আধুনিকতার শত্রু বা “কাবাবে হাড্ডি”

আজ আধুনিক সভ্যতা বলতে আমরা পশ্চিমা বিশ্বের সেকুলার সভ্যতাকে বুঝাই এবং এর  প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্র।  আধুনিক সভ্যতার এই যুগে একজন  সভ্য মানুষ হিসাবে বিশেষকরে একজন মুসলিম হিসাবে আসুন আমাদের “ওয়ার্ল্ড ভিউটা” (World View)কি বা কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে একটু আলোচনা, পর্যালোচনা করা যাক।  এ বিষয়টা যদিও দার্শনিক ও ব্যবহারিক বাস্তবতার দিক সহ দুটি মাত্রায় পরিবেষ্টিত এবং এর বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে তবু আমি চেষ্টা করব লিখাটা যথা সম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতে।
বর্তমান সভ্যতার মেইনস্ট্রিম সমাজের কাছে ধর্ম বিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই বাস্তব জীবনের চলার পথে যেমন  দৈনন্দিন আচার আচরণে কারো ধর্ম বিশ্বাসের গুরুত্ব না দেয়াটই আধুনিকতার লক্ষণ অর্থাৎ এটাই বর্তমান আধুনিক সভ্যতার প্রত্যাশিত আদর্শ। অতএব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তির কাছে ধর্মের ব্যাপারে কোন আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে ধর্মকে কেন আধুনিকতার শত্রু বা “কাবাবে হাড্ডি” মনে করানো হয়েছে তা জানা দরকার বিশেষকরে মুসলিম হিসাবে নিজের ঈমান তথা বিশ্বাসকে সঠিক অবস্থানে রাখতে অবশ্যই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

ধর্মকে কেন বিসর্জন দেয়া হল?

আজকাল মুসলিম দেশের পাশ্চাত্য শিক্ষার সেকুলার সুশীল সমাজে একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই যে,”ওরা আমাদেরকে মধ্য যুগীয় বর্বরতায় ফিরিয়ে নিতে চায়” বিশেষ করে কেউ যখন ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক সমাজ সংস্কারের কথা বলেন। অবশ্য সেকুলার মনোবৃত্তি প্রসারিত করতে এ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব আমাদের জানা উচিত মধ্যযুগে আসলেই কি হয়েছিল এবং কেনই বা পশ্চিমা জগত তাদের ধর্মকে বিসর্জন  দিল?

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মধ্যযুগে পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হত পাদ্রী শাসনে এবং ধর্মের নামে তখন চলত কুসংস্কার,অত্যাচার,অবিচার। তখনকার সামন্তবাদী  ও পাদ্রী শাসকরা ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ঘোর বিরোধী। সে যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  তাই সে যুগকে “অন্ধকার যুগ” (Dark Age)বলা হয়।

The Middle Ages are often said to be ‘dark’ because of a supposed lack of scientific and cultural advancement. During this time, feudalism was the dominant political system. The feudal system of labor hindered upward social mobility, which basically means that poor people had very little opportunity to improve their condition in life. Religious superstition was also widespread during this time. The Catholic Church was extremely institutionalized, and often opposed the scientific and cultural advancements the Greeks and Romans had pioneered. The ‘Dark Ages’ were a difficult time in which to live: famine and disease were common. The ‘Black Death’ bubonic plague devastated Europe in the late 1340s, killing an estimated 100-200 million people. Warfare was also a part of everyday life. The Europeans and the Muslims of the Arab world fought numerous conflicts. These conflicts, called the Crusades, began in 1095 and ended in 1291. The ‘Dark Ages’ have often been described as a ‘backwards’ time in human history.তথ্য লিংক।

তবে ইতিহাসের সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা কিন্তু ছিল ভিন্ন। ইসলামের ইতাহাসে তখনকার যুগকে বলা হয় স্বর্ণ যুগ (তথ্য লিংক)। ১৫০০ শতাব্দীর দিকে ইউরোপে যখন  রেনেসাঁ অন্দোলন শুরু হয় তখন থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সেই অন্ধকার যুগের  অবসান ঘটে । আবার ইতিহাস বলে ইউরোপের এই  রেনেসাঁ অন্দোলনেও  ইসলামী সভ্যতার  জ্ঞান বিজ্ঞানের ও সুস্থ চিন্তার  অন্যতম প্রেরণা ছিল (বিস্তারিত তথ্য লিংক)

যেহেতু ধর্মের নামে শত শত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে ছিল এবং পাদ্রীদের কুশাসনে মানুষের জীবন ছিল বিপর্যস্ত  তাই রেনেসাঁ উত্তর সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মকে বিসর্জন  দেয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রযুক্তির উন্নয়নে কিভাবে দুনিয়ার বস্তুতান্ত্রিক জীবনকে সহজ ও উপভোগ্য করা যায় সেটাই ছিল সবার কাম্য। আর এ  প্রযুক্তির উন্নয়নে ইউরোপিয়ানরা সামরিক শক্তিতেও শক্তিশালী হতে থাকে এবং সেই সাথে তখনকার  শাসকগুষ্টির মনে জাগে সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা। শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ও বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মুসলিম দেশ দখলের অভিযান। বাকি ইতিহাস কম বেশী সবারই জানা। তবে আজ প্রত্যক্ষ উপনেবেশিকতার অবসান হলেও  পরোক্ষভাবে তাদের প্রভাব এখনও বিদ্যমান।

মুসলিমদের হীনমন্যতা ও ইসলামে উদাসীনতা।

মুসলিম দেশে শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে গড়ে উঠেছে এক ধরনের এলিট গুষ্টি যাদের কাছেও ইসলাম  একটি কালচারাল বা সাংস্কৃতিক ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। ইসলামের আদর্শ ও দর্শন বুঝার চেয়ে কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করাটাকেই তারা যথেষ্ট মনে করেন। পশ্চিমা দেশের চাকচক্য এবং বিলাস বহুল জীবনযাপন করতে পারাটাই তাদের জীবনের লক্ষ্য। যার ফলে তাদের চরিত্র ও নৈতিকতা এত দেউলিয়া যে তাদের কাছে দেশ প্রেমের চেয়ে নিজেদের বিলাস বহুল জীবনযাপনই মুখ্য।এর প্রয়োজনে দেশের সম্পদ লুট,ঘুষ,কমিশন খাওয়া ও দূর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি যাবতীয় কুকর্ম করাটাই তারা গ্রহনযোগ্য প্রথা মনে করে।ফলে সমাজে দুর্নীতি ক্যান্সার আকারে বিস্তার লাভ করছে।

মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতা

আমাদের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মুসলিম সমাজের অনুন্নতি বা পশ্চাৎপদতার কারণ পশ্চিমাদের মত লাইফ-স্টাইল গ্রহণ করতে না পারা। আর সে জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তারা যেভাবে ধর্মকে বিসর্জন দিয়েছে আমাদেরকেও তা করতে হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের ধর্ম ত্যাগের প্রেক্ষাপট ও তাদের ধর্মের সমস্যা আর মুসলিমদের অবস্থা এক নয়।আমাদের ধর্মের কোন সমস্যা নাই সমস্যা হচ্ছে ধর্মকে সঠিকভাবে বুঝার। আমাদের সভ্যতার ভিত্তিই ছিল আমাদের ধর্ম তথা ইসলামী আদর্শের অনুসরণ। আরবের একটি জাহেল সমাজে ইসলাম এসেই তাদেরকে একটি সফলকাম জাতীতে পরিণত করেছিল। ইসলামের ইতিহাসের কোন বিজ্ঞানীকে অত্যাচার করা হয় নাই যেমনটি হয়েছে পশ্চিমা দেশে 

ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ বা কোন অত্যাচারী রাজা বাদশাহ অত্যাচার করতে পারলেও ধর্মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে মানুষের উপর অত্যাচারের ইতিহাস ইসলামে নাই যা ইতিমধ্যে উপরের আলোচনায় এসেছে। আর আধুনিক কালে কোন দেশে অত্যাচারী শাসক থাকলেও তার পিছনে পরাশক্তির সেই পুরাণো সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র দায়ী।

তাই ইতিহাস স্বাক্ষী পশ্চিমা সেকুলার সভ্যতার রেকর্ডও তেমন সুখকর নয়।এ সভ্যতায় ইতিমধ্যে দুটা বিশ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে যাতে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।(কেবল ২য় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়) এটম বোমা দিয়ে জাপানের দুটি বৃহৎ শহরকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।যা অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ হত্যর ইতিহাস
 

আর তারই ধারাবাহিকতায় আজও  চলছে মুসলিম দেশগুলাতে মানুষ নিধন!

সেই সাথে মুসলিম দেশের ধ্বংস লীলায় জড়িত মুসলিম সমাজের কায়েমি স্বার্থ-বাদী ঐসব সেকুলার নেতৃত্ব।এরাই সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে দেশে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও সুস্থ মানসিক চিন্তায় বাঁধা দেয়।এদের পুঁজি হল কিছু সস্তা বুলি ও আবেগের ফুলঝুড়ি।এখানে ইসলামের কোন দুষ বলা যাবে না।তবে এটা ঠিক আজকাল ইসলামকে যারা রিপ্রেজেন্ট করার দাবী করেন বা ভূমিকা রাখছেন তাদের দুর্বলতাও কম নয়।

তাই আমাদের ওয়ার্ল্ড ভিউটা হওয়া উচিৎ ইতিহাসের সঠিক তথ্যের উপর এবং সুস্থ ও সঠিক মানসিকতা নিয়ে।এখানে তথাকথিত “মুক্ত চিন্তা” নয় বরং “সুস্থ চিন্তাই” হচ্ছে আসল বিষয়।অতএব মুসলিমদেরকে এগিয়ে আসতে হবে ধর্মকে বিসর্জন করে নয় বরং সত্য ধর্মের তথা ইসলামী আদর্শের সঠিক অনুসরণে ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সমন্বয়ে।একটি নূতন সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে যেখানে থাকবে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সকল মানুষের কল্যাণ।তবে কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গি পদক্ষেপে এটা কখনই সম্ভব নয়।মনে রাখতে হবে যারাই সন্ত্রাসী বা জঙ্গি পথে চলতে চায় তারা আসলে ইসলাম বা মুসলিমের পক্ষের শক্তি নয়।

Reference :
1) http://en.wikipedia.org/wiki/Islamic_Golden_Age
2)http://study.com/academy/lesson/the-dark-ages-definition-history-timeline.html
3) http://www.regentsprep.org/regents/global/themes/goldenages/islam.cfm
4) The Inquisition’s injunction against Galileo, 1616

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *