সত্যের জয়

শরতের শেষ ভাগ। প্রখর সূর্যের রূপালী আভা সারা পৃথিবীতে  ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের সূর্যত্ব আজ যেন বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর দিক হতে ঝির ঝির করে হিমেল হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু শরীর তাতে মোটেই ঠাণ্ডা হচ্ছে না। এমনি এক অপরাহ্নে দাওয়ায় বসে আছি। পিছন থেকে কে যেন হঠাৎ আমার চোখ দু’টি চেপে ধরল। আমি সঠিক নামটি বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। অবশেষে সে হেসে আমার চোখ ছেড়ে দিয়ে আমার বলার অপেক্ষা না করেই একটা মোড়া টেনে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে বল্ল,”মক্কর ভাই, একটা গল্প শোনাও না।“ আমি বল্লাম,”কি গল্প, আষাঢ়ে গল্প না বাস্তব?” ও বল্ল,” না, বাস্তব গল্পই বল না।“ আবার বললাম, “সামাজিক না রাজনৈতিক?” বল্ল, “সামাজিকই হোক।“

আচ্ছা তাহলে শোন-

নতুন কলেজ – সবে মাত্র খোলা হয়েছে। বিরাট এগারো চালার মধ্যে কলেজ বসে। প্রথমে ভাবলাম কোন অধ্যাপক বোধ হয় এখানে আসবেন না। এই গণ্ড গ্রামে কি শিক্ষিত লোকের মন বসে? তাছাড়া মানুষ এখন শহরমুখী – লেখাপড়া জানুক আর নাইবা জানুক সে থাকতে চায় শহরে। পাড়াগাঁ আজ উপেক্ষিত।

সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হল, উজানপুর কলেজের জন্য অধ্যাপক চাই। বেতনের হার ৩০০।-টাকা। তাড়াতাড়ি আবেদন করুন।

সেক্রেটারী, উজানপুর কলেজ, খুলনা।

পাঁচ দিনের মধ্যে দেখা গেল ষাট খানা দরখাস্ত পড়েছে। ভাবলাম, ইন্টারভিউ ডাকলে ওরা আসবে না, আর আসলেও এই গণ্ড গ্রাম দেখে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালাবে।

যথা সময়ে ইন্টারভিউ ডাকা হল। দেখা গেল, ষাট জনই হাজির হয়েছেন – কেউই বাদ যাননি। ইন্টারভিউতে আটজনকে রেখে বাকীগুলোকে বিদায় করা হল। অধ্যক্ষ এসেছিলেন ফরিদপুর থেকে। আর ছাত্র? ছাত্র হল চারশ’। তার অধিকাংশ পাড়াগেঁয়ে। সেই বিরাট এগারো চালার মধ্যেই কলেজের  কাজ আরম্ভ হয়ে গেল। টিনের ঘর; অসহনীয় গরম। তবু এতটুকু বিরতি নেই। অধিকাংশই গরীবের ছেলে বলে এই কষ্টের মধ্যেই তাদের পড়াশোনা চালায়ে যেতে লাগল। তারা চায় শত কষ্টের মধ্যেই উচ্চ শিক্ষা।

এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনাব আমজাদ হোসেন চৌধুরী। তিনি একজন বিদ্যোৎসাহী ভদ্র লোক। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেয়ে ভিক্ষা চাইলেন কলেজের জন্য। কেউ তাঁকে নিরাশ করেলন না। যিনি যা পারেন মুক্ত হস্তে দান করতে লাগলেন। এক টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত তিনি পেতে থাকলেন।

তারপর সরকারের নিকট থেকে একটা বিরাট এলাকা লীজ নিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করলেন এই কলেজ। রাত নেই দিন নেই তিনি খেটে যেতে থাকলেন দিনের পর দিন। নিজের রক্ত তিলে তিলে বিলিয়ে দিয়ে গড়ে তুললেন তাঁর স্বপ্নের সৌধ উজানপুর কলেজ। একটা অজ পাড়াগাঁয়ে একটা কলেজ গড়ে তোলা কতটা অসাধ্য তা প্রতিটি চিন্তাশীল লোকই বুঝতে পারেন।

এই অঞ্চলের সবাই যখন একটা মহৎ কাজে একাট্টা তখন একদল এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তারা ভাবল এখানে যদি কলেজ টিকে যায় তাহলে তাদের সম্মানের লাঘব হবে। চেয়ারে হেলান দিয়ে পা ঝুলানো আর চলবে না। আর অল্প বিদ্যা নিয়ে বেশী বিদ্যার ভাণ করে গ্রামের লোককে ধোকা দেয়া যাবে না। কয়েকটি গণ্ড মূর্খের ছেলের সামনে তাদের মাথা হেট হয়ে যাক এটা তারা চায় না। তাই তারাও কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু তারা ভর্তি হল উচ্চ শিক্ষার জন্য নয়, কলেজের সর্বনাশ ও ছাত্রদের মাথা খাওয়ার জন্যে। আজ ধর্মঘট, কাল প্রতিবাদ দিবস, পরশু অন্যায়ের প্রতিকার ইত্যাকার বিভিন্ন অজুহাতে দলাদলি করে কলেজের মহৎ উদ্দেশ্যটাকে পণ্ড করতে লাগল। অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে খুব মিল দিয়ে তাঁকে নিজেদের দলে ভিড়ায়ে নিল। তারা যেন অধ্যক্ষ সাহেবের জীবন মরণের হর্তা কর্তা।

লোকে বলে জোর যার মুল্লুক তার। এটা প্রাচীন মতবাদ হলেও বর্তমান যুগেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন অসভ্য যুগে একজন অপরজনকে হিংসা করত। সামনা সামনি হলে হাতাহাতি থেকে ভীষণ যুদ্ধও লেগে যেত। যে দুর্বল সে সবলের চাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সেই সবলই হত সারা মুল্লুকের কর্তা। সভ্যতার যুগে অসভ্যতা দেখে প্রাণ হু হু করে কেঁদে উঠে। মানুষ সামাজিক জীব। সে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে ভালবাসে। সে চায় অপরের কাজে সহযোগিতা করতে এবং নিজের কাজে অন্যের সাহায্য পেতে, সুখে শান্তিতে বাস করতে। কিন্তু বর্তমান সমাজ কতিপয় দুষ্টের দৌরাত্বে কলূষিত। সাধারণ লোকের শান্তিতে বাস করার অন্তরায়। যে আঘাত হানতে জানে, যে অপরের অহিত করতে জানে, তার জন্য সমাজ নয়। যে শান্তি চায় তার আশ্রয় স্থল জঙ্গলে। জন্তুর সাহচর্যে বাস করা যায় কিন্তু মানুষের জন্য সবলের অত্যাচার উৎপীড়ন অসহনীয়। যতই আমরা সভ্যতার দাবী করছি ততই আমরা অসভ্যতার বিশাল পারাবারে হাবুডুবু খাচ্ছি। সমাজ আজ গুণের সমাদর করতে জানে না, জানে উৎপীড়ক, শোষক ও হননকারীর পদলেহন করতে। গুণবান দুর্বল ধনবান নির্গুণের চেয়েও অধম। কারণ তার কথায় সমাজ কাণ দেয় না। বরং দুর্বল সবল হতে চাইলে সমাজ তাকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিতে কখনও কসুর করে না।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ লেখাপড়া বা উচ্চ শিক্ষা লাভ করে সমাজে প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য। মানুষ চায় ডিগ্রী, জ্ঞান চায় না। আর সে চায় অপরকে শিক্ষা থেকে বিরত রাখতে, যাতে তার উপরে কর্তৃত্ব বিস্তার লাভ করা যায়। আর একটা বিষয় আজকের শিক্ষিত সমাজ গুণ্ডার হাতের পুতুল। গুণ্ডা যা বলবে শিক্ষিত লোক অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে। তারা গুণ্ডাকে শায়েস্তা করতে সাহসী হয় না বরং গুণ্ডাকে আরও পরিপুষ্ট করে গড়ে তোলে। তাঁদের প্রশ্রয়েই তো ওরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, মানী লোকের মান নষ্ট করছে, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করছে। শিক্ষিত সমাজ যদি ওদেরকে পদতলে পিষে অংকুরেই বিনষ্ট করত তাহলে আর এমনটি হত না। এ পৃথিবী সুখের হত, মানুষের মুখে ফুটত অমিয় হাসি, কতই না আনন্দ লাগত তখন!

এই কলেজের অধ্যক্ষ সাহেবও গুণ্ডাদের চক্রান্ত থেকে রেহাই পেলেন না। ওদের মিষ্ট কথায় একেবারে গলে গেলেন। এই দল যা বলত অধ্যক্ষ সাহেব বিনা প্রশ্নে সায় দিয়ে যেতে লাগলেন। তারপর? তারপর চলল নাটকীয় ঘটনা সমূহ। তিনি মাত্র তিন জন অধ্যাপক নিয়ে দল সৃষ্টি করলেন আর পাঁচ জনকে বানালেন নিজের দুষমন। ছলে বলে উৎপীড়ন করে চললেন পাঁচ জনকে। এই দুষ্ট ছাত্রদের চক্রান্তে অন্যান্য শান্তিপ্রিয় ছাত্রগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।

এমনি সময়ে এলেন আমাদের তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপক এম,এ, রউফ সাহেব। প্রথম প্রথম তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি বড্ড অহঙ্কারী আর ক্রোধোদীপ্ত। আমরা তাঁর ক্লাসে অস্বস্থি বোধ করতে লাগলাম। আমরা একবাক্যে অধ্যক্ষ সাহেবকে দোষ দিতে লাগলাম তিনি কেন এমন অধ্যাপক আনলেন, আরোতো অনেক ভাল অধ্যাপক পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই  আমরা তাঁর স্বরূপ উদঘাটন করতে পারলাম, দেখলাম তিনি মোটেই অহঙ্কারী নন – তাঁর মত অমায়িক আর দু’টি হয় না। তিনি  ছিলেন বন্ধু প্রিয়। তিনি আমাদিগকে তাঁর স্নেহ জালে এমন ভাবে আবদ্ধ করলেন যা কোনদিন পচবে না ছেড়াও যাবে না। তিনি এমন ভাবে পড়াতেন বাড়ীতে এসে আর পড়ার প্রয়োজন হত না। আমি মাঝে মাঝেই তাঁর বাসায় যেতাম। প্রাণ খুলে আলাপ করতেন আমার সাথে যেন কোন অন্তঃরঙ্গ বন্ধু – কোন একান্ত আপনার লোক। বাড়ীর কথা, ছোটবেলাকার কথা, ছাত্রজীবনের কথা সব কিছু আমার কাছে নিঃসঙ্কোচে বলে যেতেন। কোনদিন আমাকে অবিশ্বাস এমনকি সন্দেহও করেননি। ঘন্টার পর ঘন্টা  আলাপ করতেন – কোনদিনই শেষ হত না। আর তাঁর আলাপের সময় কোন দিয়ে যে সময় চলে যেত তা টেরই পাওয়া যেত না। তিনি যা কিছু খেতেন একা খেতেন না। আমাকে আগে দিয়ে তারপর নিজে নিতেন। উভয়েই ভাবতাম পরস্পরের বিদায়ের সময় কেমন দশাটা হবে। বিদায় জগতের চিরন্তন নিয়ম – জগতের কোন শক্তিই তাকে পরাভূত করতে পারে না। তাই বিদায় দেয়া ও নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। যাকে ঠেকানো যাবে না তাকে ঠেকানের প্রচেষ্টা মানুষের পরিচয় নয়। তাই হাল ছেড়ে দিলাম।

এদিকে অধ্যক্ষ সাহেবের অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলল। তাতে অধ্যাপকগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। তিনি এই পাঁচ জনের নামে চরমপত্র দিলেন। তাতে লেখা ছিল,”আপনাদের বিষয়ে কেন ছাত্ররা বেশী অকৃতকার্য হয়? নিশ্চয়ই আপনারা ভাল পড়ান না।“ অথচ তিনি তাকিয়ে দেখলেন না অন্য কলেজ থেকে কত কম ছাত্র পাশ করেছে আর নিজের বিষয়টিতে কত ছাত্র অকৃতকার্য হয়েছে। অন্যের দোষ খোঁজার আগে নিজের দোষটা একবার ভেবে দেখা দরকার। গুণাগুণ বিচার না করে নিজের দলের অধ্যাপকগণের বেতন বাড়ায়ে দিলেন। তারপর চালালেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ; বাড়ী যেতে, বেড়াতে যেতে, খেতে যেতে, এমনকি বাইরে যেতে হলেও তাঁর অনুমতি নিতে হবে। এ যেন তাঁর বাবাতি চাকর। এই বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে আমাদের রউফ সাহেবও বাদ গেলেন না। তিনিও শিকারে পরিণত হলেন। দুষ্ট ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে অপমান করতে লাগলেন। তাঁর আদেশে দুষ্টদের দৌড়াত্ব আরও বেড়ে গেল।

তারপর ভীষণ উত্তেজনায় কেটে গেল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন। অপমানিত হলেন উপেক্ষিত অধ্যাপকগণ দুষ্ট ছাত্রদের হাতে। তারপর এল অধ্যাপকগণের বিদায়ের পালা। তাঁরা অশ্রু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায় নিলেন কলেজ থেকে। তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপক সাহেবও বিদায় চাইলেন। আমরা হাসি মুখেই বিদায় দিলাম। অথচ সেদিন পেটে ভাত দিতে পারলাম না। সন্ধ্যায় আবার গেলাম তাঁর সাথে দেখা করতে। পরম হৃদ্যোতার সাথে আলাপ চলল তিন ঘন্টা ব্যাপি। তিনি অধ্যক্ষ সাহেবের হিংসা থেকে আরম্ভ করে অপমান করার অপূর্ব অপকৌশল ও তাড়ানোর প্রচেষ্টা পর্যন্ত সম্পূর্ণ খুলে বললেন। আর বললেন আজ হোক কাল হোক সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। সেদিন প্রকাশ্য সভায় কাণ ধরে বেরিয়ে যেতে হবে। তারপর আমার একটা ফটো চাইলেন তিনি। তাঁর একটা ফটোও আমাকে দিলেন। বহু উত্তেজনায় রাত কাটল। মনে হল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিই সারা পৃথিবী, দুষ্টের বুকে হানি শত পদাঘাত, সবলের গলা পিষে কলূষিত সমাজকে করি পবিত্র।

সকালে কলেজে গেলাম। দেখলাম, চারদিকে বিদ্রোহের সুর। উৎপীড়িত মজলুম শান্তিপ্রিয় ছাত্রগণ সংঘবদ্ধ। তারা মরিয়া হয়ে উঠল। আমার ক্রোধও সপ্তমে উঠে গেল। ক্রোধে আমার চোখ থেকে যেন রক্ত বেরিয়ে পড়বে। যে কয়েকটি কথা বলেছিলাম তা যেন জ্বলন্ত আগুন। সবাই বলে উঠল যে কোন মূল্যে আমরা অরাজকতাকে রুখবো। বাধ্য হয়েই প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হবে। একযোগে সবাই হুঙ্কার ছেড়ে শয়তানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল বাঘ-বিড়ালের যুদ্ধ। প্রথমে শয়তানরা ভেবেছিল ওরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল মজলুমদের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ওরাই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। পরদিন  দেখা গেল আমাদের অধ্যক্ষ সাহেবও পালিয়ে গেছেন। নতুন অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকগণ এলেন। কলেজের প্রগতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। দুষ্টরা বাধ্য হয়ে কলেজ ত্যাগ করল। সত্যের জয় যে অবশ্যম্ভাবী মজলুমরা তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিল।

 

Comments are closed.