আজ কেন ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনের একান্ত প্রয়োজন

ভূমিকা:
আধুনিক যুগের ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত চরমপন্থিরা কিংবা ইসলামের সমালোচকরা – এরা কেউ কি কুরআনকে আসলেই বুঝতে পেরেছেন? এটি এক বিরাট প্রশ্ন, তবে এই প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে আজ কেন ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনের একান্ত প্রয়োজন।

বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনের প্রচলিত প্রাচীন শিক্ষা-ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে এখানে ধর্মীয় ধারণাসম্বলিত যে নেরেটিভ মধ্যযুগ বেয়ে আমাদের যুগে এসেছে তাতে কোন পরিবর্তন নেই – সেই কাল থেকে এ কাল পর্যন্ত সব চিন্তা-ধারা ‘একঘেয়ে’ হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, এই বিরাজিত ধর্মীয় নেরেটিভ বা বক্তব্যের মধ্যে সক্রিয় হয়ে কাজ করছে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-কলহ, আত্মস্ফীতি, আর অতীতের গল্প-কাহিনী  যা আধুনিক যুগে একেবারে অচল। এই নেরেটিভ পরিবর্তনের প্রয়োজন।

আজ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে যুব-সম্প্রদায়ের একটি অংশ নি-ধর্মী বা ধর্মত্যাগী হয়ে পড়ছে,এবং এই বাস্তবতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে!

এর পরিবর্তন না হলে মুসলমানদের  দুর্গতি বাড়তেই থাকবে, এবং বিশ্বের দরবারে একটি সম্মানিত ও শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত এমনকি  নিজেদের পরিচিতি ও অস্তিত্ব বজায় রাখাও জটিল হয়ে পড়বে।

তবে ইসলামের ব্যাপারে কেউ হতাশ হলে বুঝতে হবে সমস্যা ইসলামে নয় সমস্যা হচ্ছে ইসলামের ব্যাপারে যে কাহিনী বা ব্যর্থ-নেরেটিভ চলে আসছে সেখানে।

আর এটাও অস্বীকার করা যাবে না  যে এই ব্যর্থ-নেরেটিভের কারণে ইসলামের সমালোচকরাও ইসলামকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছে না, বরং বিরাজিত নেতিবাচক বাস্তবতার আঙ্গিকে তারাও ইসলামকে সরাসরি নেতিবাচক আলোকে সমালোচনা করছে, এবং এটাও  মানুষকে ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার রাস্তা সহজ করছে।

আমরা আজকে এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করব, এবং এর জন্য বিদায় হজ্জের ভাষণটি প্রধান করে দেখব। 

৭তম শতাব্দীতে ইসলামের বিজয়ের পর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার জীবনের শেষ প্রান্তে বিদায় হজ্জে লক্ষ মানুষের সামনে কিছু মৌলিক কথা শুনিয়ে যেতে দাঁড়ান। শেষ জীবনে এসে, এবং সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে,ইসলামের আসল মেসেজ বা বার্তা কী হতে পারে, তিনি সে বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন। এই কথাগুলোই ইসলামের মূলনীতি ও আদর্শ (the core components of Islamic ideology), এবং ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝার ও অনুসরণ করার মাপকাঠি।

সেই  ভাষণটির শুরু হয়েছিল এভাবে:

“উপস্থিত জনমণ্ডলী! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। হয়তো আমি আর কখনো এখানে তোমাদের সঙ্গে একত্রিত হতে পারব না। হে জনমণ্ডলী! আজকের এই দিন (জুমার দিন), এই মাস (জিলহজ মাস) ও এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র, তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু, মান-সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত এমনই পবিত্র।”

তখন যারা সে ভাষনটি শুনছিলেন তারা যেন যারা অনুপস্থিত তাদের কাছেও কথাগুলো পৌছিয়ে দেয় সে আদেশটিও দিয়েছিলেন নবী (স:)। অর্থাৎ এ ভাষণটি ছিল তখনকার সে বিরাট ময়দানে উপস্থিত লাখো মুসলিম ও অনাগত ভবিষ্যৎ মুসলিমসহ সকল মানুষের উদ্দেশ্যে। 

বিশ্ব নবী স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে সত্য প্রমাণের পরিসমাপ্তি অর্থাৎ “ইতমাম আল হুজ্জত” সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও সে সময় কোরআনের একটি আয়াত দিয়েও তা কনফার্ম করেছেন।

সেই সময়ের পর থেকে মানুষের ভেদ-বিভক্তি টানা, বৈষম্যের প্রাচীর দাঁড় করানো যেমন  “আমরা বনাম ওরা”, মুসলিম বনাম অমুসলিম এই মর্মের যাবতীয় সাম্প্রদায়িকতা লালন করা যাবে না —এসব খতম হয়ে গিয়েছে।  এখন থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, শাসনের নামে শোষণ, ধনী কর্তৃক গরীবের উপর প্রসহন, শোষণ বাতিল হয়েছে। বিশেষকরে, সেদিনের প্রচলিত মহাজনী সুদ প্রথা বাতিল, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার এগুলো পরিত্যাজ্য। তারপর, মুসলমানেরা যাতে ধর্মীয় জীবনের আনুষ্ঠানিকতা পালনসহ ধর্মের বিশ্বজনীন সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শ বজায় রেখে মানুষের সাথে সুসম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সেইসব প্রেক্ষিতে ও মানব জীবনে সাম্য, সুকৃতি, ন্যায়, ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা কুরআন ও সুন্নাহর আলোক  গ্রহণ করবে –এটাই ছিল সেই সমঝের অন্তর্ভুক্ত। (The correct understanding of that sermon delivered by the most trustworthy upright person of the history, our beloved prophet peace be upon him.)

প্রথমেই আলাপ করা যাক ইসলাম-সমালোচকদের আলোচনার স্থান।

ইসলাম সমালোচকরা বলে থাকেন যে “কুরআন পড়লে আমরা দেখতে পাই সেখানে অমুসলিমদেরকে হত্যার কথা, যুদ্ধের কথা, অবিশ্বাসীদের প্রতি অভিশাপ ও তীর্যক ভাষা ব্যবহার ইত্যাদি রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে মানুষ যে সামাজিক ভদ্রতা প্রত্যাশা করে সে দৃষ্টিতে এ ধরণের কথাবার্তায় অশোভন আচরণ দেখায় অর্থাৎ তাদের অভিযোগ হচ্ছে এসব কথাবার্তা বা আচরণে একটা ঠাণ্ডা-শীতল ভাব প্রকাশ পায় না, বরং সহিংসতা, ধর্মীয় সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম প্রকাশ পায়। তারপর আছে সপ্তম শতকের দাসী-বাদীর অনুমোদন, হুদুদের আইন, অতীত কিসসা কাহিনী। তাই তারা বলতে চায় “ধর্মান্ধতা সম্বল করে মানব প্রজাতিকে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচানো যায় না। এসবের মাধ্যমে ও প্রেক্ষিত থেকে তাদের বক্তব্য হচ্ছে “এমন বৈষম্য ও সহিংসতা ও অতীত কালের আইনকে সম্বল করে মানব-জাতিকে পথ-প্রদর্শন করার কথা বলা নিজেদেরকে প্রতারিত করার নামান্তর। এসব দিয়ে বিশ্ব সভ্যতার আকাশকে আচ্ছাদিত করা যায় না”ইসলাম সমালোচকরা বলে থাকেন যে “কুরআন পড়লে আমরা দেখতে পাই সেখানে  অমুসলিমদেরকে হত্যার কথা, যুদ্ধের কথা, অবিশ্বাসীদের প্রতি অভিশাপ ও তীর্যক ভাষা ব্যবহার ইত্যাদি রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে মানুষ যে সামাজিক ভদ্রতা প্রত্যাশা করে সে দৃষ্টিতে এ ধরণের কথাবার্তায় অশুভন আচরন দেখায় অর্থাৎ তাদের অভিযুগ হচ্ছে এসব কথাবর্তা বা আচরনে একটা ঠান্ডা-শীতল ভাব প্রকাশ পায় না, বরং সহিংসতা, ধর্মীয় সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম প্রকাশ পায়। তারপর আছে সপ্তম শতকের দাসী-বাদীর অনুমোদন, হুদুদের আইন, অতীত কিসসা কাহিনী। তাই তারা বলতে চায় “ধর্মান্ধতা সম্বল করে মানব প্রজাতিকে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচানো যায় না। এসবের মাধ্যমে ও প্রেক্ষিত থেকে তাদের বক্তব্য হচ্ছে “এমন বৈষম্য ও সহিংসতা ও অতীত কালের আইনকে সম্বল করে মানব-জাতিকে পথ-প্রদর্শন করার কথা বলা নিজেদেরকে প্রতারিত করার নামান্তর। এসব দিয়ে বিশ্ব সভ্যতার আকাশকে আচ্ছাদিত করা যায় না”

অর্থাৎ তাদের সমালোচনার স্থান হচ্ছে কুরআনের সে সব কথাবার্তা উত্তম আদর্শ প্রকাশ পায় না, বরং সহিংসতা ও রিলিজাস রেসিজম ও বৈষম্যতা প্রকাশ পায়!

সত্যি বলতে কী – আজ ধর্মীয় অঙ্গনে চরমপন্থিরা এরকমই একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যে তা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং সে কারণে সমালোচকগণ বাস্তবতার উদাহরণ দিয়ে কথা বলতে পারছে।

তবে মানুষের জীবন-কাল ও অবস্থানগত দুর্বলতার মাঝে অন্যতম একটি দুর্বলতা হচ্ছে এই যে মানুষ যে যুগে বাস করে, সেই যুগের সামাজিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির নিরিখে তার চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ থাকে, তার বাহিরে যেতে স্বস্তি বোধ করেনা। তাই যখন কোন একটি বিষয়ে নিজস্ব এক মতামত গড়ে তোলে, তখন তার বাহিরে কিছু চিন্তা করতে চায় না, এমনকি  যত যুক্তি তাকে দেখানো হউক না কেন। অবশ্য কালের পরিক্রমায় এমন এক সময় আসে যখন অতীতের অনেক কিছুর পরিবর্তন সহ্য করতেই হয়।

তেমনিভাবে অতীতকে বুঝতে হলে কিংবা সে সময়ের কোন সমাজ সংস্কারকে মূল্যায়ন করতে চাইলে সে যুগের পরিবেশ পরিস্থিতি ও তাদের প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও সে সংস্কৃতির বাস্তবতার নিরিখে তাকে পর্যালোচনা করতে হবে।

কুরআন নাজিল হয়েছিল এমন এক যুগে এমন এক সময় যা আজকের সমাজ থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামের ইতিহাসে সে সমাজকে বলা হয় ” জাহেলিয়াত” যুগ।
বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় কলাম লেখক গোলাম মওলা রনি তার এক নিবন্ধে যথার্থই লিখেছিলেন, “সে সময় জাজিরাতুল আরবের সমাজে ছিল ভয়ঙ্কর, নোংরা এবং অমানবিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা যার নিকৃষ্টতা বুঝানোর জন্য আইয়ামে জাহেলিয়াত শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ওই আমলের বেশির ভাগ আরব অধিবাসীর মন-মানসিকতা, চরিত্র, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা ও রাজনীতি ছিল যুদ্ধ-কেন্দ্রিক। তাদের বিয়েশাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভোগ-বিনোদন, যৌনতাড়না, প্রেম-বিরহ, শিল্প-সাহিত্য-কবিতা ইত্যাদি সব কিছুর মূলেই ছিল যুদ্ধের তাড়না।”

তাই যুদ্ধের তাড়নায় লিপ্ত এমনি এক অসভ্যতার সমাজকে সংস্কার করতে এবং তাদের সামনে ইসলামের সত্যকে পরিষ্কার করে প্রকাশিত করার পরেও যখন মক্কার অবিশ্বাসীরা ও মুনাফিকেরা ইসলামের বাতিকে নিভিয়ে দিতে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে সময়ের প্রেক্ষিতে তা প্রতিহত করতে ভয় ভীতি, শক্তি প্রয়োগ বা যুদ্ধের কথা এসেছে কুরআনে তা আমরা অস্বীকার করি না।

এখানে বুঝতে হবে, ইসলামের শেষ নবী মোহাম্ম (স:) যে দায়িত্বে লিপ্ত ছিলেন সে মিশন কামিয়াব করতে বা সত্য প্রমাণের পরিসমাপ্তি করতে তাকে দিক নির্দেশনা দিতে আসত কুরআনের আয়াত। এক কথায় কুরআন ছিল সে সংগ্রামের এক রানিং কমেন্টারি, জীবন্ত সংলাপ আল্লাহর পক্ষ থেকে তার রাসুলের প্রতি। তাই সেখানে এসেছে অনেক কথা, অনেক নির্দেশ ও তথ্য। কখনও রাসুলের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে, কখনও এসেছে তাঁর সাহাবিদের বিষয়ে, কখনও অতীতের নবী রুসূলদের কাহিনী, কখনও সে সময়ের যুদ্ধের বিষয়ে যেমন ওহুদ, খান্দক, বদর সহ যুদ্ধের খবর ও মক্কা বিজয়ের পূর্বাভাস ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে কুরআনের একটি সুরা নাস্‌র্‌ এর কথা দেখা যায়।

সে সুরাটিতে -এ মক্কা বিজয়, ইসলামের উন্নতি, মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও গুণ বর্ণনা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আদেশ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল।

অবশেষে অষ্টম হিজরিতে মহান আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা বিশাল সেনাদল নিয়ে মক্কায় এসে বিনা যুদ্ধে তা জয় করেন। আর এভাবে মহান আল্লাহর সেই মহাবিজয়ের ওয়াদা পূরণ হয় এবং কুরআনের মু’জিজা বা অলৌকিকতা তথা খোদয়ি গ্রন্থ হওয়ার বিষয়টি আবারও প্রমাণ হয়।

উল্লেখ্য মহানবী (সা) বিজয়ী মুসলিম বাহিনীকে খুব কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তারা মক্কার কাউকে কষ্ট না দেন ও বিরক্ত না করেন এবং কোনো ধরনের রক্তপাত যেন না ঘটে।

মক্কায় প্রবেশের পর মহানবী (সা) মাসজিদুল হারামে যান এবং কাবা ঘরের কাছে এসে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চূরমার করেন। এরপর কাবা ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসীকে প্রশ্ন করেন: আজ তোমরা আমার কাছে কি আশা করছ? তারা বলল: ক্ষমা। মহানবীর (সা) চোখ অশ্রু-সজল হল। কাঁদল মক্কার জনগণও। গত বিশ বছর ধরে মক্কাবাসীর হাতে এতসব নির্যাতন, হয়রানি ও যন্ত্রণার শিকার হয়েও দয়া, ক্ষমা ও মানবতার নবী বললেন: ‘আমি তোমাদের সম্পর্কে তাই বলব যা বলেছিলেন আমার ভাই ইউসুফ। তোমাদের জন্য আজ কোনো তিরস্কার নেই। মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তিনি দয়াদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে দয়াদ্র। আজ তোমরা সবাই মুক্ত, যেখানে খুশি সেখানে যেতে পার।’ (সুত্র)

তাই ইসলামের বিপক্ষে লাগামহীন সমালোচনার আগে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপঠে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। তখনকার সময়ে বা তার কয়েকশ বছর পরেও আরবের বাহিরের অবস্থা কেমন ছিল জানা দরকার। ক্রসেড, ইউরোপীয়ান ইনকিউজিশন সহ মধ্যযুগের বর্বরতার ইতিহাস ভূলে গিয়ে শুধু সপ্তম শতাব্ধীর কিছু সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কুরআনের কিছু বাক্যকে বাচাই করে যথেচ্ছভাবে ইসলামের দুষ খোজার কোন মানে হয় না।

এবারে দেখি ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত চরমপন্থিরা আসলেই কি বলতে চান।

প্রথম কথা হল এই শ্রেণীর লোকেরা মনে করেন তারা যে আকিদায় বিশ্বাস করেন, সেটিই আল্লাহর আদেশ। তাদের কথা হচ্ছে “আল্লাহ যদিও মানুষকে ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন, কিন্তু আমরা সেই স্বাধীনতা গ্রহণ করতে পারি না, কারণ যেহেতু  রাসুল (স:) তার জীবনে অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, আমরাও সেটি সেভাবে করে যাব, অনন্তকাল ধরে, যতক্ষণ আমরা বিজয়ী হয়ে সকল মানুষকে আমাদের অধীনে আনতে পেরেছি, বা আমাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী করাতে পেরেছি। তবে সবাইকে আমাদের ধর্মে আনার আগ পর্যন্ত, আমরা যেসব দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে শক্তিতে না পারলেও, গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ত করে, প্রথমেই “ইসলামী রাষ্ট্রের” বা “খিলাফতের” ঘোষনা দিব এবং আল্লাহর দ্বীন কায়েম করব। আর এই প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হলেও, হাজার হাজার প্রাণ বিসর্জিত হলেও, আমরা এই ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাব, এবং  “ইমাম মেহদী” ও ঈসা (আ:) এর আগমনে বিশ্বাস করে চলতে থাকব, যখন তারা এসে দুর্বলতা ঘোচাবেন —এটাই খাটি ইসলাম, কোরান-হাদিসের ইসলাম।”

সত্যি বলতে কী – এটিই সেই ব্যর্থ-নেরেটিভ যা কম বেশী মুসলিম ধর্মীয় অঙ্গনের বিভিন্ন মহলে সবাইকে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে এবং এর ব্যর্থতার দিকে মানুষের জান-মাল ধ্বংস করা হচ্ছে। এই ব্যর্থ-নেরেটিভকে পরিবর্তন করা দরকার।

আজ মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে সহজেই দেখা যাবে যে মুসলমানদের ধর্মীয় অঙ্গনে অতীতের মধ্যযুগীয় শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক যুগের ধ্যান-ধারণা বুঝতে ব্যর্থই হচ্ছে, এবং সমস্যার মধ্যে জটিলতা বৃদ্ধি করছে, যার ফলে মানুষ এখন প্রাচীন শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রশিক্ষিতদের কথাবার্তা আমলে নিতে পারছে না, এবং এই পরিস্থিতির আলোকে আমাদের আজ নতুনভাবে কুরআনকে পাঠ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যুগের চাহিদা এখন ভিন্ন, মধ্যযুগীয় ব্যাখ্যার ভয়ভীতি জড়িয়ে মানুষকে আর বুঝ দেয়া যাচ্ছে না।

কুরআন আল্লাহর কালাম যা সন্দেহ করার কোন অবকাশ নাই মুসলিমদের জন্য তবে কুরআনকে বুঝতে হবে কুরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট বিবেচনা সাপেক্ষে। কোরআনের কোন কথা বা আদেশ নিষেধ বুঝতে হলে সে কথাটি শুরু হয়েছে কোথা থেকে বা কেন এসেছিল কুরআনে তা না জেনে, না বুঝে মাঝখান  থেকে randomly যথেচ্ছভাবে একটি নির্দেশ বা বাক্যকে লুফে নিয়ে কুরআন বুঝার যে ব্যর্থ প্রয়াস চলে আসছে অনেক যুগ ধরে তা বন্ধ করতে হবে। একথাটি আত্যন্ত যুক্তি সহকারে ধীরস্তিরে শান্ত মাথায় বুঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রখ্যাত কুরআনের গবেষক ইসলামী স্কলার জনাব জাবেদ আহমেদ ঘামিদী কিন্তু তার ঠাই হয় নাই “ইসলামি রাষ্ট্র” পাকিস্তানে!

তার লিখিত অন্যতম একটি গ্রন্থের নাম ” মিজান” যা ইংরেজিতে ISLAM A Comprehensive Introduction নামে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছরে কুরআন বুঝার প্রচেষ্টা পর পবিত্র কুরআন ও প্রায় ১২০০ সহীহ হাদিসের রেফারেন্স সহ তার বক্তব্য রেখেছেন। তার সব কথাতে সবাইকে যে একমত হতে হবে তা নয় তবে তার লিখাতে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনের যে একান্ত প্রয়োজন তা প্রকাশ পেয়েছে। আজ সময় এসেছে আমাদেরকে এ ধারায় চিন্তা করতে।

Reference : Al Mawrid 

Comments are closed.