বাঙ্গালীরাই হয়তবা একমাত্র জাতী যারা অতীত থেকে শিক্ষা নিতে চায়না বরং অতীত ঘিরে, কল্পনা তৈরি করে, আবেগী খেলায় মত্ত হতে আনন্দ পায়, পার্বণ পালনে উল্লসিত থাকতে চায়, অতীতকে নিয়ে এভাবেই ব্যস্ত থাকতে চায়। কেউবা আবার পার্বণী অতীতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আত্মতৃপ্তি পেতে চায় –এতে বর্তমানের দশা যা’ই হোক। বললে হয়তবা খুব একটা ভুল হবে না, আমরা আসলে ভাবাবেগে আপ্লূত এক নির্বোধ জাতী!
আর এ কারণেই আমাদের দেশ আবেগে আবেগে অগ্নিকুণ্ডের মত রূপায়িত হয়ে ব্যক্তিধর্মী রাজনীতিতে সহজেই আবদ্ধ হয়ে যায়। কথাগুলো আরেকটু প্রশস্ত করতে যাচ্ছি।
ব্যক্তি পূজার রাজনীতি, ক্যাচাল রাজনীতি ও জাতির অবস্থা
উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধ বিজয়ের নেতৃত্ব দেয়া স্বত্বতেও ব্রিটিশ জাতী তাকে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী করে নাই। আর চার্চিলের ভক্তরাও সে জন্য মাতম করেন নাই। অতীতে কে ভাল আর কে মন্দ ছিলেন এ সব নিয়ে মাতাল না হয়ে বর্তমানে দেশের জন্য কে কি করতে পারেন সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু আমাদের দেশের কিছু লোক দেশের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু ব্যক্তি পূজায় অন্ধ! তাই তো এরা পরিবারতন্ত্রের বাহিরে অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। এটাই হচ্ছে সব চেয়ে বড় সমস্যা!
মূল সমস্যা কোথায়?
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, আনু মুহাম্মদ তার এক নিবন্ধে লিখেছেন,
“অর্থনৈতিক তৎপরতায় ব্যাংক লুট (ঋণ-খেলাপি, জালিয়াতি) করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, শেয়ারবাজারে প্রতারণা ও প্রভাব বিস্তার, জমি-পাহাড়-নদী-জলাশয় দখল, রাষ্ট্রীয় বৃহৎ প্রকল্পে শতকরা ২০০ বা ৩০০ ভাগ বেশি ব্যয়, বিদেশি ঋণে ভোগবিলাসিতা, কমিশনের বিনিময়ে দেশের জন্য সর্বনাশা চুক্তি স্বাক্ষর—এগুলো সবই বর্তমান অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাঁরা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, যারা ঋণ নিয়ে বড় বড় খেলাপি, তাঁরাই তো দেশের অর্থনীতির প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার খণ্ড হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রতিবছরে বাংলাদেশ থেকে লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। প্রবাসী-আয় আর পোশাকশ্রমিকদের জীবন পানি করা বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ না থাকলে এই লুটেরাদের জন্য দেশের অর্থনীতিতে ধস নামত অনেক আগেই।
ফুটপাতের হকার, খাদ্য পরিবহন থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চাঁদাবাজি, প্রতারণা, গুম, অপহরণকে দ্রুত অর্থ উপার্জনের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার—এগুলোও বর্তমান অর্থনীতির অংশ। সর্বজনের সাধারণ সম্পত্তি হয় জোরপূর্বক দখল অথবা সরকারি নীতির মাধ্যমে ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সম্পদের স্থানান্তর ঘটছে দ্রুত। আর এসবের মধ্য দিয়েই নদী, উন্মুক্ত জমি, বন উজাড় হচ্ছে। এগুলোর মধ্য দিয়েই অট্টালিকা উঠেছে, গাড়িতে রাস্তা অচল, ভোগবিলাস প্রাচুর্য বেড়েছে।
এই পরিস্থিতির সুবিধাভোগীদের মধ্যে আছে রাজনীতিবিদ নামের লুটেরা দখলদার গোষ্ঠী,বহুজাতিক পুঁজি,দেশি কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী, কমিশনভোগী আমলা আর কনসালট্যান্টরা। আর তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই রাজনীতিতে সন্ত্রাস,স্বৈরতন্ত্র আর সহিংসতা। দেশি-বিদেশি সমর্থন ভিত্তি এসবের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। এখানে গণতান্ত্রিকতা,‘আইনের শাসন’ বা স্বচ্ছতা-জবাবদিহির কোনো জায়গা নেই। সে জন্যই ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য এত অস্থিরতা। যার শিকার সর্বজন, কেননা তাদের স্বার্থের রাজনীতি এখনো গড়ে ওঠেনি।”
বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে দুভাগে বিভক্ত -তা সবাই স্বীকার করবেন। তবে এখানে একটি বিষয় হয়তবা অনেকে লক্ষ্য করে থাকতে পারেন তা হল এ উভয় ক্যাম্পে যারা অপরাধী অর্থাৎ দুর্নীতিবাজ, সুবিধাবাদী, অর্থলোভী, দালাল প্রকৃতির লোক তারা কিন্তু তলে তলে একই ডালের পাখি।
এখন কি করা উচিৎ?
আমাদেরকে গম্ভীরভাবে (seriously) চিন্তা করতে হবে যে সন্ত্রাস,স্বৈরতন্ত্র আর সহিংসতা,দুর্নীতি, অস্থিরতা, অশান্তি ইত্যাদি যাবতীয় পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত এক অভিশপ্ত জাতিতে দ্রুত আজ যেভাবে দাবিত হচ্ছি তার কারণ কি, কেন আমরা এ পরিস্থিতির শিকার হলাম এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? আজকের বাস্তবতায় যারা সত্যিই দেশের উপকার চান, দেশের জন্য স্বপ্ন দেখেন এবং আগামী প্রজন্মের ভাল চান তাদের উচিত সবাইকে নিয়ে একটি ফলপ্রসূ সংলাপের মাধ্যমে দেশের সকল মতের সকল মানুষের জন্য একটি সম্মানজনক সমাধান খোঁজে বাহির করা। বেশি দূর অতীতে না গিয়ে নিত্যকালের অবস্থা থেকে বিবেচনা শুরু করতে পারেন। তারপর সেই স্থান কিছু ঐক্যের সূত্র বের করে আনার চেষ্টা করতে পারেন। এ পসঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
১) ২০১৪ সালের গত নির্বাচন যে একটি ব্যর্থ নির্বাচন যা কোন অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক ও সঠিক বলা যায় না –এটা স্বীকার ও সনাক্ত করতে হবে। যদি তা’ই করা হয় তবে পরবর্তী পদক্ষেপ স্বরূপ অচিরেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
২) বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও দলীয়করণ মুক্ত করতে হবে।
৩) দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠ করতে হবে যাতে যে অন্যায় করবে কিংবা অপরাধ করবে তাকে আইনানুগ শাস্তি পেতেই হবে।
৪) র্যাব, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্কৃতি দিতে হবে এবং রাজনৈতিক হয়রানী ও অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।
৫) সকল রাজনৈতিক বন্ধীদেরকে মুক্তি দিতে হবে।
৬) মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৭) ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হতে হবে।
৮) রাষ্ট্রিয় ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
তবে একথা মনে রাখতে হবে যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের হালুয়া রুটির ভাগীদার ও দালাল গোষ্ঠী এমন কোন স্বচ্ছ রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে আগাতে দেবে না। কারণ এতে তাদের স্বার্থে আঘাত আসবে এবং তাদের অপরাধ বেরিয়ে পড়ার ভয় থাকবে।
তাই গণআন্দোলনের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। এমন আন্দোলনে যা প্রকৃত অর্থে গণ-আন্দোলন হতে হবে, সেজন্য জাতি গঠন নিয়ে সকলের ধ্যান-ধারণা স্থান পেতে হবে। অন্য কথায় দেশের আপামর গণ মানুষের কল্যাণের লক্ষে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকতে হবে যা কোন বিশেষ দলের এজেন্ডা নয়। যদি তা’ই হয় তবে এতে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। এখানে এ গণআন্দোলনের লক্ষ্য হবে নীতি বা আদর্শের বাস্তবায়ন এবং শুধু ক্ষমতার পালা বদল নয়।
কিন্তু ক্ষমতাসীনরা যদি দেখে যে এ আন্দোলন শুধু বিএনপি-জামাত জোটের কাণ্ডকারখানা – অর্থাৎ এই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে গণ-আন্দোলন নয়, সকল মানুষের অংশগ্রহন নাই, তাহলে এই সরকার তার স্বৈরাচারী অবস্থান থেকে এক কদমও নড়বে না। দলীয়ভাবে যে যতই শোডাউন করেন না তাতে কোন কাজ হবে না।
তবে এটাও সত্য ও স্বাভাবিক যে প্রত্যেক দলই তাদের শক্তি প্রদর্শন বা জনপ্রিয়তার প্রচার করতে চায়। কিন্তু এখন এই কাজ কোনো দলকে করতে দেয়া যেতে পারে না। প্লাটফর্ম ‘জনতার’ হতে হবে। এখানে কারো দলীয় ব্যনার দেখাবার প্রয়োজন নাই । দেশ যখন প্রকৃত গণতান্ত্রিক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে তখন বহু দলীয় রাজনীতি কার্যকর হতে পারে। যে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই এবং তা সৃষ্টি করতেও দেয়া হয়না, সে দেশে গণ-আন্দোলনের ভিত্তিতে প্রাথমিক কিছু নিয়ম নীতির প্রতিষ্ঠা ভিন্ন অন্য কিছুর চিন্তাই করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ আজ আমরা তুরস্কের একে পার্টির দিকে তাকাতে পারি। বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম প্রধান দেশ তাই যারা দেশের কল্যাণ চান তারা তুরস্কের একে পার্টির নেতাদের মত নেতৃত্ব তৈরির চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু গণভিত্তির বাহিরে কিছুই হবে না।
উপরে বর্ণীত যে দাবীগুলার কথা বলা হয়েছে তা দেশের কে না চাইবে? এমন কি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মাঝেও যে সব ভাল লোক আছেন, যারা নীতিমান তারাও সমর্থন করবেন বলে বিশ্বাস করা যায়। যদিও আমাদের দেশে রাজনীতির পক্ষপাতিত্ব কিছু লোকের কাছে ধর্ম সমতুল্য। তাদের বিশ্বাস দলের ভাল মন্দ সকল কাজকেই বৈধতা দিতে হবে। কিন্তু একটি দেশে এই মনোবৃত্তি লালন করলে স্বচ্ছ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশেষ করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে বিরাট বাধা সে উপলব্ধির বীজ বপন করতে হবে মানুষের মনে। কেননা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তার সুফল সবাই উপভোগ করতে পারবে।
বাংলাদেশে আজ যে রাজনৈতিক বিরুধীতা চলছে তা দুই পক্ষের ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে এবং মিডিয়াও তা সুন্দর উপস্থাপনা করে যাচ্ছে! তাই বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ্য করলে দেখা যায় সরকার জামাতকে ব্যস্ত রাখতে পেরেছে তাদের নেতাদের মুক্তি আন্দোলনে আর বিএনপিকে ব্যস্ত রেখেছে তাদের নেতা তারেকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে তাই তাদের মিটিংয়ে দেখা যায় তারেক জিয়ার পোষ্টার। তাই কখনও দেখি মিডিয়াতে আসছে শিবিরের শোডাউন কখনও আসছে ছাত্রদলের শোডাউন! সামাজিক মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রচারিত হচ্ছে একে অন্যের শোডাউন বলে।
আর এ সবের কারণে ভোটার বিহীন এত বড় একটা অগণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার পিছনে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি বিরোধী দলেরাই করে দিচ্ছে! এখানে নীতিগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে বা দেশের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যের কোন আবেদন নাই অন্তত মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনের অবস্থাতে তা এখনও প্রকাশ পায় নাই।
প্রশ্ন হচ্ছে এ ব্যর্থতা কার? আজ শক্তির দাপট সব কিছুর উপরে এখানে বৈধ অবৈধ বলে কিছু নাই! জোর যার মুল্লুক তার! এটা কি কোন সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে?