লিডারশীপ বা নেতৃত্বের দৈন্যতা

লিডারশীপ বা নেতৃত্ব কাকে বলে?

লিডারশীপ বা নেতৃত্ব হচ্ছে একজন মানুষের সেই সক্ষমতা যা দিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সমাজের মানুষকে বা কোন দলকে অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে পরিচালিত করতে পারে। একজন সফল নেতার দায়িত্ব হচ্ছে তার অনুসারীদেরকে শুধু অনুপ্রেরিত ও পরিচালিত বা তাদের দিয়ে কাজ করানোই নয় বরং তার অনুসারীদের মাঝ থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্যতা অর্জনের প্রতিভার অন্বেষণ ও প্রশিক্ষণ।

তবে যে কোন আন্দোলনের নেতৃত্বে বিশ্বাসযোগ্যতা বা Credibility একটি বিরাট ব্যাপার, বিশেষ করে কোন সমাজের গুনগত পরিবর্তনের আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আজকাল মুসলিম বিশ্বের দূর্বৃত্তায়নের যুগে মানবতার কল্যাণে ইসলামী আদর্শের নেতৃত্বকে সামনে আসতে হলে সমাজে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বা Credibility অর্জন করতে হবে। আর তা কেবল সম্ভব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারলে। এখানে বক্তৃতা ভাষণের চেয়ে বড় প্রয়োজন দক্ষতার সহিত মানুষের কল্যাণে কাজ করে জনগণের আস্থা অর্জন। আদর্শিক আন্দোলনে ব্যক্তির চেয়ে আদর্শ বড় তাই আদর্শের স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। আর শুধু আদর্শের বুলি আওড়ালে কাজ হবে না বাস্তবে মানুষের বৈষয়িক জীবনের কোন কাজে না আসলে সে নেতৃত্ব সমাজের গুনগত পরিবর্তনে সফল ভূমিকা রাখতে পারবেনা। দুনিয়ার কামিয়াবি ও আখেরাতের সাফল্য উভয়ই হতে হবে সঠিক নেতৃত্বের কাম্য। সঠিক লিডারশীপের যোগ্যতা অর্জন করাটাও একটি বিরাট বিষয়। আজকের লিখাটায় চেষ্টা করব সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করার। এখানে কাউকে হেয় বা অসম্মান করার জন্য নয় বরং এ আলোচনায় কিছুটা সচেতনতা জাগবে সে প্রত্যাশায় এ প্রচেষ্টা।

একটি দেশের সত্যিকার উন্নতি তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্রে সুশাসন থাকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণ মুক্ত করে সমাজে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং গণতন্ত্র,মৌলিক অধিকার,বাক স্বাধীনতা,লিঙ্গ সমতা, দায়বদ্ধতা সহ স্বচ্ছ শাসন প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুসারে রাষ্ট্র চলে। অতএব মানবতার কল্যাণে বিশ্বজনীন এই নীতিমালা অর্জনের লক্ষ্যে দেশে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে দরকার নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত একটি দক্ষ জনশক্তির। কিন্তু সমস্যা হল মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছেন বা যাদেরকে বিশ্ব মোড়লরা ক্ষমতায় দেখতে চায় তাদের কাছে কখনও এটি আশা করা যায় না আবার যারা সমাজ পরিবর্তন করতে চান তারাও সমাজে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বা Credibility অর্জন করতে অনেক পিছনে পড়ে আছেন। এ জন্য সবচেয়ে বড় অভাব হচ্ছে একজন সুযোগ্য ও দূরদৃষ্টি সুসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্বের।

একজন মুসলিম হিসাবে আমরা যদি রাসুল (স:) এর সিরাহ্ তথা জীবন ইতিহাস দেখি তাহলে সেখান থেকেও অনেক কিছু শিখার আছে যা আমরা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করেও অনেকেই জানতে চাইনা!
বিশেষ করে রাসুল (স:)নবুওয়ত-পূর্ব জীবনে মহান আল্লাহ তাঁর রসুলের বিশ্বাসযোগ্যতা বা Credibility গড়তে কি করেছেন তা জানা দরকার। এ প্রসঙ্গে এখানে একটি ভিডিও সংযোজন করলাম যা ইতিমধ্যে ৪৭ হাজারের হাজারে ঊর্ধ্বে মানুষ দেখেছেন। ধৈর্য ধরে পুরাটা শুনতে হবে। আর না শুনলে ও না পড়লে জ্ঞান অর্জন কেমনে হবে? আগের যুগে বিজ্ঞ মুসলিমেরা শত শত মাইল সফর করতেন মাসের পর মাস,বছরের পর বছর সময় ব্যয় করেছেন ইসলামী জ্ঞান অর্জনে আর আজ আমরা তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ঘরে বসে অনেক কিছু জানার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সামান্য সময় ব্যয় করতে চাই না ভাবতে অবাক লাগে!

আমরা জানি রাসুল (স:) নবুওয়তের পূর্বে আরব সমাজে তিনি “আল্ আমিন ও আস্ সাদিক” তথা সত্যবাদী ও বিশ্বাসী সুযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।
এমনকি বিখ্যাত ইতিহাস-রচয়িতা Sir William Muir রাসুল (স:) এর বাল্যকালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেন,
“Our authorities all agree in ascribing to the youth of Muhammad a modesty of deportment and purity of manners rare among the Makkans …….. Endowed with a refined mind and delicate taste, reserved and meditative, he lived much within himself, and the pondering of his heart no doubt supplied occupation for leisure hours spent by others of a low stamp in rude sports and profligacy. The fair character and honourable bearings of the unobtrusive youth won the approbation of his fellow-citizens: and by common consent he received the title of al-Amin the Faithful”

এখন কথা হল এই খ্যাতি রাসুল (স:) নিশ্চয় ঘরে বসে পান নাই বরং সে খ্যাতি অর্জনে তিনি মানুষের সাথে উঠা বসা চলা ফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন দেন ও তার উত্তম চারিত্রিক ব্যবহারের মধ্যমে সমাজে রোল মডেল হিসাবে খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন । তারপর মোহাম্মদ (স:) বয়স ৪০ বৎসর অতিক্রম হওয়ার পরই আল্লাহ তাঁকে রাসুল হিসাবে ইসলামের আদর্শ প্রচারের দায়িত্ব দেন। এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা বা Credibility গুরুত্ব কি বুঝা যায় না?

সে জন্য মানুষের কল্যাণে যে কোন আন্দোলন সফলকাম হবে যখন সে আন্দোলনে যারা জড়িত তারা সকল প্রকার সন্দেহ ও বিতর্কের বাহিরে থেকে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ আন্তরিক মনে ও ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সে আন্দোলনের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত হবে। আর সে প্রচেষ্টা হতে হবে ছলনাবিহীন একান্ত খাঁটি মনে এবং তা পরিচালিত হতে হবে সুযোগ্য দক্ষ নেতৃত্বে।

প্রশ্ন হচ্ছে কোন প্রতিষ্ঠানে বা কোন আদর্শিক আন্দোলনে একজন সুযোগ্য তথা দক্ষ ও দূরদৃষ্টি সুসম্পন্ন নেতৃত্ব কিভাবে গড়া যায়? আমি মনে করি বর্তমানে আদর্শিক আন্দোলনে যারা নিজেদেরকে শরিক করতে চান তাদের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সবচেয়ে বেশী জরুরী। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র (সিএসসিএস) এর ওয়েব সাইটে প্রকাশিত ড: তারেক সুয়েইদানের Leadership Challenges from Islamic Perspective নিবন্ধটি পড়া উচিত মনে করি।

সফল নেতৃত্বের উদাহরণ।

এ বিশ্বের সবচেয়ে সফল নেতৃত্বের উদাহরণ হচ্ছেন ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ (স:)। নেতৃত্বের ইতিহাসে তাঁর সমান অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছেন এমন অন্য কোন ব্যক্তি মানবজাতির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কিভাবে মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হয় এবং নেতৃত্ব বিষয়ক আধুনিক বিশ্বের লেখকদের সকল বই পুস্তক পড়লে দেখা যায় সেগুলাতে নবীজির নেতৃত্বের গুণাবলীর কথাই বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নেতা এবং মানবতার জন্য মডেল। একটি জাহেলী সমাজের মানুষকে তিনি পরিচালিত করেছেন,অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সর্বোত্তম ডিসিপ্লিন শিখিয়েছেন। আর সে সমাজের এমন ছিল যখন মেয়েদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া হত, অধিকাংশ মানুষেরা ছিল নিরক্ষর,অশিক্ষিত, যারা একে অন্যকে হত্যা করত তুচ্ছ কারণে। সেই বর্বর চরিত্রের জন গুষ্টিকে কিভাবে মোহাম্মদ (স:) সক্ষম হন ইসলামের পথে অনুপ্রাণিত করতে। তিনি সম্পূর্ণ নেতিবাচক একটি সমাজকে ইতিবাচক সমাজে পরিবর্তন করে একটি সভ্যতার সৃষ্টি করেন যা অর্ধেক পৃথিবীকে দীর্ঘদিন শাসন করেছে।

ইন্টারনেটে দেখলাম জনৈক সুলতান মাহমুদ ইসলামী নেতৃত্বের বিষয়ে একজন ইসলামী স্কলারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “ইসলামী নেতৃত্ব হচ্ছে বিশ্ব মানবতাকে ধ্বংসের প্রান্ত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর পথে নিয়ে আসা।”। আসলেই আল্লাহ যেহেতু মানুষকে সৃষ্টি করছেন তাই তিনিই ভাল জানেন মানুষের জন্য কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ।

ইসলামী নেতৃত্বের মডেল বোঝার জন্য আমাদের প্রিয় নবীর জীবন, বিশেষ করে নেতা হিসেবে তাঁর নিজের ও তাঁর সহচারী তথা সাহাবীদের নেতৃত্বের গুণাবলী পরীক্ষা করলে দেখা যায় তাঁরা:

১) মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রাণিত করেছেন।
২) অনুগামীদের প্রতি ছিল তাদের অফুরন্ত ভালবাসা ও উদারতা এবং প্রচুর দরদ।
৩) পরস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সর্বদা ছিল অটুট।
৪ তাঁরা ছিলেন একে অন্যের বিশ্বাসী ও আস্থা ভাজন।
৫) পরামর্শের দরজা ছিল সর্বদা উন্মুক্ত তাদের কাছে ।
৬) অন্যের স্বার্থে তারা নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করেছেন।
৭) তাদের ছিল দায়িত্ব বোধ এবং আল্লাহর উপর অটল বিশ্বাস।
৮) তাঁদের ছিল খোলা মন
৯) তাঁদের ছিল দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা
১০) মানুষের সমস্যা বুঝার ক্ষমতা
১১) যোগাযোগ দক্ষতা (Communication skills )
১২) সু-দূরদর্শী ও পরিকল্পনাকারী (Farsighted and Planning )
১৩) প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ও আমানতের খেয়ানত না করা।
১৪) জবাবদিহিতার নেতৃত্ব।
১৫) কখনও তাঁরা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন না।

নেতা হিসাবে বিভিন্ন সংকটপূর্ণ সময়ে প্রিয় নবী মোহাম্মদ (স:) এর নিকট ওহির মধ্যামে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কিভাবে নির্দিশ দিয়েছেন তার এক অসাধারন র্ব্ননা পাবেন নিম্নের ভিডিও আলোচনায়।

অপর দিকে ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার নেতৃত্বের উদ্দেশ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা. নিজের স্বার্থ রক্ষা,খ্যাতি অর্জন (রিয়া) ও বস্তুবাদ। সেকুলারদের কাছে দুনিয়ার জীবনের স্বার্থটাই বড়। ইসলামি নেতৃত্ব এর লক্ষ্য সমাজের সবার স্বার্থে কাজ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান লাভ করা।
ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে সেকুলার নেতৃত্ব মানুষকে ধোকা ও মিথ্যা ওয়াদা বা কৃত্রিম সমস্যার ভয় দেখিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন করলেও মানুষের কোন কল্যাণ আসেনা তখন মুষ্টিমেয় কিছু লোক লাভবান হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসে না। তাই দেখা যায় এমন নেতৃত্বের পিছনে ছুটে গিয়ে অনেক জনগুষ্টি উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পড়ে।

অতএব, উপরুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী নেতৃত্ব গড়তে পারলে মুসলিম বিশ্বে শান্তি আসবে ইনশাআল্লাহ।

References
Ahmed, A. (1987). Islam, Ethnicity and Leadership in South Asia. New York: Oxford University Press, USA.
Bangash, Z. (2001). Concepts of Leader and Leadership in Islam, The. New York: Crescent Publications.
Leadershi in the Islamic Perspective Regarding our culture. by Sultan Muhammad
Abul Ala, . (n.d.). Principles of Islamic Leadership. Retrieved June 12, 2008,
The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History by Michael H. Hart,

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *