চেনা পথ অচেনা পথিক

জাহিদের মত মানুষদের প্রেমে পড়তে নেই, এ কথা জাহিদ জানে; আর জানে বলেই শিউলির আহ্বান সে এড়িয়ে চলতে চাইছে প্রাণপণে, পাত্তা দিচ্ছে না একেবারেই। সদ্য সমাপ্ত ছাত্র জীবনেও বাস্তবতার শিকলে আটকা পড়ে থাকা জাহিদ কখনও প্রেম-ভালোবাসার জন্য লালায়িত হয় নি। টিউশনি করে নিজের খরচ যোগাড় করতে হয়েছে, কখনও টিউশনির টাকা বাড়িতেও পাঠাতে হয়েছে। এখনও বেতনের টাকার সিংহ ভাগই পাঠাতে হয় সংসারের খরচ মেটাবার জন্য। নিত্য অভাবের সাথে যার সখ্যতা তার কী আর প্রেম করার অবসর জোটে!

সেদিন সকাল সাড়ে দশটায় ক্লাস। একটু সময় হাতে নিয়েই জাহিদ বাসা থেকে বের হয়েছে। তার রুমমেট ম্যারেড ব্যাচেলর হাসান ভাই আর ঢাকা ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র রাসেল আগেই যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেছে। ঘর থেকে বের হয়ে তালার চাবিটা বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকাতেই তার কানে এলো, ‘আরে, যাদু না?’ জাহিদের ডাক নাম যাদু। সেই ছোটবেলায় মা তাকে এই নামে ডাকতো। একটু বড় হলে মা অবশ্য জাহিদ নামে ডাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে একজন তাকে কখনোই জাহিদ বলে ডাকে নি, সে হচ্ছে তার মায়ের মামাতো বোন অনন্যা, জাহিদের অনা খালা।

অনা খালার বিয়ে হয়ে যায় জাহিদ যেবার প্রাইমারীতে বৃত্তি পেয়েছিল সে বছর। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে। হাই স্কুল জীবনে দু’একবার অনা খালার সাথে দেখা হলেও কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে এসে আর কোন যোগাযোগই রাখা হয়ে ওঠে নি। বাড়িতে গেলে মায়ের কাছে অনা খালার কথা জানা হলেও দেখা আর হয় নি কখনও। আজ হঠাৎ এই পরিবেশে আচম্বিতে সেই ‘যাদু’ ডাক শুনে জাহিদ থমকে গেলো, মুহূর্তে সে ফিরে গেলো হারানো অতীতে, ফিরে পেলো সেই ১২/১৩ বছর আগের অনুভূতি। ঘরে তালা লাগাতে ভুলে গেলো জাহিদ, চমকে ফিরে তাকালো। সত্যিই তো অনা খালা দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির গোঁড়ায়, পাশে শিউলি। দৌড়ে যেয়ে অনা খালাকে জড়িয়ে ধরার প্রবল ইচ্ছাটাকে গলা টিপে সামলে নিলো।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জাহিদ, “অনা খালা, তুমি! তুমি এখানে?’’ কথায় কথায় অনেক কথা জানা হয়ে গেলো তাদের। শিউলির বাবা কামরুল সাহেব অনা খালার একটু দূর সম্পর্কের চাচা শ্বশুর। অনন্যা কিছুদিন যাবত কী একটা মেয়েলী রোগে আক্রান্ত হয়েছে, ডাক্তার দেখাবার জন্য এসেছে ঢাকায়, থাকতে হবে বেশ কয়েক দিন। কথার মাঝেই অনন্যার স্বামী নিচে নেমে এলেন, খালুজীকে আগে দেখলেও অচেনাই মনে হচ্ছিল জাহিদের কাছে এতদিন পরে দেখে। নতুন করে পরিচয় হলো। নতুন পরিচয়ের এক পর্যায়ে শিউলি, “আপনি তো তাহলে আমার যাদু মামা, অনা ভাবীর কাছে কত শুনেছি আপনার কথা!” জাহিদ একটু অপ্রস্তুত হলো এ কথায়, “কী শুনেছেন?” “জাদু, ওকে আপনি করে বলতে হবে না, এবার মাত্র অনার্সে ভর্তি হবে, বাচ্চা একটা মেয়ে, ওকে আপনি বলবি কেন?” অনা খালা শাসনের সুরে বললেন।

অনন্যা স্বামীর সাথে বাইরে চলে গেলো, শিউলি গেলো তাদের বাসায়। পুরাতন দিনের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে জাহিদ রাস্তায় যেয়ে একটা রিকশা নিয়ে এগিয়ে গেলো তার কর্মস্থলের দিকে। দুপুরে সব দিনই বাইরে খেয়ে নিতে হয়, রাতের খাবারটা ঘরে। কাজের চাপে সেদিন ফিরতে একটু রাতই হলো। কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসবার প্রস্তুতি নিয়েছে মাত্র, এমন সময় বাড়িওয়ালার কাজের ছেলেটা এসে জানালো যে সাহেব তাকে ডাকছে। খাওয়ার পরে যাবে জানালে ছেলেটা তক্ষুনি যেতে বলেছে জানালো। অজানা আশঙ্কা জাহিদের মনে তখন। বাড়ি ছাড়ার নোটিশ নাকি? তার দুই রুমমেট খেয়ে দেয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল, তারাও এবার উঠে বসলো, “যান না, ভাই, শুনে আসুন”। অগত্যা কী আর করা!

শিউলির আব্বা ড্রয়িং রুমেই ছিলেন, সাদর আহবান জানিয়ে সাথে করে নিয়ে গেলেন সরাসরি ডাইনিং টেবিলে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন শিউলির মা, অনন্যা ও তার স্বামী। জাহিদকে সাথে নিয়ে কামরুল সাহেব চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন, শিউলি ও তার ছোটভাইটাও এসে যোগ দিল তাদের সাথে। হতবিহ্বল জাহিদ সব বুঝেও কেমন এক ঘোরের মাঝে পড়ে গেল। অনা খালার আগমনে বাড়িওয়ালার সাথে আত্মীয়তা, শিউলির সাথে মামা-ভাগ্নির সম্পর্ক গড়ে উঠায় সে কিছুটা স্বস্তিও বোধ করতে লাগলো। খেতে বসে এ কথা সে কথায় পরিবেশ বেশ সহনশীল হয়ে উঠলো জাহিদের কাছে।

*** *** ***

অনন্যা সুস্থ হয়ে ফিরে গেলো। জাহিদের ব্যবস্থা এখন বেশ পাকাপোক্ত। বাড়ি থেকে তাড়া অন্তত খেতে হবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। অনা খালা এসে জাহিদের জন্য বেশ খানিকটা স্বস্তি রেখে গেছে।

*** *** ***

শিউলি জিওগ্রাফি অনার্সে ভর্তি হয়েছে। মাঝে মাঝেই সে এখন জাহিদের সাথে একই রিকশায় করে ইউনিভার্সিটিতে যায়। তাকে নামিয়ে দিয়ে জাহিদ তার ডিপার্টমেন্টের সামনে যেয়ে রিকসা থেকে নামে। কখনও ছুটির দিনে বা বিকেলে কোথাও যেতে হলে শিউলি জাহিদকে সাথে নেবার জন্য বায়না ধরে। জাহিদ সে বায়না সব সময় পূরণ করতে পারে না। শিউলির বাবা-মাও মামার সাথে যেতে দিতে আপত্তি করে না। এক বিকেলে শিউলি জাহিদকে নিয়ে নিউমার্কেটে গেলো। সেখানে নোভেলটি আইসক্রিম নামের এক রেস্তোরায় তারা আইসক্রিম খেলো, জাহিদের শত আপত্তি এড়িয়ে বিল পরিশোধ করলো শিউলি। এমন দামী একটা রেস্তোরায় জাহিদ আগে কখনও ঢুকবার সাহস পায় নি, এত ভালো সুস্বাদু আইসক্রিমও সে আগে কখনও খায় নি। ধনীলোকের মেয়ের সাথে ঘুরতে বের হয়ে এই নতুন অভিজ্ঞতায় জাহিদ কিছুটা বিব্রতও। এরপর বুক প্যালেসে যেয়ে ‘বাণী চিরন্তনী’ নামের একটা বই কিনে জাহিদকে উপহার দিল শিউলি। বাসায় ফিরে বইটা খুলে জাহিদ দেখলো মলাটের পরের সাদা পৃষ্ঠায় পরিষ্কার নিষ্কম্প হাতে লেখা,

“আমরা দু’জনা দুই কাননের পাখি,
একটি রজনী, একটি শাখার শাখী,
তোমার-আমার মিল নাই, মিল নাই—
তাই বাঁধিলাম রাখী।”

শিউলি বইটা কিনে কখন যে এই কথা লিখেছে তা খেয়ালই করে নি জাহিদ।

*** *** ***

বাইরে কোথাও জাহিদের সাথে বেড়াতে গেলে শিউলি সাধারণত: শাড়ি পরে বের হয়। সেদিনও শাড়ি পরে কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ দিয়ে বের হয়েছে সে। রিকশায় সে শাড়ির আঁচল টানতে যেয়ে টের পেলো যে কিসের সাথে যেন আটকে গেছে। জাহিদকে বললো শাড়িটা ছাড়িয়ে দিতে। নেট ধরণের শাড়ি, টানাটানিতে আটকে গেছে ব্লাউজের হুকের সাথে। ছাড়াতে যেয়ে ব্লাউজের হুক গেল খুলে, ভিতরে ব্রার হুক নজরে পড়লো জাহিদের। কি মনে করে সে বললো, “কি যে সব পরো তোমরা, যত সব যন্ত্রণা!” জাহিদের এ কথায় শিউলির কোন ভাবান্তর হলো না, উলটে বললো, “এ সব না পরলে কী আর আপনাদের মন ভরে?” শুনে জাহিদের কান গরম হয়ে উঠলো।

*** *** ***

অবশেষে এলো সেই দিনটি, যে দিনের অপেক্ষায় শিউলি ছিল দীর্ঘ দিন যাবত উন্মুখ। জাহিদের রুমমেট দু’জনের কেউ সেদিন নেই বাসায়। দু’দিনের ছুটি পেয়ে দু’জনেই বাড়িতে গেছে। জাহিদের বাড়িতে যেতে আসতেই লাগে দুই দিন, তাই তার যাওয়া হয় নি। আলসেমি লাগছিল বলে বাইরে বের হতেও ইচ্ছা করছিল না। ওদিকে শিউলির বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে গেছে শিউলির এক ফুফাতো বোনের বিয়েতে। শরীর খারাপের কথা বলে শিউলি সেখানে যাওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। বেলা বারোটা না বাজতেই জাহিদদের কাজের বুয়া রান্না-বান্না সেরে চলে গেছে – বিকেলে এসে বাকি কাজ সারবে বলে।

রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে একটু ঝিমুনির মত এসেছিল, হঠাৎ গায়ে নরম ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে তার তন্দ্রা ছুটে গেলো। বিছানায় তার মাথার কাছে বসে আছে শাড়ি পরিহিতা শিউলি, মুখে মিটিমিটি হাসি! ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল জাহিদ, কিন্তু শিউলি ততক্ষণে তার শরীরের দু’পাশে এমন ভাবে তার দু’হাত রেখেছে যে সে উঠতে পারলো না। শিউলি একটু নিচু হতেই জাহিদ তার বুকের স্পর্শ পেল বুকে, শিউলির নিঃশ্বাস এসে লাগলো জাহিদের মুখে। রেডিওতে তখন বাজছে ‘সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে’! গান শেষ হতেই একটা ছোট্ট ঘোষণার পরই শুরু হলো আবৃত্তি, ‘আমরা দু’জনে স্বর্গ খেলনা গড়িবো না ধরণীতে’। “আজ এত ভালো ভালো গান আর আবৃত্তি হচ্ছে কেন বলেন তো?” বলেই  শিউলি তার মুখের কাছে মুখ এনে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে বললো, “যাই এখন!” এই ‘যাই’ এমন করে বলা, যার অর্থ ‘আরো কিছুক্ষণ থাকি’!

জাহিদের রক্তে তখন নেশা, নতুন কিছু পাবার নতুন কিছু দেখার বাসনা। সে তার দু’হাত বাড়িয়ে শিউলিকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে দিতে চাইলো। শিউলি আপত্তি না করায় সাহসী হয়ে উঠলো জাহিদ। চার ঠোঁটের অবাধ মিলনে দু’জনে তখন স্বর্গদ্বারে উপনীত প্রায়! শিউলির ঠোঁটের লিপস্টিক আর মুখের সব প্রসাধনী ততক্ষণে সব জাহিদের পেটে! অনভ্যস্ত হাতে ব্লাউজ-ব্রেসিয়ারের হুক খুলতে ব্যার্থ জাহিদ তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। শিউলি নিজেই সব হুক খুলে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিল, জাহিদের সামনে উন্মোচিত হলো এক অপার বিস্ময়। অপলক দৃষ্টিতে সে এই অপরূপ রূপ দু’চোখ ভরে দেখলো, তৎপর হয়ে উঠলো তার হাত, মুখ, জিহ্বা। বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই শিউলি বলে উঠলো, “কী সাধু, কোথায় গেল এত সাধুতা?” মুখে তার বিদ্রূপের কুটিল হাসি!

বিরাট একটা ধাক্কা খেলো জাহিদ। সমগ্র পৃথিবী দুলে উঠলো, আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথার উপরে। দু’হাতে জোর করে শিউলিকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো সে, ড্রয়ার খুলে কী যেন একটা হাতে নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে চললো চেনা পথ দিয়ে অচেনা পথিকের মত। বাসার কাছের ছোট্ট পার্কটাতে এসে তার পথ চলা থেমে এলো, এক কোনের একটা বেঞ্চে বসে ড্রয়ার থেকে আনা বস্তুটা সে দু’হাতে খুললো, দুমড়ানো মুচড়ানো একটা কাগজ, যে কাগজটা শিউলি মাটির ঢিলে জড়িয়ে ছুড়ে দিয়েছিল তার ঘরে, যাতে লেখা আছে,

“দিনটা আজ মেঘলা, তাই মন উড়াধুরা
বাইরে বাতাস দিচ্ছে চ্রম রকম ফুরফুরা
এসো প্রেম করি, নইলে কিন্তু ভবিষ্যৎ ঝুরঝুরা
কেমন আছো যাদুটা, আমার মনচুরা?”

কাগজখানাকে টুকরা টুকরা করে ছিড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল জাহিদ।

[শেষের চার লাইন কবিতা চতুর্মাত্রিকের সহব্লগার বাতিঘরের লেখা। তার কাছে এই কবিতা আর পুরো গল্পের আইডিয়ার জন্য আমি ঋণী।]

Loading


Comments

চেনা পথ অচেনা পথিক — 6 Comments

  1. “বলার কিছু নাই, ছিলও না কখনও।”
    তবু নাই বলেও যা বলেছেন তা পড়ে ভাল লাগলো! আরো অসুক। ধন্যবাদ।

  2. বাহ! বড় চমৎকার ঘটনা! এই ভাবেই অনেক ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে থাকে। তাই তো জ্ঞানী লোক বলে পুরুষ মানুষ খালু/মামা হতে পারেনা! {hihihi}
    আরো আসবে এই আশা থাকলো! ধন্যবাদ।

    • পড়েছেন আর মন্তব্য করে উৎসাহিত করেছেন, এ জন্য অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *