ড. ইউনূসের বই ‘তিন শূন্য বিশ্ব’ এবং চিরায়ত বিশ্বঅর্থনীতি

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তার সর্বশেষ বইটি প্রকাশ করেন।  শিরোনাম ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’ বা ‘তিন শূন্য বিশ্ব’, যা বিশ্বের দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নির্গমনকে শূন্যে উপনীত করার একটি আহ্বান সংবলিত আশাবাদ। এ নিয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি নীতি ও প্রশাসন অনুষদ আয়োজিত ও অধ্যাপক পিটার লোয়েনের উপস্থাপনায় তিনি দেড় ঘণ্টার এক উন্মুক্ত বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ‘ইন্নিস টাউন হল’ ঠাসা কৌতূহলী অধ্যাপক, শিক্ষার্থী ও অন্যদের মাঝে এক অবারিত আলোকচ্ছটার উন্মেষ ঘটান।

বাস্তবে বইটি বিশ্বের ধনতন্ত্রের ব্যর্থতাকে উপজীব্য করে চলমান সমাজ ব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য অসমতা, বিপুল বেকারত্ব ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রতি সবিশেষ আলোকপাত করেছে।  সে কারণে পৃথিবী ও মানবকূল রক্ষায় অধিক মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে উদার পরার্থবাদে উজ্জ্বীবিত হয়ে প্রত্যেকের তা স্বীয় স্বার্থে ধারণ করা জরুরি বলে প্রকাশ।  সেক্ষেত্রে তার অতিরিক্ত লোলুপতাহীন লভ্যাংশের সামাজিক ব্যবসার মডেলটি নিয়ামক সফলতা বয়ে আনবে। সেটা ধনতন্ত্রের মুক্ত বাজার ব্যবস্থা ও বাজার সৃষ্টিতে যুগপৎ হওয়া চাই। কেননা সহজাতগতভাবে মানুষ উদ্যোগী। আর পরিবেশ সংরক্ষণে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের চেয়ে এগিয়ে যাবে, কেননা সে সব অর্জনে তারা পুরোপুরি উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

নিঃসন্দেহে বিষয়টি পরহিতকর চেতনার একটি অতি উত্তম ভাবনাই বটে। কিন্তু চিরায়ত বিশ্বঅর্থনীতিতে পরিদৃশ্য যে, কখনোই কোনো অর্থনীতিতে পূর্ণকর্মসংস্থান অর্জন অসম্ভব, অর্থাৎ ‘শূন্য’ বেকারত্বে উপনীত হওয়া অসম্ভব। তার অতি সাধারণ কারণটি হচ্ছে, কর্মক্ষম মানুষের ক্ষেত্রে মৌসুমী বেকারত্ব, সাংঘর্ষিক বেকারত্ব ও নিম্ন-কর্মসংস্থানের মুখোমুখি হওয়াটা নিরন্তর ঘটনা। এই প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণ করলে ষাটের দশকের ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্তের প্রখ্যাত ‘হোয়াট ইজ সাবজেক্টিভিটি’ বা ‘প্রজা কী’ বইটি বলে দেয় সমাজে ৮০ শতাংশ দরিদ্র এবং ২০ শতাংশ সকল সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী ও তন্মধ্যে ১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সেভাবেই প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের ধারাটি বিমূর্ত। ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালের আগস্টে নিউইয়র্ক সিটিতে বিশ্ব অবলোকন করেছে ‘উই দ্য ৯৯ পার্সেন্ট’ মুভমেন্ট। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের বাইরে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের রয়েছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং উৎপাদন সক্ষমতা। পরবর্তীতে সেটাই হয়েছে বিশ্বময় আন্দোলনের স্লোগান। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সটকে পড়া শিল্পসমৃদ্ধ প্রতিটি দেশে পরিবেশগত কার্বন নির্গমনকে কীভাবে রুখবে? উপরন্তু, নানা কারণে উদ্ভূত বিশ্বের চলমান শরণার্থী বিষয়ক সমস্যাটি কীভাবে বিদূরিত হবে? এই প্রশ্নগুলো সেদিন সরাসরি প্রশ্নকর্তাদের একজন হিসেবে তাকে করেছি। উত্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টি খোলাসা করতে গিয়ে বলেন, আমরা উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণের কথাটি বলছি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রসঙ্গে সাহসিকতায় বলেন, ‘ক্রেজি পিপল ডু ক্রেজি থিংস’ অর্থাৎ পাগলেরা অনেক কিছুই করে। এসময় পুরো হলে হাসির রোল পড়ে যায়।

তবু প্রশ্ন জাগে, যেখানে ধনতন্ত্রের কেইন্সিয় অর্থব্যবস্থায় মন্দাত্ব ও বেকারত্ব মোচন এবং উচ্চ মজুরি ও সকলের জন্য সমৃদ্ধ জীবন সুনিশ্চিত করা যায়নি, সেখানে তিনি বিশ্বের দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নির্গমনকে শূন্যে উপনীত করার স্বপ্নটি দেখছেন, সেটি অবশ্যই অত্যুজ্জ্বল আশাবাদ।  তাতে বোধ করি, তার ‘২০৫০ সালের মাঝে দারিদ্র্য মিউজিয়ামে যাবে’ ধারণার হাতছানিটি প্রকারান্তরে প্রতিটি প্রাণে উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে এক নতুন বিশ্ব রচনায় সকলকে তাগিদ জোগাবে।

 

[email protected]

Comments are closed.