‘সহিষ্ণু’ জাতি এবং সভ্যতার বস্ত্রহরণ

লবণসহিষ্ণু বীজ আর ভূমিকম্পসহিষ্ণু দালান। কিন্তু অত্যাচারসহিষ্ণু জাতি আবার কী? যে জাতি অত্যাচারিতের বিরুদ্ধে অত্যাচারীর পক্ষ নেয়, এরাই অত্যাচারসহিষ্ণু জাতি।

প্রশ্ন, এসব কথা ওরা কেন বলছে? ঈদের আগের দিন সাদ্দামের ফাঁসির সাথে ট্রাইব্যুনালের তুলনা করে আমাদের বিতর্কিত ফাঁসিগুলোকেও কি এক মানদণ্ডে দাঁড় করানো হলো না! সাদ্দামের ফাঁসির পেছনে বুশের মোটিভ সবাই জানে। এ কথাও জানে, ৯/১১-এর আগে আইএস বা আল-শাবাব পর্যায়ের সন্ত্রাস কখনোই ছিল না। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নাম কেউ শোনেনি। কিন্তু এখন? ৯/১১-এর মাশুল দিচ্ছে সারা বিশ্ব। যেন সাপের আস্তানায় ঢিল ছুড়েছেন বুশ। গ্রেফতারের ভয়ে আমেরিকার বাইরে না যাওয়ার কারণ মাথার ওপর ওয়্যারক্রাইমের অভিযোগ। ইরাকে সাংবাদিকের জুতা খাওয়ার পর থেকে লেজ গুটিয়েছেন। ডাব্লিউএমডি আবিষ্কার, সাদ্দামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ, ৯/১১-এর ষড়যন্ত্রকারী সব কিছুই সাজানো নাটক। উদ্দেশ্য একটাই, ইরাকের খনিজসম্পদ দখলে রাখার জন্য সাদ্দামের ফাঁসি দিয়ে বাথ পার্টিকে বিলুপ্ত করা। মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র বুশ ছাড়া অন্য কোনো প্রেসিডেন্টকেই এড়িয়ে যায়নি তার দল। এদিকে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর আলোচিত বক্তব্যের অর্থ বিশাল।
১/১১ থেকে এ যেন অচেনা বাংলাদেশ। নির্যাতন সইতে সইতে এমন সহিষ্ণু জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছি, ধর্ষকের হাতে আপনজনকে সঁপে দিয়ে উল্লাস ফেটে পড়ব। অপরাজনীতি শিখিয়েছে, সভ্যতাকে কিভাবে উলঙ্গ করতে হয়। আর আওয়ামী লীগ একাই শিখিয়েছে শোক হলে কেন উল্লাস করতে হবে এবং বিশেষ করে যখন তা জিয়া পরিবার। ড. ইউনূসসহ বছরজুড়েই সভ্যতার বস্ত্রহরণে তাদের রেনেসাঁর কথা সারা বিশ্ব জানে।
রানা প্লাজা, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকÑ অপরাধগুলো বোমার মতো আসে কিন্তু ঢেউয়ের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে কার ইশারায়? বাতাসে লাশের গন্ধ কিন্তু নিপীড়নের পক্ষে উলঙ্গ উৎসব কিছুতেই থামছে না। তাহলে উৎসব দিয়ে ঘুম পাড়ানোই কি আওয়ামী রাজনীতির মন্ত্র? ৫ জানুয়ারির পর ২৮ এপ্রিলের ভোট ডাকাতির ঘটনাও উৎসব থেকে একচুল নড়াতে পারল না। ভারত-পাকিস্তানেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বই লেখা হয়। আমরাও বানিয়েছি জীবন থেকে নেয়ার মতো আইয়ুববিরোধী সিনেমা, করেছি ১১ দফা আন্দোলন। কিন্তু বর্তমান আমলে এসব কথা কল্পনাও করা বৃথা। ভারতের আছে গণতন্ত্র, অন্য দেশের আছে আদালত। কম গণতন্ত্র বেশি উন্নতির দেশে, প্রোপাগান্ডা ছাড়া আমাদের আর কী আছে? ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। মানুষ মরুক, চীন-রাশিয়া-ভারত খুশি থাকলেই যথেষ্ট। বুশ ক্ষমতায় থাকাকালেই তার বিরুদ্ধে ‘৯/১১ ফারেনহাইটের’ মতো ছায়া ছবি নির্মাণ হয়েছিল। এভাবেই মানুষ সচেতন হয়। আমার মতো চুনোপুঁটির লেখা থেকেও ঝাল-নুন কমাতে হয় সম্পাদকের। এ সবই মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে সরকারি অবস্থানের প্রভাব। হাওয়ার্ড জিন্স এবং প্রভাব চমস্কিরা আমেরিকাতে বসেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে লিখে প্রশংসিত। আজ যারা বেশি উন্নতি কম গণতন্ত্রের জন্য পাগলা ঘোড়া, ওই জ্ঞানীগুণীরাই নোয়াম চমস্কি বলতে পাগল। এর অর্থ দাঁড়ায়Ñ মুক্তচিন্তাকে কারারুদ্ধ করলে গণতন্ত্র কারারুদ্ধ হয়। আমাদের বিজ্ঞজনেরা এখন বই লেখেন না, পরিচালকেরা ভালো ছবি তৈরি করেন না বরং রাজনীতিতে ঝাঁপ দিয়ে অধ্যাপকেরাও টেলিভিশনে লাইভ মারামারি এবং গালিগালাজ শিক্ষা, কোনোটাই বাদ দেন না। সভ্যতার বস্ত্রহরণে আওয়ামী রেনেসাঁই নির্যাতন সহিষ্ণু জাতি সৃষ্টির একমাত্র কারণ। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র পর্যন্ত আলোচনায় না থাকাটা কিসের প্রমাণ? অন্যথায় ৯/১১-এর মতো দশক ধরে আলোচনায় থাকার কথা রানা প্লাজা কিংবা সাত মার্ডারের মতো ঘটনাগুলো। উল্টো, বেশির ভাগ মিডিয়ার কাজ অপরাধমূলক ঘটনাগুলো নিভিয়ে দিয়ে, কম গণতন্ত্র বেশি উন্নতি প্রচার করা।
মুক্তচিন্তার বিকল্প নেই। একমাত্র আফ্রিকান ওয়্যারলর্ড ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি দৃষ্টান্ত নেই যেখানে অত্যাচারের প্রতিবাদ না করে অত্যাচারীর পক্ষে দাঁড়ায়। এমন জাতি হয়তো পৃথিবীতে একটাই। শ্রদ্ধেয় কলামিস্ট এরশাদ মজুমদার খোদার কাছে মুক্তি চেয়ে কলাম লিখেছেন। আমার কথা, খোদাও বলেছেন, ‘তোমরা নড়াচড়া করো।’ মুক্তি কিভাবে আসে প্রমাণ দিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা। শ্বেতাঙ্গদের নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে রচিত এলিস হেইলির রুটস বইটি বিশ্ববিখ্যাত। ৪০০ বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের যারা একতরফা পিটিয়েছে, বাল্টিমোরের ঘটনার পর, কালোদের ‘সিভিল রাইটস’ ভঙ্গের অভিযোগে সেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ আইনমন্ত্রী (এই সেই মন্ত্রী যিনি বাংলাদেশী নাফিসের প্রসিকিউটর)। অর্থাৎ প্রতিবাদই মুক্তি।
শরীরের ওপর বুদ্ধিযুক্ত মাথা থাকলেই মানুষ নয়। অন্যায় থেকে ন্যায়কে আলাদা করার সক্ষমতা পশুর নেই। বিএনপির প্রায়শ্চিত্ত শেষ। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত দূরে থাক বরং পরাশক্তির হস্তক্ষেপে বৃহস্পতি আরো তুঙ্গে। জুলুম দেখেও জ্ঞানীগুণীরাই যখন ক্ষমতাসীনদের মাইক, গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ হবে না কেন? অত্যাচারিতের পক্ষে কেউ নেই বরং অত্যাচারীর পক্ষে ব্যানার-ফেস্টুন। এমনকি সহস্র নাগরিকের ব্যানারে সুপরিচিত ব্যক্তিত্বরাও সুবিধাবাদী অমুক স্যারদের মতো কিছু প্রত্যাশায় রাস্তায় নেমে পড়েছেন। সভ্যতার বস্ত্রহরণকারীরা একমাত্র কুশিক্ষা ছাড়া জাতিকে কিছুই দিতে পারবে না। আফ্রিকার নির্বাচন স্বচ্ছ করতে বাংলাদেশী সৈন্য পাঠিয়ে নিজের দেশে ভোট ডাকাতির ইতিহাস সৃষ্টি করি।
২.
ভুলে গেছি রাজবন্দীদের কথা
প্রদীপের আলোর তলে রাজত্ব করে ঘন অন্ধকার। সময়ের সাথে ঊর্ধ্বে না উঠলে আমরা সবাই কিন্তু নিচেই পড়ে থাকব। আওয়ামী লীগ জানে, কিভাবে তারা বিনা খরচে ঘৃণা-অপমানের কোর্স দিয়ে যাচ্ছে। মানীগুণীদের ইজ্জত লুণ্ঠনের কাজে অর্থ আর শিক্ষকের অভাব হয় না। ব্যাংক এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দৃশ্যত ছাত্রলীগের টাকার গোডাউন। এদিকে কুকর্মের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপের সাথে মন্ত্রিসভায় উন্নতির বিলগুলো পাস হওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়।
চৌধুরী আলমদের গুম-খুনের খবরের আয়ু কয় দিন? জেলখানাগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ বেশি বন্দীদের মধ্যে রাজবন্দীরাও বড় একটি অংশ, যারা আলোচনাতেই নেই। এমনকি দলের লোকেরও ভুলে গেছে। নানা ব্যাধি শরীরে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু পথযাত্রী তারা। মাহমুদুর রহমানদেরকে সেই কবে থেকে বিনাবিচারে জেলে রেখে বছরের পর বছর পচানো হচ্ছে। সত্য প্রকাশ করাই তাদের অপরাধ। সুস্থ মানুষ ধরে নিয়ে যায়, রিমান্ডের পর রিমান্ড দিয়ে চেহারার ব্লুপ্রিন্ট পাল্টে ফেলে। কিন্তু এ সবের বিরুদ্ধে কেউ নেই, কথিত এক্টিভিস্টরাও রক্তশূন্য মানববন্ধনে সীমাবদ্ধ। এসব করে কিছু হবে কি? বলছি, পিন্টুর মৃত্যু স্বাভাবিক হলে অস্বাভাবিক মৃত্যু কী? এই মৃত্যু কেন অস্বাভাবিক, আইনের দেশ হলে অবশ্যই এর তদন্ত হতো। কারাবন্দী কিংবা পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুগুলোর একটিও স্বাভাবিক হলে প্রমাণ চাই। প্রতিশোধের রাজনীতিতে এখন আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে, পিন্টুর মতো মৃত্যুগুলো কোনো খবরই নয়। মির্জা ফখরুলকে ময়লার ট্রাকে আগুন, মান্নাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, মাহমুদুর রহমানকে ধর্মীয় উসকানি, একুশে টিভির সিইওকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ইত্যাদি নিপীড়নের কিছু নমুনা। আমরা বিশ্ববিবেকে কড়া নাড়তে ব্যর্থ হওয়ায় রাজবন্দীদের নীরব ও সরব মৃত্যু চলছে, চলবে।
ইরাকের আবু গরিব প্রিজনে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা বিশ্বের কাছে ফাঁস করে দিলো মার্কিনীরাই। সিআইএর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব মিডিয়া, সরব সাধারণ নাগরিকেরাও। তবে আমরাই একমাত্র জাতি যারা এই হারে নির্যাতন দেখেও ঠা-ঠা হাসতে পারি। রিমান্ড দিলে উল্লসিত হয়ে মিছিলে যাই। ফাঁসির খবরে কেক কাটি কিন্তু ত্বকির অথবা সাত মার্ডারের ঘটনায় বিচলিত নই। সাগর-রুনিকে কবর থেকে তুলে তদন্তের নামে গা ঢাকা দেয়ার পরেও নিশ্চুপ। বিশ্বজিতের লাইভ হত্যাকাণ্ডের পরেও খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবিতে শাহবাগে একটি লোকও নেই। আমরা হয়তো আর মানুষই নই। অন্যথায় অন্যায়কে ন্যায় বলে চাপিয়ে দেয়ার তোড়জোড় এত বেশি কেন?
মেয়র মান্নান, বাবর, মাহমুদুর রহমান, মান্নাভাইদের চেহারায় নির্যাতনের ছাপ। খালেদার ধৈর্য-সহিষ্ণুতা দলের জন্য সমস্যা হতে পারে, যা সাধারণ নাগরিকদের জন্য অস্বস্তিকর। এদিকে, পিন্টুর ডাক্তার পর্যন্ত চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। আদালত তাকে ঢাকার বাইরে নিতে নিষেধ করেছিলেন। প্রশ্ন, কার ইশারায় রাজশাহী নেয়া হলো? এই খানেই সব প্রশ্নের উত্তর। সুতরাং আদালতের স্বপ্রণোদিত হওয়াই উচিত।
রাজবন্দীদের পক্ষে এখনই সোচ্চার না হলে আরো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সরকারের চোখে কারাবন্দীদের মানবাধিকার নেই, মন্ত্রীদের মুখে প্রমাণ ছাড়াই সবক’টা দোষী। যেন উনারাই আদালত। জেলকোড ভঙ্গের উৎসব। অসুস্থদের পর্যন্ত চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ। কারা কর্মচারীরা দিনকে রাত, রাতকে দিন বানাচ্ছেন। পিন্টুর চিকিৎসার বিষয়ে অসত্য কথা বলেছেন। জেলকোডে এগুলো শাস্তিযোগ্য। রাজবন্দীদের কিসের সংস্পর্শে আনা হচ্ছে, তা প্রিয়জনদের না জানাটা বিপজ্জনক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাজাপ্রাপ্তদের একটার পর একটা মৃত্যুর ঘটনা সন্দেহজনক। তবে কারাগারে পিন্টুর মৃত্যুই শেষ নয়।
৩.
পুত্রশোকের জবাবে
খালেদা আমাকে খাওয়ান না, পরান না, আমিও নই; কখনোই তাকে চোখে দেখিনি। তবে গাঁটের পয়সা খর্চা করে ২০০৮ সালে ওয়াশিংটনে হাসিনাকে দেখতে যাওয়ার কারণ, ফতোয়া চুক্তির পরেই হাসিনার মতিগতিতে গাফ্ফার চৌধুরীর অস্বস্তি। অনেকেই এখন আমাকে একটি বিশেষ দলের সমর্থক বলে মন্তব্য করেন। প্রশ্ন, ১২ বছর জনকণ্ঠে লিখে কি আওয়ামী লীগার? বরং প্রফেসর অমুকদের মতো সুবিধাবাদীদের দৃষ্টান্ত হলে বুঝতাম। উল্টো, নয়া দিগন্তে অন্য স্রোতের কলামিস্টদের সংখ্যা বাড়ছে। বলছি, সময় এলে আবারো হাসিনার কর্মকাণ্ড সমর্থন করবা। আপাদমস্তক আমি একজন মুক্তচিন্তার মানুষ, কোনো দলের তিলক আমার কপালে নেই। তবে লেখার অপরাধে খালেদার আমলে সামান্য যন্ত্রণা ভোগ করলেও ১৯৭৪-এর রেকর্ড ভঙ্গ করল আওয়ামী লীগ নিজেই। কিছু লেখা যাবে না। কিছু বলা যাবে না। কোনো প্রশ্ন করা নিষেধ। এরা কাউকে ছাড়ে না। এমনকি ড. ইউনূসকেও না। এদের শিক্ষা এমন, শিক্ষকের ঘাড় ধাক্কা দাও। হচ্ছে সেটাই। এত সব কুকর্মের পর আইনের দেশ হলে নিক্সনের মতো বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত পাবলিক। এই দেশে আইন নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না। প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না। যে যা মনে করে, সেটাই যেন আইন। নাসিম, কামরুল, সুরঞ্জিত বাবুরা প্রতিদিনই যা বলেন সেটাও আইন। শামীম ওসমানের লাইভ হুমকি-ধমকিও আইন। মনে পড়ে, ফজলুল হক মনির সেই বিখ্যাত কথা। ‘দেশে অন্য কোনো আইন থাকবে না, মুজিবের কথায় যুদ্ধ হয়েছে, মুজিব কোনো আইন মানেননি, সুতরাং এখন থেকে তিনি যা বলেন সেটাই আইন।’ ৪০ বছর পর পরিস্থিতির আরো অবনতি। এমনকি আমার মতো চুনোপুঁটির বিরুদ্ধেও গোয়েন্দাদের ব্যস্ততা। এটাই যখন রাষ্ট্রের চরিত্র, তখন ভলতেয়ারের কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, পছন্দ না হলেও বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করতে হবে, প্রয়োজনে জীবনও দিতে হবে। কথাটি নেহায়েত সাংকেতিক অর্থে। বাস্তবে কারো জন্যই জীবন দিই না; তবে ন্যূনতম সম্মানটুকু করতে পারি, বিশেষ করে যখন তা কারো অকালমৃত্যু।
সাতসকালে কম্পিউটার খুলেই দুচোখ ভিজে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম নিন্দুকদের কাজ। কিন্তু না, সত্যিই কোকোর মৃত্যু হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে চেয়ারে বসে রইলাম। তখনই ভেবেছি, আবারো শেকসপিয়ারের নাটক শুরু হবে এবং সেটাই হলো। মৃত্যুশোক নয়, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির নাটক। নাটক শেষ। হাউজ ফুল দর্শকেরা বেজায় প্রতিক্রিয়াশীল এবং পারমাণবিক বোমার মতো উত্তেজিত। তাদের ভাষ্য, এটা কী করলেন খালেদা! আমাদের নেত্রীকে অপমান? মহান নেত্রী সব ভুলে সমবেদনা জানাতে গেলে দরজা বন্ধ রাখা? ৫ জানুয়ারির আগেও টেলিফোনে অপমান! খালেদা একজন ডাইনি, হিংস্র, জঙ্গি… ইত্যাদি। অর্থাৎ, নাটকের সাফল্য সেখানেই, দর্শকেরা যখন এতটা প্রতিক্রিয়াশীল হয়। পুত্রশোকাহত মা নয়, ভিলেন খালেদা নাটকের মূল বিষয়। যতবড় শত্র“ই হোক, একমাত্র আফ্রিকান ওয়্যারলর্ড ছাড়া পুত্রশোকাহতের বিরুদ্ধে কোনো বাঙালিই এ ধরনের একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিতে এই ধরনের উদাহরণ প্রথম। কখনোই বিশ্বাস করতে চাই না, মায়েরাও খালেদাকে এই ভাষায় গালাগাল করল! এমনকি, প্রধানমন্ত্রীও সদ্যপুত্রহারার কাটাঘায়ে নুন দিতে একচুল ছাড় দেননি। এমন সব বাক্য উচ্চারণ করেছেন যা কোনো মায়ের পক্ষে অসম্ভব (সব আর্কাইভে)। অন্তত ওই রকম সময়ে রাজনীতি না করলেও চলত।
মন্ত্রীদের বিষোদগারের কিছু নমুনা দিলাম। ‘সন্তানের জন্য খালেদার মায়া নেই, মায়া ক্ষমতার জন্য। কোকো গাঁজাখোর, নেশাখোর, এ জন্যই মরেছে। খালেদা মাছের মা। পুড়িয়ে মানুষ মারার জন্য গজব পড়েছে। বিদেশে বসে লাখ লাখ টাকার গাঁজা খাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে। মুদ্রাপাচারকারী পুত্রের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী, অসুস্থ পুত্রকে পর্যন্ত দেখতে যায়নি, কেমন মা খালেদা…!’ অর্থাৎ শকুনের মতো মড়াকেই ছিঁড়ে খাচ্ছে কিন্তু সমালোচকেরা নীরব দর্শক। এমনকি ২০ দলও নীরব। কোকোর ঘটনায় মনে হতে পারে, এরপর থেকে মায়েদের উচিত, পুত্রশোক হলে উল্লাস করা। তিন কুল হারানো বিএনপির উচিত প্রাণ খুলে সত্য কথা বলা। বলে না বলেই প্রতিপক্ষ এত বেশি উগ্রমূর্তি।
এবার আমাদের সাত বছর পেছনে ফিরে সত্য বের করতে হবে। ১/১১-এর সময় থেকে এই পরিবারটির ওপর পরিকল্পিত অত্যাচার। ১/১১-এর সরকার রিমান্ডে নিয়ে একজনের মেরুদণ্ডের হাড় গুঁড়া, দুই পুত্রকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা এবং এক নেত্রীকে বিদেশে পাঠিয়ে দলের জন্য সুবিধা করা। এরপর থেকেই খালেদার দল ও পরিবার লণ্ডভণ্ড করার অদম্য উৎসব । এই যুদ্ধ সামাল দেবে কে? আমার প্রশ্ন, আদালত থাকলে সব সরকারের আমলেই রিমান্ডের প্রয়োজন কেন? রিমান্ডই কি তাহলে বিচারক? ২০ দলের বিরুদ্ধে লাখো মামলা দিয়ে মইনু-ফখরুর মতো ক্রিমিনালদের বিষয়ে নীরব সর্বোচ্চ নির্বাহী। কিন্তু কেন? খালেদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার বিষয়টিকে কী চোখে দেখছেন সমালোচকেরা! মইনু-ফখরুর সাথে মিটিং করে দেশ ছাড়ার সময়, ঢাকা এয়ারপোর্টে খোলামেলা ঘোষণা, সরকার গঠন করতে পারলে ১/১১কে বৈধতা দেবো। কথাটি নিশ্চয়ই হাওয়া থেকে পাওয়া নয় বরং শক্ত ভিত্তি ছিল এর। এটাই ১/১১-এর মন্ত্র। পরবর্তীতে সরকার গঠন করে, তালিকা ধরে ধরে শুধু ভিটা থেকে উচ্ছেদই নয়, লাগাতার হামলা-মামলা, রিমান্ড দিয়ে দলের শিরদাঁড়ার সব হাড় চুরমার করে সাদ্দামের বার্থ পার্টির দৃষ্টান্ত স্থাপন করল আওয়ামী লীগ। সপরিবারে নিজেদের রাজকীয় জীবনবিলাস, বিরোধী দলের জন্য ফেরারি জীবন। চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে এমন অচল করে ফেলেছে, খালেদার পার্টিও নিশ্চিহ্ন করাই মিশন। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির নেতারা কারাগারে, অন্যদের গুম, খুন, ক্রসফায়ার। নেত্রীকে হয়রানির শেষপর্যায়ে। এত কিছুর পরও একমাত্র খালেদাই দু’চারটা প্রতিবাদ করেন। তার অন্যতম গুণ, চাপের মুখে কখনোই বিদেশ চলে যাননি এবং ‘রাবিশ’ বলা থেকে বিরত। অপর দিকে, ক্ষমতায় যেতে ২০০৭ সনে সন্ত্রাসী দলের সাথেও ফতোয়া চুক্তির প্রমাণ আওয়ামী লীগেরই।
বলছি, পুত্রশোক নিয়ে প্রতিপক্ষের উল্লাস। একমাত্র সভ্যতার বস্ত্রহরণকারীরাই কোকোর মৃত্যুর পেছনে আওয়ামী অবদানের কথা অস্বীকার করবে। ডাক্তারেরাও বলে থাকেন, অতিরিক্ত মানসিক এবং পারিপার্শ্বিক চাপে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। কোকোর বেলায় তা হয়নি, প্রমাণ দিতে পারবে না আওয়ামী লীগ। খালেদাকেও চরম যাতনার মুখে ঠেলে দিয়ে এখন শুধুই অপেক্ষা। মৃতকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে তীব্র ঘৃণা ছড়ানো, জীবনে এবারই প্রথম দেখলাম। বাঙালির সংস্কৃতিতেও নতুন আবিষ্কার। মৃত্যুকেও রাজনীতিকীকরণে একচুল ছাড় দিলো না সন্ত্রাসীরা। এরপর সন্ত্রাসী খোঁজার কাজে জামায়াত-শিবিরকে বাদ দেয়া উচিত। সর্বোচ্চপর্যায় থেকে শব্দবোমার বিস্ফোরণ, ঘৃণা ছড়ানোর কাজে প্রয়োজনীয় স্টেরয়েড জুগিয়েছে। যত ছোটই হোক, কোনো অন্যায়ই ন্যায় নয়। যারা হাওয়া ভবনের জন্য তারেকের সমালোচনা করেন, বলছি, চোখ খুলে দেখুনÑ দেশ-বিদেশে কত হাওয়াভবন! সেই তুলনায় তারেকের ভবনটি শিশু। হলমার্কের সন্ত্রাসীর সাথে গণভবনের উপদেষ্টার সংশ্লিষ্টতার খবর কি মিথ্যা? এ ছাড়া দেশের লুটপাট করা অর্থে বিদেশে অসংখ্য হাওয়াভবনের বহু তথ্য-প্রমাণ প্রবাসীদের রাডারে। এখনো ‘হাওয়া ভবন’ না থাকলে হাজার হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়?
প্রশ্ন, শোক বনাম উৎসব। এখন আর কবিতা লেখার সময় নেই। পুত্র যদি ২০০ মণ গাজা খেয়েও মরে, মৃত্যুর পর যারা তার চরিত্রহরণ করবে, মা হিসেবে কী করতাম? পুত্রের মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়ী ব্যক্তিরা যেন ত্রিসীমানায় ঢুকতে না পারে, সে জন্য আরেকটু বেশিই ‘প্রতিক্রিয়া’শীল হতাম। বরং পরবর্তী সময়ে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ভদ্রতা দেখিয়েছেন খালেদা, যে কথা মিডিয়ায় নেই। ৫ জানুয়ারির আগেও একই কথা বলেছিলেন, সেটাও মিডিয়ায় নেই। বিশ্বজিতের ওপর লাইভ চাপাতির পর, আফ্রিকান ওয়্যারলর্ড অনুসারীদের তো রাজনীতিতেই থাকার অধিকার নেই। বলছি, আফ্রিকান আচরণ বাদ দিয়ে মানুষের আচরণ করুন। মৃত্যু ও ক্ষমতা দুই জিনিস না হলে, বাকশাল ঘোষণার মাধ্যমে সবারই মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার কথা। মা হিসেবে খালেদা সঠিক কাজটি করে মৃত পুত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন বলে মনে করি। গণভবনকে যারা পারিবারিক ভবন বানিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর এই পর্যায়ের নির্যাতন চালাচ্ছে, বিনীত অনুরোধ, ঘৃণা ছড়ানোর মতো আর একটি বাক্যও উচ্চারণের আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখুন।
বাজে কথা বলি না, যারা বলে, তার প্রতিবাদ করি। এ জন্য সারা জীবনই কঠিন মূল্য দিয়ে চলেছি। প্রমাণ ছাড়া অনুমানে খুব কমই লিখি। অপঃরারংস রং হবাবৎ রিঃযড়ঁঃ রহঃবষষবপঃঁধষরংস. গ্রেনেড হামলার পর খালেদা জিয়া যখন সমবেদনা জানানোর জন্য বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন, হাসিনা শুধু ‘না-ই’ বলেননি, এমন মন্তব্য করেছিলেন যা বলার মতো নয়।
দ্বৈতনীতিতে আওয়ামী লীগ কেন অদ্বিতীয়, দু-একটি উদাহরণ :
১. বিরোধী দলে থাকাকালে ৩০৩ দিন হরতালের রেকর্ড। ২. ২০০২ সালে এইচএসসি পরীক্ষার সময় দুইবার হরতাল। ৩. ১৯৯৫ সালেও আট দিন হরতাল। একই সালে এসএসসি পরীক্ষায় আট দিন হরতাল। ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অবরোধ। ৪. ২৮ অক্টোবরে পিটিয়ে-পুড়িয়ে অনেক মানুষ হত্যার ফুটেজ ইউটিউবে। ৫. ১৯৯৫ সালে ৩০ দিন হরতাল, চার দিন অবরোধ, ১৯৯৬ সালে ৮৫ দিন হরতাল, এক দিন অসহযোগ, ২৬ দিন অবরোধ ইত্যাদি।

সারমর্ম
নির্যাতনসহিষ্ণু জাতি সৃষ্টির জন্য ইতিহাসে জায়গা হবে আওয়ামী লীগের। ৭৪-এর মতো সরকারকে ঘিরে ফেলেছে বিদেশী ষড়যন্ত্র, দেশের মানুষকে ত্যাগ করেছে। ধাপে ধাপে পায়ের তলে কুয়াশায় তৈরি ক্ষমতার যে ভবনটি, এর কোনো ভিত্তি নেই। ক্ষমতার পুরো বিষয়টাই কুহেলিকা, সূর্য উঠলেই মিলিয়ে যাবে। কিন্তু এ জন্য গণতন্ত্র এবং মানুষের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, কত দিনে সারবে! কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য লবির দোকান খুলে বসিনি। বলছি, আওয়ামী লীগকে না থামিয়ে দিলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে ফেলা বোমার বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ার মতো ঘটনা ঘটবে বাংলাদেশেও। ৭০ বছর পরেও সেখানে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতি একটি বিশেষ প্রশ্ন, একবার হলেও ভাবুন, ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারিতে পাস হওয়া সংবিধান কার্যকর থাকলে আজ আপনারা কী বলতেন!

ইমেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট : www.minafarah.com
সৌজন্যে নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *