পিলখানা মামলায় সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ চাই

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি বিদ্রোহের নাম দিয়ে গণহত্যা করা হয়েছিল ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। এ ঘটনায় বিদ্রোহের বিচারের জন্য প্রথমে পাঁচটি, পরে তা বাড়িয়ে ১১টি আদালত গঠন করা হয়। এসব আদালতে ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিদ্রোহের অভিযোগে পিলখানাসহ সারা দেশে দায়ের করা হয় ৫৭টি মামলা। চার বছরের মাথায় একে একে প্রতিটি মামলার বিচার কাজই শেষ হয় গত বছর। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন বিডিআর সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিডিআর ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে নাম-পোশাক সবই বদল হয়েছে এ বাহিনীর। ১৯৭২ সালের বিডিআর আইন সংশোধন করে পরবর্তীতে কোনো বিদ্রোহের ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- রাখা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের আদলে আইনের ভূতাপেক্ষা বলবৎকরণের সুযোগ দিয়ে বিদ্যমান আইনকে সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হয়নি এই আইনে।   বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘এ সংবিধানে যাহাই থাকুক তাহা সত্ত্বেও গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের আটক, গ্রেফতার বা দ-দান করিবার বিধান-সংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে তা বাতিল বা বে আইনি হইবে না। সেই সঙ্গে ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ মতে, এই সকল অপরাধীকে সংবিধানের আওতায় কোনো প্রতিকার চাইবারও অধিকার নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।’ যার ফলশ্র“তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনকে সংশোধন করতে আমরা দেখেছি এমনকি কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরও। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ১৯৭১ সালের সংঘটিত অপরাধকে ভূতাপেক্ষা কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। পরে গত কদিন আগে এই আইন সংশোধন করে সংশোধিত বিধানের কার্যকারিতা ২০০৯ সাল থেকে বলবৎকরণ করা হয়। এসবই করা হয়েছে সংবিধানে উল্লিখিত ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ বলে। যদিও আমাদের সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা আছে যে, অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ আইনে দ- ছাড়া কাউকে ভিন্ন কোনো দ- দেওয়া যাবে না। কিন্তু গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের কারণে সংবিধানের ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক এসব অপরাধী সংবিধানের কোনো প্রতিকার পাওয়া এমনকি মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে পিলখানায় সংঘটিত সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে অর্থাৎ সহায়ক বাহিনী হিসেবে বিডিআর-এর সদস্য কর্তৃক গণহত্যা অপরাধটিও বিদ্যমান আইনটির সংশোধন করে পেছনের দিকে কার্যকর বা বলবৎকরণ করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এই সংশোধনীকে কেউ চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে যেতে পারবে না বলেও সংবিধানের ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ গ্যারান্টি দিচ্ছে। কিন্তু তা আমরা করলাম কোথায়?   ২৫ ফেব্র“য়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বর্ষপূর্তি পালিত হবে এবার। এ ট্র্যাজেডি আমাদের জাতীয় জীবনের বহু অর্জনকে বিসর্জনে পর্যবসিত করেছে। বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যে গৌরবোজ্জ্বল মাস ফেব্র“য়ারি। এই ফেব্র“য়ারি কলঙ্কিত হয়েছে পিলখানা ট্র্যাজেডিতে। ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি ঢাকার বিডিআর সদর দফতরে। ওই দিন সকাল ৯টায় বসেছিল দরবার। বেশ আনন্দঘন পরিবেশই ছিল গোটা এলাকা। কিন্তু সেই আনন্দ মোটেও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছু বিপথগামী সৈনিক বিদ্রোহের নামে গণহত্যা চালায়। তখন মঞ্চে আসীন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও অন্যান্য কর্মকর্তা। মুহূর্তেই বিদ্রোহীদের একটি অংশ মঞ্চে উঠে আঘাত হানে বিডিআর প্রধানকে, যা স্বল্প সময়ের মধ্যেই সদর দফতরের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে সেদিন স্পষ্টত দেখা গেছে, লাল কাপড় মাথায় বাঁধা কিছু মানুষ কিভাবে দৌড়াদৌড়ি করেছে। সংবাদ মাধ্যমে এমনও খবর বেরিয়েছে যে, এ ঘটনার সঙ্গে ইউনিফর্ম পরিহিত নয় এমন কিছু মানুষও যোগ দিয়েছিল। বাইরে থেকে গাড়ি প্রবেশের কথাও বলা হয়েছে। রক্তাক্ত বিদ্রোহের নাম দিয়ে এভাবে গণহত্যা করা হয়েছিল ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। এ ঘটনায় সমগ্র জাতি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সমাজের সর্বস্তর থেকে দোষীদের বিচারের দাবি ওঠে। বিদ্রোহের বিচারের এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন বিডিআর সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রহিত হয়ে যায় ১৯৭২ সালের বিডিআর আইন। বর্তমানে শৃঙ্খলাবিরোধী যে কোনো কর্মকা-ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আইনে বিচার করা হবে বাহিনীর সদস্যদের। আর বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে মৃত্যুদ-। কিন্তু সবই করা হলো ভবিষ্যতের অনুরূপ কোনো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য। আর যা ঘটে গেছে সেগুলোর জন্য বিদ্যমান আইনকে সংশোধন না করেই অপরাধীদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হলো।   বিডিআর ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে বিডিআরকে করা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিডিআর নামেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ২০০৯ সালের বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাকা-ের পর বিডিআর আইন পরিবর্তনের দাবি ওঠে। একই সঙ্গে বিডিআর গণহত্যার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিও ওঠে। সংসদে এ নিয়ে বিল ওঠার পর কণ্ঠ ভোটে তা পাস হয়। এর আগে পরিবর্তিত হয়েছে বাহিনীর পোশাক। নাম ও পোশাক পরিবর্তনের পাশাপাশি বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে এ বিলে। বিলের ১১২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে এক বা একাধিক বর্ডার গার্ড আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালে একজন সভাপতি ও দুজন সদস্য থাকবেন। মহাপরিচালকের অনুপস্থিতিতে ন্যূনতম উপমহাপরিচালক পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালের সভাপতি হবেন এবং পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা সদস্য হবেন। এ ছাড়া বাহিনীর কার‌্যাবলি, ক্ষমতা ও দায়িত্ব আরও বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। সুযোগ রাখা হয়েছে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির। বাকস্বাধীনতা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান আগে ছিল না, বর্তমান আইনে তা রাখা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে উল্লিখিত ৪৭(৩) অনুচ্ছেদের আওতায় বিদ্যমান আইনটিকে সংশোধন করে পেছনের ঘটনাকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আসলে দোষ আমাদের ভাগ্যের। নতুবা এতদিনে আমরা ঠিকই আইন সংশোধন করে ঘৃণ্য এই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- নিশ্চিত করতে পারতাম। আর না হয় অন্ততপক্ষে প্রতি বছর ২৫ ফেব্র“য়ারিকে জাতীয় শোক দিবস তো ঘোষণা করতে পারতাম। পিলখানা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আর বর্বর ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার দিয়ে আপাতত আমাদের দায় কিছুটা হলেও লাঘব করি।

লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধানবিশেষজ্ঞ

পুর্ব প্রকাশিত:    বাংলাদেশ নিউজ২৪ : ২৫/০২/২০১৩

Loading


Comments

পিলখানা মামলায় সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ চাই — 1 Comment

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *