তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে…

একটু থতমত খেয়ে রয়েছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, কীভাবে হরতাল করতে হয় সেটা যেন সিপিবি, বাসদ আর বাম মোর্চার ১৮ তারিখের হরতাল থেকে বিরোধী দল শিক্ষা গ্রহণ করে। ঠিক যে বামপন্থীরা হরতালের আগের দিন রাতে কোনো গাড়িতে আগুন দেয়নি। তাদের পিকেটিং ছিল শান্তিপূর্ণ। তারা রাস্তার মাঝখানে বসে গান করেছেন। তবে পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে। তাদের প্রতি পুলিশের আচরণও ছিল দোস্তির। অবশ্য নেতারা দাবি করেছেন তাদের কোথাও কোথাও গ্রেফতার করা হয়েছে। হতে পারে, তবে পত্রিকায় তার পক্ষে কোনো খবর দেখিনি। কোনো মামলা হয়েছে বলেও শুনিনি। যেখানে শাসক ও শোষক শ্রেণীর স্বার্থ যেসব দল রক্ষা করে তাদের প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা আক্রমণাত্মক ও সহিংস সেই ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের প্রতি পুলিশের এই মমতা আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। এরূপ দেখবার জন্য আমাদের মন ও দৃষ্টি প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু সিপিবি, বাসদ আর বামমোর্চার দুর্ভাগ্য—হরতালের সাফল্য তাদের জন্য গৌরব নয়, চিরদিনের জন্য কলঙ্কের তিলক এঁকে দিয়ে গেল। তাদের এই হরতাল আসলে সরকারি হরতাল বলেই হাজির হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে যেমন তার সায় আছে, পত্রপত্রিকার খবরেও তার প্রমাণ মেলে। যারা হরতালের দিন রাস্তায় বেরিয়েছেন তাদের অনেকেই তার সাক্ষী। আগের রাত থেকেই জানাজানি হয়ে যায় যে, ক্ষমতাসীন সরকারই মঙ্গলবারের হরতাল সফল করে দেবে। রাস্তায় গাড়ি বের না করার জন্য পরিবহন মালিকদের বলে দেয়া হয়েছে। হরতাল সফল করার জন্য পুলিশের উত্সাহ ছিল রীতিমত দেখার মতো। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশই রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। এর আগের যে কোনো হরতালে পরিবহন স্বাভাবিক প্রমাণ করবার জন্য অন্য গাড়ি না হোক সরকারি মালিকানাধীন বিআরটিসি চলত। এবার দেখা গেল, বাসগুলো বাস ডিপোতেই সারি বেঁধে কচ্ছপের মতো মুখ লুকিয়ে ঘুমাচ্ছে। সরকারের মদতে পুলিশের সক্রিয় পিকেটিংয়ে যে হরতাল হয়ে গেল, তা বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে।
সিপিবি, বাসদ আর বাম মোর্চার মূল দাবি হচ্ছে মহাজোট সরকার জামাত-শিবিরসহ সব সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ করুক, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও নিষিদ্ধ হোক এবং সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার ‘দ্রুত শেষ করে শাস্তি কার্যকর করা’ হোক। উদ্ধৃতি দিচ্ছি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী দলের (বাসদ) যৌথভাবে প্রচারিত একটি হ্যান্ডবিল থেকে। এটাই তাদের প্রধান দাবি। তাদের প্রচারে ও বক্তৃতায় অন্যান্য দাবি গৌণ হয়ে গিয়েছে। তারা গার্মেন্ট অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী মালিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান চান, কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য দাবির ভিড়ে ক্লিন্ন, ক্লিষ্ট ও ক্ষীণভাবে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার দাবিও করা হয়েছে। কিন্তু সেটা আছে যেন মূল দাবির অলঙ্কার হিসেবে।
যারা হরতাল ডেকেছেন তারা নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীর দল বলে দাবি করেন। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে শ্রমিকরা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার মতো এত বড় নিষ্ঠুর ঘটনায় সারা দেশের মানুষ যখন শ্রমিকদের পক্ষে ও মালিকদের বিরুদ্ধে সংবেদনশীল হয়ে উঠল তখন শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা, কারখানায় তালা মেরে রাখা কিম্বা তাদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের জন্য তারা হরতাল ডাকেননি। বাংলাদেশে বারবার কারখানায় শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, কিম্বা বিল্ডিং ধসে গিয়ে শ্রমিকদের জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড নতুন কোনো ঘটনা নয়। অর্থাত্ যখন শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতি সমবেদনা ও সংবেদনায় মানুষ কাতর হয়েছে, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের পক্ষে বিপুল জনমত তৈরি হয়েছে তখন বামদের শ্রমিকদের স্বার্থে কোনো হরতাল দিতে দেখিনি, কোনো ধর্মঘটের কর্মসূচি দেননি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ধরনের কর্মসূচিতে জনগণ অংশগ্রহণ করার সমূহ সম্ভাবনা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় সেটা ছিল মোক্ষম সময়। তাজরীন ফ্যাশনে শ্রমিক পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে এ কঠোর কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার সমস্ত সম্ভাবনাই বিদ্যমান ছিল। অথচ এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্ত তারা হেলায় পার করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন এমনিতেই দুর্বল ও ক্ষীণ। শ্রমিক, কৃষক নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ নাই। লড়াই করা তো দূরের কথা। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পতাকা হাতে নিয়ে কমিউনিস্ট পরিচয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে গেল সেই কলঙ্কের ওপর আরও কালি আরোপ করা আমি আমার কাজ বলে মনে করি না। এই কুকর্ম করবার লোকের অভাব নাই বাংলাদেশে। কমিউনিজমের দাফন কাফন সম্পন্ন করা এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসাবে কমিউনিস্টদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে চাইবার লোকের কোন অভাব এখন আর নাই। এদের সংখ্যা আর বাড়াবার দরকার নাই। সিপিবি, বাসদ বা বাম মোর্চা তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার জবাব কি দেবেন সেটা তাদের ব্যাপার। কমিউনিজম আর যাই হোক, ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারি কর্মসূচি সফল করা যে নয় সেই সত্য বাংলাদেশের জনগণকে অন্তত বুঝিয়ে বলার আর দরকার নাই।
বরং আমাদের দাঁড়াতে হবে কমিউনিজমেরই পক্ষে, যেখানে আস্তিক/নাস্তিকের ভেদ দিয়ে রাজনীতি ঠিক হয় না, ঠিক হয় কে জালিম আর কে মজলুম সেই বিভাজন দিয়ে। ঠিক হয় না ইহকাল/পরকালের ভেদ দিয়ে; পরকালের কথা তো আমরা ইহকালেই বলি, পরকালে কি আছে সেটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াই বরং মোমিনের কাজ। আজ সেই কমিউনিজমের পক্ষেই আমাদের দাঁড়াতে হবে যে কমিউনিজমের কাছে কে টুপিলুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে আর কে প্যান্ট-শার্ট সেই ভেদ নাই, ভেদ আছে কে নিপীড়তের পক্ষে আর কে বিপক্ষে, কে মাদ্রাসায় আর কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে সেই বিভাজনও কমিউনিজম মানে না, মানে গরিব আর ধনির, শ্রমিক ও পুঁজিপতির শ্রেণী বিভাজন। গরিব ও নিপীড়িত মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে কমিউনিজ সন্তুষ্ট নয়, লেলিন যাকে অর্থনীতিবাদী আন্দোলন বলতেন, বরং নিপীড়িতের নজর দিয়ে জগত ও ইতিহাসকে দেখা, নজরদারির মধ্যে আনা এবং সব মানুষের স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যসূচক কাজ।
আজ আমাদের সেই কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে যে কমিউনিজম মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক করে তাকে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ করতে চায় না, বরং যে কমিউনিজম গরিব-নিপীড়িত মাদ্রাসার ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের গৌরবের দিকগুলো চিনিয়ে দিতে চায়। ইতিহাস স্মরণ ও ব্যাখ্যা করে দেখাতে চায় কীভাবে এই কালে তাদের লড়াই সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে হবে, দেখাতে চায় কীভাবে ইসলাম যুগে যুগে নিপীড়তের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের সংস্কার নিজে করতে সক্ষম হয়েছে, গরিব ও নিপীড়তের পক্ষে ইসলামের ভূমিকাকে স্পষ্ট করেছে। ইউএসএইড, ডিএফআইডি বা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দাতা সংস্থার সাহায্য দরকার হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার করতে হবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাস হওয়ার জন্য নয়, বরং জালিমের বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের অধিকার রক্ষা করেছে সেই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের জন্যই শিক্ষার সংস্কার দরকার। গোলাম হওয়ার জন্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম একাট্টা একরকম নয়। কোরআন নিজের তাফসির নিজে করে না, করে মানুষেরাই। আর মানুষের মধ্যে যদি জালিম ও মজলুমের ভেদ থাকে সেই তাফসিরের মধ্যেও জালিম ও মজলুমের ভেদ আছে।
ঠিক আজ সেই কমিউনিজমের পক্ষেই দাঁড়াবার সময় হয়েছে, যে কমিউনিজম ইসলামের ইতিহাসের দিকে আমাদের নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকাতে সহায়তা করে, আমাদের দেখিয়ে দেয় একাট্টা ইসলাম বলে কিছু নাই। ইসলামের ইতিহাসেও একটি পক্ষ আছে যারা জালিম রাজা-বাদশা ভূস্বামী, ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর, সুদখোরদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। হয়তো ইতিহাসে তারাই এ যাবতকাল শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে ও ইসলামকে তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু আরেক পক্ষে আছে বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের পক্ষের ইসলাম। যে ইসলাম পরকালের কথা বলে ইহলোকে ইনসাফ কায়েমের লড়াই স্থগিত রাখে না। আজ মনে করিয়ে দিতে হবে কমিউনিজম কোনো ধর্ম বিশ্বাস নয়। কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল কোরআন শরিফ নয়। একটির বিপরীতে অপরটিকে স্থাপন করার বিদ্যা আমরা জালিমদের কাছ থেকে শিখেছি। কমিউনিজম মানে মাথায় আগে থাকতেই মনগড়া বদ্ধমূল ছক এঁকে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়। মানুষের জীবন্ত লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কমিউনিজম নিজের গতি ও দিক নির্ধারণ করে।
আসলেই। তাহলে কমিউনিজম ব্যাপারটা কি? কার্ল মার্কস তাঁর তরুণ বয়সে বন্ধুকে লেখা বিখ্যাত একটি চিঠিতে বলেছিলেন, এটা নতুন কোনো কাজ নয়, মানুষের আদি কাজটাই বাস্তবায়িত করা। লিখেছিলেন, ‘শেষমেষ এটা তো পরিষ্কার যে মানুষ নতুন কোনো কাজ ধরবে না, বরং সচেতনভাবে তার পুরানা কাজটাই সম্পূর্ণ করবার দিকে নিয়ে যাবে’(১)। তাঁর গুরু হেগেলের ছাত্র হিসেবে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন ধর্মের দিকে। ‘নতুন’ কথাটার ওপর জোর দিতে তার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের কর্তব্য কি সেটা তো আদি কাল থেকেই নানাভাবে মানুষের চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা হাজির হয়েছে নানান রহস্যে মোড়ক পরে, ধোঁয়াশার মধ্যে আলো হয়ে। সেই আদি কাজ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাই কমিউনিস্টদের কাজ। সেই কাজের হদিস ধর্মের মধ্যেও আছে। কিন্তু অনেকে বলবেন ধর্ম তো অযৌক্তিক, বায়বীয় জিনিস, কাল্পনিক চিন্তায় ভরপুর। কল্পনাও তো চিন্তা। চিন্তার বাইরের কিছু তো নয়। মার্কস বলছেন, ‘যুক্তি তো সব সময়ই ছিল, কিন্তু আগে যুক্তি নিজের স্বরূপে হাজির থাকেনি’। তাহলে কমিউনিস্টদের কাজ কি? ক্রিটিক করা বা বিচার করতে শেখা। অর্থাত্ বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে বের করা মানুষের সত্য কর্তব্য এর আগে মানুষ কীভাবে সমাজে হাজির করেছে। বিচার মানে সমালোচনা নয়, নাকচ করা নয়। বিচার মানে রহস্যের মোড়কে যখন সত্য লুকিয়ে থাকে তাকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে তোলা। পর্যালোচনা। বিচার শুরু করতে হবে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ নিয়ে চেতনার বিভিন্ন প্রকাশগুলোকে এক এক করে ধরে ধরে। তত্ত্ব ও দৈনন্দিন চর্চা হিসাবে ধর্ম বাস্তবেরই জিনিস। বায়বীয় কিছু নয়। তবে, মার্কসের কথা হছে, ‘যদি সত্যিকারের এখনকার জীবনের কথাই ধরি, তাহলে রাজনৈতিক রাষ্ট্রের রূপের মধ্য দিয়ে যুক্তি তার সব প্রস্তাবনা আধুনিক কায়দায় পেশ করে’। তফাতটা মর্মের নয়, হাজির হবার ধরনের মধ্যে। এখানে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের পার্থক্য বিচারের একটা সূত্র তরুণ মার্কসের কাছে আমরা পেতে পারি।
অতএব, কমিউনিজম শেষ হয়ে গেছে এটা একটা বাজে গুজব। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই যতদিন থাকবে ততদিন কমিউনিজম কায়েমের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো ঘাটতি হবে না। হতে পারে ভিন্ন নামে, হয়তো ভিন্ন পতাকা হাতে তার আবির্ভাব ঘটবে। যে নামেই ডাকি, কিছুই আসে যায় না। যে ব্যবস্থা দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের রিজিক ধ্বংস করে দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য তার শরীরের সৃষ্টিশীল শক্তি অন্য মানুষের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করে সেই ব্যবস্থার উচ্ছেদ ছাড়া কমিউনিজম উবে যাবার চিন্তা হাস্যকর। যে-সম্পর্কের অধীনে কোনো মানুষের পক্ষেই পুঁজির দাস হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো মানবিক অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব, তাকে যতই ‘আধুনিক সভ্যতা’ বা ইতিহাসের শেষ অবস্থা দাবি করা হোক সেই ব্যবস্থা উচ্ছেদের আগে কমিউনিজমের বিলুপ্তি অবাস্তব। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার নানান আকাঙ্ক্ষা বিভিন্ন নামে সমাজে হাজির হতেই থাকবে। অতীতে যেমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। সত্যিই যিনি কমিউনিস্ট তার পক্ষে সেসব চিহ্ন পাঠ করে ইতিহাসের অভিমুখ চিনে নেয়া মোটেও কঠিন হবে না। কিন্তু সে চিহ্নগুলো আমরা ঠিকভাবে শনাক্ত ও পাঠ করতে পারছি কি? এবং তার সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ণ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি গড়ে তোলা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?
আমি মনে করি সম্ভব। কিন্তু এই দায় শুধু যারা কমিউনিজমের পতাকা হাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছেন তাদের একার নয়। যাঁরা বাংলাদেশের গরিব ও মেহনতি মানুষের কথা বলেন তাঁদের সবারই কাজ। সে কারণেও সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চার সমালোচনা আমার প্রধান কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আমার বরং বিনীত আবেদন থাকবে, এসব দলের আন্তরিক কর্মীদের মধ্যে যাদের ত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা ও সংকল্পে সন্দেহ করার কোনো কারণ আমি দেখি না। নিবেদন হচ্ছে, আসুন খোলা মনে সাধারণভাবে কমিউনিজমের দিক থেকে ধর্মকে বিচার করবার সঠিক নীতি ও কৌশল সম্পর্কে আমরা আলোচনা করি। বিশেষত মার্কস, লেনিন বা এঙ্গেলস বিষয়টিকে কীভাবে বিচার করেছেন তার কিছু খোঁজ-খবর নেই। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম নিয়ে আলোচনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই। আমাদের দেশে আগামী দিনে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী আদর্শগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে ইসলাম প্রশ্নের একটা মীমাংসা দরকার। সেই দিক থেকে কমিউনিস্টদের মধ্যে কীভাবে আলোচনা হলে তা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে সেই দিক নিয়েও ভাবতে হবে। ফলপ্রসূ বলতে আমি বুঝি যে, আলোচনায় কমিউনিস্টরা ছাড়াও যাঁরা ইসলাম কায়েমের রাজনীতি করেন তাঁরাও যোগ দিতে আগ্রহ বোধ করবেন। কমিউনিজম সম্পর্কে তাদের বিভ্রান্তি কাটিয়ে তোলার তাগিদ তাঁরা বোধ করবেন। এই বিতর্কে সততার সঙ্গে কেউ অংশগ্রহণ করবেন কিনা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মন থেকে কমিউনিজম ও কমিউনিস্টদের সম্পর্কে ভুল ধারণা কাটিয়ে তোলার একটা দায় আমি বহন করি এবং তা মীমাংসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করি।
আমি বহুদিন ধরে বলেই আসছি যে, ধর্ম বা ইসলামের নির্বিচার বিরোধিতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য আত্মঘাতী হয়েছে। কমিউনিস্টদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বাংলাদেশে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের লড়াই মুখ থুবড়ে পড়েছে। আজ তাদের পক্ষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো ‘খামোশ’ বলে দাঁড়াবার কেউ নাই। এই দেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। অথচ ইসলাম বা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম কমিউনিস্টই খোঁজ-খবর রাখেন। এই দেশের মানুষের মন জয় করতে হলে অবশ্যই ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আমার কাছে ইসলামের সঙ্গে এই মোকাবিলা নিছকই কৌশলের প্রশ্ন নয়, নীতিগত প্রশ্ন। অর্থাত্ কাকের মতো কোকিলের পাখা গুঁজে কোকিলগিরি করা নয়। আমি মনে করি ইসলামকে শুধু ধর্মতত্ত্ব হিসেবে নয়, একই সঙ্গে দর্শন বা চিন্তার ইতিহাসের দিক থেকে বোঝার কাজ অসম্পূর্ণ হয়ে আছে। যাঁরা ইসলামের দার্শনিক দিক নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা দাবি করেন চিন্তাকে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন—এভাবে বিভক্ত করে বোঝা ঠিক না, কারণ এভাবে বোঝাবুঝির পদ্ধতি পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। ইসলাম নিজে নিজেকে এভাবে ভাগ করে না। এই আপত্তি মনে রেখেও আমি মনে করি ধর্মতত্ত্ব নয়, দর্শনের দিক থেকেই ইসলামের বিচার দরকার। এই কাজ না করা গেলে শুধু পাশ্চাত্যচিন্তার পরিমণ্ডলের মধ্যেই আমাদের নিরন্তর খাবি খেয়ে যেতে হবে। কোনো পথ খুঁজে পাব না।
এক কিস্তিতে কথা শেষ হবে না। দুটো বিষয়ের উল্লেখ করে এই কিস্তি শেষ করব। আমি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নাস্তিক্যবাদী আন্দোলন মনে করি না। কেন করি না তার কৈফিয়ত আমি আমার ‘মোকাবিলা’ বইতে দিয়েছি। তার পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন মনে করি না। পরের কিস্তিতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে জরুরি, মূলত তা উল্লেখ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব। প্রস্তাবনা হিশেবে কয়েকটি কথা শুধু পেশ করব। যাতে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। ২৩ ডিসেম্বর ২০১২। ৯ পৌষ ১৪১৯। শ্যামলী

পূর্ব প্রকাশিত : (আমার দেশ, ২৪/১২/২০১২)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *