রুপি
ঙ)আসাম – ১৩,৯০৪-০০ রুপি
চ)পশ্চিম বঙ্গ – ১০,৩৪,৯৫১-৭৯ রুপি
৮. ত্রিপুরা সরকার কর্তৃক জনগণকে দেয় ক্ষতিপূরণ – ১১,৪৫,৪৯০-০০ রুপি
৯.রাজস্থান সরকার কর্তৃক জনগণের জীবন ও সম্পদের ক্ষতিপূরণ বাবদ – ৬,২৯০-০০ রুপি
১০. স্থানীয় শরনার্থীদের সহায়তায় মেঘালয় সরকারের খরচ – ৬৯,৫৪,১৪৫-০০ রুপি
১১. পাঞ্জাব সরকার কর্তৃক সর্বমোট ক্ষতিপূরন – ১,৭৭,৮৭,০০০-০০ রুপি
১২. সেনাবাহিনীর মৃত এবং আহতদের ক্ষতিপূরন বাবদ – ১,৬১,৩৯,২৭৪-০০ রুপি
১৩. অফিসার,জেসিও, ও আর দের ক্ষতিপূরণ বাবদ -১,৫৯,৭০,০০০-০০ রুপি
১৪. বাংলাদেশ থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনা বাবদ – ৮৮,৭৯,৪৫৮-১৫ রুপি
১৫.পিওএল ( চঙখ) – ৭,৫৩,০২,০০০-০০ রুপি
১৬. বেসামরিক গাড়ী ভাড়া / রিকুইজিশন বাবদ – ৬,১০,২৯,৫২৫-৮৮ রুপি
১৭. যুদ্ধবন্দীদের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ – ৩৮,০৯,৯৮,০০০-০০ রুপি
সর্বমোট – ৫৪৩,৫১,১৪,২৯৪-৯০ রুপি
আমাদের অনেকের ধারনা একটা নিঃস্বার্থ ভালবাসা থেকেই ভারত আমাদেরকে একাত্তরের যুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল। ফলে এরা ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি চাইতেও লজ্জা পায়। এই তালিকাটি দেখার পর তাদের সেই লজ্জা কিছুটা কমতে পারে।
যে ভারত আমাদেরকে তিস্তার পানি দিতে চায় না সেই তারাই যুদ্ধাপরাধের বিচারে সহায়তা দিতে সবকিছু উজাড় করে দিতে চায়। ভারত আমাদের কোন জিনিসটি দিবে আর কোন জিনিসটি দিবে না তার একটি স্পষ্ট তালিকা জানা থাকলে আখেরে ভালো হবে।
বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনীর হাতে পাক বাহিনী আত্ম সমর্পন করেছিল। কিন্তু ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীসহ ৯০ হাজার পাক সেনাকে কৌশলে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। এখানে একটি বিরাট কেক তৈরি হয়েছিল যা এই বড়দা আমাদেরকে কোনরূপ ভাগ না দিয়ে একা একাই ভক্ষণ করেছে। অথচ এর বড় শেয়ারটি আমাদের প্রাপ্য ছিল।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে যুদ্ধে যত খরচ হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশী পাকিস্তানের কাছ থেকে সেই সময়েই আদায় করে নিয়েছে। মাঝখান থেকে আমাদেরকে বেধে ফেলেছে সর্বনাশা এক কৃতজ্ঞতার বন্ধনে ।
মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে কত পয়সা কামিয়েছে তা উপরের তালিকা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে । মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটি একবারের তরেও উচ্চারন করা হয় না। এব্যাপারে জনমনে সৃষ্ট প্রশ্নেরও কোন জবাব দেয়া হয় না।
কিন্তু তাদের অক্সিলারি ফোর্সকে শাস্তি দিতে দেশটিকে ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে । আমাদের সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার জাতি রাষ্ট্রটি বিভক্ত হয়ে পড়েছে । জঙ্গীবাদের ধূয়া তুলে দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে । এর ফলে তাদের লাভ,লাভ আর লাভ। এই লাভের হিসাব গণনা করে শেষ করা যাবে না।
পূর্ব প্রকাশিত: আমাদের সময়২৮ এপ্রিল ২০১৪