ডনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় আমাদের শিক্ষা

আজ থেকে চার বছর আগে আমেরিকার বিরাট সংখ্যক মানুষকে ” মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন ” স্লোগান ও মিথ্যা আশা দিয়ে আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প । তার পর একের পর এক কি বলেছেন ও কি করে যাচ্ছিলেন সেটি আর বিশ্বের মানুষকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নাই।
অনেকের মতে ট্রাম্পের মত “অসুস্থ মিথ্যাবাদী” (Pathological liar) ও কেবল নিজের স্বার্থে অর্থ লোভী এই ব্যবসায়ী ব্যক্তি আমেরিকার মসনদে বসে পৃথিবী জুড়ে অত্যাচারী শাসকদেরকে বেপোরয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাতে পরোক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

ট্রাম্প শাসন আমলে আমেরিকায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ২২ মিলিয়ন লোক তাদের চাকরি হারিয়েছিল!
দেশটি এখনও মারাত্মক মহামারীর গভীরে নিমজ্জিত! অন্য দিকে এত দিন থেকে মিথ্যা ও ভিবাজনের বিষাক্ত বাতাস ছড়িয়ে সংখালগিষ্ট মাইনোরেটি জনগুষ্টি বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছিলেন ট্রাম্প ও তার সমর্থকেরা তা আমেরিকার জন্য কল্যাণকর হতে পারেনা সেটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন।

তবে আমেরিকায় সংবিধান ও আইনের নীতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সিস্টেম চালু থাকায় এখনও মানুষের আশা ভঙ্গ হয় নাই। আমেরিকার নির্বাচনে ৩য় বিশ্বের দেশের মত ভোট কেন্দ্রে সহিংসতা বা সন্ত্রাসী হামলার ভয় না থাকা সত্ত্বেও যারা এতদিন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে যেতেন না এবার মহামারীর কারণে ডাক যুগে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকায় তারাও ভোট দিতে পেরেছেন নিরাপদে নিজের ঘরে বসে। আর সে কারণে ট্রাম্পের বিপদ আসতে পারে ভেবে তিনি শুরু থেকেই এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন এবং ভোট জালিয়াতির দোহাই দিয়েছেন আর সেটি বন্ধ করতে আদালতেও গিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের নিয়োগ প্রাপ্ত বিচারক হওয়া সত্ত্বেও বিচারক সে দাবী নাকোচ করে দিয়েছেন।

আমেরিকার পাবলিক সার্ভিসে কর্মরত কর্মচারীরা জনগণের ও রাস্ট্রের স্বার্থে কাজ করেন তারা কোন ব্যক্তি বা দলের হয়ে কাজ করেন না। তাদের সততা এবং দক্ষতার জন্য এখনও কোন অনিয়ম বা জালিয়াতির প্রমাণ ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকেরা জোগাড় করতে পারেন নাই যদিও কোন কোন রাজ্যে তারা আদালতে যাচ্ছেন শুনা যাচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে তাদের সে প্রচেষ্টাও ও ধূলিসাৎ হবে। আজ রিপাবলিকান দলের মাঝ থেকেও অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছেন ট্রাম্পের মিথ্যা আস্ফালনের বিরুদ্ধে। আমেরিকা আবার প্রমাণ করল তাদের দেশের গণতন্ত্রের শক্তি তথা জনগণের শক্তিই সবার উপরে।

“মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন ” এর স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প প্রশাসন মেক্সিকো বর্ডারে অবৈধ প্রবেশকারী এক দল মানুষদের কাছ থেকে যেভাবে ৪৫০টি শিশু সন্তানকে ভিন্ন স্থানে সরিয়ে নেয়ার অমানবতর কাজটি করেছিল তা ভুলার নয়! যার ফলে সেই শিশুদের অনেকে চিরদিনের জন্য অভিভাবক হারা হয়ে গিয়েছে! সেটি ছিল এক হ্রদয় বিদারক অমানবিক কাজ!

অবশ্য আমেরিকার মানুষ এত দিন নীরব বসে ছিল না । গণতন্ত্র ও মানবাধীকার সংঘটনের একটিভিষ্টরা ও ডেমোক্রেট দলের সমর্থকেরা প্রচুর লেখালেখি, সেমিনার, মিটিং মিছিল ইত্যাদি করে ট্রাম্প বিরুধী জনমত গড়ে তুলেছে সেই সাথে নির্বাচনে বিলিয়ন ডলারের উপর খরচ হয়েছে। ট্রাম্প শিবিরও প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন যা আমেরিকার নির্বাচনে অপরিহার্য।

আমেরিকার রাজনীতির পরিবর্তনের এ ঘটনাপ্রবাহ থেকে কি শিক্ষা নিতে পারে মুসলিমরা
সে বিষয়ে কিছু লিখা উচিত।

ট্রাম্পের আগে ওবামা প্রশাসনের আট বছরে মানুষ অনেক প্রত্যাশা ও আশার আলো দেখে ছিল তার সবকিছু ঘটে নাই। বিশেষ করে বিশ্ব মুসলিমদের কপালে তেমন কিছু হয় নাই এবং অনেক দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফসলও স্থায়ী হয় নাই নানা কারণে।

মুসলিমরা এখনও সন্ত্রাসী কলঙ্কের ছাপ মুছতে পারে নাই। সে জন্য মুসলিমদের নিজেদেরও অনেক কিছু করার আছে সেটিও বুঝতে হবে। এ প্রসঙ্গে জ্ঞানের অন্বেষণে ইউটিউব চ্যানেলের নায়ক যখন ভিলেন হয় শিরনামের ভিডিওটি দেখা উচিত ।

বাইডান প্রশাসন আমেরিকার আভ্যন্তরিন কিছু সংস্কার নীতি গ্রহন করবেন যার ফলে মধ্যবিত্ত ও স্বপ্ল আয়ের লোকদের জন্য ভাল হবে আশা করা যাচ্ছে বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে। তবে বাইডান প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নিপীড়িত মুসলমানদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়ে যাবে এ প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। তবু আমরা আশা করব ভাল কিছুর তবে সময় বলে দিবে সে আশা কতটুকু সত্য হবে।

একথা স্বীকার করতে হবে এ নির্বাচনের ট্রাম্পের পক্ষে ভোটের সংখ্যা প্রমাণ করে ট্রাম্পের সমর্থক কিন্তু কম নয়! এ পৃথিবীতে এখনও মানুষ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারে নাই। ট্রাম্পের পক্ষে এত অধিক সংখ্যক ভোট পরার অন্যতম অনুঘটক বা Catalyst হয়ে কাজ করেছে খৃষ্টান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদি। অনেক ধর্মীয় সংগঠন যে ট্রাম্পের পক্ষে ছিল তা বলার অপেক্ষা করে না।

তবে দু:খের বিষয় হল ট্রাম্প এ বিশ্বাস নিয়ে মরবেন যে আমেরিকার অর্ধেক মানুষ তাকে ভালোবাসতো!

আপনি খুশি হন বা দু:খীত কিছু যায় আসে না। আপনাকে মানতে হবে আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বের জনমত হচ্ছে মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও পরমত সহনশীলতার পক্ষে। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই মানুষের সাথে আচরণ করতে এবং দেশ শাসন করতে শিখতে হবে। যে জাতী বা কোন গুষ্টি এর বাহিরে গিয়ে যতই লাফা লাফি করুক না কেন সাধারণ মানুষ এসবকে ভালো চোখে দেখে না

ইতিহাস সাক্ষী দেয় কিছু লোক সব সমাজেই সব যুগে এগিয়ে এসেছে মানুষের মাঝে সে সচেতনতা সচেষ্ট করে জাগিয়ে তুলতে যাতে সমাজে সকল মতের ও ধর্মবিশ্বাসের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় আসে বাঁধা বিপত্তি। তবে হাজারো প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা তাদের হৃদয়মন আচ্ছন্ন করে ফেলেনা বরং এ সবের মধ্যেই তারা সম্ভাবনার সন্ধান খুঁজেন। এরকম মানুষদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

পরিশেষে বলা যায়, মুসলিমদের সামনে এখন মাত্র দুটি রাস্তাই আছে :

১) নিজেদেরকে শক্তিশালী করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তোলার এবং দরকার হলে লড়াই করার সক্ষমতা অর্জন করা যা এখনও সুদূর পরাহত! এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ও নিজেদের আত্মরক্ষার কথা বলা হচ্ছে এ ছাড়া কোন কারণে যুদ্ধ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

২) ধৈর্য ধরে জ্ঞান ভিত্তিক কথা বলার সক্ষমতা অর্জন করা এবং তা দিয়ে বৌদ্ধিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে মানুষের মন জয় করা।

এক জন মুসলিমদের মাঝে এ আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত যে সে কারো চেয়ে কম নয় এবং অন্য কেউও তার চেয়ে কম নয়। অর্থাৎ মানুষকে সমানভাবে দেখতে হবে এবং সম্মান করা শিখতে হবে। সমাজে ভাল কাজ করার জন্য অন্য ধর্মের মানুষের সাথেও সেতুবন্ধন গড়তে হবে। মানবিক ভ্রাতৃত্ব-বোধ জাগানোটাই আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
বর্তমান সভ্যতার মূলধারার সমাজে ইসলামকে উপস্থাপন করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে সেজন্য নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক সমাজে সকল ক্ষেত্রে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে।

Comments are closed.