খালেদা জিয়ার সংগ্রাম

বিএনপির চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এখন খুব কঠিন সময় পার করছেন। জানুয়ারি ২০০৭-এ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া, তার পরিবার ও পার্টি বিএনপির ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসে তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ২০০৮-এ তার দুই ছেলেই সপরিবারে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। বড় ছেলে তারেক রহমান ছিলেন গুরুতর আহত। তিনি যান লন্ডনে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন অ্যাজমা রোগাক্রান্ত। তিনি যান থাইল্যান্ড ও পরে মালয়েশিয়ায়। ডিসেম্বর২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবার পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা সরকার নিতে থাকে। নভেম্বর ২০১০-এ আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধভাবে খালেদা জিয়ার ৪০ বছরের বাসভবন থেকে তাকে উচ্ছেদ করে। জানুয়ায়ারি ২০১৪-এ ভোটারবিহীন নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবার পর খালেদা জিয়ার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

জানুয়ারি ২০১৫ থেকে তিনি গুলশানে তার অফিসে অবরুদ্ধ হন (টাইমলাইন দেখুন)। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় মালয়েশিয়ায় আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু হয়। ব্যক্তিগত জীবনে নানামুখী বিপর্যয়ের পর আবারও খালেদা জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেশব্যাপী দৃঢ়ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিপূর্বে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন (১৯৮২-১৯৯০) অবসানের লক্ষ্যে খালেদা জিয়া প্রথমবার দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সফল হয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ অকালবিধবা এক গৃহিণী নিজেকে রূপান্তরিত করেছিলেন সফল দেশনেত্রী রূপে। ১৯৯১-এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৯৬-এ তিনি দেশের মানুষের আরেকটি আকাক্সক্ষা, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করেছিলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে সসম্মানে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর পরই ২০০১-এ দেশবাসী তার দল বিএনপিকে বিপুলভাবে ভোট দিয়ে তাকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী করে।

এরপর ২০০৭-এ সেনাসমর্থিত সরকার এবং ২০০৮ ও ২০১৪-র আওয়ামী লীগ সরকার বহু চেষ্টা করেছে সারা দেশ জুড়ে গভীরভাবে প্রোথিত খালেদা জিয়ার এই অসাধারণ জনপ্রিয়তার শিকড় উপড়ে ফেলতে। আগের তুলনায় খালেদা জিয়াকে এখন আরো অনেক বেশি প্রতিকূল অবস্থায় সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া। নিজের অফিসে অবরুদ্ধ হওয়া, বিভিন্ন সময়ে টেলিফোন, ইলেকট্রিসিটি, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কেবল টেলিভিশন কানেকশন প্রভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, পুত্র বিয়োগে কাতর হওয়া, জলকামান থেকে মরিচ পানিতে (পেপার স্প্রে) আক্রান্ত হওয়া, হয়রানিমূলক মামলায় হাজির হওয়া, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া এবং অতি অসভ্য, অশালীন ও অশুদ্ধ ভাষায় আওয়ামী নেত্রী-নেতা দ্বারা চরিত্র হননের শিকার হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত সফল, তার দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ফলে দেশবাসীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিরাজ করছেন। যে দেশে নারী হয়ে জন্ম হওয়ার ফলে প্রথম থেকেই বিবিধ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়, সেই বাংলাদেশে কিভাবে সর্ববিধ প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হতে হয় সেই শিক্ষা ও প্রেরণা এখন দিচ্ছেন সাহসী সর্মুদ্যত সংগ্রামী নারী খালেদা জিয়া।

সবিস্ময়ে দেশবাসী লক্ষ করছে সংগ্রামের ডাক দিয়ে এই নেত্রী আত্মসমর্পণ করেননি বরং তিনি মানুষের পাশে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সশ্রদ্ধচিত্রে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে গুলশান কেল্লায় অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার নিরস্ত্র সংগ্রাম। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ঘটছে সহিংস সরকারের বিরুদ্ধে এক অহিংস আন্দোলনকে বিজয় করার লক্ষ্যে নেত্রীর নতুন ধরনের কৌশল। পার্টি কর্মী-সমর্থকদের অটল আনুগত্য এবং জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপানসহ অন্তত ১৬টি দেশের পরোক্ষ সমর্থন।
এসব কারণে খালেদা জিয়ার এই পুনরুত্থান দেশ ও বিশ্ববাসীর প্রচণ্ড আগ্রহের বিষয় হয়েছে।
তাহলে জেনে নিন খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস ৭ মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত।

প্রথম জীবন

খালেদা জিয়ার জন্ম হয়েছিল ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে একটি সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারে। তার পিতা ছিলেন ইস্কান্দার মজুমদার। মাতা ছিলেন তৈয়বা মজুমদার। এই পরিবারের আদি বাড়ি ছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ফেনী জেলায়। খালেদা জিয়ার ডাক নাম ছিল পুতুল। তার বড় এক বোন এবং ছোট এক বোন ও দুই ভাই ছিল। পিতা বিত্তশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। ভাইবোনের জীবন আনন্দ ও সুখের ছিল। খালেদা লেখাপড়া করেন দিনাজপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে বেগম খালেদা জিয়া

২৫ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি হামলা শুরু করে। এই সময়ে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে কর্মরত। সেই রাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশরূপে ঘোষণা করতে হবে। সেই লক্ষ্যে তিনি তার অধীনস্থ ও অনুগত সামরিক অফিসারদের ডেকে বলেন, উই রিভোল্ট (We revolt)। আমরা বিদ্রোহ করলাম।
দেশের অন্যান্য অংশে কর্মরত আর্মি, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস), পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও একযোগে বিদ্রোহ করেন। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। জিয়াউর রহমান ছিলেন এক নাম্বার রণাঙ্গনের অধিনায়ক জেড ফোর্সের প্রধান। প্রায় ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলার পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশরূপে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়। এই যুদ্ধে ভারত সার্বিকভাবে সাহায্য করে মুক্তিকামী বাংলাদেশের মানুষকে।

স্বাধীনতার পর জুন ১৯৭২-এ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান হন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন এবং তার বাকশাল সরকারের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ হন নতুন প্রেসিডেন্ট। ২৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ তিনি জিয়াউর রহমানকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করেন। ৫ নভেম্বর ১৯৭৫-এ মোশতাক পদত্যাগ করেন। ৭ নভেম্বর ১৯৭৬-এ নতুন প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি এ এস এম সায়েম। একই দিন তিনি জিয়াউর রহমানকে অন্যতম মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করেন এবং জিয়াউর রহমান হন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।

দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পত্রপত্রিকার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এই লক্ষ্য পূরণে সহায়করূপে তিনি একটি রাজনৈতিক দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ৩ জুন ১৯৭৮-এ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। তার বহু সাফল্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করা। পূর্ববর্তী ও পতিত আওয়ামী লীগ ও বাকশাল শাসনামলে বাংলাদেশ মাসের পর মাস যে দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে তিনি দেশকে মুক্ত করেন।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

৩০ মে ১৯৮১-এর রাতে চট্টগ্রামে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন। তিনি তখন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। খালেদা জিয়া তার দুই শিশু ছেলেসহ ছিলেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে তাদের বাসভবনে। আগে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এমনকি কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে তাকে বেশি দেখা যেত না। আগস্ট ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেও খালেদা লাজুক গৃহবধূরূপে তার দুই ছেলে তারেক রহমান (ডাকনাম পিনো) এবং আরাফাত (ডাকনাম কোকো)-কে নিয়ে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তদানীন্তন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসন হন।

২৪ মার্চ ১৯৮২ সালের ভোরে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি সামরিক ক্যুর মাধ্যমে বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর দলীয় রাজনীতিতে বিচারপতি সাত্তার প্রভাবহীন হয়ে পড়েন।

তখন থেকে বিএনপির মধ্যে চাপ সৃষ্টি হয় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিমুখী করতে। বিচারপতি সাত্তার রাজনীতি থেকে অবসর নিলে ১২ জানুয়ারি ১৯৮৪-তে খালেদা জিয়া হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। ১ মে ১৯৮৪-তে তিনি হন বিএনপির চেয়ারপারসন। ১০ জানুয়ারি ২০১০-এ তিনি চেয়ারপারসন পদে পুনর্নির্বাচিত হন।

সংসদীয় নির্বাচনে সম্ভবত বিশ্ব রেকর্ড
পাচটি সাধারণ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার প্রাপ্ত ভোট ২৫ লক্ষের বেশি!

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১

ফেনী-১ ৩৬,৩৭৫ বগুড়া-৭ ৮৩,৮৫৪ ঢাকা-৫ ৭১,২৬৬ ঢাকা-৯ ৫৫,১৪৬ চট্টগ্রাম-৮ ৬৯,৪২২
মোট : ৩১৬,০৬৩

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
ফেনী-১ ফেনী-২ বগুড়া-৭ রাজশাহী-২ সিরাজগঞ্জ-২

নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ এবং নিম্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে ১৫ ফেব্রুয়ারি ’৯৬ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা জানা যায়নি। বলা হয়, এই নির্বাচনের কোনো রেকর্ড তাদের সংরক্ষণে নেই। ফলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

১২ জুন ১৯৯৬

ফেনী-১ ৬৫,০৮৬ বগুড়া-৬ ১৩৬,৬৬৯ বগুড়া-৭ ১০৭,৪১৭ লক্ষ্মীপুর-২ ৫৯,০৫৪ চট্টগ্রাম-১, ৬৬,৩৩৬
মোট : ৪৩৪,৫৬২

১ অক্টোবর ২০০১

ফেনী-১ ১০৩,১৪৯ বগুড়া-৬ ২২৭,৩৫৫ বগুড়া-৭ ১৪৭,৫২২ লক্ষ্মীপুর-২ ১২৩,৫২৬ খুলনা-২ ৯১,৮১৯
মোট : ৬৯৩,৩৭১

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮

ফেনী-১ ১১৪,৪৮৩ বগুড়া-৬ ১৯৪,৭৬৭ বগুড়া-৭ ২৩২,৭৫৮
মোট : ৫৪২,০০৮

২০০১ সালে নিবাচনে ভোট দিচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া

হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৭.০২.১৯৯১ থেকে ২৯.১২.২০০৮ অনুষ্ঠিত পাচটি নির্বাচনের মধ্যে চারটি নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ২০ লাখ (মোট ১,৯৮৬,০০৪) ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ, গড়ে প্রতিটি আসন থেকে তিনি পেয়েছেন (১,৯৮৬,০০৪গু১৮= ১১০,৩৩৩) ভোট। এই গড় হিসাবে যদি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা হয় (৫´১১০,৩৩৩=৫৫১,৬৬৫) এবং সেটা যদি যোগ করা হয় তাহলে প্রাপ্ত মোট ভোটের সংখ্যা হবে (১,৯৮৬,০০৪+৫৫১,৬৬৫=২,৫৩৭,৬৬৯) অর্থাৎ, পচিশ লাখের বেশি! সম্ভবত এটি সংসদীয় নির্বাচনে একটি বিশ্ব রেকর্ড।

আপসহীন নেত্রী

১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি সাতদলীয় জোট গঠন করে এবং জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম শুরু করে। খালেদা জিয়া ৯ বছরব্যাপী আন্দোলনে এরশাদের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারের সাথে আপস করেননি। অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তাই তখন তার নাম হয় আপসহীন নেত্রী। খালেদা জিয়া তার নীতিতে অবিচল থাকেন।

এরশাদ সরকার তখন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞামূলক আইন প্রয়োগ করে খালেদা জিয়ার গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখে। এতে খালেদা জিয়া দমে যান না। এরশাদ সরকার উৎখাত আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে যেতে থাকেন। অপর দিকে আওয়ামী লীগসহ অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় জেনারেল এরশাদ তার শাসনকে একটি বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক চেহারা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এরশাদ বিভিন্ন নির্বাচনের আয়োজন করেন। কিন্তু তার শাসনামলে সব নির্বাচন খালেদা বয়কট করেন। এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে খালেদা জিয়া তিনবার গ্রেফতার হন। এতে এরশাদের লাভ হয় না।

খালেদা জিয়ার দাবির যথার্থতা ক্রমেই মানুষ বুঝতে থাকে। শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বুঝতে পারে এরশাদ সরকারের সাথে নৈকট্যের দরুন তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। ফলে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগও বাধ্য হয় এরশাদ হঠাও আন্দোলনে যোগ দিতে।
দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০-এ জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে সাহাবুদ্দীন সরকার একটি বহু প্রতীক্ষিত সংসদীয় নির্বাচনের আয়োজন করে। এ নির্বাচনে বৃহত্তম দলরূপে বিএনপি আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়া পাচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পাচটি আসনেই বিজয়ী হন। এই অসাধারণ সাফল্যের পুনরাবৃত্তি তিনি করেন পরবর্তী সব নির্বাচনেও। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এর নির্বাচনে তিনটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ঢাকার দু’টি আসনে পরাজিত হন। এভাবেই বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা যে সবার ওপরে তা বারবার প্রমাণিত হয়।

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদ

[২০ মার্চ ১৯৯১ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬]
৬ আগস্ট ১৯৯১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের দ্বাদশ সংবিধানের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথমবার শপথ গ্রহন

প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদ

[২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৯৬]
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদীয় নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন বয়কট করেছিল। খালেদা জিয়া পরপর দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। এই সংসদের আয়ু ছিল অল্প এবং এই সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আইন পাস হয়। ২৫ মার্চ ১৯৯৬ সালে এই আইন কার্যকর হয়। ১২ জুন ১৯৯৬-এ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১১৬টি আসনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি হয় দেশের সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল। সহযোগী দলগুলোর সমর্থনে শেখ হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদ
[১০ অক্টোবর ২০০১ থেকে ২৯ অক্টোবর ২০০৬]
জুন ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়া এবং দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন হারাতে থাকে। এক পর্যায়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (সংক্ষেপে টিআইবি, ঞওই) একটি রিপোর্টে দাবি করে, বিশ্বে যেসব দেশে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হয় সেই সূচকের তালিকায় বাংলাদেশ এক নাম্বারে আছে।

এ অবস্থার পরিবর্তন এবং ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্যে ৬ জানুয়ারি ১৯৯৯ সালে বিএনপি একটি চারদলীয় জোট প্রতিষ্ঠা করে। ১ অক্টোবর ২০০১-এর নির্বাচনে এই জোট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। খালেদা জিয়া তৃতীয়বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন।

১১ জানুয়ারি ২০০৭-এর পরে

এর আড়াই মাস আগে ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা লাঠি-বৈঠা-লগি নিয়ে ঢাকার রাজপথে এক ভয়ঙ্কর সহিংস আন্দোলন শুরু করে। সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারূপে আওয়ামী লীগ মেনে নেয় না। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সশস্ত্র বাহিনীর একাংশ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। তবে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যান। ২২ জানুয়ারি ২০০৭-এ যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা স্থগিত হয়ে যায়। ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ যে আর্মি ক্যুর ফলে এসব ঘটে যায় সেটি এখন ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত।

এরপর ১২ জানুয়ারি ২০০৭-এ নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ শপথ গ্রহণ করেন। খালেদা জিয়া সঠিক অনুমান করেন বেসামরিক মুখোশ পরানো ফখরুদ্দীন আহমদের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে আছে আর্মি চিফ জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে সমর্থন দানকারী সামরিক বাহিনীর একাংশ। খালেদা জিয়া বোঝেন দেশে একটি সামরিক ক্যু হয়ে গেছে। তাই তিনি সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত ফখরুদ্দীন আহমদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এটি ছিল তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, সময়োচিত ও খুব সাহসী সিদ্ধান্ত।

ফখরুদ্দীন-মইন সরকার যেটি নিজেই ছিল অবৈধ তারা অবৈধভাবে টার্গেট করে তাদের ধারণায় দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের এবং বিশেষ করে বিএনপির ছোট-বড় পলিটিশিয়ানদের। ৭ মার্চ ২০০৭ সালে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এবং ১৬ এপ্রিল ২০০৭-এ ছোট ছেলে আরাফাত রহমান গ্রেফতার হন।

খালেদা জিয়ার মেয়াদের শেষাংশে মিডিয়ার একটি অংশ তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলা অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে (খালেদা ও হাসিনা) চিরবিদায় দেয়ার পক্ষে বিরামহীন প্রচার শুরু করে। তাদের প্ল্যান ছিল, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে চিরনির্বাসনে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের দুই পার্টি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছু সংস্কার করে অনুগত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে বসাতে হবে। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন মনোনীত সংস্কারপন্থী নেতাদের পরবর্তীকালে একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে অনুগত ব্যক্তি এবং দলকে ক্ষমতাসীন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এই পরিকল্পনায় সায় দেন। তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। আমেরিকা যাওয়ার সময় ঢাকা এয়ারপোর্টে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল এই (ফখরুদ্দীন-এর) তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীকালে স্বদেশে ফিরে এসে এই সরকারের সব কাজের বৈধতা দেবো।

শেখ হাসিনা বিদেশে চলে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয় যেন তিনিও বিদেশে চলে যান। কিন্তু খালেদা জিয়া ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের ওই প্রস্তাবে রাজি হননি। সুদৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন, তিনি বাংলাদেশের মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকবেন এবং তার একমাত্র ঠিকানা বাংলাদেশ।

১৯ এপ্রিল ২০০৭ সালে বিএনপির জাতীয় এক্সিকিউটিভ কমিটির এক সদস্য আদালতের কাছে আবেদনপত্র পেশ করেন খালেদা জিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন তাকে বিদেশে পাঠানো না হয় এই মর্মে সরকারকে নির্দেশ দেন। খালেদা জিয়া যে তার বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে আছেন সেটাও চ্যালেঞ্জ করা হয় এই আবেদনপত্রে।

২২ এপ্রিল ২০০৭-এ সরকারের প্রতি হাইকোর্ট থেকে একটি রুল জারি করেন। ওই রুলে খালেদা জিয়া যে গৃহ অন্তরীণ নেই তা প্রমাণের জন্য সরকারকে পাচ দিনের মধ্যে তাকে আদালতে উপস্থিত করার নির্দেশ হাইকোর্টে দেয়া হয়। ২৫ এপ্রিল ২০০৭-এ সরকার তার পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে ঘুরে গিয়ে বলে, খালেদা তার বাড়িতে অন্তরীণ নন এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য তার ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। শেখ হাসিনার স্বদেশে ফিরে আসার প্রতি আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও সরকার এ সময়ে প্রত্যাহার করে নেয়।

তার অনমনীয় প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে এই আশঙ্কায় শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনাকেও গ্রেফতার করা হয়। সংসদ ভবনের কাছেই নতুন বানানো দু’টি সাব-জেলের মধ্যে একটিতে বন্দী করা হয়।
২ সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতির দায়ে একটি মামলা করে। ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং দ্বিতীয় সাব-জেলে বন্দী করা হয়।

ইতিমধ্যে সেনাসমর্থিত সরকার দেশকে একটি সুশাসন দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। নতুন পুঁজি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। কিছু শিক্ষায়তন বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে কারফিউ জারি হয়। পরিহাস এই যে, কিছু সেনা অফিসার সম্পর্কে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে যেসব জেনারেল ছিলেন তারা পথ হারিয়ে ফেলেন।

২০০৮-এ ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষার জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকার। ১১ জুন ২০০৮-এ হাসিনাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বৈঠক করেন। পরদিন ১২ জুনে হাসিনা আবার আমেরিকায় চলে যান।

আরাফাত রহমান যিনি অ্যাজমায় শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন, তাকে মুক্তি দেয়া হয় আগস্ট ২০০৮-এ এবং চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে যেতে অনুমতি দেয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এ তারেক রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় তাকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়েছিল এবং তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডনে যেতে অনুমতি দেয়া হয়।
সবশেষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এ। মোট এক বছর এক সপ্তাহ তিনি জেলবন্দি ছিলেন।

২০০৮ সালে মুক্তির পর খালেদা জিয়া

এরপর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সাল শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্ল্যান করে। তড়িঘড়ি ও সাজানো নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও একনিষ্ঠ গণতন্ত্রকামী খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হন।
তখনো বিএনপির বহু নেতা জেলে ছিলেন। বিএনপির বহু কর্মী পালিয়েছিলেন। যেসব বিএনপি নেতা সংস্কারপন্থী হয়ে প্রকাশ্যে ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের মাইনাস টু ফর্মুলাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তারা আবার মূলধারার বিএনপিতে ফিরে আসতে বিব্রত বোধ করছিলেন। এক কথায়, বিএনপি তখন খুবই বিশৃঙ্খল ও হতোদ্যম ছিল।

ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী একটি নতুন ভোটার লিস্ট তৈরি করেছিল এবং সেনাসমর্থিত সরকার নির্বাচনী এলাকাগুলোর নতুন বাউন্ডারি ম্যাপ প্রস্তুত করেছিল। ধারণা করা হয়, এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা। এখানে উল্লেখ্য, ওয়ান-ইলেভেনের পর বিএনপির নেতাকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিলেন। তবুও খালেদা জিয়া এই চ্যালেঞ্জ নেন এবং জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। এ বিষয়ে আলোচনা চলার সময়ে তিনি নির্বাচনী অভিযান শুরু করেন।

এটা জানার পরপরই ৬ নভেম্বর ২০০৮-এ আমেরিকা থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জরুরি অবস্থা তুলে নিতে সরকার রাজি হয় এবং ঘোষণা দেয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ নির্বাচন হবে।

১৪ দিনে ১০,০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ

একটি বিধ্বস্ত দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা এবং নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে খালেদা জিয়া দেশজুড়ে ভ্রমণ শুরু করেন। মাত্র ১৪ দিনে তিনি প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন এবং শতাধিক জনসভা ও পথসভায় নির্বাচনী ভাষণ দেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী অভিযানের ইতিহাসে এটা ছিল একটা নতুন রেকর্ড। প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী অভিযান মূলত সীমাবদ্ধ রাখেন ঢাকায় ঘরে বসে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মধ্যে।

সেনা উপস্থিতিতে সম্পন্ন নির্বাচনে খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হলেও তার দল বিএনপির শোচনীয় পরাজয় হয়। ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়। ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ নেন। খালেদা জিয়া হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। খালেদা জিয়া তার বিভিন্ন নির্বাচনী অভিযানে ২৫ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন এবং সম্ভবত এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *