বিজয় থেকে নির্বাসন – ইতিহাসের শিক্ষা

ভূমিকা

গত সপ্তাহান্তে শনিবার আমার বাড়ীর পাশে আল ফুয়াজ সেন্টারে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পি এইচ ডি ছাত্র, ইজাজ আহমেদের প্রণীত মুসলিম স্পেনের ইতিহাস বিষয়ে একটি অসাধারণ উপস্থাপনা শুনার সুযোগ হয়েছিল। আজকের লিখাটি মূলত সে প্রেক্ষিতে লিখা। ৭১১ থেকে ১৬১৪ সনের সুদীর্ঘ প্রায় নয় শত বছরের মুসলিম স্পেনের ইতিহাস বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে অবশ্যই কয়েকটি পর্বে লিখার দাবী রাখে। তবে সময়ের অভাবে এবং আধুনিক পাঠকের ব্যস্ততার কথা চিন্তা করে ভাবলাম অতি সংক্ষিপ্তসার  (bird’s-eye view) আকারে কিছু লিখা যায় কি না। তাই এ বিষয়ে  ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য সূত্রের সাহায্য নিয়ে এখানে কিছু তথ্য শেয়ারা করছি পাঠকের খেদমতে।

অতএব আসুন মানব সভ্যতার বিকাশে মুসলিমদের সেই নয় শত বছরের ইতিহাসে একটি দ্রুত সফর করে আসি এবং সে ইতিহাস থেকে বর্তমান মুসলিমদের শিক্ষণীয় কি হতে পারে তা আলোচনা করা যাক।

এখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করতে হবে যে মুসলিম সভ্যতার আলোচনায় শুধু মুসলিম শাসকদের সাম্রাজ্য বিস্তার নয় বরং দেখতে হবে সে যুগের সামাজিক ও দার্শনিক চিন্তা ভাবনা, জ্ঞান বিজ্ঞানে, আর্ট কালচারে, শিল্প সাহিত্যে ও দার্শনিক চিন্তাধারায় সমাজ জীবনের নৈতিকতায় ও সুস্থ চিন্তায় মুসলিম সভ্যতা কি ভূমিকা রেখেছিল, তা না দেখলে ইসলামী সভ্যতার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। কেননা ইতিহাস চর্চায় শুধু সাম্রাজ্য ও রাজনৈতিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তবা রাজনৈতিক কলহ বা ক্ষমতার লড়াই ও বিদ্রোহের কাহিনী ছাড়া অন্য কিছু নজরে আসবে না। সভ্যতা নির্ধারণী বিচার বিবেচনার জন্য বর্ধিত পরিধীতে দৃষ্টি সঞ্চালনের প্রয়োজন। ৭১১ সালে কর্ডোভা মুসলিম খিলাফতের সময় সে অঞ্চলটি ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন (sophisticated) রাষ্ট্র ছিল যখন ইউরোপের বাকী এলাকা নিমজ্জিত ছিল অন্ধকার যুগে বা ডার্ক এইজের কালো ছায়ায়। সুদীর্ঘ আট শত শত বছর ধরে, মুসলিমরা সেখানে নতুন কৃষি কৌশল, বোটানিক্যাল এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, কবিতা ও দর্শনসহ বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন এনেছিল। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই নিচের ভিডিওটা দেখা দরকার।

মুসলিমদের স্পেন বিজয় থেকে নির্বাসনের ইতিহাসকে আমদেরকে কালানুক্রমে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শাসকের উত্তরাধিকার সময়ের শাসন কালের ভাগে বা পর্যায়ে (Period) ভাগ করে দেখতে হবে।

•The Dependent Emirate (711-756)
•The Independent Emirate (756-929)
•The Caliphate (929-1031)
•The Almoravid Era (1031-1130)
•Decline (1130-1492)
বিস্তারিত এখানে পড়তে পারেন।

প্রথম পর্যায় -বিজয় কাল (৭১১- ৭৫৬)

এ সময় মুসলিমরা স্পেনের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয় বিভিন্ন চুক্তির (treaties) মাধ্যমে, কোন রকম সরাসরি যুদ্ধ বা আক্রমণ ছাড়াই। আর ইতিহাস সাক্ষী দেয় স্পেন দখল করার পর মুসলিম শাসকরা সে দেশের খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছেন এবং তাদের ধর্মপালনের অধিকার বজায় রেখেছিলেন।

দু:খের বিষয় হচ্ছে আজ ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী তথাকথিত সভ্যতার ঠিকাদার পশ্চিমা মিডিয়া ও মুসলমান নামধারী এক শ্রেণীর আত্মমর্যাদাহীন মানুষের কাছে  ইসলামের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস চর্চার কোন মূল্য নাই। তারা অবশ্যই এ গুলাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতার ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করাটাই শ্রেয় মনে করেন। অবশ্য এজন্য তাদের দুষ দেয়া যায় না। আমি বরং তাদেরকে পরিস্থিতির শিকার (victim of circumstance) বলেই মনে করি। তবে মুসলিমদের দায়িত্ব হল এ পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রত্যাশায় বুদ্ধি-ভিত্তিক চেষ্টা করা। ইতিহাস সাক্ষী দেয় আজ থেকে ১০০০ হাজার বছর আগে স্পেনে মুসলিম সভ্যতার আমলে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান করে মুসলিম, ইহুদী ও  খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনগণ সে সমাজে উদীয়মান (Flourshing) জীবন যাপন করেছিল।

এ প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য ভিত্তিক রচিত নিচের ভিডিওটি দয়া করে শুনার জন্য অনুরোধ করব।

৭১১ সনে বারবার সেনাপতি তারেক বিন জিয়া’দ একটি ছোট বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে স্পেন দখল করে নেন। সে অভিযানে ভিসিগতিক শাসক (Visigothic ruler) বাদশাহ রডারিককে পরাজিত করেন। তারপর ৭১২ থেকে ৭২০ সনে মধ্যে মুসলিমরা স্পেনের বড় বড় শহর যেমন, গ্রানাডা, সেবিল এবং বার্সালুনা সহ স্পেনের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেন। তবে মুসলমান্দের স্পেন বিজয়ের সফলতার আসল কারণ উপেক্ষা করে ইসলাম বিদ্বেষী মহল এ বিজয়কে নিছক সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনগণের দেশ দখল হিসাবে প্রচার  করেন। বিস্তারিত জানতে এখানে পড়তে পারেন।

muslim-spain

দ্বিতীয় পর্যায়: (৭৫৬ থেকে ১০৩১ সন) উমাইয়েদ খিলাফত কাল

সে সময়টি ছিল রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ বা Political centralization এর যুগ। এ সময়কে ইসলামি স্পেনের স্বর্ণযুগের  সূত্রপাত হিসাবে দেখা হয়।

৭৫৫ – ৭৫৬

এ দিকে তখন আরব বিশ্বে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় বিপ্লবের পর নতুন এক পরিবারের হাতে খিলাফত হস্তান্তর হয় এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় বাগদাদে। তবে তখন থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকদের বিদ্রোহ ও আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কলহ-বিরোধ তথা মুসলিম খলিফার অবাধ্যে চলার প্রবণতা ও ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগীতা, তথা প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত ঘোষণা! এর ফলে উত্তর আফ্রিকার স্বায়ত্তশাসন অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পায়। আব্বাসীয় বিপ্লবের সময় উমাইয়াদ রাজবংশের আব্দুর রহমান (১ম) দামেস্ক থেকে স্পেনে পালিয়ে যান এবং নিজেকে কর্ডোবার আমির ঘোষণা করেন।

আল-আন্দালুস (মুসলিম স্পেইন) সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক, উভয় দিক দিয়েই কর্ডোবার এই উমাইয়া খিলাফত ছিল পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র। জ্ঞানার্জন এবং শিক্ষাব্যবস্থার দিক দিয়ে, শৈল্পিক, সামাজিক কৃতিত্বের দিক দিয়ে আল-আন্দালুস মুসলিম বিশ্বের অন্য যেকোন অংশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে ইরাক, মিশর এবং পারস্যের মতো উন্নত সভ্যতাকেও। তবে পরবর্তী ৫০ বছরেই সবকিছুতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এক শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র থেকে আল-আন্দালুস পরিণত হয় এক বিভক্ত, ভঙ্গুর, এবং রাজনৈতিকভাবে বহিঃশক্তির উপর নির্ভরশীল এক রাষ্ট্রে। এ সময়টিকে বলা হয়  “তাইফা যুগ”, (বিদ্রোহী ক্ষুদ্র প্রশাসনের যুগ) যখন আল-আন্দালুসের পতনের বীজ রোপিত হয় এবং এর ফলে আল-আন্দালুসের চূড়ান্ত পতন হয় ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে।

“তাইফা যুগে” কি ঘটেছিল?

৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে এক ১০ বছর বয়সী বালক আল-আন্দালুসের উমাইয়া খিলাফতের উত্তরাধিকারি হওয়ায় খলিফার আসনে বসানো হয়। কিন্ত  যেহেতু সে ছিল সবেমাত্র একজন বালক, তাই নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থা তার ছিলনা। নেতৃত্বের মূলশক্তি চলে যায় উমাইয়া আদালতের এক উপদেষ্টা “আল-মানসুর ইবন আবি আমীর” এর কাছে। আল-মানসুরের সক্রিয় এবং কার্যকরী নেতৃত্বে আইবেরিয়া পেনিনসুলা (বর্তমান স্পেন এবং পর্তুগাল)-র মুসলিমগণ তাদের উন্নতির চরম শেখরে পৌঁছায়। তবে আল-মানসুরের একচেটিয়া নেতৃত্বই ছিল খলিফার গুরুত্ব হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ।

১০০২ খ্রিস্টাব্দে আল-মানসুরের মৃত্যুর পর গোটা আল-আন্দালুসে অনৈক্য মাথাচড়া দিয়ে উঠে, এবং খলিফাও তার কর্তৃত্ব জাহির করতে ব্যর্থ হন। ফলাফলস্বরূপ গোটা আইবেরিয়া পেনিনসুলার বিভিন্ন প্রদেশের শাসকেরা তাদের নিজ নিজ প্রদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে – এই প্রদেশগুলো “তাইফা” (الطائفة/বিদ্রোহী দলীয়)  নামে পরিচিত ছিল।

কর্ডোবা খিলাফতের পতনের পর ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে আল-আন্দালুসের তাইফা প্রদেশসমূহ

তাইফাগুলোর উত্থানের ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন আবদাল্লাহ ইব্‌ন বুলুগিন, যিনি তাইফাগুলোর উত্থানের সমসাময়িক এক ব্যক্তিত্ব এবং সংশ্লিষ্ট সবকিছুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনকারী:

“যখন আল-মানসুরের ‘আমিরিদ রাজবংশের ইতি ঘটে এবং জনগণ ইমামহীন বা নেতাহীন হয়ে পড়ে, তখন সকল সামরিক সেনাপতিরা যার যার শহরের ক্ষমতা গ্রহণ করে নেয় এবং নিজেদের দুর্গের চারদিক পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত করে ফেলে। এভাবেই সবার আগে নিজেদের গদি নিশ্চিত করার পর তারা নিজেদের সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে এবং সব অর্থ-সম্পদ জড়ো করতে থাকে। মূলত সবাই পার্থিব ক্ষমতা লাভের জন্যই একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু করে এবং একে অন্যকে দমন করার চেষ্টা চালায়” (Muslim Spain and Portugal: A Political History of al-Andalus, p.134)।

তাইফা রাজাদের বৈশিষ্ট্য:

তাইফা রাজাদের কেউই উমাইয়া পরিবারের ছিলনা, এবং রাজ্য শাসনের জন্য ঐতিহ্যগত দাবীও তাদের ছিলনা। শুধুমাত্র  ক্ষমতা দখল করে সমাজে কর্তৃত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযান চলানো ছিল তাদের নেশা। এভাবে জমি দখল করার মাঝেই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। নিজ নিজ রাজ্যের জনগণকে ব্যবহার করে নিজ নিজ সেনাবাহিনী গড়ে মুসলিম রাজাদের মাঝে এমন যুদ্ধ স্পেনে ইসলামকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

খ্রিস্টানদের অগ্রযাত্রা

তাইফা রাজারা মুসলিম উম্মার একতা ও স্বার্থ ছেড়ে শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতা পাকা পোক্ত করার নেশায় মত্ত হওয়ায় একমাত্র যারা তাইফা যুগে প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হয়েছিল তারা হচ্ছে আল-আন্দালুসের উত্তরদিকে খ্রিস্টান রাজ্যসমূহ। যখন একদিকে তাইফাগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত, অন্যদিকে তখন খ্রিস্টান রাজ্যগুলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তারা তাদের রাজ্য থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে মুসলিম অঞ্চলগুলো দখল করতে থাকে। এটাই ছিল একাদশ শতাব্দীতে আল-আন্দালুসের অনেক অঞ্চল মুসলিমদের হাত ছাড়া হবার প্রধান কারণ।

সর্বপ্রথম যে তাইফা রাষ্ট্র খ্রিস্টানদের কাছে সাহায্য চায় সেটি ছিল সাবেক উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী, কর্ডোবা। একাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে খিলাফতের পতন হলে শহরের অভ্যন্তরে কর্ডোবার অধিবাসী এবং সাম্প্রতিককালে উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত বারবার যোদ্ধাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায়। ১০১০ থেকে ১০১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শহরে নিজেদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় পক্ষই ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈন্যদের নিয়োগ দেয়। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথম, মুসলিম স্পেনের সাবেক রাজধানী কর্ডোবার রাস্তায় অমুসলিম যোদ্ধারা অস্ত্র প্রদর্শন করে প্যারেড করে।
কর্ডোবার ভিতরের এমন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উদাহরণ অন্য মুসলিম তাইফাগুলোও অনুসরন করতে লাগলো । তারাও দ্রুত নিজেদের বাহিনীতেই ভাড়াটে খ্রিস্টান সৈন্যদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে, এমনকি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন খ্রিস্টান রাজাদেরকে তাদের পক্ষ হয়ে অন্য মুসলিম তাইফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুরোধ করে। আর এ সব যুদ্ধের কারণে নেমে আসে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, খ্রিস্টান রাজাদের পিছনে এতো বেশী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার ফলে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার শক্তিই হারিয়ে ফেলে।

তাইফা যুগের সমাপ্তি

তাইফাগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এই সর্বনাশা চক্র যদি অব্যাহত থাকতো, তাহলে গোটা আল-আন্দালুস একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই খ্রিস্টানদের হস্তগত হয়ে যেত। যাই হোক, এমনটি আর ঘটেনি। তাইফাগুলো যখন আইবেরিয়া পেনিনসুলায় নিজেদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত, ঠিক সে সময় উত্তর আফ্রিকায় এক নতুন আন্দোলন জেগে উঠছিল।

১১২০ খ্রিস্টাব্দে মুরাবিতুন সাম্রাজ্য 

১০৪০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার বারবার গোত্রীয় এক স্কলার আবদুল্লাহ ইবন ইয়াসিন একটি নতুন আন্দোলনের ডাক দেন যা “মুরাবিতুন” (المرابطون/ইংরেজিতে Almoravids) নামে পরিচিত ছিল। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সঠিক ইসলাম পালনে কঠোর হওয়া এবং ইসলাম-বহির্ভুত চর্চা ও আইনসমূহ নির্মূল করা। আন্দোলনের শ্লোগান ছিল “ভাল কাজে উৎসাহ প্রদান, খারাপ কাজ বর্জন, এবং ইসলাম-বহির্ভূত কর বাতিলকরণ”। উত্তর আফ্রিকার বারবার জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী এবং সাহসী সামরিক ঐতিহ্যের কারণে তখনকার তাইফা রাজাগণ আশা করছিলেন মুরাবিতুনরা আল-আন্দালুসে এসে খ্রিস্টানদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিবে। যেমন- ইতিমধ্যে টলেডো এর তাইফা দখল করে ক্যাস্টিলের রাজা ৬ষ্ঠ অ্যালফোন্সো ১০৯১ খ্রিস্টাব্দে সেভিল এর তাইফাও প্রায় দখল করে ফেলছিল। এরকম ভয়ানক পরিস্থিতি হওয়ার পরই তাইফা রাজাগণ একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মুরাবিতুন আন্দোলনের নেতা ইউসুফ বিন তাশফিনকে আহবান জানান স্পেনে এসে স্পেনের মুসলিমদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে।

তাইফা যুগে আল-আন্দালুসের নোংরা রাজনীতির কথা মাথায় রেখে ইউসুফ বিন তাশফিন সংকল্প করেন যে তিনি শুধুমাত্র ৬ষ্ঠ অ্যালফোন্সোকে পরাজিত করেই আফ্রিকায় ফিরে যাবেন। কাজটি তিনি সম্পন্ন করলেও, তা যথেষ্ট ছিলনা। কারণ এরপরও বারবার আল-আন্দালুসকে খ্রিস্টানদের হাত থেকে রক্ষা করতে ইউসুফ বিন তাশফিনের প্রতি ডাক আসতে থাকে। তাই ইমাম গাজ্জালীসহ অনেক মুসলিম স্কলার ইউসুফ বিন তাশফিনকে অনুরোধ করেন অকার্যকর তাইফা রাজাদের উৎখাত করে আল-আন্দালুসকে মুরাবিতুনদের রাজ্যের সাথে যোগ করে ফেলতে। কাজটি তিনি একাদশ শতাব্দীর শেষ দশকেই সম্পন্ন করেন, সব তাইফা রাজ্যকে একীভূত করে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাইফা যুগে খ্রিস্টানদের হাতে চলে যাওয়া তাইফাগুলো মুরাবিতুনরা আবার পুনরুদ্ধার করতে না পারলেও, এটি দক্ষিণ দিকে খ্রিস্টানদের অগ্রযাত্রার গতি মন্থর করে দিয়েছিল। একারণে, এরপরও খ্রিস্টানদের প্রায় ৪০০ বছর লেগে যায় আল-আন্দালুসের মুসলিমদের সম্পূর্ণ পরাজিত করতে।

(উপরের বর্ণিত তাইফা সংক্রান্ত তথ্যগুলা অনুবাদ করা হয়েছেঃ Disunity in Al-Andalus: the Taifa Period আর্টিকেল থেকে। অনুবাদকঃ সাদাত ইফতেখার)

১৪৯২ চুড়ান্ত নির্বাসন

অবশেষে ১৪৯২ সালে মুসলমানরা আল-আন্দালুস (স্পেন) থেকে সব ক্ষমতা হারিয়ে চির বিদায় হন। ১৫০২ সালে খ্রিস্টান শাসকরা মুসলমানদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার আদেশ জারি করে এবং প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। শত শত মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করে। মিলিয়ন মিলিয়ন আরবি বই পুস্তক ও লাইব্রেরী পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তবে প্রকাশ্য নিজেদেরকে খ্রিস্টান বললেও অনেকে গোপনে ও অন্তরে মুসলিম হিসাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। আর এক সময় এদের সংখ্যা এত বেশী হওয়ায় এটা গোপন রাখা সম্ভব থাকে নি। ফলত তাদের উপর নেমে আসে নির্মম বিধিনিষেধ ও অত্যাচার। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে দলে দলে স্পেনের ভুমি থেকে বিতাড়িত (deport) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন অনেকে উত্তর আফ্রিকায় পালিয়ে যান। এভাবেই তখন ইউরোপিয়ান জাতির মানুষের কাছ থেকে স্পেনের ভূমিতে ইসলামকে চিরতরে মুছে ফেলা হয়।

উপসংহার: 

মুসলিম স্পেনের ৯ শো বছরের ইতিহাস সামনে রাখলে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় তা হল:

(ক) মুসলিমরা যখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের শাসন ব্যবস্থা প্রসারিত করেছে তখন নির্যাতনের শাসন থেকে বেঁচে থাকতে অমুসলিমগণ নীরবে সমর্থন জানিয়েছে এবং যারা মুসলিমদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে তারা আল্লাহর সাহায্যে পরাজিত হয়েছে

(খ) মুসলিমদের শাসন ব্যবস্থা যতক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়-নিষ্ঠার উপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা গণ-সমর্থন পেয়েছে, সামাজিক ব্যবস্থা স্থিতি এসেছে এবং তাদের  কর্মকাণ্ড প্রসার লাভ করেছে

(গ) যতক্ষণ পর্যন্ত আঞ্চলিক ও গোত্রীয় জাতীয়তা মুসলিম পরিচিতি ও আদর্শের গণ্ডির আওতাভুক্ত ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সকল সমস্যার ঊর্ধ্বে ইসলামের চিরন্তনী উদারতা ও মানবিক শিক্ষা সার্বিকভাবে উজ্জ্বল ছিল এবং নানান প্রতিকূলতার ভিতরেও ঐক্যের রেখা অনুভূতি বিস্তৃত ছিল

(ঘ) যখনই ব্যক্তি, পারিবারিক, গোত্রীয়, আঞ্চলিক স্বার্থ ইসলামি শিক্ষাকে অতিক্রম করেছে তখনই তাদের অধঃপতন  শুরু হয়েছে। এটা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র দেখা যাবে

(ঙ) ধর্মীয়, পারিবারিক, গোত্রীয় ক্ষমতার কোন্দল সমাজ ও রাজ্যের অন্তর্নিহিত শক্তি একদম নিকাশ করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে একটি দেশ বেশি কাল অতিক্রম করতে পারে না। এটাই হয়েছিল মুসলিম স্পেন, ভারত ও অন্যান্য মুসলিম শাসিত দেশে। এসব থেকে মুসলিমরা আজও শিক্ষা নিতে পারে।

রেফারেন্স:
(ইসলামের ইতিহাসের  ৬০৯ – ১৯৪৮ টাইম লাইনের উপর বেশ কয়েকটি লিখা এখানে পড়তে পারেন।)

বিবিসি নিবন্ধ

 

Comments are closed.