তাগুত কে বা কারা? শুধুমাত্র কোরানে বিশ্বাসীদের অনেকেই তাগুতের ব্যখ্যা নিয়ে একটি ধোঁয়াসার মাঝে আছেন। তাগুত কোরানে ব্যবহৃত একটি শব্দ। এর সঠিক মানে জানতে হলে কোরানে যত আয়াতে তাগুত বা তাগুতের ভিন্ন ভিন্ন রুপ এসেছে , সেই আয়াতগুলো পর্যালাচনা / বিশ্লেষন করলেই সঠিক মানে জানা সম্ভব। কোরানের এক আয়াত দিয়ে অন্য আয়াত বা শব্দের এই পর্যালাচনা করাকেই তারতিল করা বলে।
তাগুত শব্দটি ৮ রুপে কোরানে ৩৯ বার এসেছে। এর মূলে আছে তাগা/ ط غ ي এই আরবি শব্দটির আভিধানিক মানে–
الطاء والغين والحرف المعتل أصلٌ صحيح منقاس ، وهو مجاوَزَة الحدِّ في العِصيان. يقال هو طاغٍ.
অর্থাৎ যে অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করে।
কোরান থেকে উদাহারন –
20:24 | اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى | ফেরাউনের নিকট যাও, সে অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করেছে।(তাগা) |
69:11 | إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاء حَمَلْنَاكُمْ فِيالْجَارِيَةِ | যখন পানি সীমা পার করেছিল (তাগা) তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহণ করিয়েছিলাম। |
96:6 | كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى | সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে (ইয়াতগা) |
বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আয়াতে-
53:52 | وَقَوْمَ نُوحٍ مِّن قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا هُمْ أَظْلَمَوَأَطْغَى | এবং তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে, তারা ছিল আরও জালেম এবং আরও অবাধ্য। (আতগা), |
তাগুতের এক রূপ আতগা দিয়ে অবাধ্যর ও অবাধ্য অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবাধ্যদের বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ আতগা শব্দটি দিয়ে কোন ডিক্টেটর বা শাসনকর্তাকে বোঝাননি , বরং নূহের সম্প্রদায়ের সকলকে বুঝিয়েছেন। সুতরাং যেসকল কোরান অনুসারী তাদের ছেলেমেয়েকে স্কুল কলেজে পড়াতে চান না তাগুতের স্কুল কলেজ দাবী করে , বোঝায় যাচ্ছে তাদের দাবীর কোন ভিত্তি নেই কোরান অনুযায়ী।
তাগুতের আরেক রূপ তাগি অর্থাৎ যে সীমা অতিক্রম করে। তাগি শব্দটি ও সাধারন জনগনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে –
37:30 | وَمَا كَانَ لَنَا عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ بَلْ كُنتُمْقَوْمًا طَاغِينَ | এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কতৃত্ব ছিল না, বরং তোমরাই ছিলে সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। |
51:53 | أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ | তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্তুতঃ ওরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। |
52:32 | أَمْ تَأْمُرُهُمْ أَحْلَامُهُم بِهَذَا أَمْ هُمْ قَوْمٌطَاغُونَ | তাদের বুদ্ধি কি এ বিষয়ে তাদেরকে আদেশ করে, না তারা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়? |
68:31 | قَالُوا يَا وَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا طَاغِينَ | তারা বললঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের আমরা ছিলাম সীমাতিক্রমকারী। |
69:5 | فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ | অতঃপর সমুদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক তাগিয়া দ্বারা। (প্রলয়ংকরবিপর্যয় ???) |
78:22 | لِلْطَّاغِينَ مَآبًا | সীমালংঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। |
প্রিয় পাঠকবৃন্দ তাগুত শব্দ নিয়ে আলোচনার আগেই আমরা জানলাম যে তাগা , আতগা ও তাগি দিয়ে শাসনকর্তা , সাধারন মানুষের সাথে সাথে পানি , বিপর্যয়ের সীমা অতিক্রমকে ও বোঝানো হয়েছে কোরানে।
যে সকল আয়াতে তাগুত শব্দটি আছে সেগুলো একে একে বিশ্লেষন করব। প্রথম যে আয়াত আলোচনায় আসবে তা এই-
5:60 | قل هل أنبئكم بشر من ذلك مثوبةعند الله من لعنه الله وغضب عليهوجعل منهم القردة والخنازير وعبدالطاغوت أولئك شر مكانا وأضل عنسواء السبيل | বলুনঃ আমি তোমাদেরকে জানাই , তাদের মধ্যে কার মন্দ প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধাম্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন এবং যারা তাগুতের দাসত্ব করেছে, তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকেও অনেক দূরে। |
এই ৫:৬০ আয়াতের শুরুই হয়েছে ‘উনাব্বিউকুম’ (আমি তোমাদেরকে জানাই) বাক্য দিয়ে। আল্লাহ জানালেন , আমরা জানলাম অর্থাৎ নবী / অবহিত হলাম। কিন্তু না , আমরা নবী হলাম না , নবী হতে অস্বীকার করলাম। কারন আমরা বিশ্বাস করি শেষ যে ব্যক্তি নবী হয়েছেন , আল্লাহর কাছ থেকে অবহিত হয়েছেন , তিনি মুহাম্মদ। আর কেউ নবী হবে না , অবহিত হবে না , জানবেনা। ফলে আল্লাহ আমাদের কোরানের আয়াতের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জানাতে থাকলেও আমরা জানছি না , কোরানে বর্ণিত আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলছি না অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্ব করছি না। কার দাসত্ব করছি? তাগুতের। এরা কারা? এরা তাঁরাই যারা দাড়ি রেখে , টুপি পাগড়ি পরে , ওয়াজ মহফিল করে আল্লাহর নামে মিথ্যা প্রচার করছে , কোরানে যা নেই সেগুলোকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ বানিয়েছে , জান্নাতে যাওয়ার অভিনব সব রাস্তা দেখিয়েছে , জান্নাতের টিকেট বিক্রি করছে , দানের নুতন নুতন খাত বানিয়েছে , নিজেকে রবের আসনে বসিয়েছে।
এই তাগুতের পরিচয় আরো পরিস্কার ভাবে আল্লাহ জানিয়েছেন নিম্নের আয়াতে-
4:60 | ألم تر إلى الذين يزعمون أنهم آمنوابما أنزل إليك وما أنزل من قبلكيريدون أن يتحاكموا إلى الطاغوت وقدأمروا أن يكفروا به ويريد الشيطان أنيضلهم ضلالا بعيدا | আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিচারের জন্য তাগুতের কাছে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। |
ভাবুন – ধর্মীয় বিরোধ বা বিধি নিষেধের বিচারের জন্য কারা তাগুতের কাছে যায়? এরা সেই সকল বিশ্বাসী মুমিন যারা দাবী করে তারা কোরান ও এর পূর্বের কিতাব সমূহে ঈমান এনেছে কিন্তু বিচারের জন্য কোরানের পরিবর্তে যায় তাগুতের কাছে , যদিও তাগুতকে না মানতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মানে দাড়ায় তাগুত তাদের মতোই মানুষ , যার কাছে বিচারের জন্য যাওয়া যায়।এই আয়াত থেকে এটাও পরিস্কার শয়তান ও তাগুত দুইটি ভিন্ন সত্বা। এরা কি সেই সকল বিশ্বাসী শিয়া সুন্নী নয় যারা বিশ্বাস করার দাবী করে কোরানে কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশের জন্য যায় তাগুত তথা হুজুরদের কাছে?
আরো একটি আয়াত-
4:51 | ألم تر إلى الذين أوتوا نصيبا من الكتابيؤمنون بالجبت والطاغوت ويقولون للذينكفروا هؤلاء أهدى من الذين آمنوا سبيلا | তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা বিশ্বাস করে ঝাঢ় ফুকে ও তাগুতে এবং এই কাফেরদেরকে বলে যে, এরা বিশ্বাসীদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে। |
ভাবুন – কারা ঝাঢ় ফুক দেয়া হুজুরে তথা তাগুতে বিশ্বাস করে? কারা শুধুমাত্র কোরানে বিশ্বাসীদেরকে কাফের , পথভ্রষ্ট বলে?
এই সব তাগুতের বাহ্যিক রুপ দেখে মনে হবে এরা কত না জ্ঞানী , এদের থেকে ধার্মিক আর কেউ নেই। এদের দেয়া বিভিন্ন আমলও দোয়ার বর্ণনা শুনে মনে হবে বেহেস্তের চাবিকাঠি এদের হাতে। এরা মানুষের এমনই মগজ ধোলাই করেছে যে সুন্নীরা ভাবে যত পাপই করেন না কেন , সরিষা পরিমান বিশ্বাস থাকলেই রসুলের শাফায়াতের মাধ্যমে বেহেস্ত যাওয়া নিশ্চিত।
2:257 | الله ولي الذين آمنوا يخرجهم منالظلمات إلى النور والذين كفرواأوليآؤهم الطاغوت يخرجونهم من النورإلى الظلمات أولئك أصحاب النار همفيها خالدون | যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে। |
আরো গভীরে যাওয়ার দরকার আছে কী? যারা আল্লাহকে অভিভাবক মেনেছে , আল্লাহ তাদেরকে কোরানের বাণীর মাধ্যমে আলোর দিকে তথা আল্লাহর দিকে নিয়ে যান। আল্লাহই আলো। “২৪:৩৫ আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আলো।” আজকের মুসলমান নামধারীদের অভিভাবক এই সব হুজুর তথা তাগুত। এই তাগুতরা কোরানে নির্দেশিত আমল তথা ভাল কাজের(আমালুস সালেহা) পরিবর্তে এই নামাজ , সেই নামাজ , এই রোজা সেই রোজা , এতবার এই দোয়া, অতবার সেই অজিফা- এইরকম হাজারো উদ্ভট আমলের কথা বলে মানুষকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।
2:256 | لا إكراه في الدين قد تبين الرشد منالغي فمن يكفر بالطاغوت ويؤمن باللهفقد استمسك بالعروة الوثقى لاانفصام لها والله سميع عليم | দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবেনা এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। |
আল্লাহ বলছেন : দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। এই তাগুতরা কি বলছে? মুরতাদদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।বলেই ক্ষান্ত হয়নি , আইন নিজের হাতে তুলে নিতে মানুষকে উৎসাহিত করছে। ফলে গত কয়েক বছরে অভিজিত , রাজীব এবং আরো বেশ কিছু নাস্তিক নিহত হয়েছে , হুমায়ুন আজাদ , তসলিমা নাসরিন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে রসুল মুহাম্মদের মতো।আল্লাহর রাস্তা শান্তির রাস্তা। ভাল কথা বলে , বুঝিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার রাস্তা। অন্যায় কাজে নিষেধ করতে হবে।তাগুতের রাস্তা অশান্তির রাস্তা , জিহাদের নামে অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে যুদ্ধের রাস্তা।
4:76 | الذين آمنوا يقاتلون في سبيل الله والذينكفروا يقاتلون في سبيل الطاغوت فقاتلواأولياء الشيطان إن كيد الشيطان كانضعيفا | যারা ঈমানদার তারা যে, জেহাদ করে আল্লাহর রাহেই। পক্ষান্তরে যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পক্ষে সুতরাং তোমরা জেহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষালম্বনকারীদের বিরুদ্ধে, (দেখবে) শয়তানের চক্রান্ত একান্তই দুর্বল। |