নিজেকে নিজে চিন্তে হবে – (২য় পর্ব)

গত পর্বের নিজেকে নিজে চিন্তে হবে নিবন্ধটির পর দ্বিতীয় কিস্তিতে ইমাম গাজ্জালি (রা:) এর একটি কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি তার রচিত কিমিয়ায়ে সাআদাত গ্রন্থে প্রথম পরিচ্ছেদ আত্ম-দর্শনে বলেন,

” যে ব্যক্তি নিজেকে চিনিতে পারিয়াছে সে আল্লাহ’তালাকে চিনিতে পারিয়াছে।”

একজন বিশ্বাসীর জন্য এ কথাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নিজের অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ও সঠিক জ্ঞান না থাকলে অনেক ধর্ম-কর্ম অপর্যাপ্ত ও অপরিপূর্ণ থেকে যেতে পারে। যেমন কেউ হয়ত লোক দেখানো ইবাদত করতে পারে কিন্তু এটা আল্লাহর ইবাদততুল্য হতে পারে না। যশ-প্রশংসা, খ্যাতি, ক্ষমতা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। তাই ইখলাসের সাথে চলতে হলে আত্মজ্ঞানের প্রয়োজন। নিজেকে বাদ দিয়ে বাহ্যিক জ্ঞান নিজের কোনো কাজে আসতে পারে অথবা পারে না -এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়। তাই আত্মপথে জ্ঞান লাভের অধ্যায়কে সামনে রেখে ইমাম গাজ্জালি (রা:) বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে দুটি উপাদানে সৃষ্টি করেছেন যথা:

১) সাধারণ চোখে দৃশ্যমান আমাদের এই প্রকাশ্য দেহ

২) আভ্যন্তরীণ পদার্থ – রুহ, দেল বা আত্মা, পরমাত্মা যাহা জ্ঞান চক্ষু ব্যতীত চর্ম চক্ষে দেখা যায় না মানব সৃষ্টির সেই আভ্যন্তরীণ পদার্থটিই মানুষের মূল উপাদান যা X-Ray, MRI বা Scanning ইত্যাদি কোন কিছুতেই দৃষ্টি গোচর হবার নয়। এছাড়া বাকী যা কিছু বিদ্যমান তা মূল পদার্থের অধীনস্থ লস্কর, খেদমতগার বা আজ্ঞাবহ। মানুষের মৃত্যুর পর মানবের মূল পদার্থের অধীনস্থ লস্কর তথা শারীরিক সব উপাদান ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু তার আসল সত্ত্বা আত্মার সমাপ্তি নাই সেটা চিরন্তন থাকবে। তবে মৃত্যু বলতে যা বুঝা দরকার তাহল আত্মাকে এ দুনিয়ার জীবনের জন্য যে মানব দেহ ও তার অধীনস্থ লস্কর, খেদমতগার বা আজ্ঞাবহ সে সব উপাদান দেয়া হয়েছে তা থেকে বিদায় হওয়া  যা কিনা খুবই কষ্টকর। তাই আল্লাহ বলেন,

” কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত” প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে।

তারপর সে আত্মা পরকালের জীবনে চলে যাবে। স্কুল জীবনের শেষে একজন ছাত্রের রিপোর্ট কার্ড যেমন তার পড়াশুনার সফলতার সনদ থাকে তেমনি মানুষের দুনিয়ার জীবনে কৃতকর্মের রিপোর্ট কার্ডটি হবে তার আমলনামা যা প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ হচ্ছে এবং এর ভিত্তিতে সে পুরস্কার ও শাস্তি পাবে তার স্রষ্টার ইচ্ছা মাফিক। কোরআনে (সুরা ৬৭:২) আল্লাহ বলেন

“যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদের মৃত্যু ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করিবার জন্য – কে তোমাদের মধ্য কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।”

এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায় আল্লাহ নিজের পরিচয়ে যেমন পরাক্রমশালী বলছেন তেমনি ক্ষমাশীলও বলছেন (কত বড় আশার বানী!  বিশ্বাসীর কান্না আসার কথা যারা জীবনে ভুল ট্রুটি করেছেন – (সুরা ৩৯:৫৩-৫৪))। এখানেই আসে আল্লাহকে চিনার মাহাত্ম্য।

মানব জীবনের নির্মম পরিহাস হল  নাস্তিকদের বাদ দিয়েও ধর্মে বিশ্বাসী অনেক মানুষের মনে উপরোক্ত  ধারণাগুলো সচেতনার দিকে স্বল্প ও হাল্কা সচেতন। তারা  দৈনন্দিন জীবনের সাথে বিশ্বাসের সঠিক সমন্বয় খুব কমই ঘটিয়ে থাকেন। আর মূলত এই সঠিক বিশ্বাস ও সঠিক  প্রয়োগ দেখাতেই যুগে যুগে আল্লাহ নবী রসুল পাঠিয়েছেন। সেই নবী-রাসূলগণ ও তাদের ধর্মপ্রাণ অনুসারীগণ নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ঊঠে মানব জাতীকে যুগে যুগে আলোর পথে আহ্বান করেছেন। সে জন্য তাঁদেরকে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, ইতিহাস তার প্রমাণ বহন করে। শেষ নবী মোহাম্মদ (স:) বিশ্বের মানুষের কাছে শেষ নবী হিসাবে আরবের বুকে এসেছিলেন আজ থেকে ১৪০০শত বছর পূর্বে। তাঁর অনুসারীরা এক সময় পৃথিবীর বুকে এক সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। আজকের আধুনিক যে সভ্যতার গর্ব আমরা করতে চাই তার অনেক কিছুই ইসলামী স্বর্ণযুগের দার্শনিক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, ইত্যাদি পেশার লোকদের অবদানের কাছে ঋণী তা অস্বীকার করার উপায় নাই। এই মহান ব্যক্তিবর্গ খোদাভীতি (তাকওয়া) সহকারে জ্ঞানের পথে হেঁটেছেন, এবং খোদার এই বিস্ময়কর সৃষ্টিরাজিকে দেখেছেন। খোদাভীতি বা তাকওয়া জ্ঞান লাভের পথে বিশেষ করে আত্মজ্ঞানের পথে এক এক বড় পাথেয়। যারা তাকওয়ার সাথে জীবন যাপন করেন তাদেরকে মুত্তাকি বলা হয়। আল্লাহ কোরআনে মুত্তাকিদের ব্যাপারে বলেছেন,

“যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে …” (কুরআন সুরা বাকারা ২:২)।

তাকওয়া বিষয়ে আরো কয়কটি কথা বলা জরুরী। তাকওয়া ভিত্তিক জীবন একজন বিশ্বাসীকে মানবতাবোধ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়। ধনী-গরীব, সাদা-কালো নির্বিশেষে যে নারী পুরুষ তাকওয়া অবলম্বন করবে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সামগ্রিক জীবন পরিচালনায় ও সফলতায় এক অনবদ্য ও অপরিমেয় প্রভাব ফেলবে। কেননা তাকওয়া বোধ মানবীয় সহজাত প্রবৃত্তি (নফস) মানুষকে অন্যায়, অশ্লীল, খারাপ ও অনিষ্টিকর কথা, কাজ ও চিন্তা থেকে বিরত রাখে।

আজকাল ধর্মকে হীন অর্থে ধারণ করার যত যৌক্তিক প্রচেষ্টা ও প্রোপাগান্ডা দেখা যায় সেগুলো উপনিবেশ আমল থেকে শুরু হয়েছে এবং আজও চলছে। এই বিশ্বকে “ওয়ান ওয়ার্ল্ড অর্ডার” (One World Order) এর আয়ত্তে আনার প্রক্রিয়ায় সে ধারণা আরো প্রবল হচ্ছে ! আর এ মহলটি হচ্ছে ইসলামী পরিভাষায় তাগুতি শক্তি। এটিকে যারা নিছক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে উড়িয়ে দিতে চান তারা যে এ ব্যপারে অনেকটা মূর্খ এতে সন্দেহ নাই।

আসলে ওয়ান ওয়ার্ল্ড অর্ডার কি তা বুঝতে হবে। তবে ওয়ান ওয়ার্ল্ড অর্ডারের পিছনে কারা সে বিতর্কে না গিয়ে সেটা যে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র নায়কের কাছে বিশ্ব ব্যবস্থার ভবিষ্যত দর্শন হিসাবে প্রকাশ পাচ্ছে তা অস্বীকার করা যায় না। এই ওয়ান ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রবক্তারা কি সুন্দর ও গোছালো কথা বলেন তাদের ভিশনের পক্ষে যা শুনে হয়তবা শয়তানও লজ্জা পায়! কেননা তারা মুখে যা বলে বাস্তবে করে তার বিপরীত! তেমনি একটি উদাহরণ, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল।

Bush’s vision was, “A hundred generations have searched for this elusive path to peace, while a thousand wars raged across the span of human endeavor. Today that new world is struggling to be born, a world quite different from the one we’ve known”

অর্থাৎ ” সহস্র যুদ্ধের মানবিক প্রচেষ্টায় শত বছর চলে গেছে শান্তির সন্ধানে আধরা পথে। আজ এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা জন্মের সংগ্রাম চলছে, যা হবে এক আলাদা বিশ্ব যা আমরা এত দিন জানতাম তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।”

আসলেই এই নতুন বিশ্বে যে কি হতে যাচ্ছে এবং কিভাবে ভিন্ন হতে যাচ্ছে তা আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি! তাই বিশ্ব মোড়লদের কর্মকান্ড ও তাদের পরিচালিত মিডিয়ার আচরণ দেখে অনেকে যখন বলেন,

“ওয়ান ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রবক্তাদের কাছে সুদমুক্ত, সুসম অর্থনীতি, ও নাস্তিকতা মুক্ত এবং তৌহিদ ও তাকওয়া অভিমুখি ইসলামী সমাজ গঠন হচ্ছে এক বিরাট হুমকি সেটা পৃথিবীর ছোট বড় যে দেশেই হউক না কেন। সে চিন্তা চেতনার বাহক বিশ্বের তথাকথিত ইলিট সমাজের কাছে ইসলাম এখন একটি বড় সমস্যা।”

আসলে এ কথা যে একেবারে ভ্রান্ত তা বলা যায় না কেননা ইসলামকে শত্রু বানাবার যে অপচেষ্টা সর্বত্র বিদ্যমান তা থেকে পাওয়া যায় এর স্পষ্ট প্রমাণ!

যাক, আবার ফিরে আসি উপরোক্ত  কোরআনের আয়াতের  অদৃশ্য বা গায়েবে বিশ্বাস বলতে আমরা কি বুঝি সেটিতে। বিষয়টি ব্যাপক ও গভীর। এ বিশ্বাসকে বুঝতে ও সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করতে  সুফি সাধকরা যে জ্ঞানের অন্বেষণে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আজ আমাদেরকে সেই জ্ঞানের ধারায় যেতে হবে এবং তা কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হতে হবে। এখানে আবার বৈরাগ্যবাদও নেই। এটা যেমন মনে রাখতে হবে তেমনি দুনিয়ার অতিরিক্ত আসক্তির ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। অদৃশ্যে বিশ্বাসের জ্ঞানের অর্থ এই নয় যে, যে কেউ ভিটামিন ট্যাবলেটের মত কিছু গিলে খেলে তা অর্জিত হয়ে যাবে। এজন্য প্রত্যেকে নিজস্ব সাধনা করতে হবে, অনুশীলন করতে হবে নিজেকে মুত্তাকি করার। একজন মুত্তাকির বিশ্বাস বা ইমান হচ্ছে এমন এক গভীর দৃষ্টি ভঙ্গি অর্জন করা যা তার জীবনের চলার পথে,  জীবনের চারপাশের ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য যুক্তিবিজ্ঞান অর্জন, তার গবেষনা ও বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ইত্যাদি সকল প্রচেষ্টা । যার উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তিগত মুনাফা লাভ ও অন্যকে শোষণ নয় বরং জনকল্যাণ এবং তার স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া, স্রষ্টার হুকুম পালন করা এবং সেই সাথে চোখ ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বিষয়ের প্রতি হৃদয় ও মনে সংকেত পাওয়ার সক্ষমতা অর্জন। এ ক্ষমতা যার মনে প্রতিষ্ঠিত হবে তার কাছে নৈতিকতার মূল ভিত্তি হবে সমাজে মানুষের কল্যাণ। তার চিন্তা চেতনায় থাকবে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ -পরোপকার, আল্লাহর সন্তুষ্টি, পাপ পঙ্কিলতা ও অশ্লিলতামুক্ত ন্যায় ভিত্তিক বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের একটি সমাজ গঠন। এমন পুত-পবিত্র মন নিয়ে যখন তার নিজ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবে তখন তার পক্ষে গায়েবে বিশ্বাস ও আল্লাহর অস্তিত্ব বুঝার বিষয়টি সহজ হবে এবং আরো সহজ হবে কেন এই পৃথিবীর জ্ঞান, বিজ্ঞান, উন্নতি, প্রযুক্তি এসব কিছুর উদ্দেশ্যকে নৈতিক মূল্যবোধ (ethical value) এর সাথে সংগতি আনা দরকার তা বুঝার।
(চলবে,,,)

বি:দ্র :
সময় সাপেক্ষে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের নিচের ভিডিও ক্লিপটি শুনতে পারেন।

 

*******************************************************************

রেফারেন্স:

১) Why Islam?

২) কিমিয়ায়ে সাআদাত, ইমাম গাজ্জালি (রা:)

Comments are closed.