এ বছরেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!

সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মহননের পর বিশ্ব মানচিত্রে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কেউ কেউ বলেছেন এটা ছিল সমাজবাদের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়। অনেকের মূল্যায়ন ছিল সমাজবাদের তুলনায় পশ্চিমা পুঁজিতান্ত্রিক গণতন্ত্র বেশি টেকসই। যারা ভাবতেন এটা পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের স্বাভাবিক পরিণতি, তারা যুক্তি দিতেন আদর্শিক কারণেই সমাজবাদ স্বাপ্নিক সমাজের ধারণা দেয়Ñ যার বাস্তবে টিকে থাকার মতো অন্তর্নিহিত কোনো প্রাণশক্তি নেই। এমনও মন্তব্য ছিল, মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো সমাজবাদ অবজ্ঞা করার চেষ্টা করেছে। তাই পরিণতিটা এমন হওয়ারই কথা ছিল।
এই তত্ত্বীয় বিতর্ক একেবারে কুতর্ক নয়। এটা স্বীকার করতে হবে পশ্চিমা মূল্যবোধ যা কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপিত হয় সেটি সমাজতান্ত্রিক বা সমাজবাদী চিন্তার চেয়ে গুণগত বিচারে মন্দের ভালো। যদিও সমাজবাদ-পুঁজিবাদ দুটোই বস্তুবাদের যমজ সন্তান। সাম্যচিন্তার কারণে সমাজবাদের মানবিক আবেদন বেশি, অন্তত পুঁজিবাদের তুলনায়। পশ্চিমা গণতন্ত্র পুঁজির দাসত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। সমাজবাদ রাষ্ট্রের দাসত্বের অবয়বে অল্প লোকের ক্রীড়নক বানায়। তারপরও পুঁজিবাদের নিষ্পেষণ ও শোষণের ভেতর শব্দ করে কাঁদা যায়, সমাজবাদের ভেতর লীন হলে কাঁদাও যায় না। তারপরও মজলুম-জালেমের লড়াই, শাসক-শাসিতের যুদ্ধ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর দ্বন্দ্ব-শ্রেণী সঙ্ঘাতের জায়গাটা শূন্য রাখবে না। নাম সর্বহারা না হোক দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার তাগিদ কমছে না।
বাস্তবে সমাজবাদ সংশোধিত হতে হতে পুঁজিবাদের নিকটতম পড়শি হয়ে উঠেছে। কিন্তু পুঁজিবাদ সৃষ্ট পশ্চিমা গণতন্ত্র ধনতন্ত্রের খোলসও পাল্টায়নি। বড়জোর কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা তৈরি করে দিয়ে কিছু জায়গা ছেড়েছে কিছু স্থান ভোগদখলে নিয়ে পুলিশি রাষ্ট্রের রূপ পেয়েছে। যারা মনে করেন অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সমাজবাদের ধারণাটাই মিলিয়ে যাবে। তারা সবটুকু সত্য বলেন না, অন্তত বাস্তবতা তা শেখায় না। বাস্তবতা বলে, দেয়া নেয়ার ধারায় সমাজবাদ পুঁজিবাদ থেকে একটু বেশি নিলেও সমাজবাদ থেকে পুঁজিবাদ একেবারে কম নিচ্ছে না।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যে দিন আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করল সে দিনই তাদের প্রতীকী লাশের কফিনে পেরেক ঠুকেছিল। ইমাম খোমেনি বলেছিলেন সমাজবাদ বা সমাজতন্ত্রকে একসময় জাদুঘরে খুঁজতে হবে। চীন-রাশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো সেই বক্তব্যটি অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। অন্তত প্রায়োগিক প্রক্রিয়ায় সমাজবাদ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যুগযন্ত্রণার কারণেই তারুণ্য সমাজবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া অবস্থায়। মাওয়ের ক’টি উদ্ধৃতি দিয়ে মাওবাদ ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল। লেনিনবাদের নামে কার্ল মার্কসের চেহারাবিহীন সমাজতন্ত্র দেখালো সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারপরও যখন দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু উপস্থাপন করা যাচ্ছিল না তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভূত দেখানোর একটা চেষ্টা হলো। কার্ল মার্কস পণ্ডিত মানুষ; তার চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছেন যে ক’জন তারাও বিশ্বকে প্রায়োগিক তত্ত্বটা ধরিয়ে দিতে পারেননি। ফল হলো বিপ্লব শেষ পর্যন্ত চে গুয়েভারা, চারু মজুমদার, সিরাজ সিকদার কিংবা ক্যাস্ট্রোর মার্কিনবিরোধী অবস্থানের মধ্যে গিয়ে আটকা পড়ল। সেখানে সাহসী মানুষের উপস্থিতি আছে, কোনো নির্যাস নেই। এখন পর্যন্ত মনে করার যথেষ্ট কারণ আছেÑ সমাজবাদ স্বপ্নবর্জিত হলেও রোমাঞ্চকর মানবিক ভাবনা। চর্চিত গণতন্ত্রের অবস্থান দৃঢ় করে দিয়ে সমাজতন্ত্র আত্মহত্যা করেছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতোই গণতান্ত্রিক সমাজবাদ সোনার পাথর বাটি। তাই সমাজবাদের লড়াকু আদর্শের পথিকৃৎ হয়ে নয়, বেপরোয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাদী আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য রাশিয়ার উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতি চুপসে যাওয়ার পর জায়গাটা কোনো মুসলিম শক্তি নিতে পারেনি। সেটার দিকেই রাশিয়ার দৃষ্টি। ইরাকে ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র পোড়ামাটি নীতি বাস্তবায়ন করে বাহবা পায়নি। লিবিয়ায় আগ্রাসনটা অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। মিসরে মার্কিন নীতির মুখোশটা খসে পড়েছে। সৌদি জোটের স্বরূপটাও স্পষ্ট। একই সাথে ইসরাইলের আকারা পাওয়ার জায়গাটা চিহ্নিত হয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সমাজবাদ ও পুঁজিবাদ হিসেবে তত্ত্বীয় ধারায় আদর্শিক দ্বান্দ্বিক অবস্থানটা গৌণ। বিশ্ব শক্তি হিসেবে কে কার মোকাবেলা করবে, কারা কার পক্ষে থাকলে নিজেদের, রাষ্ট্রের, সরকারের, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মেরুকরণে সুবিধা বাড়বে সেটাই এখন বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির মুখ্য বিষয়। সৌদি আরব প্রভাবশালী দেশ; কিন্তু বিশ্বজোড়া ভাগ-বিভাজনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। তারপরও সৌদি আরব নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে চায় না, সেই সক্ষমতা আছে এমনটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরাও আছে বলে মনে করেন না। বাস্তবে পারস্য সভ্যতার ধারক ইরান, অটোমান সৌর্যবীর্যের উত্তরাধিকার হিসেবে তুরস্ক এখন আলোচনায়। পৃথক পৃথক অবস্থান থেকে তারা প্রভাবক; কিন্তু ব্যাপক অর্থে শক্তিধর নয়। যে শক্তি তাদের রয়েছে তাতে তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এককভাবে অন্যদের মাথা ভাঙতে ও মাথাভাঙা ঠেকানো রোধ করতে পারে না। নিজেদের অবস্থান সংহত রেখে সাহায্য করতে পারে।
সম্প্রতি একটা গুণগত বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। অপর দিকে রাশিয়া ধীরে ধীরে আস্থার জায়গাটা মেরামত করে বন্ধু বৃদ্ধির জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সাড়াও পাচ্ছে। এটি যা না রাশিয়া নির্ভরতা তার চেয়ে বেশি মার্কিন ঝুঁকি কমানোর দায়। ইরান ইমামত ধারার নেতৃত্বের আসনে। অপর দিকে ঐতিহ্যগত কারণে তুরস্ক খেলাফত ধারার পথিকৃৎ। এই দু’টি পড়শি দেশ একক অবস্থান নিলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটা নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারে। আবার শিয়া-সুন্নি বিরোধ কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের আঞ্চলিক ঠিকাদারদের বাড়াবাড়িরও একটা মোক্ষম জবাব মিলে যেতে পারে। এই ধরনের আশাবাদ এক সময় স্বপ্ন ছিলÑ সিরিয়া ইস্যুতে দেশ দু’টির গ্রহণযোগ্য অবস্থান নতুন আশাবাদের জন্ম দিচ্ছে। সুফল যাবে ইরাক, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইয়েমেন-লেবাননের ঘরেও। এর ইতিবাচক গুণগত ফলাফল সুদূরপ্রসারী। আফ্রিকা জাগবে নতুন প্রণোদনায়। মধ্যপ্রাচ্যের সীমা অতিক্রম করে এই বার্তা যাবে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে মরক্কোর রাবাত পর্যন্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে। নতুন অঙ্ক মেলাতে হচ্ছেÑ ভারত-চীনকেও। তাই বিশ্ব রাজনীতির মাঠটা নতুনভাবে সাজবে। হান্টিনটনরা পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্কট বলে এত দিন যা বলে আসছে সেটা হয়তো বিশ্বাসগতভাবে নতুন মাত্রা পেয়ে যেতে পারে।
এটি বিশ্বপরিস্থিতির একটি চিত্র। অন্যটি শুরু হয়েছে বিশ্বাসগত। পাশ্চাত্যে চরম ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়লেও সব দেয়া-নেয়া ও বাস্তবতার সমন্বয়ে দাঁড়াচ্ছে আন্তঃধর্ম সংলাপ সমঝোতায় ঐক্যচিন্তার নবরূপ। একেশ্বরবাদী তিনটি বিশ্বাস কাছাকাছি এসে সে রূপটাই হয়তো দৃষ্টিগ্রাহ্য করবে। তারপরও শঙ্কা কাটছে না। কর্তৃত্ববাদী চিন্তার প্রসার ঘটছে। জনগণের বিশ্বাসও আক্রান্ত। দেশে দেশে বিশ্বাসী জনগণ উপেক্ষিত হচ্ছে। এই চিত্র দুনিয়াজুড়ে, কোথাও বেশি, কোথাও কম। যারা বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা ২০১৭ সালেই বেধে যাবে এবং যুদ্ধের মাঠটা হবে মধ্য এশিয়া কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তাদের মূল্যায়ন অর্থহীন নয়। কারণ, শোষণ-বঞ্চনা মানুষের মন বিগড়ে দেয়। যুদ্ধবাজ ও অস্ত্রবণিকেরা সেটা সুযোগ হিসেবে নেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দাহ্য পদার্থ আছে। আগুন লাগা বিচিত্র নয়। উগ্রবাদ, চরমপন্থী উৎপাত এবং বঞ্চিত কিংবা নিপীড়িত মানুষের রোষ ক্রমবর্ধমান দাহ্য পদার্থ হবে নাÑ এই নিশ্চয়তা কে দেবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ ভাবেনি মাত্র দুই দশক পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলামত অনেকবারই সৃষ্টি হয়েছিল। টানটান উত্তেজনায় বিশ্বপরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারত। পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ চায় না। শান্তি চায়। তা ছাড়া সব সময় শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ ঠেকিয়েছে। তারপরও যুদ্ধবাজ দেশগুলো বারবার অন্য দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর নগ্ন হামলা চালিয়ে যুদ্ধ চাপিয়েছে। নতুন অস্ত্র পরীক্ষার জন্য আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, লিবিয়া, ফিলিস্তিন বারবার আক্রান্ত হয়েছে। তাই পশ্চিমাশক্তি যুদ্ধের স্বাদ মিটিয়েছে আগ্রাসন চালিয়ে। বড় ধরনের ও বিস্তৃত পরিসরে যুদ্ধ বাধায়নি। তা ছাড়া ইউরোপ যুদ্ধের বিভীষিকা দেখেছে। ইউরোপের মাটি নতুন যুদ্ধ চায় না। তারপরও তারা যুদ্ধ চায়, তবে যুদ্ধক্ষেত্রটা হোক এশিয়া বিশেষত মুসলিম কোনো দেশ। জুনিয়র ও সিনিয়র বুশ প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়েছেন অনেক দেশে। কিন্টন-ওবামা নতুন করে যুদ্ধ চাপাননি, মার্কিন নীতি সংযত হয়ে বাস্তবায়ন করেছেন। রাশিয়ার পুতিন শান্তিবাদী নন। ইসরাইল শুধু বর্ণবাদী ও যুদ্ধবাদী নয়, যুদ্ধকে বৃহত্তর আরব জাহানে ছড়িয়ে দিতে চায়। ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত তাদের টার্গেট হচ্ছে।
নতুন মর্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গরম মাথার যুদ্ধবাদী বণিক। পুতিন প্রভাব বিস্তার করে টিকতে চান। ইসরাইল ঐশী গ্রন্থ তৌরাতের অপব্যাখ্যা যেমন করে বর্ণবাদী এবং যুদ্ধনীতিতে বিশ্বাসকে ধর্ম পালনের অংশ ভাবে। চীন যুদ্ধবাদী নয়, কিন্তু তার প্রভাব বলয় ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে ধস নামাতে চাইলে উত্তর দেয়ার পক্ষে। ভারতের জনগণ বর্ণবাদী; কিন্তু যে অর্থে যুদ্ধবাদী সে অর্থে ভারতীয় জনগণ যুদ্ধবাদী নয়। ভারতীয় শাসকদের মনে পড়শিদের সামাল ও নিয়ন্ত্রণের অভিলাষ রয়েছে। আবার শক্তিধর পরমাণু অস্ত্রের দেমাগও আছে। ভারত নিজেদের মানচিত্র নিয়ে কম উদ্বিগ্ন নয়। চীন কান খাড়া করে না রাখলে নেপাল উচ্ছন্নে যেত। শ্রীলঙ্কা আরো উত্তপ্ত হতো। পাকিস্তানের ঝুঁকি বাড়ত। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের নামে যে যুদ্ধ চাপানো হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া সেটা থামার নয়, এমন মতও উপেক্ষার নয়।

[email protected]

Comments are closed.