তবলীগ জামাত নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ব্যবচ্ছেদ।

তবলীগ জামাতের পুরোধার মুরব্বী হজরতজী ইলিয়াস(র) সাহেবের নাতি মওলানা সাদ কান্ধলভী গত বছর ২০১৭ সনে হজ্জের সময় মদিনা মুনাওরায় সাথীদের মাঝে একটি বয়ানে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তার দ্বীনের দাওয়াতের মেহনতের জন্যে প্রতি জামানায় কোনো নবীকে কোনো জাতিকে সুযোগ করে দেন। এই সুযোগ দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা নেন যে সে জাতি এই ভারী দাওয়াতের কাজের জন্যে উপযুক্ত কিনা। এভাবে বাইরে থেকে দেখলে আমাদের মনে ধারণার সৃষ্টি হয় যারা এই দ্বীনের মেহনত করছেন তারাই এ কাজটি করতে পারবেন বা তারাই শুধু করবেন।

একইভাবে কাজ করনেওয়ালা কোনো মুরব্বি বা কর্মী ভেবে বসতে পারেন যে আমার ব্যতিরেকে এই কাজ চলবেনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এধরণের ভাবনা ওয়ালা মানুষদের সবসময় পরীক্ষা নিয়েছেন। এই পরীক্ষা নবীদের, সাহাবাদের এবং এযুগের মানুষ যারা দ্বীনের মেহনতের সাথে সংযুক্ত তাদেরকেও আল্লাহ নেবেন। যারা আল্লাহর এই পরীক্ষায় পাশ করবেনা তাদেরকে আল্লাহ এই কাজ করার সুযোগ থেকে সরিয়ে দেবেন। আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের কাজ কোনো মানুষের মুখাপেক্ষী নয়, আল্লাহ তার নিজস্ব পরিকল্পনায় তার দ্বীনকে তিনি জীবিত আর চালু রাখবেন’।

যে মানুষটি উপরের কথাগুলি মাত্র কয়েক মাস আগে বলেছেন যা এখনো ইউটিউবে শোনা যায়, তার বিরুদ্ধে এখন প্রচার মাধ্যমগুলো থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এমন ভাবে যেন মওলানা সাদ কান্দলভী কোনো ধরণের নেতা হবার জন্যে বা পজিশন পাবার জন্যে আগ্রহী এবং তার বয়ানের এখান ওখান থেকে ছোট ছোট লাইন উদ্ধৃত করে কিছু সংবাদ এমন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে মওলানা সাদ ইসলাম ধর্ম সম্মন্ধে কিছুই জানেন না, সব উল্টাপাল্টা বলছেন।

সাউথ আফ্রিকার আহমেদ দীদাত যখন বাইবেলের বর্তমান ভার্সনের ভুলগুলি ধরিয়ে কোরআনুল করিম একমাত্র অবিকৃত ঐশী গ্রন্থ প্রমান করে ফেললেন তখন রহস্যজনক রোগাক্রান্ত হয়ে তিনি বাকরুদ্ধ হলেন। কেউ যেন তাকে থামিয়ে দিলো।

ভারতের ডাক্তার জাকির নায়েক যখন ইসলাম প্রচারক হিসাবে সারা পৃথিবীতে নাম করে ফেললেন তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলো জঙ্গি প্ররোচনার আর দানের অর্থ লোপাটের। গোয়েন্দারা তার সব রেকর্ডেড বক্তৃতায় জঙ্গি প্ররোচনা খুঁজে পায়নি জানানোর পর দানের অর্থ অনর্থের মূল হয়ে দাড়ালো তার জীবনে। তার ইসলাম প্রচার পদ্ধতিকে থামিয়ে দেয়া হলো।

মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে সঠিক বেঠিক আকিদা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও ইসলাম অপছন্দকারীদের কাছে সব মুসলমানদের একটিই ভীতিকর পরিচয় — এই জাতি যেকোন সময় জেহাদের নামে পৃথিবীময় সংগঠিত হতে পারে। তারা বিশ্বাস করে, এরা এমনই ক্ষমতাসম্পন্ন বা রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পন্ন মুসলমানের দল যাদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা সব এটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।

এর সঙ্গত কারণ আছে,– তারা জানে কোরান হাদিস অনুযায়ী তারা যেকোন সময় বিজিত হবে ঈসা (আঃ)এর কমান্ডের সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর কাছে। এই অভ্যন্তরীন ভীতি বোধ এতো আগে থেকে তাদের অবচেতন মনে কাজ করে যে কারণে আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নতুন নিশানা ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম দেশগুলি।

সে কারণে তাদেরকে গত কয়েক বছর ধরে ইসলাম ধর্মকে বিতর্কিত প্রমান করার জন্যে বিভিন্ন পথ ও প্রচারণার আশ্রয় নিতে দেখা গেছে পৃথিবীর সব জায়গায়। ‘জেহাদ’ শব্দটিকে পচানোর জন্যে হটাৎ আইসিস এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন তৈরী করে জেহাদের নামে নৃশংস ভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা দেখানো হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই সকল দাবীকৃত জেহাদীদের গায়েবী সহায়তা দেননি, তাই এই ধরনের সব জঙ্গিবাদী দল আর তাদের সব প্রচেষ্টা উৎখাত আর নিন্দিত হয়েছে। আল্লাহ তার পরিকল্পনায় এবং পন্থায় বুঝিয়ে দিয়েছেন এগুলি জেহাদ ছিলোনা।

কিনতু এতসব কিছু ঘটার পরেও কোনো বিশ্বাসীর অন্তঃকরণে আল্লাহর বর্ণনার আসল ফরজ জেহাদের নিয়ত ও নিয়ম কানুনের কোনো পরিবর্তন কেউ করতে পারেনি।

বিধর্মীদের অবচেতন মনের জেহাদ ভীতির কারণে ইসলাম বিরোধী কার্য্যকলাপ তারা কখনো বন্ধ করতে পারবেনা। মাত্র গতকালই নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মুসলিম পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তাদেরই অফিসের লকারে ঘৃণা মূলক কথা লিখে রেখেছে তাদের অমুসলিম পুলিশ কলিগরা।

এই ভীতির কারণেই পৃথিবীর সব দেশে ইসলামের নামে রাজনীতি করা সব দলগুলিকে সন্ত্রাসী সাইনবোর্ড লাগিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। বাকি রয়েছে অরাজনৈতিক ইসলামিক দলগুলি আর তবলীগ জামাত হচ্ছে তাদের লেটেস্ট টার্গেট।

ভারতের নব্য হিন্দুত্ববাদী শক্তি বিজেপি, আরএসএস, শিবসেনারা আমেরিকার এই অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের সুযোগে ভারতে যত ইসলাম ভিত্তিক সংগঠন আছে সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে গোপনে প্রকাশ্যে সব ধরণের পরিকল্পনাতে সহায়তা দিচ্ছে তা বোঝা যায় ইসলাম বিরোধী সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে।

তবলীগ জামাতের মত ঈমান শেখার প্রারম্ভিক স্তরের শিক্ষাঙ্গনকে ভ্রান্ত প্রমান করার জন্যে বেদাত, ভুল কিতাব অধ্যয়ন জাতীয় বহু প্রচার প্রোপাগান্ডার পরও মানুষকে তবলীগ জামাতে সময় দেয়া বন্ধ করা যায়নি। এজন্যে এখন নতুন একটি পন্থা নেয়া হয়েছে যাতে দেখানো হবে এদের নেতৃত্বের মধ্যে কোন্দল।

ঠিক যেমন নবী (সা) এর ওফাতের পরে ইসলাম ধর্মের খেলাফতের ভেতর শয়তান ঢুকে ইসলাম ধর্মের ঐক্যকে বিনষ্ট করেছিল তেমনি শয়তানের কিছু চামুন্ডা ঢুকে গেছে তবলীগের ভেতরে।

এর প্রেক্ষিতে কাকরাইল মসজিদে দুই নন আলেম মুরব্বির সমর্থকরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তা এসেছিলো পত্র পত্রিকায়।এখন শুরু হয়েছে দিল্লীর তবলীগ মারকাজের বিশিষ্ট মুরব্বিদের সাথে দেওবন্দের বিতর্ক।

পর্য্যবেক্ষকদের ধারণা, একটি ইসলামের শত্রু দল রিমোট কন্ট্রোলে তবলীগ নিয়ে খেলছে। ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, সম্ভবতঃ তারা ভারত বাংলাদেশের তবলীগের মুরব্বিদের অযোগ্যতা দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে ভাই বশিরের মত কোন মুরুব্বীকে দিয়ে দিল্লির মারকাজের গুরুত্ব কমিয়ে পাকিস্তানের হাতে এই কাজের মুরুব্বীয়ানা দেয়াতে বাধ্য করবে।

তখন আমেরিকা এবং অন্যান্যদের সুবিধা হবে বলতে যে আমরা আগেই বলেছিলাম, পাকিস্তান নেতৃত্বাধীন কোনো ইসলামী আন্দোলন পৃথিবীর জন্যে নিরাপদ হতে পারেনা, তাই তবলীগের কাজকে নিষিদ্ধ করা হোক। পৃথিবী ব্যাপী ইসলাম প্রচার করার সর্বশেষ পথটিকে বন্ধ করার জন্যে তাই দেশ বিদেশের মুরব্বিদের মধ্যে ভাগাভাগি দলাদলি করার প্রসেস শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা এবং কানাডার মুরব্বিরা কাকরাইলের সিদ্ধান্তকে বদলাতে অনুরোধ করেছেন।

বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে যে বুজুর্গ ইসলামিক পন্ডিতেরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে যেয়ে মানুষদের নজর কাড়ছেন তাদেরকে থামানোর জন্যে কোনো না কোন ধরণের পন্থা ব্যবহৃত হচ্ছে সব দেশে সব জায়গায়।বিখ্যাত ইসলাম প্রচারকদের ভিসা দেয়া হয়না বাইরে যাবার, ভিসা দিলে ঢুকতে দেয়া হয়না এয়ারপোর্ট থেকে। কানাডার ইসলাম প্রচারক গ্রন্থকার বিলাল ফিলিপ্স আবু আমিনা এই ধরণের ঘটনার নিষ্ঠুর শিকার।

একজন তবলীগের মুরব্বির কাছ থেকে শুনলাম, ভারতের পুলিশ বিভাগ মওলানা সাদের ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের মুরুব্বীরাও বিতর্ক এড়াতে মওলানা সাদকে বাংলাদেশের ভিসা না দিতে অনুরোধ করেছিলেন। ভারতে নাকি পুলিশের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা সম্প্রতি তাঁর সাথে দেখা করে বলেছেন, “ভগবানকে ওয়াস্তে হামলোগকো মাফ কর দেনা, কুছ গলদ ফাহমি হুয়াথা, আপনি যেখানে যেতে যান যেতে পারেন”, তিনি বাংলাদেশ চলে আসলেন, বাংলাদেশ তাকে ঢুকতে দিয়েছে। ঢোকার পরের ঘটনা ব্রেকিং নিউজ।

বাংলাদেশে এয়ারপোর্টে তাকে যারা আটকালো তাদের পরিচয় পত্রিকা মারফত জানলাম তারা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদল। কয়েকটি পত্রিকা লিখেছে, তারা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এবং হেফাজতে ইসলামের সদস্য। গতকাল তাদের হুঙ্কারে শাহজালাল এয়ারপোর্টে যানজট হয়ে গেলো।

শোনা যায় তারা বিভিন্ন গাড়ির জানালা খুলিয়ে পরীক্ষা করছে মওলানা কোনো গাড়িতে করে শহরে ঢুকে পড়লো কিনা। তবলীগ জামাতের মধ্যে কোনো দল উপদল আছে, পত্রিকার মাধ্যমে কোনো নাম এই প্রথম শুনলাম। যারা তাবলীগে সময় দেন তারা এলাকা ভিত্তিক জামাতে যান অনেক সময় কিন্তু এছাড়া অন্যকোন পরিচয় তারা বহন করেন না।

আমাদের ছোটবেলা থেকে তবলীগ জামাতে দেখতাম বক্তার নাম কখনো ঘোষণা করা হয়না। কারণ কি জানতে চাইলে তারা বলতেন, আল্লাহর প্রশংসার কথাগুলি শোনা মূল উদ্যেশ্য, মানুষের বক্তৃতার গুণাবলীর প্রশংসা শোনা কারো কাম্য নয়।

এই মেহনত যার যার নিজের জান আর নিজের মাল নিয়ে করতে হয়, চাঁদাবাজি, দান খয়রাত, জাকাতের টাকা সংগ্রহ, এধরণের প্রকাশ্য কোনো ইনকামের ব্যবস্থা নেই এদের।কাকরাইলের মসজিদে কোন দান বাক্স নেই, আপনি চাইলেও পয়সা দান করতে পারবেন না। তারা কোন রাজনৈতিক দল নয়, তারা কোনো দলের পক্ষে বিপক্ষে কথা বলেনা। তাদের চারণ ক্ষেত্র মাটির নিচের জগতে আর আসমানের ওপরে।

চরম শত্রুরাও নির্ভিগ্নে তাদের আসরে পাশাপাশি বসে যায়। দুজন দুজনকে যাবতীয় সমালোচনা করার পরেও শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া কখনো পরস্পরকে বলেননা, উনি গেলে আমি তবলীগের মোনাজাতে যাবোনা। এই একটি মাত্র ইসলামী ওপেন ইউনিভার্সিটি চালু রয়েছে পৃথিবীতে যেখানে সব ফেরকা সব মাজহাব সব বিতর্কের বাইরে মানুষেরা এক দস্তরখানে খানা খায়।

ইসলাম ধর্ম যে সৌহার্দের সহমর্মিতার ধর্ম তা প্রমান করার জন্যে আল্লাহ এই কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যে বেছে নিয়েছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষেরা যখন টঙ্গীর মাঠে সমবেত হয় বিশ্ব এস্তেমায়, এবং বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ায় তখন তারা সেটি অনুভব করেন।

মানুষ ভুল করতে পারে। কিনতু যেকোন দ্বীনের দায়ীর ভুল ধরে মুসলমানদের একটি কমন প্লাটফর্মকে ধ্বংস করে মুসলমানরা নিজেরাই দুর্বল হবে, খুশি হবে শয়তান আর তার চেলারা।

শেষ কথা হলো যার যার আমল নিয়ে মানুষেরা কবরে যাবে, আমার কোনো কথা, কোন আমলে আল্লাহর দ্বীনের কোনো ক্ষতি হলে না আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে, না ইসলাম ধর্মকে মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে আমার জবাব দেবার ভাষা থাকবেনা।

আল্লাহ বলেন, “ওরা ভীষণ কৌশল করবে, আর আমিও ভীষণ কৌশল করবো। সুতরাং তুমি অবিশ্বাসীদের অবকাশ দাও, ওদেরকে কিছু সময়ের জন্যে অবকাশ দাও”। (৮৬:১৫,১৬,১৭)

পরপর দুইবার দুই আয়াতে একই অবকাশ দেয়ার কথা বলে আল্লাহ বোঝালেন, অবিশ্বাসীদের কৌশল একটু বেশি সময় ধরে চলবে।

কিন্তু সর্বশেষ জিত আল্লাহর দলের।

ছবি মাসুম আহমেদ.কম

Comments are closed.