আটরশির পীর সাহেব ও রাষ্ট্রপতি এরশাদ

১৯৭৮  থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জাতীয় গ্রন্থকন্দ্রেে কর্মরত থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে আমলাতন্ত্রকে দেখেছিলাম নিকট থেকে, আরও কিছু দেখেছিলাম যেমন রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব এবং আটরশির পীর সাহেব। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় এসে কিছু চটকদার পরিবর্তন আনলেন। তার অন্যতম বাংলা একাডেমীতে পরিবর্তন। এতকাল একাডেমির মহাপরিচালক হতেন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এবার তার বদলে সিএসপি যুগ্ম সচিব মনজুরে মওলা মহাপরিচালক হয়ে এলেন। বাংলা একাডেমীতে কোন আমলা মহাপরিচালক হয়ে আসতে পারেন এমনটা কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। মওলার শখ ছিল কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে তার পরিচিতি হোক। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে ড.আশরাফ সিদ্দিকী সাহেবকে সরিয়ে দিয়ে একাডেমীর মহা পরিচালক হয়ে আসল।

আমি ভাবলাম খারাপ হবে না। এক সময় তার বিদেশে যাবার  জন্য আলী আহসান সাহেবের নিকট তদবির করেছিলাম। না, আমার কপাল খারাপ তিনি এখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে তাঁর অধীনে আনতে চান। একদিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি। তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে অবস্থিত। সেকশন অফিসার বললেন আমার চিঠি-পত্র বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। সরাসরি চিঠি পাঠালে সে চিঠি তারা গ্রহন করবেন না।  কী ব্যাপার? বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব আইনে চলে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তার নিজস্ব নিয়মে চলে। তাকে কেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের অধীনে চলতে হবে?  শুনলাম এরশাদ সাহেব  সরকারের খরচ বাচানোর জন্য এক মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি   সংস্থাকে একতৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন  এবং একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। সেই কমিটি বিভিন্ন সংস্থা থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। সেই কমিটি সব দিক বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করবেন যে কোন সংস্থা অপর কোন সংস্থার সঙ্গে মিলিত হবে ইত্যাদি। সেই কমিটি তখন পর্যন্ত আমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছুই জানতে চায়নি। অথচ মওলা সাহেব আমাদের মন্ত্রণালয়ের সচিবের  সঙ্গে কথা বলে তারা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন যে গ্রন্থকেন্দ্র বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের অধীন একটি সংস্থা। প্রথমে মুসড়ে পরলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী করবো।  অফিসে সহকর্মী প্রায় সকলেই পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে থাকার পক্ষপাতি। সংস্থার নাম যাই হোক না কেন এর কাজ গ্রন্থজগতের সকল পক্ষকে একতৃত করে সকলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে  বইয়ের উন্নয়ন তথা পাঠক সৃষ্টি করা। লেখক, প্রকাশক, বই বিক্রেতা, বই পরিবেশক, মুদাকর, লাইব্রেরিয়ন ইত্যাদি সকল পক্ষকে নিয়ে কাজ করাই গ্রন্থকেন্দ্রের কাজ। বাংলা একাডেমীর কাজ ভিন্ন। সবচেয়ে বড় কথা , যে প্রতিষ্ঠানটিকে সরদার জয়েনউদ্দীন সাহেব টিকিয়ে রেখে গেলেন সেই প্রতিষ্ঠান আমার আমলে লুপ্ত হবে? আমার অফিসের সহকর্মীবৃন্দ কী করবেন? তারা চুপ করে আছেন। হলিডে পত্রিকার সম্পাদক এনায়েতউল¬াহ খানকে বললাম তাঁর কাগজে আমাদের পক্ষে লিখতে। কবি শামসুর রাহমানকে বললাম আমাদের পক্ষে পত্রিকায় কিছু লিখতে। এমনি করে কতজনের কাছে ছোটাছুটি করলাম তার ঠিক নেই ।

 

এমন সময় খেয়াল হল যে এরশাদ সাহেব আটরশির পীর সাহেবের ভক্ত। তিনি প্রায়ই আটরশি যান। মনে পড়ল যে আটরশির পীর সাহেবের সংস্পর্শে এসেছিলাম গ্রন্থকেন্দ্রে যোগদানের পরপর যখন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রর অফিস তখন পুরানো পল্টন বয়স্কাউট ভবনের দোতালায়। গুলিস্তানের নিকট গ্রন্থকেন্দ্রের নিজস্ব ভবন তখনও তৈরি শেষ হয়নি। আলী আহসান সাহেব তখন মন্ত্রী সভায় নেই। শাহ আজিজ প্রধান মন্ত্রী। একদিন দুই যুবক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। একজন আটরশির পীর সাহেবের বড় ছেলে এবং অপরজন তাঁর বন্ধু। পীর সাহেবের বড় ছেলে বেশ কিছুদিন আরবদেশে ছিলেন। তিনি ইংরেজিতে একটা বই লিখেছেন, নাম স্ট্রিম ইন দি ডেজার্ট – রসুলাল¬াহর জীবন কথা। এই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করতে হবে। লেখকের ইচ্ছা প্রধান অতিথী হবেন তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজ ও সভাপতি হবেন সৈয়দ আলী আহসান। আমি বললাম, ‘আমরা কেবল ব্যবস্থা করব, সভাপতি ও প্রধান অতিথী তাদেরকেই ঠিক করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে আলী আহসান সাহেব আমার অফিস ঘরেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি সম্মতি জানালেন, প্রধান অতিথীকে তারা যোগাযোগ করবেন। কার্ড আমার নামে ছাপা হবে। যাবতীয় খরচ তাদের। সেই প্রকাশনা উৎসব ভালভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম অনেক আর্মি অফিসার পীর সাহেবের ভক্ত। দেখলাম তারা পীর সাহেবের ছেলেকে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুছি করছে। এসময় পীর সাহেবের বড় ছেলে ও তার বন্ধুর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। এমন কি কিছুদিন পর পীর সাহেব তাঁর ছেলেকে দিয়ে আমাকে ও বড় মামা সৈয়দ আলী আহসান সাহেবকে আটরশি যাবার জন্য দাওয়াত করেছিলেন। পীর সাহেবের এক ভক্ত তার এয়ারকনডিশনড গাড়িতে করে  আমাদেরকে আটরশি নিয়ে গিয়েছিলেন। পীর সাহেবের মেহমান হিসেবে সেবার গিয়েছিলাম। আমাদের খাতির যত্ন  ছিল অসাধারণ। পীর সাহেবের এলাকায় প্রবেশ করার পর তাঁর ভক্তরা জুতা খুলে ফেললেন। আমরাও জুতা খুলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু সবাই নিষেধ করলেন, এই বলে যে ‘আমরা মেহমান’, আমাদের জুতা খুলতে হবে না। আমাদের জন্য দোতালায় একটা সুসজ্জিত বড় ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হল। কার্পেট বিছানো চমৎকার ঘর। সোফা, আলমিরা ভরা বই, পালং, পড়ার টেবিল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ঘর।পাশেই বাথরুম। কে বলবে গ্রামের বাড়ি। আমরা পৌছেছিলাম বিকেলের দিকে। হাতমুখ ধোয়ার পর টেবিল ভর্তি নাস্তা ও চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হল। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন পীর সাহেবের বড় জামাই। তিনি ফরিদপুর শহরে ওকালতি করেন। আমরা আসছি শুনে তাঁকেও আনা হয়েছে আমাদের সঙ্গ দিতে।চা নাস্তা খাওয়ার পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর হুজরা ঘর ছোট একটা টিনের ঘর ছিল । সামান্য উচু একটা জলচৌকিতে তিনি বসে আছেন। তার সামনে দুসারি সোফায় আমরা বসলাম। পীর সাহেব বড় মামাকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে কথাবার্ত বলছিলেন।  বলছিলেন যে তাঁর ইচ্ছা আটরশিতে একটা আন্তর্জাতিক মানের ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করবেন। বুঝলাম সে বিষয়ে আলাপ করার জন্যই তিনি বড় মামাকে দাওয়াত করেছেন। আমি মাধ্যম। সে সময় বেশ কয়েকবার পীর সাহেবের বড় ছেলে ও তারঁ বন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাত ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।

এখন এই বিপদের দিনে তাঁদের কথা মনে পড়ল। পীর সাহেবের বড় ছেলের বন্ধুকে ডেকে বললাম আমাদের গ্রন্থকেন্দ্রের বিপদের কথা। তিনি সব শুনে বললেন যে এরশাদ সাহেব মাঝে মাঝে জুম্মার নামাজ পড়তে আটরশি যান। তিনি খোঁজ রাখবেন কবে এরশাদ সাহেব আটরশি যাবেন তখন আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।এক বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ফোন করে জানালেন আগামী কাল শুক্রবার এরশাদ সাহেব আটরশিতে জুম্মার নামাজ আদায় করবেন। আমাকে রাতের মধ্যে আটরশি গিয়ে পৌছতে হবে।এবার আর আমি মেহমান নই। অন্য সবার মত পীর সাহেবের ভক্ত হিসেবে গেলাম আটরশি। বাসে করে গোয়ালন্দ ফেরি পার হয়ে সন্ধ্যায় আটরশি পৌছলাম। সঙ্গে বদিউদ্দীন নাজির। ভাগ্য ভাল সেই ভদ্রলোক আমাদের অপেক্ষা করছিলেন। তিনি রাতের বেলা একটা ঘরে শোবার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে আরো কয়েক জন পরিচিত ব্যক্তিকে দেখলাম। একজন নাম করা সাংবাদিক, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অপর জন সোনালী ব্যাঙ্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমার গাইড চুপিচুপি রাতের বেলা বলে গেলেন, সকাল বেলা প্রস্তুত হয়ে থাকতে। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলেই বুঝতে হবে পেসিডেন্ট সাহেব আসছেন। আমি যেন তখনই কোন একটি বিশেষ ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা করি। তিনি সেখান থেকে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাবেন। একটা কথা বলা হয়নি, সেদিন সেখানে কয়েক হাজার লোক জমায়েত হয়েছিল। তারা এসেছে পীর সাহেবের দোয়া নিতে। সেই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে অন্য অনেকের মত আমি অপেক্ষা করছি পীর সাহেবের দোয়া নিতে। অসংখ্য লোক বা জনসমাগম, কিন্তু তেমন কোন শব্দ নেই। সবাই হাতে হাতে সুশৃঙ্খল ভাবে কাজ করছে, সকলেই সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। সকালে নাস্তা খেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন হেলিকপ্টার আসবে। বেলা ১০টা কি সারে দশটার সময় হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে নির্ধারিত ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর হঠাৎ দরজা খুলে মুহূর্তে সেই ভদ্রলোক আমাকে এক ঝটকায় ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছি। আরো কিছু সময় পর ভেতরের দিকের দুটি দরজার এক দরজা দিয়ে পীর সাহেব ও অপর দরজা দিয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি হুসেন মুহম্মদ এরশাদ প্রবেশ করলেন। যতদূর মনে পড়ে, পীর সাহেব আগে ঘরে ঢুকলে তাঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার সমস্যা তথা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রকে লুপ্ত করার যে প্রকৃয়া চলছিল সে বিষয়ে বলা হয়েছিল যাতে পীর সাহেব রাষ্ট্রপতিকে এ বিষয়ে বলতে পারেন। অতঃপর রাষ্ট্রপতি প্রবেশ করলেন। কথা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি বললেন যে পীর সাহেবের দোয়ায় রাষ্ট্রপতি এবার পুত্র সন্তান লাভ করেছেন। পীর সাহেবও বললেন যে তিনি এ বিষয়ে আগেই বলেছিলেন যে এবার তার পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে। এই সব কথাবার্তার পর পীর সাহেব রাষ্ট্রপতিকে বললেন আমার কথা যে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলা একাডেমী দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন প্রকৃতির কাজ করে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্রপতি আমাকে বললেন, আমি যেন ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমি জানতে চাইলাম কিভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। তিনি তার কোন জবাব দিলেন না। এরপরই জুমার নামাজের জন্য কাপড় বদল করতে তিনি ভিতরে গেলেন। আমার গাইড আমাকে নিয়ে গেলেন মসজিদে। সেখানে দেখলাম মসজিদের ডান দিকের শেষ প্রান্তে কিছুটা অংশ লোহার শিক দিয়ে ঘেরা যার মধ্যে জনা বিশেক নামাজি দুই কাতারে দাড়াতে পারে। আমার গাইড কোন রকমে প্রায় জোর করে রাষ্ট্রপতির বাম পশে দাড় করিয়ে দিল। অপর পার্শে ছিলেন পীর সাহেব। বুঝলাম নিরাপত্তার জন্য এই জেলখানা। নামাজ শেষ করেই রাষ্ট্রপতি আবার ভিতরে চলে গেলেন কাপড় বদল করতে। আবার আমরা শেষবারের মত দেখা করতে আগের ঘরে গেলাম। এবার দেখলাম পীর সাহেব খাটের উপর বসে আছেন। রাষ্ট্রপতি এসে উপুর হয়ে সেজদার মত করে সালাম করলেন।  আমি কী করি? তবু কদমবুছি করলাম। আমি চেষ্টা করলাম তার নিকটে যেতে বা ঘনিষ্ট হতে। কিন্তু পারছিলাম না। বিশেষ করে কী যে বলব বুঝতে পারছিলাম না। তিনি পীর সাহেবের নিকট হতে বিদায় নিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে অগ্রসর হলেন, তখনো আমি তাকে তুলে দিতে তাঁর পেছনে পেছনে গেলাম ও হেলিকপ্টারের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তিনি আবারো বললেন ঢাকায় দেখা করতে।

আমার মত ছোট অফিসারের পক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করা সহজ নয়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই আবেদন করতে হবে।  পরদিনই সচিব সাহেব ডেকে একটু  ভর্ৎসণার সুরেই বললেন, আটরশি গিয়ে আমি কাজটি ভাল করিনি। তার জবাবে বললাম ‘ কি আর করা? চেষ্টা করতে দোষ কি?’ তখন সচিব আসাফউদ্দৌলা, আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে আমাকে আনার পেছনে তাঁর অবদানই বেশি। অথচ আজ তিনি মওলার পক্ষে কেন বুঝলাম না। আমি যে আটরশি গিয়েছি সে খবর সচিব পেলেন কী করে বুঝলাম না। এর মধ্যে খবর পেলাম সরকার যে কমিটি তৈরি করেছেন তার প্রধান ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক খান তিনি নাকি আমারই সহপাঠী । ঢাকা কলেজে আমার সঙ্গে পড়তেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজে আইএসসি পড়ার পর তিনি সেনাবহিনীতে যোগদান করেন। তারপর আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। আজ ১৯৮২ সাল। তিরিশ বছর পর, এত দীর্ঘ কাল পর সে কী আমাকে চিনতে পারবে! তবু তাকে একটা চিঠি দিলাম। সে তখন লগ এরিয়ার কমান্ডিং অফিসার। চিঠি পেয়ে সে আমাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠালো । বলল ক্যান্টনমেন্টে তার অফিসে যেতে। গেলাম তাঁর অফিসে। আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার অফিসারের অফিস। তার জাঁক জমকই ভিন্ন রকমের। এনাম সত্যই বন্ধু। দীর্ঘদিন পর দেখা। সে মোটেই ভুলে যায়নি পুরাতন সহপাঠীদের। সে মনযোগ দিয়ে আমার অফিস সম্পর্কে বিস্তারিত শুনল। এনাম বলল সচিবালয়ে তাঁর অফিসে যেতে। সেখানে এনামকে সাহায্য করার জন্য বেশ কয়েকজন বেসামরিক অফিসার ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কোন সরকারি কলেজের শিক্ষক। নাম দেলোয়ার হোসেন। তাঁকে আনা হয়েছে ডেপুটেশনে। বরিশাল বাড়ি। খুবই ভদ্র ও বিণয়ী। পরে এক সময় গণগ্রন্থগার অধিদপ্তরের পরিচালক হয়েছিলেন। তিনি যখন বুঝলেন এনাম আমার সহপাঠী, তখন আমাকে কিভাবে সাহায্য করা যায় তার চেষ্টা করতে আরম্ভ করলেন।তিনি পরামর্শ দিলেন আমাদের কাজ কর্মকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে। বদিউদ্দীন নাজির সেই প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তার মধ্যে গ্রন্থ-সুহৃদ সমিতির কাজকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মানচিত্রে কোথায় কোথায়, কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রন্থ-সুহৃদ সমিতি রয়েছে তা দেখানো হয়েছিল। প্রকৃতই গ্রন্থ-সুহৃদ সমিতি গঠন করার মাধ্যমে দেশে একঝাক গ্রন্থপ্রেমিক বা গ্রন্থাগার প্রেমিক সৃষ্টি হয়েছিল। তখন কেবল সূত্রপাত। কাগজ পত্র দেখে এনাম গ্রন্থকেন্দ্রের কাজের ধারা ও উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিল।

এনাম কমিশনের কথা বলছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। আগেই বলেছি, এনামের অফিস আমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কিত তথ্য নিতে আরম্ভ করেছিল। তার আগেই আটরশির পীর সাহবের দরবার ঘুরে এসেছি। কাজ হয়েছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ সচিব সাহেব যেভাবে কথা বললেন তা হতে কিছু আন্দাজ করতে পারছিলাম না। মওলা সাহেবও এরশাদ সাহেবের প্রিয় পাত্র। বঙ্গবন্ধুর সময় সে বাকশালে যোগদান করে  কোন এক জেলার গভর্ণরও হয়েছিল। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় আসার পেছনে সামরিক ও বেসামরিক – দুপক্ষের কিছু উর্ধতন অফিসার তার সমর্থনে ছিলেন। বেসামরিক আমলাদের মধ্যে মওলা অন্যতম। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার এনামও সামরিক দিকে হতে এরশাদ সাহেবের আপন। এখন আমাকে নিয়ে, অর্থাৎ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নিয়ে দু’ পক্ষের টানাটনি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। এরই মধ্যে একদিন সচিব সাহেব স্থির করলেন মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠানের সকল অফিসার একদিনের বেতন রাষ্ট্রপতির ত্রাণতহবিলে দান করবে। সেই অর্থ একদিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেভাবেই দিন তারিখ স্থির করা হল। সচিব সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সকল প্রতিষ্ঠান প্রধান দলেবলে নির্ধারিত দিনে রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলাম। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এরশাদ সাহেব পাউডার-টাউডার মেখে সেজে গুজে এলেন। ইতিপূর্বে তাঁর সঙ্গে যে আটরশির পীর সাহেবের আস্তানায় আমার দেখা হয়েছে তার কোন ইঙ্গিত বা আভাস দেখলাম না। বরং তিনি মওলা ও আসাফউদ্দৌলার সাথেই যা কথা বলার বললেন। তিনি সচিব সাহেবকে থাকতে বললেন, যে তার সাথে কিছু কথা আছে। অনুষ্ঠান শেষে আমরা চলে এলাম। সচিব সাহেব থেকে গেলেন, সঙ্গে একাডেমীর মহাপরিচালক মওলাও রয়ে গেল। যদিও মওলাকে থাকতে বলা হয়নি।

যাহোক আমরা সকলে যে যার অফিসে চলে এলাম। পরদিন হঠাৎ দেখি ব্রিগেডিয়ার এনাম খুব উত্তেজিত হয়ে আমার অফিসে এসে হাজির। আমার এই ছোট অফিসে তাঁর আগমন যেন গরিবের ঘরে হাতির পদধূলি। সে আমাকে খুলে বলল। সে সব কিছু ঠিক করে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছিল যে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তার নিজের জায়গায় যেমন আছে তেমন থাকবে; বাংলা একাডেমী তেমনি পৃথকভাবেই থাকবে। সে অন্য যে সকল ফাইল রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠিয়ে থাকে সেভাবেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি কেবল সই করবেন। কিন্তু না, সেখানে যে আমলারা আছে তারা বিষয়টিকে আমাদের সচিব ও মওলার নিকট প্রকাশ করে দিয়েছিল। তাই গতকাল তারা দুজন আমাদের চলে আসার পর রাষ্ট্রপতির অফিসে অপেক্ষা করে এনামের প্রস্তাবকৃত নথি দেখেছে ও নিজেরাই হাতে করে  রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থিত করে তাদের আপত্তি জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এনামের প্রস্তাব নাকচ করিয়েছে। এনামের উত্তেজনার কারণ, বিষয়টি সম্পূর্ণ এনামের এখতিয়ারের। সেখানে অন্য কারো অধিকার নেই ভিন্ন প্রস্তাব দেয়ার। তাই মওলা ও আমাদের সচিব দুজনে মিলে এনামের প্রস্তাবের নিচে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, আপাতত দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করার নির্দেশ। এবার এনামকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির নিকট নতুন করে  প্রস্তাব দিতে হবে। তাই সে সোজা চলে এসেছে আমার অফিসে তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি সংগ্রহ করতে। সঙ্গে তার দুজন বিশেষজ্ঞ সহকারী এসেছেন। আমার ঘরে বসেই রাষ্ট্রপতির নির্দেশের বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বিস্তারিত নোট লিখিয়ে, সেখানে এনাম তার স্বাক্ষর দিয়ে বলল,নথি সে নিজে হাতে রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি নিয়ে যাবে যাতে অন্য কেউ মাঝ থেকে বাগড়া দিতে না পারে। সে বুঝতে পারছিল যে আমলারা আমলাদের পক্ষে।

দুদিন পর দেখলাম সত্যই এনাম নিজের হাতে নথি নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে, অফিস নির্দেশ জারি করিয়ে তারপর আমাকে তার অফিসে ডেকে সেই নির্দেশ এক কপি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এক মাত্র তোমার অনুরোধে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে অবলুপ্ত হতে দিলাম না, এই নাও চূড়ান্ত অফিস নির্দেশ’। আর অন্যান্ন কপি যেখানে যেটা পাঠাবার সেখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করল। এনামরা চাচ্ছিল উন্নতদেশের মত আমাদের দেশেও স্থানীও সরকার গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী হোক। কিন্তু তা যে হবার নয়। ইংরেজরা যে আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা দিয়ে গিয়েছে সেই ক্ষমতা তারা ছাড়বে কেন? তাইতো ডেপুটি কমিশনারের বাংলা করেন ‘জেলা প্রশাসক’। হে মোর দুর্ভগা দেশ। সেদিনও বুঝিনি আমলাতন্ত্র আমার সারা জীবনের শত্র“তে পরিণত হয়েছে।

 

About ফজলে রাব্বি

লেখক বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক হিসেবে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে অনেক ঘটনা, সিদ্ধান্ত, নীতি-নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

Comments are closed.