প্যারেন্টিং এর মূলনীতি

প্যারেন্টিং বিষয়টা খুব বেশী দিন আগে আমাদের মাঝে পরিচিতি পায়নি। যদিও পৃথিবীর শুরু থেকেই বাবা-মায়েরা সন্তান লালন পালন করে আসছেন, কিন্তু এটা যে শেখার মতন একটা বিষয় সেটা আমরা অনুধাবন করেছি মাত্র কয়েক বছর হলো। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, অন্তত এই যুগে পারেন্টিংকে “এমনি এমনি” হয়ে যাবার বিষয় হিসাবে ছেড়ে দেবার কোনো সুযোগ নেই।

প্যারেন্টিং আসলে কি? একটি শিশুর বিকাশে চারপাশের মানুষের যে ভূমিকা তাকেই প্যারেন্টিং বলে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে – It takes a village to raise a child. প্যারেন্টিংএ শিশুর চারপাশের সবাই – তার বাবা -মা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, শিক্ষক অংশ নিলেও এর মূল ভূমিকায় থাকেন বাবা- মা। তাই প্রতিটি বাবা-মায়েরই এই বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরী।

সন্তান লালন-পালন এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিটি পিতা-মাতারই থাকে আকাশ ছোয়া আকাঙ্খা। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সময় উপযোগী সুষ্ঠ এবং সুন্দর পরিকল্পনা থাকে না বললেই চলে। ফলে সন্তান লালন পালনের সার্বিক বিষয়গুলো অনেকটা গৎবাধা নিয়মে অতিবাহিত হয়। সন্তান প্রতিপালন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি, পাঠ্য পুস্তক, যথেষ্ট রিসার্চ, বা বই-পুস্তক না থাকায় বাবা-মায়েরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে চেষ্টা করেন; প্রায়শই ভুল করেন আর তারপর নিজেদের ভুল থেকে শেখেন (যাকে বলে Trial and error)। এভাবে তারা অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে শিখতে দক্ষ হতে থাকেন। একারণেই প্রথম বাচ্চার তুলনায় পরের বাচ্চাগুলোর সময় তারা বেশী পারদর্শীতার সঙ্গে সন্তান প্রতিপালন করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো এভাবে যখন এই মূল্যবান দক্ষতা ও জ্ঞান পরিপূর্ণভাবে তাদের আয়ত্তে চলে আসে ততদিনে বেলা গড়িয়ে যায়; সন্তানরা বড় হয়ে যায়, তাদের উপর এই জ্ঞান খাটানোর আর সময় থাকে না। একারণেই শুধুমাত্র করতে করতে শেখার এই পরম্পরার ওপরে নির্ভর না করে সন্তানের সুষ্ঠ বিকাশের স্বার্থে বরং পিতামাতার জন্য প্যারেন্টিং এর ভালো ও যথাযথ জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকা অতীব জরুরী।

বর্তমানের অনেক পিতামাতাই উপলব্ধি করেন যে তাদের পিতা-মাতা হবার আগেই যদি শিশু প্রতিপালনের জ্ঞান ও কলাকৌশল জানা থাকত তাহলে অনেক ভালো হত; তারা তাদের সন্তানদেরকে আরো বেশি কার্যকরী পন্থায় লালন পালন করতে পারতেন। বেশির ভাগ বাবা-মাই অনুধাবন করেন যে সন্তান লালন-পালনে তাদের আরো বেশি সময় দেয়া প্রয়োজন ছিল। তারা মনে করেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে; এ বিষয়ে আগে জানা থাকলে তারা অতি মূল্যবান এ সময়টাকে আরো অনেক বেশি সম্মৃদ্ধ করতে পারতেন।

এই চাহিদাকে সামনে রেখে শিশুদের লালন পালনে বাবা-মায়েদের জানার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো একজন শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার প্রয়াসেই এই বই লেখা। এটি একটি সিরিজ যাতে থাকবে কয়েকটি পর্ব। বাবা-মায়ের সুবিধার্থে এক একটি পর্বে এক একটি বিষয় তুলে ধরা হবে। এই সিরিজের প্রথম পর্বে প্যারেন্টিং এর মূলনীতি গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মায়েদের ১৫ টি মূলনীতি অবশ্যই মনে রাখতে হবে –

এক : সন্তানের সুস্থ প্রতিপালনের জন্য দরকার জ্ঞান, দক্ষতা , পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি
দুই : সন্তানের জীবনের মূল প্রভাবকগুলোকে জানুন
তিন: প্রান্তিকতা বর্জন করুন – মধ্যমপন্থা অবলম্বন করুন
চার: সবসময় মনে রাখুন শিশুরা আপনার আচরণকে অনুকরণ করছে।
পাঁচ. বাচ্চার সবথেকে বেশী প্রয়োজন আপনার সময়ের
ছয়: বাচ্চার সঙ্গে নিয়মিত বই পড়ুন
সাত : সমালোচনা নয়, প্রশংসা কে ব্যবহার করুন
আট: বাচ্চাদের ভুল করতে সুযোগ দিন ও ভুল থেকে শিক্ষা নিতে দিন
নয়. বাচ্চার সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-চারিতা চালিয়ে যান
দশ: সন্তানদের নিজেদের কাজ নিজেদের করতে দিন, সংসারের কাজে অংশ নিতে দিন
এগারো: সন্তানকে পরিবারের অন্যান্যদের সাথে আপনার প্রতিযোগীতার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবেন না
বারো: সন্তানের বন্ধু নির্বাচনে সহযোগীতা করুন
তেরো: আপনার সন্তানের জীবনে বড় ও সার্থক হওয়া জরুরী, কিন্তু তার থেকেও বেশী জরুরী মানুষ হওয়া
চৌদ্দ: প্যারেন্টিং এর মূলমন্ত্র হলো – ধৈর্য ও অধ্যবসায়
পনেরো: সন্তানদের জন্য দোয়া করুন ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করুন

Comments are closed.