আত্মবিস্মৃতি বিপর্যয় ডেকে আনে।

বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের আচরণে দেখা যায় মানুষেরা বলে এক কথা কিন্তু বাস্তবে তা করে না বা করে সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এ প্রবণতা এখন এত বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ব জুড়ে এখন যেন চলছে ধোকাবাজী আর সত্যকে মিথ্যা করার প্রতিযোগিতা! কোনটা সঠিক বা কোনটা বেঠিক, কে মিথ্যুক আর কে সত্যবাদী বুঝা দায়! বিশ্বের বড় বড় নেতাদের আচরণে তো মানুষ আরো দিশাহারা। কাউকে যেন আর বিশ্বাস করা যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষের কাছে আজ মিডিয়ার যে প্রযুক্তি এসেছে তাকে ব্যবহার করে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা এত সহজ হয়েছে গিয়েছে যা মানব সভ্যতার অতীতে কোন কালে ছিলনা। তাই বলা যায় আমরা এখন বাস করছি এক প্রতারণার যুগে।
পবিত্র কোরআনের সুরা আস্ সাফ্ফ্ পড়লে পাওয়া যায় মহান আল্লাহ বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ 02
ওহে যারা বিশ্বাসী (অর্থাৎ মুমিনগণ!) তোমরা যা কর না, তা কেন বল?

كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ 03
তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।

আসলে ইসলাম যে আল্লাহর প্রদত্ত সত্যিকার এক জীবন ব্যবস্থা আর ইসলামের শেষ নবী (স:) এর প্রতিটি কথা যে কালের আবর্তে কি ভাবে আরো সত্য প্রমাণিত হচ্ছে ভাবতে অবাক লাগে। আজ থেকে ১৪ শত বৎসর আগে নবী (স:) যে কথা বলে গিয়েছেন কিয়ামতের আলামত প্রসঙ্গে তা এখন দ্রুত আমাদের সামনে আসছে। চৌদ্দ শত বছর আগে, নবী মুহাম্মদ (স:) মুসলিমদের জন্য তাদের জীবন যাপনের যে দিকনির্দেশনা এবং তাঁর উম্মতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা, আখেরি জামানা ও রোজকেয়ামত বিষয়ে যে সব অজানা তথ্য ও ভবিষ্যতবাণী বলেছিলেন তা এখন বাস্তবে প্রকাশ পাচ্ছে। আর ইসলামী পণ্ডিতরা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মহা নবীর মূল্যবান উপদেশ ও বানী লিপিবদ্ধ করে রাখার যে ট্র্যাডিশন রেখে গেছেন তা ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর এক বিরাট রহমত।
অনেকে বলেন সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে মানুষ যে সব বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তা যেহেতু আগেই বলা হয়েছে ঘটবে এবং এখন তা ঘটলে আমরা কি করতে পারি? তা নিয়ে চিন্তা করার কি আছে? যা হবার হবে। কিন্তু একজন মুসলিম হিসাবে আমরা এ বিষয়টার সমীকরণ এত সহজভাবে নিতে পারিনা। প্রতারণার যুগে আছি বলে কি শুধু প্রতারিত হতেই থাকব? আর আমাদের কি কিছুই করার নাই? এধরণের হীন মনোবৃত্তি একজন মুমিনের হতে পারে না। মুসলিম মানে যদি আমরা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ বুঝি তাহলে এর সাথে আমাদের দায়িত্বও কিন্তু বেড়ে যায়। প্রশ্ন হল এ দায়িত্বটা আসলে কি? এ কথা বুঝতে হলে আল্লাহ কি বলেছেন তা জানতে হবে এবং তা পাওয়া যায় আল্লাহর প্রদত্ত বাণী আল কোরআনে ও তার প্রেরিত শেষ নবী মোহাম্মদ (স:)জীবন চরিত্রে। মুসলিম জাতি হিসাবে পরিচয় দিলে আমাদের মাঝে একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড খাকতে হবে এবং এ কথাটাই এ রচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি অর্থাৎ কথায় ও কাজে মিল থাকতে হবে। অত্যাচারী যেই হউক না কেন সে একজন মুসলিমের শত্রু। তার কাজকে ঘৃণা করতে হবে। মুসলিম জাতিকে আল্লাহ বলেছেন “কুন্তুম খাইরা উম্মতি!অর্থাৎ তোমরা উত্তম জাতি। আর তাদের বৈশিষ্ট্য কি? তাও বলে দিয়েছেন, সেটি হল “আমিরু বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের হুকুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
“তোমাদের মধ্যে একটি উম্মত অবশ্যই থাকতে হবে যারা (মানবকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায় কাজে নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ যোগ্যতা অর্জন করতে আজ কেন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি? তার উত্তর পেতে হলে আমাদের চেতনায় যে গলদ তা বুঝতে হবে। বাঙ্গালি মুসলিম হিসাবে আজ আমরা ভুগছি চরম হীনমন্যতায় আর তা হয়েছে নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য নয়। সন্ত্রাস, দুর্নীতি,ব্যর্থ প্রশাসন বা আইন-আদালতও নয়। মূল বিপদ আরও গভীরে, সেটি স্মৃতি বিলুপ্তির। এবিষয়ে কিছুদিন পূর্বে কয়েকটি কথা আমাকে একজন ইমেইল করেছিলেন যার প্রেক্ষিতে এ আলোচনা পাঠকদের জন্য উপস্থাপনার প্রয়োজন মনে করছি।
আজ দেশের মানুষ স্মৃতিবিলুপ্তির অতল গহ্বরে পড়েছে বললে ভুল হবে না। চরম স্মৃতি-বিলুপ্তির শিকার দেশটির নিজের ইতিহাস। বাঙালী মুসলিমরা ভুলেই গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও বর্ণ-হিন্দুদের অতীতের ষড়যন্তু ও শোষণের কথা। আত্মবিস্মৃতি প্রতি পদে বিপর্যয় ডেকে আনে। মানুষের কর্ম ও আচরণের ন্যায় তার রাজনীতিও নিয়ন্ত্রিত হয় স্মৃতি থেকে। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকেই মানুষ জানে কে তার শত্রু এবং কে তার মিত্র? সমাজে যখন শয়তানের অনুসারী অসৎ নেতৃত্ব জেঁকে বসে তখন তারা চায় জাতির “মেমোরি লস” বা স্মৃতি-বিলুপ্তি হউক। এমন স্মৃতি বিলুপ্তির নজির মানব ইতিহাসে অসংখ্য। আল্লাহকে ভুলে মানুষ শয়তানের পথ ধরে তো এমন স্মৃতি-বিলুপ্তির ফলেই। ফিরোউনের বর্বর নিষ্ঠুরতা থেকে বনি ইসরাইলের লোকদের মহান আল্লাহ-তায়ালা প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। তাদের বাঁচাতে তিনি সাগর দ্বিখণ্ডিত করে তল দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা করে দিয়েছিলেন। মিশর থেকে উদ্ধারের পর সিনাই মরুভূমিতে আহার জোগাতে তাদের জন্য আসমান থেকে মান্না ও সালওয়া পাঠিয়েছেন। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) যখন মাত্র ৪০ দিনের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যে যান তখন করুণাময় আল্লাহকে ভুলতে তাদের দেরী হয়নি। নিজ হাতে তারা গরুর স্বর্ণমুর্তি গড়ে সেটির পুঁজা শুরু করে দিয়েছিল।
বাঙ্গালী মুসলিমদের স্মৃতি থেকে শুধু আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্যমে ইসলামী ন্যায় নীতির শাসনে একটি সভ্য সমাজ গড়ার দায়ভারই হারিয়ে যায়নি। হারিয়ে গেছে বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলমানদের স্মৃতি। ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে ইখতিয়ার মহম্মদ বখতিয়ার খিলজীকে –যিনি বাংলা জয় করে পৃথিবীর এ প্রান্তে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় শক্তি রূপে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন । হারিয়ে যাচ্ছে শাহজালাল, শাহ মখদুম ও খানজাহান আলীর মত মহামানবদের স্মৃতি। ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে সিরাজুদ্দৌলা,তিতুমির, হাজী শরিয়াতুল্লাহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া হচ্ছে নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব আব্দুল লতিফ, মুন্সি মেহেরুল্লার মত মহান ব্যক্তিদের। নবাব সলিমুল্লাহ জমিদার পুত্র ছিলেন। রাজনীতিকে তিনি জনসেবার মাধ্যম রূপে ব্যবহার করেন। ফলে সম্পদের পাহাড় না গড়ে বরং নিঃস্ব হয়েছেন। ইন্তেকাল করেছেন ঋণী অবস্থায়। নিজ অর্থে ঢাকার বুকে গড়ে তুলেছেন বহু প্রতিষ্ঠান। উপমহাদেশের মুসলিম নেতাদের ঢাকায় এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম লীগ। সে মুসলিম লীগের হাতেই জন্ম নেয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। আর পূর্ব পাকিস্তান না হলে আজ বাংলাদেশ গড়াও সম্ভব হত না। তখন কাশ্মীরের অবস্থা হত আমাদের। । অথচ সে ইতিহাস আজ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় না। বরং পড়ানো হয় তাদের ইতিহাস যারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেছে দুর্নীতির হাতিয়ার রূপে এবং দেশের সম্পদ লুটেছে দুহাতে। রাজনীতির মাধ্যমে ঢাকার অভিজাত এলাকায় তারা বাড়ি-গাড়ি ও বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছে। তাদের সে লুণ্ঠনের কারণে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে এবং বাংলাদেশের নাম উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকায়!

প্রোপাগান্ডা ও প্রতারণা
Philip M Taylor তার লিখা “Munitions of the Mind” (A history of Propaganda from the ancient world to present day) পুস্তকে লিখেছেন “Propaganda thus become the enemy of independent thought and an intrusive and unwanted manipulator of the free flow of information and ideas in humanity’s quest for peace and truth.” প্রচারণা এইভাবে পরিনত হয় স্বাধীন চিন্তার শত্রু রূপে এবং মানুষের শান্তি ও সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টায় সঠিক তথ্য ও মতামতের অবাধ প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা করে।

প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার মাধ্যমেই হয় প্রতারণা এবং এর কুফলের তুলনা হয়না। প্রচারণার সামর্থ্য বিশাল । লাগাতর প্রচারণার মাধ্যমে ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় অতি দুর্বৃত্তদেরও ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা দেয় যায়। তেমনি শাপ-শকুন,গরু-ছাগলকেও দেব-দেবী রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। হিটলার, মুসোলিনি, স্টালিন, জর্জবুশ ও ব্লেয়ারের ন্যায় গণহত্যার নায়কদের যে নিজ নিজ দেশে নেতা রূপে প্রতিষ্ঠা মিলেছিল সেটি তো প্রচার-প্রোপাগান্ডার জোরেই। লাগাতর প্রচারের মাধ্যমে মানুষের স্মৃতির মানচিত্রই পাল্টে দেয়া যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিকল সেটিই ঘটেছে। সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ, গণতন্ত্র ও মানবতা বিরোধী তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা যারা লালন করে তারাই হয়ে যায় দেশ প্রেমিক!

আত্মবিস্মৃতির মহা শাস্তি
আল্লাহর স্মরণ যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁকে ভুলে যাওয়া যে কত বিপদজনক সে ঘোষণাটি পবিত্র কোরআনে বার বার এসেছে। বলা হয়েছে “যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে,অবশ্যই তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে,“হে আমার প্রতিপালক!কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম।” তিনি বলবেন,“এরূপই আমার নিদর্শন-বলী তোমার নিকট এসেছিল,কিন্তু তুমি সেগুলি ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে।” –(সুরা তা-হা আয়াত ১২৪-১২৬)। প্রতিদিন ৫ বার নামায আদায়ের মূল উদ্দেশ্যটি হলো মু’মিনের স্মৃতিতে আল্লাহর স্মরণকে চির জাগ্রত রাখা। তবে আল্লাহর স্মরণের অর্থ শুধু তাঁর নামের স্মরণ নয়,বরং তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার স্মরণ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“আমিই আল্লাহ,আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণ জাগিয়ে রাখতে নামায কায়েম করো।” –(সুরা তা-হা আয়াত ১৪)। যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর স্মরণটুকুই বেঁচে নেই তার স্মৃতিতে কি সিরাতুল মোস্তাকীমে চলার প্রেরণা থাকে? তেমনি যে জাতি আল্লাহ-বিস্মৃত হবে এমন জাতি যে পথভ্রষ্ট হবে এবং শয়তানের অনুসরণ করবে সেটিই তো স্বাভাবিক। আর এজন্য দেশের সর্বত্র চলছে অস্থিরতা, অন্যায়, অবিচার, সাধারণ মানুষের জীবনের নাই নিরাপত্তা। এক দল অন্য দলের লোকজনকে হত্যা করছে। নারী পুরুষের গলা কাটা লাশ ভাসছে খালে বিলে। নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে, প্রতিষ্ঠানাদিতে অগ্নি-সংযোগ করছে। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে। সরকারের ভিতরে বাহিরে লুট হচ্ছে। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ ন্যায় বিচারের অভাবে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। আজকে ক্ষমার চেয়ে প্রতিহিংসা হচ্ছে বড় আদর্শ! যারা দলীয়ভাবে চুরি করে, ডাকাতি করে, রাহাজানি করে, তারাই পালা বদল করে সমাজের ও রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসে। জাতীয় একতার চেয়ে বিভক্তিকে মুক্তি যুদ্ধের চেতনা লাভের সুপান বলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। যার ফলে জাতীয় বিভক্তিকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়ানো হচ্ছে। আর সে জন্য আধিপত্য-বাদীদের পক্ষে ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি দিয়ে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে দেশকে শোষণ করার পথ সহজ হচ্ছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে প্রতারণার এ যুগে আমরা আর কত প্রতারিত হতে থাকব? কবে জাগবে আমাদের বিবেক?

Loading


Comments

আত্মবিস্মৃতি বিপর্যয় ডেকে আনে। — 1 Comment

  1. “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষের কাছে আজ মিডিয়ার যে প্রযুক্তি এসেছে তাকে ব্যবহার করে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা এত সহজ হয়েছে গিয়েছে যা মানব সভ্যতার অতীতে কোন কালে ছিলনা। …

    বাঙ্গালী মুসলিমদের স্মৃতি থেকে শুধু আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্যমে ইসলামী ন্যায় নীতির শাসনে একটি সভ্য সমাজ গড়ার দায়ভারই হারিয়ে যায়নি। হারিয়ে গেছে বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলমানদের স্মৃতি। ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে ইখতিয়ার মহম্মদ বখতিয়ার খিলজীকে যিনি বাংলা জয় করে পৃথিবীর এ প্রান্তে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় শক্তি রূপে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন । হারিয়ে যাচ্ছে শাহজালাল, শাহ মখদুম ও খানজাহান আলীর মত মহামানবদের স্মৃতি।”

    উপরের উদ্ধৃতির আলোকে দুই/তিনটি কথা বলতে যাচ্ছি। কথাগুলো রাবণ ও বিভীষণ বিষয়ক: ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক,হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত পৌত্তলিক মুসলিম -এই তিন শ্রেণীর ঐক্যগত ব্যাপারে।

    কিছু কিছু জিনিস এমন আছে যা ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক,হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত পৌত্তলিক মুসলিমদের মধ্যে একই। সব দেশ ও জাতীতে ভাল মন্দের সমন্বয় থাকলেও পাকিস্তানের ব্যাপারে এই তিন প্রজাতি এক। এদের ভাষা এখানে এসে একদম একাকার হয়ে যায়। এদের বাক্য, শব্দ চয়ন ও যুক্তির অবতারণা প্রায় একই। আমুতে এদেরকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে উল্লেখ করে একটি ব্লগ দিয়েছিলাম, একথা কারো কারো হয়ত মনে থাকতে পারে। তবলীগ জামাতসহ সব ইসলামী দলগুলো বিশ্বের সব দেশে পাকিস্তানী মুসলমানদেরকে ভাই ভাই হিসেবে দেখেন, ওঠা-বসা করেন এবং একাত্তরের ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক/মিলিটারি ঐতিহাসিকতায় সিভিলিয়ান মুসলমানদেরকে আলাদাভাবে দেখে মুসলিম-ভ্রাতৃত্বে বিঘ্নতা ঘটাননা, যদিও উল্লেখিত তিন শ্রেণী উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাকিস্তানীদেরকে সব সময় ঘৃণা, ভর্ৎসনা ও অবজ্ঞার ভাষায় উল্লেখ করে। তাদের অনেক উক্তি সাক্ষাৎ ফ্যাসিস্ট হিসেবেও দেখা যেতে পারে। মানুষে মানুষে যেমন নানান কারণে মত পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে তেমনি এই তিন শ্রেণীতেও কিছু মত পার্থক্য দেখা গেলেও তাতে beguiled হতে নেই: নাস্তিকদের সাথে পৌত্তলিক মুসলিমের অনেক পার্থক্য কেবল তাদের মধ্যকার পারসোনালিটি কেন্দ্রিক বা অন্য কোনো বৈষয়িক কারণে হতে পারে কিন্তু মূলের দিকে ওরা এক। আমার কাছে খাটি ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকেরা পৌত্তলিক প্রভাবিত মুসলিমের চেয়ে শতগুণে ভাল। কেননা দ্বিতীয় পক্ষের হাতে ইসলাম মার খায় বেশি। বিভীষণের কারণেই নাকি লংকার পতন হয়েছিল।

    আমরা যে কয়টি ব্লগে সামান্য বিচরণ করেছি সেখানেই দেখেছি ইসলামকে ঘায়েল করতে পাকিস্তান ও পাকিস্তানীদের ‘adverse’উদাহরণ টানা হয়। এটা এমন-ভাবে যেন পাকিস্তানের ঘটনাদি ইসলাম ও মুসলমানদের একমাত্র representativeঅবস্থা। বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না, কেননা তা’হলে দেশ পাকিস্তানের মত নিরাপত্তাহীনতা হয়ে পড়বে,মসজিদে মসজিদে বোমা ফুটবে ইত্যাদি। যদিও পাকিস্তান ইসলামী দেশ নয় (গঠনতন্ত্রে একটা কিছু লিখে দিলে অথবা এরশাদের মত একটা ঘোষণা দিলেই দেশ ও জাতি ইসলামী হয়ে যায় না) এবং সৌদিও পুরোপুরি নয়, তবুও ইসলামের উদাহরণটা সৌদি থেকে টানলে কী হত?

    মক্কা বিজয়ের দুই সপ্তাহ পরে মক্কা থেকেই মুহাম্মাদ (সা.) যখন হুনায়েনের যুদ্ধে যাত্রা করেন তখন তাঁর সাথে নব-দীক্ষিত ২,০০০ মক্কী লোক অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু হাওয়াজুন গোত্র যখন অতি প্রত্যুষে অতর্কিতভাবে মুসলিম পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন ঈমান ও নিষ্ঠার সাথে আক্রমণ প্রতিহত না করে এই ২,০০০ পিছন থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং দ্রুতই পলায়ন করতে শুরু করে। কারণ, এদের ভিতরে তাওহীদ প্রবেশ করেনি। এক ব্যক্তি সাফওয়ান নামক একজনের কাছে গিয়ে বলে, ‘আবু ওয়াহাব, সুসংবাদ গ্রহণ কর। মুহাম্মাদ আর তার দল পরাজিত হতে যাচ্ছে।’এই হচ্ছে পৌত্তলিকতার এক দিক। আর অপর দিক হচ্ছে এভাবে: সাফওয়ান বলেন,‘আমাকে যদি দাসে পরিণত হতে হয়, (অর্থাৎ এই ময়দানে মুহাম্মাদ পরাজিত হলে আমরা তো হাওয়াজুনের দাসে পরিণত হব) তবে আমার কাছে একজন কোরাইশ প্রভু হাওয়াযুন প্রভু থেকে উত্তম হবে।’ এখানেও কোন ইসলাম নেই, আছে কোরাইশী প্রাধান্য, কোরাইশী অনুভূতি।

    বাঙালী পৌত্তলিক ইসলামের মোকাবেলায় ব্রাহ্মণকেই অগ্রাধিকার দেবে। ইসলামকে দরজার বাহিরে রেখে দাদার সাথের সখ্যতা করবে, কেননা তার ক্বলবে পৌত্তলিকতা, তাওহীদ নয়।

    দ্বীনের এসসাস ও দ্বীনি ভ্রাতৃত্ববোধের মোকাবেলায় ওদের সাথে গঠিত সাম্প্রদায়িকতাই তার কাছে ‘অসাম্প্রদায়িক’ সংস্কৃতি হবে। উটের পাল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে রাখালের হাঁকে যেভাবে দ্রুত অন্যস্থানে সংঘবদ্ধ হয়, তেমনি সেদিন রাসূলের ডাকে সেই ছত্রভঙ্গ বাহিনীর বদরী, ওহুদীরা সংঘবদ্ধ হয়েই যুদ্ধের মোড় ঘুরান, নিজেরা নিজেদের দিকেই তাকান। আজকে তাওহীদ পন্থিরা নিজেদের দিকে তাকাতে হবে।

    আবু সুফিয়ান রাসূলের সাথে থেকেই তাঁর পাশের এক জনকে নাকি বলেছিলেন, ‘ওরা বাঁচতে হলে সাগরের দিকেই দৌড়াতে হবে।’ কিন্তু সাগরের দিকে পালাবার প্রয়োজন হয়নি। জয় বিজয় আল্লাহর হাতে। আজকে সেই মাক্কীদের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, ওদের দিকে তাকালে মনে ভীতির সঞ্চার হবে এবং সমুদ্রের দিকে পলায়নের এসসাস আসবে।

    আজকের বাস্তবতা জটিল। শিকওয়ার দুটি পঙতি দিয়ে শেষ করি:

    মুর্তি-সূদন নেই কেহ আর, আছে তো কেবল মূর্তিকর,
    ভুত-বিক্রেতা আজর সেজেছে ইব্রাহীমের বংশধর …
    আসনে বসনে খৃষ্ট তোমরা, হিন্দু তোমরা সভ্যতায়,
    তুমি মুসলিম? যাহারে দেখিয়া ইয়াহুদীও লাজে মরিয়া যায়!
    (জওয়াব-ই- শিকওয়া -আল্লামা ইকবাল)

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *