আধুনিক কবিতা সম্পর্কে দু’টি কথা

যারা আধুনিক ধারার কবিতা ছাড়া কিছুই বোঝেন না তাঁদের মধ্যে এক জাতীয় ঊন্নাসিকতা কাজ করে। তাঁদের মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দু’টি কথা বলতে চাই; আধুনিক কালের দু'একজন নামকরা কবির ‘ক্রেজে’ পড়ে যদি আমার গর্ব আমার অহংকার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, মধুসূদনকে ভুলে যেতে হয় সে কবিতা আমরা চাই না। আধুনিকতা ছাড়া কি মানুষের ট্রেডিশন বলে কিছু নেই? যত আধুনিকই হই না কেন রাতারাতি বদলানো যায় না, তেমন চাওয়াটাও অন্যায়। তবে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবো। শিল্প-সংস্কৃতি বা কবিতার ধারাকে বাঁধ দিয়ে আটকানো যায় না, আর তা উচিৎও নয়। আধুনিক হবো বলে প্রতিদিনই কি ফাস্টফুড খাবো, ডালভাত ভুলে যাবো, ভুলে থাকতে পারবো কি?

'সুররিয়েলিজম' ধারার আধুনিক কবিতা যা কেবলই বিমূর্ত ভাব রেখে যায় তা মোটে মূর্ত হতে চায় না। এক একজন তার এক একরকম ভাব ও অর্থ করেন! ‘পরাবাস্তব’ কিংবা ‘অধিবাস্তব’ এসব তো সাধারণ পাঠকের বোঝার কথা নয়! হয়তো অনেক উঁচু ভাবধারার লেখা কিন্তু তা কি আদৌ গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে? সেসব কবিতার ক’জন সমঝদার আছেন? এমন কিছু বানী তো নজরুলও রেখে গেছেন – “আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি…” অথবা “মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল, কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথীর চৈতি চাঁদের দূল…” ইত্যাদি। জীবনানন্দ, কবিগুরুও কি তেমন সৃষ্টি রেখে যাননি? খুঁজলে তেমন অনেকের মাঝেই পাবো। আমাদের ট্রেডিশনাল কবিতা শতভাগ পাঠক বুঝতে পারেন, উপভোগ করেন আর জীবন বিধানে তা রপ্তও করেন। সেখানে কিছু টেক্সট থাকে যা কিছু পরিস্কার ম্যাসেজ দিয়ে যায়। কিন্তু আধুনিক কবিতা সেখানে পাঁচভাগ উচ্চশিক্ষিত মানুষই বুঝতে পারেন কি না আমার সন্দেহ। অন্ততঃ আমি ভাল বুঝি না। এমন কবিতা লিখলাম যা একমাত্র কবি ছাড়া আর কেউ বুঝলোই না (কতক ক্ষেত্রে কবি নিজেও বোঝেন কি না সন্দেহ আছে) তাহলে কি কবি নিজে গিয়ে বুঝিয়ে আসবেন?

তাই আমি 'সুররিয়েলিজম কবিতা'য় বলেছি:

"কবিতার পাতা আমার জড়ানো অনেক

উঁচু মার্গের ভাবধারায়

যা কিছু লিখি সব যেন লাগে কেমন ধামাধরা

আমিও কি বুঝি ছাই, সব কিছু তার?"

আধুনিক কবিতার ধরণ ধারণ দেখে 'কবিতার কড়চা'য় লিখেছিলাম:

"রঙ মেখে কেঁচোগুলো ভাসালাম পর্দায়

গান কি না কাব্য তা; সৃষ্টিটা বুঝা ভার।

হাত নেই পা নেই তবু যেন কিভাবে

ছবি এরা এঁকে যায়, ফুটে উঠে কবিতা!"

নিজেও আধুনিক স্টাইলে লিখতে চেষ্টা করি তবু ট্রেডিশনকে কোন ভাবেই পাশ কাটাতে পারি না, পারবোও না। কারণ গায়ের গন্ধের মতই ওটা যে আমার জীবনে মিশে আছে? ময়ূরপূচ্ছ ধারণ করলেই কি কাক রাতারাতি ময়ূর হয়ে উঠতে পারে? যে শিল্প গণমানুষের কাছে দূর্বোধ্য সে শিল্প যত দামীই হোক তা তেমন আবেদন কিংবা অবদান রাখতে পারে না। তা অচীরেই নতুন অধুনিকের কাছে পুরনো হয়ে যাবে নিশ্চিত। অনেকেই আমরা জাত কবি নই, মনের আনন্দের জন্য যে যার মত কাব্যচর্চা করছি মাত্র। চাইলেই নিজে কবি হওয়া যায় না, ওটা প্রকৃতির দান। আমরা কেবল তার শিকড়ে জল সিঞ্চন করতে পারি, পরিচর্যা করতে পারি মাত্র।

কবিবর শিমুল শুভ্র'র মতই বলতে চাই –

আসুন কবিতায় হাসি, কবিতায় ভাসি।

সবাইকে ধন্যবাদ।

Loading

অনিরুদ্ধ বুলবুল

About অনিরুদ্ধ বুলবুল

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। আমি সেই সমাজেরই অংশ। যে সমাজে বাস করছি সেই সমাজের উন্নয়ন আমার স্বপ্ন। সমাজের যেকোন অনিয়ম অসংগতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ইচ্ছা হয়; সুযোগ পেলে সমাজটাকে বদলিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলি। সমাজের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের কিছু ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও মতামত উপস্থাপন করে সমমনা পাঠকেদের সাথে তা শেয়ার করার মানসে মাঝে মাঝে কিছু লিখি। তাতে সমাজের সামান্যতম উপকার হলেও নিজেকে ধন্য মনে করি।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *