বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এক মুসলিম নারী – ফাতিমা আল-ফিহ্‌রী


ইসলামের ইতিহাস জুড়ে নারী শিক্ষার ব্যাপারটিকে সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। নারীরা শিক্ষা গ্রহণের যোগ্য নয়, অথবা তারা শিক্ষক হবার উপযুক্ত নয়, এ ধরনের কোন মতবাদ প্রচলিত ছিল না। এই নজির স্থাপন করেছিলেন স্বয়ং রাসূল ﷺ এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ)। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম বড় একজন স্কলার এবং রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর তিনি মদিনাতে অনেক মানুষের শিক্ষক ছিলেন।

নারীদের কাজের প্রভাব ইসলামের ইতিহাসের পরবর্তী অংশগুলোতেও দেখা যায়। মুসলিম বিশ্ব জুড়ে নারীরা মসজিদে বক্তৃতা দিতেন, মাদ্রাসায় যেতেন, এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই শিক্ষকতা করতেন। উদাহরণস্বরূপ, দ্বাদশ শতাব্দীর স্কলার ইবন ‘আসাকির, যিনি দামেস্ক নগরী নিয়ে তাঁর লিখিত বই ‘তারিখ দিমাস’ এর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি জ্ঞান অন্বেষণে প্রচুর ভ্রমণ করেন এবং প্রায় ৮০ জন নারী স্কলারের অধীনে জ্ঞানার্জন করেন।

৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা আল-ফিহ্‌রী প্রতিষ্ঠিত আল-কারাওনি বিশ্ববিদ্যালয়, ফেস, মরক্কো

বিদ্যানুরাগী হিসেবে নারীরা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেঃ

  • ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর “ফেস” নগরীতে মুসলিম বিশ্বের সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা “আল-কারাওনি বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহ্‌রী নামক একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী।
  • আব্বাসী খলিফা হারুন-অর-রশিদের স্ত্রী জুবায়দা ব্যক্তিগত উদ্যোগে হিজাজ অঞ্চলে অনেক মসজিদ, রাস্তাঘাট এবং কূপ খননে আর্থিক সহায়তা দেন। যার ফলে এ অঞ্চলে যাতায়াতকারী অনেক শিক্ষার্থী এই সুবিধাগুলো পেয়ে অনেক উপকৃত হয়।
  • উসমানী সুলতান সুলাইমানের স্ত্রী হুররেম সুলতান বিভিন্ন হাসপাতাল, পাবলিক টয়লেট ও গোসলখানা এবং গরীবদের বিনামূল্যে খাবার বিতরণের জন্য রান্নাঘর প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুদান দেয়ার পাশাপাশি অসংখ্য মাদ্রাসাতেও আর্থিক সাহায্য দেন।
  • দামেস্কে আইয়ুবী শাসনামলে (১১৭৪ – ১২৬০) নারীরা ২৬টি ধর্মীয় স্থাপনা (মাদ্রাসা, মসজিদ এবং ধর্মীয় স্থাপনা) নির্মাণ করেন।

গত ১৪০০ বছরে নারীরা ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন যা মধ্যযুগীয় ইউরোপে (এমনকি উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতেও) অনুপস্থিত ছিল। নারীদের কখনোই সমাজের “অবহেলিত শ্রেণী” হিসেবে দেখা হয়নি, বরং জাতীয় জীবনে বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছেন।

আধুনিক ইতিহাস
ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা এবং অন্যান্য চিরায়ত ধারার ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র আজও চালু আছে, যদিও সংখ্যায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হল উনবিংশ শতাব্দীজুড়ে মুসলিমবিশ্বে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির আগ্রাসন। উদাহরণস্বরূপ, ওসমানী সাম্রাজ্যে ফরাসি ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদী উপদেষ্টারা সুলতানকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন। এর অংশ হিসেবে তাদের পরামর্শ ছিল পাঠ্যক্রম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা মুছে ফেলা এবং শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালু করা। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা বাদ দিয়ে ইউরোপীয় বইপুস্তকের উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় পাঠ্যক্রম চালু করে। যদিও মাদ্রাসাগুলো এখনও চালু আছে কিন্তু সরকারী সাহায্যের অভাবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ আধুনিক মুসলিম বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে সাবেক ওসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ইউরোপীয় ধাঁচে পরিচালিত। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন তা নির্ভর করবে আপনি উচ্চ-বিদ্যালয়ের শেষে একটা নির্দিষ্ট পরীক্ষায় (আমাদের দেশে যেটা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা) কেমন ফলাফল করেছেন। যদি আপনি সেই পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেন, কেবল তখনই আপনি বিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়গুলো যেমন মেডিকেল অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ার সুযোগ পাবেন। আর যদি আপনার ফলাফল একটি নির্দিষ্ট স্কোরের চেয়ে খারাপ হয় তবে আপনি কেবল ইসলামিক এবং অন্যান্য বিষয়গুলোতে পড়তে পারবেন।

মুসলিম বিশ্বের বেশীরভাগ অঞ্চলেই এই নতুন সিস্টেম চালু হয়ে গেলেও চিরায়ত ধারার ইসলামিক শিক্ষাপদ্ধতি আজও চালু আছে। কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মরক্কোর ফেস নগরীর আল-কারাওনি বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ এ এখনো চিরায়ত ধারার ইসলামিক শিক্ষাপদ্ধতি চালু রয়েছে যেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ও পড়ানো হয়। এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যই ছিল অতীতের সব ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাপদ্ধতির মূলে, যার থেকে বেরিয়ে এসেছিল ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সব স্কলারগণ। এখনো এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে জনসাধারণের মাঝে।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Education in Islamic History আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ আম্মার মেহফুজ

Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ

Ibn Khaldūn. The Muqaddimah, An Introduction To History. Bollingen, 1969. Print.

Lindsay, James E. Daily Life in the Medieval Islamic World. Indianapolis: Hackett Publishing Company, Inc., 2005. Print.

Morgan, M. Lost History. Washington D.C. : National Geographic Society, 2007. Print.

বি:দ্র: ( এ নিবন্ধটি পূর্ব প্রকাশিত হয়েছে ইসলামের হারানো ইতিহাস ওয়েব সাইটে)

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

Comments are closed.