ফ্রিডম অফ স্পীচ তথা বাক স্বাধীনতা

ব্যক্তিগতভাবে আমি ফ্রিডম অফ স্পিচে বিশ্বাসী। কারন, ফ্রিডম অফ স্পীচ অসত্যকে বাতিল করে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রিডম অফ স্পীচের একটা ভালো উদাহরণ হইলো ফেসবুক। এই খানে, প্রপাগান্ডা অনেকেই অনেক রকম করে। কিন্তু, কেউ মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করলে, সবাই মিলে তাকে ধরে এবং সেই প্রোপাগান্ডা খারিজ হইতে থাকে। এবং মিথ্যা প্রমানিত হইতে হইতে, ফেসবুকে মিথ্যাবাদিদের সংখ্যা আমার হিসেবে অনেক কমে গ্যাছে। যেমন ধরেন, কিছু লোক আগে ফেসবুকে গালি গালাজ করতো, তারাও সামাজিক ভাবে বর্জিত হইতে হইতে এখন অনেক ভদ্র হয়ে গ্যাছে। এই গুলো ফ্রিডম অফ স্পীচের মজেজা।
ফ্রিডম অফ স্পীচ না থাকলে কি হয়, সেইটা বুঝতে, আপনারে বাংলাদেশের মেইন্সট্রিম মেডিয়ার বেশী যাইতে হবেনা। এক পক্ষ ইচ্ছা মত, মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। মামলা দিয়ে, প্রেস বন্ধ করে, জেলে ঢুকিয়ে, পর্ণোগ্রাফির কেস দিয়ে, থ্রেট দিয়ে – বিরুদ্ধ পক্ষের মতকে সাপ্রেস করে রাখছে। এবং বাংলাদেশের মানুষের মনে কি ব্যাপক পরিমান ক্ষোভ আছে সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, সেইটা ফ্রিডম অফ স্পীচ সাপ্রেশানের কারনেই বুঝা যাইতাছেনা। এই ধরনের আরো অনেক উদাহরণ দেখানো যাবে, বিগত ৩০ বছরের।
কিন্তু, রাষ্ট্র এবং ধর্ম একই জিনিষ না। রাষ্ট্রের জায়গা থেকে ফ্রিডম অফ স্পীচকে মাথার উপরে তুলে রাখার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু, ধর্মের জায়গা থেকে ফ্রিডম অফ স্পীচকে কত টুকু স্বাধীনতা দেয়া যায়, সেইটা কোন ধর্ম কতটুকু এলাউ করে, সেইটা নিয়ে থিয়লজিকাল যেই বিতর্ক আছে সেইটা রাষ্ট্রের সেই কন্সেপ্টের সাথে সাঙ্ঘরসিক হইতে পারে।
এই খানে আমরা বিষয়টা আরো একটু স্পেসিফিক করি। যখন ইসলাম ধর্মের প্রশ্ন আসে তখন, ফ্রিডম অফ স্পীচ না। বিষয়টা ব্লাস্ফেমি নিয়ে চলে যায়। তো আলচনার সুবিধার্থে আমরা ব্লাস্ফেমিতে ফোকাসড থাকি।
যাক ব্লাস্ফেমি জনিত ফ্রিডম অফ স্পীচের আলচনায় গেলে আমরা দেখবো, একটা জায়গায় প্রাসচাত্যের ফ্রিডম অফ স্পীচ এবং ইসলামের ফ্রিডম অফ স্পীচের কোন পার্থক্য নাই। সেইটা হইলো, উভয়েই মনে করে, যে ফ্রিডম অফ স্পীচ এবসলিউট না। উভয়েই মনে করে, ফ্রিডম অফ স্পীচের সীমানা আছে।
প্রাসচাত্যের ফ্রিডম অফ স্পীচ বলে দেয়, হারম প্রিন্সিপাল বা অফেন্স প্রিন্সিপাল হইলো, ফ্রিডম অফ স্পীচের সীমানা। কোন আচরন বা কথা যদি, সমাজ বা সমাজের একটা অংশ মনে করে যেই সেইটাকে তাকে সাইকোলজিকালি আঘাত দিচ্ছে, বা তার জন্যে ক্ষতি বয়ে আনছে- প্রাসচাত্যের ফ্রিডম অফ স্পীচের মূলনীতি হইলো, সেইটাই ফ্রিডম অফ স্পীচের সীমানা এবং সেইটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আর ইসলামের পরিভাষায়, অনেক গুলো কাজ এবং আচরনকে, অন্যায় হিসেবে, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ডিক্লেয়ার দেয়া হইছে। এই গুলো আল্লাহর আইন। এই গুলো অনেক ক্ষেত্রেই, মানবিকতা, মানুষের সামাজিক আচরণের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে আমলে নিয়ে তৈরি। যেমন গীবত না করা, যেমন আরেকজনকে আঘাত না করা ইত্যাদি।
তাইলে আমরা দেখতাছি, আল্লাহর আইন এবং প্রাসচাত্যের আইন উভয় ক্ষেত্রেই, ফ্রিডম অফ স্পীচের সীমানা আছে। এবং এই সীমানা ভাংলে কি শাস্তি হবে, সেইটা নিয়ে উভয় আইনেই, নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে।
আমরা এই খানে দেখবো, মোটের উপরে ফ্রান্সের কার্টুনিস্ট এবং প্রাসচাত্যের রাষ্ট্র এবং কার্টুনিস্টদের উপরে হামলা যারা করেছে, তারা উভয়েই তাদের নিজস্ব আইন ভেঙ্গেছে।এবং ভুল করেছে।
প্রথমে আমরা দেখি, পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের প্রবলেম। প্রাসচাত্য সমাজ এবং রাষ্ট্র, তাদের পলিটিকাল কারনে, মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্যে ব্যাপক সেন্সিটিভ এবং আপত্তিকর, কার্টুন এবং আর বিভিন্ন ধরনের লেখাতে, মুসলমান সমাজকে আঘাত করেছে নিরন্তর ভাবে। যেইটার মাধ্যমে তারা তাদের ফ্রিডম অফ স্পীচের মুল নীতি, অফেন্স প্রিন্সিপাল এবং হারম প্রিন্সিপালের ভায়লেশান করছে। কিন্তু করলেও, তারা সেই ব্যাপারে নির্বিকার কারন, তাদের সমাজে ইসলাম বিদ্বেষ ব্যাপক।কারন, তাদের সেই ক্রুসেডের ইনহেরিট করা মুসলমান ঘৃণা।
তারা, তাদের রাজা রানিদেরকে নিয়ে, এই ধরনের কিছু ছাপায় না। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু ছাপায় না। ছাপাইলেই, সেইটা এন্টি সেমিটিজমের শাস্তিতে পরে। কিন্তু , মুসলমানদের জন্যে তাদের অবস্থান ইন্সেন্সিটিভ। তারা মনে করে, মুসলমানদেরকে ইচ্ছা মত খোঁচানো যায়। তাদের নবীকে অপমান করা যায়, অথচ। এইটা, প্রাসচাত্যের ফ্রিডম অফ স্পীচের মুলনিতির একটা বড় ভায়লেশান।
এখন আসেন, যেই সব সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে, ১২ জন মানুষকে মারছে। তারা মনে করছে, তারা আল্লাহর আইন জারি করছে। কি অসম্ভব ভুল।প্রথমত, ব্লাস্ফেমির বিচার, হত্যা না।এই বিষয়ে অল্প পড়াশোনা করলেই দেখা যাবে, ইসলামে অনেক স্কুল আছে যেই খানে আলেমরা পরিষ্কার বলছেন, আল কোরআনে, পরিষ্কার ভাষায় বলা আছে কোন কোন ধরনের আচরনের জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে। সেই গুলোর মধ্যে, ব্লাসফেমি নাই। ব্লাসফেমির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সেইটা পলিটিকাল আবিষ্কার, যেইটা কোরানের কিছু ব্যাখ্যা থেকে এসেছে, ডাইরেক্ট কোরানের আদেশ থেকে আসে নাই। এই বিষয়ে, কয়ালিফাইড বিতর্কের মত জ্ঞান আমার নাই। ফলে, এই ডেলিবারেশেনে যাবোনা।
কিন্তু, একটা বিষয়ে আমার পরিষ্কার জ্ঞান আছে, সেইটা হইলো,শাস্তি যেইটাই হোক সেইটাকে একটা যোগ্য আদালতে বিচার করে, উভয় পক্ষের সাক্ষ্য প্রমান নিয়ে, শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সেই শাস্তিটা যাই হোক।
কিছু মানুষের ইচ্ছা হইছে, তারা রাসুলের অপমানকে মাথায় রেখে, ১০ ১২ জন মানুষকে খুন করে, ফেলবে, সেই ধরনের নৈরাজ্য কারি ধর্ম ইসলাম না।আমাদের নবী ছিলেন, অসম্ভব মানবিক একটা মানুষ। উনার পথে যারা কাটা বেছাতো, তারা কোন দিন কাটা না বেছালে তাদের খোজ খবর তিনি নিতেন। এই ধরনের মানবিকতা দিয়েই ইসলাম আজকে বিশ্বজয় করেছে।
কিন্তু, সেই ইসলামকে এবং মুসলিমদের তেল সাম্রাজ্যের লোভে, আজকে পুরো বিশ্বের সব চেয়ে নিকৃষ্ট জাত হিসেবে প্রজেক্ট করা হচ্ছে, অশান্তি সৃষ্টিকারি হিসেবে দেখানো হচ্ছে এই সব টেররিস্টদের কারনে। এরা সেই কার্টুনিস্টদের থেকে বেশী অপমান করছে নবীকে। তারা আজকে যেই ইসলামকে ডিফাইন করছে।
আজকে তাই, প্রাসচাত্য যেমন তার ফ্রিডম অফ স্পীচের মূলনীতি ভাঙ্গছে, শুধু মাত্র মুসলমানদের ক্ষেত্রে এবং ভেঙ্গে পৃথিবীকে অস্থিতিশীল করছে তাদের তেলের লোভ এবং মুসলমানদের থেকে ঘৃণার জায়গা থেকে ঠিক তেমনি একদল সন্ত্রাসী একটা শান্তির ধর্মকে টেররিস্টদের ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করাচ্ছে।
উভয়েই একে অপরের আইন থেকে নয়, তাদের নিজের আইন থেকেই অপরাধী। এবং উভয়ের বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটাই সবচেয়ে নৈতিক অবস্থান(অন্তত আমার মতে)।

পূর্ব প্রকাশিত ফেইস বুকে 

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *