কোরআনকে বুঝা নিয়ে কিছু কথা

সাধারণ দৃষ্টিতে কোন পাঠক কুরআন খুললে হয়তবা দেখতে পাবে এতে অনেক রিপিটেশন, বারবার একই ধরণের কথা ও আখেরাতের ভয় ভীতি, কিছু নির্দেশ কিছু কাহিনী, বিশ্ব সৃষ্টি ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য বা কথা। কিংবা সে দেখবে গতানুগতিক কোন বই পুস্তকের মত এখানে কোন ভূমিকা নাই, বইয়ের মধ্য এবং শেষ অধ্যায় বা উপসংহার বলতে কিছু নাই!
অবশ্য মানুষ তার নিজের অবস্থান থেকেই কোন একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে তাই কুরআনের ব্যাপারে এরকম ভাবাটা কোন অপরাধ নয়।

তবে উপরোক্ত ধারণা কুরআনের ব্যাপারে এ জন্য আসে যেহেতু কুরআনকে যেভাবে চিনার দরকার সেভাবে হচ্ছে না।
কুরআন আসলে প্রচলিত বই পুস্তকের মত কোন বই নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। সে জন্য জ্ঞানীরা বলে থাকেন, ” আপনি যখন তাজমহলের দিকে তাকাবেন তখন সেখানে যদিও সেটি অসংখ্য মার্বেল খচিত একটি স্থাপনা কিন্তু মার্বেল তাজমহল নয় তাজমহলের সৌন্দর্য তাজমহলের রূপেই প্রকাশিত।” বলেছিলেন মাওলানা হামিদ্দুদ্দীন ফারাহীর (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরসূরী মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ)।
ঠিক সেভাবে কোরআনের সৌন্দর্য কুরআনের বানীতে লিপিবদ্ধ।

“এটিই সেই কুরআন যা বিশৃঙ্খল তো নয়ই—বরং এর চূড়ান্ত শৃঙ্খলা, আয়াত ও বিষয়বস্তুর বিন্যাস-ধারা, সূরা ও গ্রুপ ভিত্তিক বিন্যাস-ধারার চলমান শৃংখলা—এভাবে পূর্ণ কুরআনের শৃংখলার মাঝেই—এবং যেই শৃংখলা রয়েছে অনেকগুলো ডাইমেনশনের আলোকে—সেই শৃংখলার মাঝেই যেন এই কুরআনের প্রজ্ঞার সীমাহীন সৌন্দর্য, এবং জীবনের চূড়ান্ত সমাধান লুকিয়ে আছে।”

কুরআনকে দেখতে হবে কখনো আধ্যাত্মিকতার চোখে, কখন ইতিহাসের পটভূমি সামনে রেখে নির্মোহ চিত্তে পর্যালোচনা করে।
আর কুরআন উপলব্ধির জন্য আল্লাহ কিছু শর্ত দিয়েছেন। যেগুলো না হলে কুরআনের উপলব্ধি সম্ভব নয়। যেমন,সজাগ হৃদয় ও একাগ্রচিত্তে যে শ্রবণ (সূরা কাফফ – ৩৭) সূরা কাফফ এ বলেছেন – “যে লোক আগ্রহান্বিত হৃদয় নিয়ে এসেছে”। কুরানকে এভাবে বুঝার চেষ্টা করলে কুরআনের গভীরতা, সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা ও হিকমাহ বুঝা সম্ভব হবে।

কিন্তু কোন সমাজে যদি এমন কালচার শুরু হয় যেখানে আপনাকে এই সুরা এত বার পড়লে আপনি এত ছোয়াব পাবেন কিংবা ঐ সুরা পড়লে বেহেস্তে চলে যাবেন কিংবা কেউ মরে গেলে তার নামে ঐ সুরা পড়লে তিনি আখেরাতে মুক্তি পেয়ে যাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে সেই সমাজে কুরআন বুঝা সুদূর পরাহত! এনমিতেই তো ফায়দা হাসিল হয়ে যাচ্ছে তাহলে কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করা কি দরকার।

পবিত্র কুরআনে সর্ব মোট ১১৪ টি অধ্যায় ( আরবিতে বলা হয় ‘সূরা’) আছে। কিন্তু সে আয়াতগুলো কালানুক্রমিক বা তাত্ত্বিকভাবে সাজানো হয়নি (not arranged chronologically or thematically) এমনকি অনেক সুরাগুলির মধ্যেও অনেকগুলি বিষয় হঠাৎ করে একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ের আয়াতে চলে যায় একটু পরে আবার ফিরে আসতে দেখা যায়। বাহ্যত কুরআনের এই অনন্য বিন্যাস বা কাঠামোটি অসংযুক্ত বলে মনে হতে পারে।
তবে কুরআন নিয়ে আধুনিক গবেষণায় কুরআনের উপস্থাপন একটি পরিশীলিত কাঠামোগত একাত্মতা তথা স্ট্রাকচারাল সমন্বয় আবিষ্কার করেছেন যাতে দেখা যায় কুরআনে আছে এক ধরনের “বলয় রচনা” বা “রিং কম্পোজিশন”।

রিং কম্পোজিশন তত্ত্ব (THEORY OF RING COMPOSITION)

রিং কম্পোজিশনের তত্ত্বটি মেরি ডগলাস তার বই “থিংকিং ইন সার্কেলস: রিং কম্পোজিশনের উপর একটি প্রবন্ধ” গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
রিং কম্পোজিশনের রচনাগুলির শুরু এবং শেষের মধ্যে একটি যোগাযোগ থাকতে হবে।
এটি গঠিত হয় একটি গোলাকার বৃত্ত আকারে বা সামনাসামনি প্রতিচ্ছবির মত। ( It is structured as a sort of circle, or mirror image. )
পাঠ্যের প্রধান বিষয়টি এর কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয়ার্ধটি প্রথমার্ধে প্রতিচ্ছবি করে, উল্টো দিকে। উদাহরণ স্বরূপ A, B, C, D, C’, B’, A
সহজভাবে বলতে গেলে রিং কম্পোজিশনটি হচ্ছে মাঝখানে একটি আয়না রাখার সমতুল্য অর্থাৎ প্রথমার্ধে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিফলিত হবে।

কুরআন নাজিলের পরিস্থিতি।
কুরআনের রিং কম্পোজিশন নিয়ে আলাপের আগে, কোরআন নাজিলের পটভূমি এবং পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা খুবই জরুরী:
আজ বিশ্বের যে কোন মুসলিম তার ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এটি বিশ্বাস করে ও জানে যে কুরআনের প্রতিটি কালাম বা বানি এসেছে মহা বিশ্বের স্রষ্টার কাছ থেকে । একইভাবে ইতিহাস চর্চা করলে জানা যায় যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মৌখিক ভাবে রিসাইটেশনের মাধ্যমে বক্তৃতা আকারে মোহাম্মদ (স:) এর কণ্ঠে এবং তখনকার বৃহত্তর সমাজের শ্রোতাদের মাঝে যেমন ছিলেন সে যুগের যুদ্ধংদেহী গোত্রীয়  জন-গুষ্টি যাদের সমাজে ছিল নানা সমস্যা ও কুসংস্কার, অন্যায় অবিচার, নারী নির্যাতন ইত্যাদি। যারা ধর্ম বিশ্বাসেও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল অর্থাৎ এক আল্লাহর এবাদত ছেড়ে কুফরি ও শির্কে লিপ্ত থাকত এবং সেটি যে ভুল বা পাপের কাজ সেটি তারা বিশ্বাস করত না।

আবার সেখানে কিছু সম্প্রদায় ছিলেন যারা বিগত নবী মুসা ও ঈসা (আ:) অনুসারী ধর্মীয় গুষ্টি। যারা যথাক্রমে তওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসারী ছিল, যাদেরকে কুরআন “আহলে কিতাব” বলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া ছিল সাবেইন (لصابئون ‎ al-Ṣābiʼūn) নামের আরেকটি ধর্মীয় গুষ্টি যাদের উল্লেখ কুরআনে তিনবার এসেছে। আরেকটি ছোট সম্প্রদায় ছিল হানাফি যাদের কথা কুরআনে حنيف/حنفاء হিসাবে উল্লেখ আছে তারা নিজেদেরকে নবী ইব্রাহিমের ধর্মানুসারী দাবী করতেন আর সেই সাথে ছিলেন মোহাম্মদ (স:) এর বার্তাতে বিশ্বাসী মুসলিমরা।

আমরা জানি আল্লাহর নবী মোহম্মদ (স:) লিখতে পড়তে জানতেন না। কোরআন নিজেই এটির সত্যতা নিশ্চিত করে:
“Those who follow the Messenger, the unlettered prophet, whom they find written in what they have of the Torah and the Gospel…” [Chapter 7, verse 157]
সেসমস্ত লোক, যারা এ রসূলের আনুগত্য অবলম্বন করে , যিনি উম্মী (নিরক্ষর) নবী, যার সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায় …” [ সুরা আরাফ ৭:১৫৭ ]

মুহাম্মদ (স:) এর জীবনকালে নবুয়তের পূর্বে তিনি কোন কবিতা লিখেছেন বা কবিতা অনুরাগী ছিলেন বলে তাঁর কোন সুনাম ছিল না।
কোরআন মূলত মোহাম্মদ (স:)এর কণ্ঠে আবৃত্তির মাধ্যমে বক্তৃতা আকারে এর প্রথম শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
লক্ষণীয় যে কুরআনের বাক্যকে এডিট করার বা সম্পাদনা প্রক্রিয়ার সুযোগ ছিল না, কারণ ঘটনাস্থলে অনেক আয়াত প্রকাশিত হয়েছিল অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জগুলির প্রতিক্রিয়া হিসাবে যা তাঁর কাছে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়ের কাছ থেকে আসত। তাই কুরআনের ৬,২৩৬ টি আয়াত ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে এটি একাধিক সংশোধনীর মধ্য দিয়েও যায় নি। যা যে ভাবে নাজিল হয়েছে সেটিই চূড়ান্ত বা ফাইনাল ছিল যারা শুনেছে তাদের কেউ সাথে সাথে মুখস্থ করে রেখেছে কেউ সেখানে যেভাবে পারে হুবহু লিখে রেখেছেন। মজার ব্যাপার হল এমন কি ব্যাকরণগত ভুলও ছিলনা। বরং আরবি ব্যাকরণের মাফকাঠিই হচ্ছে কোরআন। অবশ্য বৃহত্তর মানুষের পড়ার সুবিধার্থে পরবর্তীকালে দাম্মা. কাসরা ও ফাতাহ ইত্যাদি যুগ করা হয়েছে । সেটি ভিন্ন বিষয়।

আসলে কুরআন বুঝতে গেলে উপরোক্ত প্রেক্ষাপট প্রথমেই আমাদের মাথায় রাখতে হবে তখন বুঝা যাবে কুরআন কাদের উদ্দেশ্য কথা বলছে এবং কেন বলেছে ইত্যাদি তখন কুরআনের প্রতিটি আদেশ নির্দেশ ও কোনটি কখন প্রযোয্য ও অপ্রযোয্য কিংবা সমকালীন না সর্বকালীন বা সার্বজনীন ইত্যাদি তথ্যের জ্ঞান অর্জনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। কথাটি কোন হাই-থটের বিষয় নয় খুবই সহজ সরল একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।
সেই সাথে একথাও বুঝতে হবে কোরআন বিজ্ঞানের মাপকাঠি নয়,আর বিজ্ঞানও কোরআনের মাপকাঠি নয়। কোরআন বিজ্ঞানের কোন কিতাবও নয়। এখানে ঠিক ততটুকু বিজ্ঞান বিষয়ে আল্লাহ আলোচনা করেছেন, যতটুকু কোরআনের আসল বার্তাটিকে বুঝাতে তথা আল্লাহর মাহিত্য পরিপূর্ণ উপলব্ধি করাতে প্রাসঙ্গিক হয়েছে।

মাওলানা হামিদ্দুদ্দীন ফারাহীর মতে

১। কুরআনের মধ্যে যোগসূত্রের অবস্থান অস্বীকার করা মস্ত বড় যুলুম।

২। কুরআনের হেকমত ও জ্ঞানভান্ডার মূলত এর যোগসূত্রের অন্তরালে নিহিত।

তিনি আরও বলেছেন :

“একজন মিলিটারি সেনানায়ক সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে যা প্রজ্ঞার নির্দেশ করে। একমাত্র মিলিটারি ক্ষেত্রে দক্ষ লোকই এরকম সাজানোর পেছনের কৌশলগত প্রজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারে।
সাধারণ জনগণ এরকম সাজানোর ব্যবহারিক দিকের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে কেবল তখনই যখন সেনাবাহিনী বিজয় অর্জন করে। তেমনি কুরআনে একটি বিষয়বস্তু (Theme) কে বিভিন্ন স্টাইলে বহুবিদ পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছে। কেবল শৈল্পিকজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই একরকম শৈল্পিক ধারায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের পেছনের সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞা এবং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ব্যবহারিক উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে”।

তবে দু:খের বিষয় হল যারা কেবল অন্ধ বিশ্বাসের আবেগ দিয়ে কুরআনকে বুঝতে চান তখন সেখানে বিভিন্ন লোকের ভিন্ন চেতনা আসাটাই স্বাভাবিক। সেখানে কেউ হয়ে যায় সন্ত্রাসী, কেউ হয়ে যায় রাষ্ট্র কায়েমের বিপ্লবী, কেউ হয়ে যায় সুফি বৈরাগী ইত্যাদি নানা মতের নানা দলের সমাহার! তবে ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার নাই শুধু খেয়াল রাখতে হবে সন্ত্রাসীদের জন্ম যেন বন্ধ হয় মুসলিম সমাজে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু কথা আছে এখানে শুনতে পারেন।

আমিন আহসান ইসলাহী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ

যারা (কুরআনের আয়াতে ) যোগসূত্র ‘নেই’ বলতে আগ্রহী, এ অস্বীকৃতির পথে তারা কোনো প্রমাণের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়েছেন কিংবা যোগসূত্রহীনতাকেই তারা কালামুল্লাহর মহিমা ও চমৎকারিত্বে বিশ্বাসী—একথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। বরং পারস্পারিক যোগসূত্রের অভাব তারা অনুভব করেছে অথচ সমাধান তাদের জানা নেই। এমতাবস্থায় দূর্বল যতই হোক উপায় অবলম্বন একটা পাওয়া গেলেই হলো। তার ছায়ায় আশ্রয় নিতে কার্পণ্য করেনি।

এমতাবস্থায় কুরআনকে অভিযুক্ত না করে সকল ক্রটি নিজেদের উপর চাপিয়ে নিলেই তারা আন্তরিকতা ও ন্যায়নীতির অনুসারী বিবেচিত হতেন। আর দ্বিতীয়ত যারা কুরআনে যোগসূত্র থাকার সমর্থক, তাদের খেদমতের যথার্থ মূ্ল্যায়ন স্বীকার করা সত্বেও না বলে উপায় থাকে না – এ অঙ্গনে প্রমাণ সিদ্ধ এমন কোনো অবদান রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি (জটিলতা নিরসনে ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে)।

আমি এখানে উদাহরণ স্বরূপ একটি বিষয়ের দিকে খেয়াল করতে বলব। আমরা জানি কুরআন নাজিলের সময় মুসলিম ছাড়া অবিশ্বাসীরা বিভিন্ন সময় কুরআনকে মোহাম্মদ (স:) নিজের রচিত কালাম বলে সন্দেহ করত এবং প্রশ্ন করত। আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বার বার এ সন্দেহ দূর করতে নানা রকম যুক্তি দেখিয়েছেন। এমনি এক জায়গায় রাসুল (স:) এর উপর “খারাপ জিনের প্রভাব পড়েছে” বলে অপবাদ দূর করতে সে প্রসঙ্গে কুরআন সরাসরি আল্লাহর আরশে লৌহ মাহফুজ থেকে পবিত্র ফেরেস্তা মারফৎ রাসুলের কাছে আসে এবং পথিমধ্যে কুরআনকে অপবিত্র কারো হাত লাগাতে দেয়া হয়নি। এখন এ কথা শুনে ওজু ছাড়া কুরআন পড়া যাবেনা বা কুরআনে হাত দেয়া যাবে না, মেয়েদের মাসিক হলে কুরআন ছূতে পারবে না মহা পাপ বলা হয়! কুরআন যখন নাজিল হয় তখন কুরআন তো ইহুদী নাসারা সবার কাছে মুসলিমরা নিয়ে যেতেন এবং পড়তে বলতেন সেখানে কি তারা ওজু করত? আজ যদি কোন আরবের অমুসলিমকে কুরআন পড়তে দেয়া হয় তাকে কি ওজু পড়তে হবে? আমি এখানে ফিকাহর বিতর্কে জড়াতে চাই না শুধু এ উদহরণটি এনেছি কুরআন বুঝার ব্যাপারটির পেক্ষাপট না বুঝলে কুরআন থেকে বিক্ষিপ্তভাবে বাক্য নিয়ে এসে যা বাহ্যত ভাল লাগলেও কিভাবে কত অযাচিত বাধা নিষেধ আসতে পারে সেটি বুঝাতে।

সে যাক, এবার দেখা যাক রিং কম্পোজিশনের তত্ত্বটি কুরআনের ব্যাপারে কিভাবে প্রযোয্য হয়।

উপরের আলোচনায় আমরা বুঝেছি যে “রিং কম্পোজিশনের তত্ত্বনুসারে
দুইটা অংশের মাঝে বিষয়বস্তুর সুস্পষ্ট যোগসূত্র থাকতে হবে এবং এভাবে একটা অংশ আরেকটা অংশকে পরিপূর্ণ করে একে সমাপ্তিতে নিয়ে আসে। এবং এই মূল বিষয়বস্তুর সাদৃশ্যের সাথে এর ভেওরের কাঠামোরও এরকম সাদৃশ্য থাকবে।
সূরা বাকারাহ দিয়ে আমরা এর উদাহরণ দেখবো। এটি প্রায় ১০ বছরে নাযিল হয়েছিল নিরক্ষর মুহাম্মাদ (সা:) এর উপর।
নিচের ভিডিওটি শুনলেই বুঝতে পারবেন।

সূরা বাকারাহ এটি কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা যার আয়াত সংখ্যা ২৮৬টি। একে সূরার সেকশন আকারে ভাগ করলে ৯টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এর বিষয়বস্তু (Theme/Topic) অনুযায়ী।

1. ঈমান বনাম কুফুর (1 – 20).
2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (21 – 39).
3. বনী ইজরাঈলদের শরীয়া দেওয়া (40 – 103).
4. ইব্রাহীম আঃ এর পরীক্ষা (104 – 141).
5. নতুন কিবলা – কা’বা শরীফ (142 – 152).
6. মুসলিমদের পরীক্ষা করা হবে (153 – 177).
7. মুসলিমদের শরীয়া দেওয়া (178 – 253).
8. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (254 – 284).
9. ঈমান বনাম কুফুর (285 – 286).

একে নতুন করে সাজালে পাওয়া যায় এভাবে।

__1. ঈমান বনাম কুফুর (1 – 20).
________2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (21 – 39).
_____________3. বনী ইজরাঈলদের শরীয়া দেওয়া (40 – 103).
_________________4. ইব্রাহীম আঃ এর পরীক্ষা (104 – 141).
5.—————-নতুন কিবলা – কা’বা শরীফ (142 – 152).
_________________4. মুসলিমদের পরীক্ষা করা হবে (153 – 177).
_____________3. মুসলিমদের শরীয়া দেওয়া (178 – 253).
________2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (254 – 284).
__1. ঈমান বনাম কুফুর (285 – 286).

rr

ইমেজটি স্পষ্ট করে দেখুন এখানে – http://tinyurl.com/plme4lm

সুতরাং দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে এর গঠন হচ্ছে এবং বিপরীতে গিয়ে সেই আগের পজিশনে ফিরে আসছে কিন্তু এর মাঝে হেদায়েতের পূর্ণ ধারা বর্ণিত আছে সুনিপুনভাবে। বনী ঈজরাইলদের বর্ণনার সাথে সাথে তাদের ব্যর্থতা, অবাধ্যতা ও এসব কীভাবে হয়েছে উদাহরণ দিয়ে বুঝানো হচ্ছে- তাদের পৃথিবীতে সর্বোচ্চ লেভেলের সম্মান থাকা সত্ত্বেও তাদের এসব কাজের দরুন উম্মাতে মুসলিমকে ইসলামের দায়িত্ব দেওয়া হলো…। কিন্তু তারাও যদি বণী ইজরাঈলদের মত করে তবে তারাও কুফুরিতেই ফিরে যাবে এবং নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

এটা মোটাদাগে নাযম ও তারতীব দেখানো হল। আপনি যখন এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত পড়তে যাবেন তখন দেখবেন এগুলোর সাথে কত প্রজ্ঞা বা হিকমাহ জড়িত রয়েছে, কত সুনিপুন গঠনগত বিন্যাস-কাঠামো, এর ভাষা, এর প্রত্যেকটি যোগসূত্র এবং ধারাবাহিকতার মাঝে নাযিলের প্রেক্ষাপট প্রত্যেকটি আয়াত এবং সর্বসাকুল্যে সূরা পূর্ণটিই একটি বড় বিষয়বস্তুকে ঘিরেই এই ৯টি সাব-থিম বা উপ-বিষয়বস্তু আবর্তিত হচ্ছে অথচ তাদের মাঝে কোনো ভাঙ্গন নেই, সবাই একই তাসবিহর মালায় বিজড়িত হয়ে আছে। এভাবে প্রত্যেকটি সূরা যেন একেকটি সরল পথ, যার কোথাও ভাঙ্গন নেই, পূর্ণ পথটি একসাথে মিলিত আকারে চলেছে গন্তব্যের শেষ পর্যন্ত—যার উদ্দেশ্য অভিন্ন।

আরো অবাক হবেন এই দেখে যে এই ৯টি মূল বিষয়বস্তুর প্রত্যেকটিতেই এই রিং থিওরী রয়েছে অর্থাৎ সার্বিক ১টি রিং, আবার প্রত্যেকটির ভেতরেই রয়েছে একটি করে মোট ৯টি রিং। সুবহানাল্লাহ!!

বর্তমানে যেমন আমেরিকান কুয়েত ইউনিভার্সিটির এরাবিকের প্রফেসর Raymond K. Farrin মূলত ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এই দিককে গবেষণা করে দেখার ফলেই। তিনি সূরা বাকারাহর উপর (Surat al-Baqara: A Structural Analysis) যখন প্রথম ভাষাতাত্ত্বিক যোগসূত্রের বিশ্লেষণ করে অসাধারণ ফল পান এবং এতেই আগ্রহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বলেন—এই বই কোন মানুষের লিখিত হতে পারে না।

Neal Robinson তাঁর কুরআন নিয়ে বিখ্যাত বই Discovering the Qur’an: A Contemporary Approach to a Veiled Text তেও এ বিষয়ে আলোচনার নতুন মাত্র যোগ করেছেন তুলনামূলকভাবেই। তিনি আমীন আহসান ইসলাহী এর তাদাব্বুরের ধরণ নিয়ে আলোচনা এনেছেন The Order of the Surahs: Islahi’s Explanation ১৩ তম অধ্যায়ে। এবং তিনি সূরা বাকারাহর পূর্ণ সূরাটিকে এ ধারায় চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে সফলও হন।

Salwa El-Awa এর পিএইচডির বিষয়-ই ছিল এই ধরণের উপর। তাঁর বইতে সব ইতিহাস তুলে ধরে এনেছেন এবং চমৎকার ব্যাখ্যাও করেছেন। বইটির নাম Textual Relations in Quran: Relevance Coherence & Structure।
এর পূর্বে Mustansir Mir ও পিএইচডি করেন যা ছিল ইসলাহীর নাযম এর বিশ্লেষণের উপর। তাঁর বই ছিল – Cohernence in the Quran; A study of Islahi’s Concept of Nazm In Tadabbur-i-Quran – যা সবাই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন।

এ নিবন্ধটি সংকলনে কৃতজ্ঞতা ও তথ্য সুত্র
The Remarkable Structure of the Qur’an.
তাদাব্বুরে কুর’আনঃ
কুর’আনের স্বাদ, গভীরতা, মু’জিযা ও প্রজ্ঞার আরেক খনি – আহমেদ আল সাবা

Comments are closed.