ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক অর্থশাস্ত্রের আওতাভূক্ত একটি বিষয়। অর্থনীতির ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে এটা বোঝা এবং বোঝানো আমার দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এটা যে পত্রিকার পাঠকদের জন্য কলামের একটি বিষয়বস্তু হতে পারে তা কখনো ভাবিনি। কেন এবং কিভাবে এই কলাম লেখার সূত্রপাত, সেকথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আমাদের ছোট মেয়ে নায়লাকে নিয়ে একটি প্রাসঙ্গিক মজার গল্প পাঠকদের সঙ্গে আজ শেয়ার করতে চাই। গল্প নয়, ঘটনাটি আসলে সত্যি। নায়লার বয়স যখন মাত্র চার কী পাঁচ, তখন সে একদিন তার মার সাথে আমাদের বাড়ির কাছের শপিং মলে গেছে। যাওয়ার আগে কাপড়চোপড় পরে তার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে একটি ছোট্ট পিঙ্ক হ্যান্ডব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে করে তার সঞ্চিত দু’টি ডলার নিতে ভুলেনি সে। তার ইচ্ছে দোকানে গিয়ে সে নিজে পছন্দ করে নিজ হাতে কিছু কিনবে নিজের টাকায়।
মলে গিয়ে মাকে নিয়ে প্রথমে ঢুকেছে এক খেলনার দোকানে। অনেক বাছাবাছির পর সে ঠিক করেছে পাখির পালক লাগানো একটি রঙিন কলম কিনবে। কিনেছেও তাই। নিজ হাতে ব্যাগ থেকে এক ডলার বের করে দিয়েছে কলমের দাম। খুব খুশি মনে দোকান থেকে বের হল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার মুড বদলে গেল। এক হাতে তার নতুন কলম আরেক হাতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে অবশিষ্ট ডলারটি বের করে কাঁদো কাঁদো স্বরে মাকে বলল, আমার আরেক ডলার গেল কোথায়’? তার মা বললেন, ‘ওটা দিয়ে তুমি কলম কিনেছ’। তখন সে মাকে বলল, ‘কলম নিলে টাকা দিতে হবে কেন? আমি আমার ডলার ফেরত চাই’। মা বললেন, ‘তাহলে তোমার কলম দোকানিকে ফিরিয়ে দিতে হবে’। নায়লা কোনোভাবেই মানতে রাজি না, ‘জিনিস নিলে টাকা কেন দিতে হয়’? সে গিফ্ট বুঝে, দেওয়া-নেওয়া বুঝে, কিন্তু কেনা-বেচার ধারণা তখনো তার মাথায় আসেনি। কেনার সময় পণ্য নিলে যে দাম দিতে হয় এটা তার বোঝার বাইরে। ছোট্ট মেয়ে তার সঞ্চিত ডলারটি কোনোক্রমেই হাত ছাড়া করতে রাজি হল না। অবশেষে সে কলমটি ফেরত দিয়ে ব্যাগের ডলার ব্যাগে নিয়েই বাড়ি ফিরল। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় যে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা নায়লা সে বয়সে বুঝেনি। আমি অনেক বড় হয়েও তা বুঝতাম না।
অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যখন অর্থনীতি ক্লাসে ভর্তি হলাম তখন আস্তে আস্তে জানলাম ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক তিনটি স্তরে বিভক্ত। প্রথমত, দর কষাকষি, তারপর চুক্তি, তারপর বিনিময়। প্রথম পর্যায়ে ক্রেতা কী মূল্যে কী পণ্য বা সেবা পাবে তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে হয় দর কষাকষি, এর মাধ্যমে তারা দুজন পৌঁছায় দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাত্ চুক্তিতে। চুক্তি হবে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা নির্দিষ্ট পরিমাণ, নির্দিষ্ট গুণের ও মানের, নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাবে বিক্রেতার কাছ থেকে। এই চুক্তি হতে পারে মৌখিক, হতে পারে লিখিত। চুক্তির পর, চুক্তি অনুযায়ীই হবে বিনিময় বা লেনদেন। অর্থাত ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবে এবং বিক্রেতা পণ্য বা সেবা ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেবে। এ হল ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক সম্পর্কের ধরণ। এর বাইরেও যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে আরেকটি মাত্রা থাকতে পাওে, তা আমার জানা ছিল না। এটা আবিষ্কার করলাম মাত্র সেদিন। আমি আমার এক বন্ধু মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় সপরিবারে খেতে গেছি আমাদের শহরের, অর্থাত্ ন্যাসভিলের ও’চার্লিজ রেস্টুরেন্টে। ও’চার্লিজ ন্যাসভিল ভিত্তিক একটি চেইন ক্যাজুয়েল ডাইন ইন রেস্টুরেন্ট। ও’চার্লিজের একটি বিশেষত্ব হল তারা সাধারণত হীমায়িত মাছ গোশ্ত কাস্টমারদের সার্ভ করে না। তাদের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন তাজা মাছ, মাংস, তরিতরকারি, ও ফলমূল সরবরাহ করা হয়। এটা তাদের বিজনেস পলিসি। এজন্য এটা আমাদের প্রিয় খাবার দোকানের মধ্যে অন্যতম।
যা-ই হোক, ও’চার্লিজের লবি থেকে ডাইনিং হলে ঢোকার সময় দরজার ওপর বড় বড় হরফে একটি লেখা চোখে পড়ল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। মোশাররফকে ও দেখালাম। লেখা আছে, ‘এভরি ওয়ান হু এন্টারস থ্রু দিস ডোর, ইজ অ্যা ফ্রেন্ড অফ মাইন’। অর্থাত্, ‘এ দরজা দিয়ে যে-ই ঢুকবে সে-ই আমার বন্ধু’। কথাটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বা কোনো কর্মচারীর নয়, খোদ চেইন রেস্টুরেন্টের মালিক চার্লি ওয়াটকিনসের কথা। অর্থাত্ দোকানের মালিক ব্যবসা এবং লেনদেন করার আগেই তার প্রতিটি কাস্টমারকে নিজের বন্ধু হিসেবে স্বাগতম জানাচ্ছেন এবং নিতান্তই আপন বলে বরণ করে নিচ্ছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে এখানে আমি পেলাম এক নতুন মাত্রা। আমার কাছে নতুন হলেও এটা আসলে নতুন নয়। এখানে একটি প্রশ্ন যে কারো মনে দানা বাঁধতে পারে। চেনা নেই জানা নেই এমন কাস্টমারদের চার্লি কেন তাঁর বন্ধু বলছেন? কারণ কাস্টমার ছাড়া তো তার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা চলবে না, কাস্টমার ছাড়া তো রেস্টুরেন্ট টিকবেই না। কাস্টমাররাই রেস্টুরেন্টের জান, রেস্টুরেন্টের প্রাণ। কাস্টমারদের সেবা করার জন্যই ব্যবসা। কাস্টমাররা প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে আসে, তারা খায়, পান করে, আড্ডা দেয়, ভাল সময় কাটায়। রেস্টুরেন্টের পরিবেশকে মাতোয়ারা করে রাখে। তারা ব্যবসাকে রাজস্ব দেয়, মুনাফা দেয়। ব্যবসায়ীর কাছে এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? আর তাই তার কাছে কাস্টমারদের ছাড়া আর আপন জন, বড় বন্ধু কে আছে? তাই তো চার্লি ঠিকই বলেছেন, ‘আমার প্রতিটি ক্রেতা আমার বন্ধু’। কথাটি শুধূ ও’চার্লিজ রেস্টুরেন্টের বেলাই সত্যি নয়, এটা পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজের তাবত্ ব্যবসার বেলাই সমানভাবে প্রযোজ্য।
আজ ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের এ নতুন মাত্রা নিয়ে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পাঠকদের সঙ্গে দু’একটি কথা শেয়ার করতে চাই। চার্লি যেভাবে তাঁর প্রতিটি কাস্টমারকে বন্ধু বলে বরণ করে নিচ্ছেন। শুধু মুখে মুখে নয়, কাজেও। কীভাবে কাজে, সে ব্যাখ্যা না হয় আরেক দিন দেব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা গ্রামে গঞ্জে শহরে নগরে তাদের অসংখ্য ক্রেতা/ভোক্তাদের কী একইভাবে তাদের বন্ধু ভাবেন? না, ভাবেন না। তবে কদাচিত্ দু’একজন সহৃদয় ব্যবসায়ী মনে করলে করতেও পারেন, কিন্তু বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর মধ্যে এ ধারণা নেই, এ সংস্কৃতির চর্চাও নেই। আর নেই বলেই অধিকাংশ বিক্রেতা/ব্যবসায়ী তাদের ক্রেতা/ভোক্তাদের ওজনে কম দেন, পণ্যে ভেজাল দেন, কাস্টমারদের সঙ্গে কথায় কথায় মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন, কারণে অকারণে দাম বাড়ান, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যার জন্য সাধারণ মানুষের অর্থাত্ আমজনতার দৈনন্দিন জীবনে হয়রানী ও বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। এখানে আমার একটি ছোট্ট পুরনো অভিজ্ঞতার কথা বলার লোভ সমালাতে পারছি না। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকের কথা আমি গ্রীস্মের ছুটিতে সপরিবারে দেশে গেছি। উঠেছি মোহাম্মদপুরে আমার শ্বশুর বাড়িতে। ওই সময় একদিন দুপুর বেলা মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজারে গিয়েছি আম কিনতে। রাস্তার পাশে এক আমওয়ালা থরে থরে সাজিয়ে
বড় বড় আমের পসরা পেতে বসে আছে। তাজা আমগুলো দেখে খুব লোভ লাগল। দামদর ঠিক করে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আম মিষ্টি হবে তো’? এরকম প্রশ্নের উত্তরে অনেক সময় আমওয়ালারা ছুরি দিয়ে কেটে এক চিলতে খেতে দেয়, কিন্তু ওই আমওয়ালা তা করল না। সে উল্টো আমাকে মিষ্টি সুরে বলল, ‘বলেন কী সাব? আমার আম মধুর মত মিষ্টি হবে। বাড়িতে নিয়ে যান, কেটে খান, যদি আম টক হয়, নিয়ে আসবেন, টাকা ফেরত্ দেব, সঙ্গে রিক্সা ভাড়াও’। অভিজ্ঞতা না থাকলে, এমন কথায় কারো বিশ্বেস না হয়ে পারে? বাড়িতে এনে দেখা গেল আম এতই টক যে মুখেই দেওয়া যাচ্ছে না। জুলাই আগস্টের ওই দিনটি ছিল ভীষণ গরম না হলে ঠিকই রিক্সা ভাড়ার জন্য আমের ছালা নিয়ে বাজারে ফিওে যেতাম।
আমি জানি চোরা না শোনে ধর্মের কথা, তবু সেইসব অসত্ বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীর বিবেকের উদ্দেশ্যে দু’একটি কথা বলেই আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। আমার প্রিয় ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন? যেসব ক্রেতা/ভোক্তা হর হামেশা আপনাদের দোকানে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসেন, আপনাদের থেকে পণ্য কিংবা সেবা কিনেন, আপনাদের ব্যবসা দেন, মুনাফা দেন, তাদের চেয়ে বড় উপকারি আপনাদের কাছে আর কেউ কী হতে পারে? তারা আপনাদের আপন জন, হৃদয়ের বন্ধু। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করুন। তাদেরকে ঠকাবার চেষ্টা করবেন না, তাদেরকে প্রতারিত করবেন না। মনে রাখবেন তাদের জন্যই আপনারা ব্যব্সায় টিকে আছেন, মুনাফা কামাই করছেন, শান শওকতের সাথে জীবন যাপন করছেন, বাড়ি বানাচ্ছেন, গাড়ি হাকাচ্ছেন। স্মরণ করুন খলিফা উমর (রাঃ) এর সময়ের সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা, যাকে তার মা বলেছিল, ‘আজ দুধে পানি মিশিয়েছিস’? মেয়েটি বলেছিল, ‘না, মিশাইনি’। ‘রাতের আঁধারে এই কুঁড়ে ঘরে উমর দেখতে পাবে না, মিশা, জলদি পানি মিশা’ বলেছিল মা। মেয়েটি তখন উত্তর দিয়েছিল, ‘মা, উমর দেখতে না পেলেও আল্লাহ্ যে দেখবেন’!
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
বাহ! খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন ভাই। কিন্তু চোর কি শুনবে ধর্মের কাহিনী!!!