মুসলিম খিলাফতের কথা বললে অনেকই আজ আঁতকে উঠেন কারন তারা ইতিহাস জানতে চান না। খিলাফতের অপর নাম মুসলিম শক্তিও বলা যেতে পারে তবে তা বুঝতে ইতিহাস বুঝতে হবে। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা কিভাবে কেন এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা জানতে হলে আমাদেরকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ (First orld War) সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা খুবই জরুরী। এখানে যে সব তথ্য উপাত্ত পেশ করা হবে তা মূলত পাঠ্যপুস্তক, অন লাইন, মেইন স্ট্রিম ইতিহাস সোর্স থেকেই নেয়া। কোন তথাকথিত “ষড়যন্ত্র তত্ত্বের” (conspiracy theory) ব্যাপার নয়।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের (First World War) পূর্বে মুসলিম বিশ্ব মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল বলা যায়। আর প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ফলেই পৃথিবীর মানচিত্রে ও রাজনৈতিক মেরুকরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। অনেক পুরানো সাম্রাজ্যের পরিবর্তন ও পতন ঘটে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের নতূন রুপ নেয়, বদলে যায় অনেক দেশের ভৌগলিক সীমা রেখা। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলিম উম্মাহ। অবসান হয় শত শত বছর ধরে চলে আসা মুসলিম খিলাফতের অস্তিত্ব। কীভাবে কেন তা হল বুঝতে ইতিহাস জানা অবশ্যই দরকার। এই নিবন্ধে সে বিষয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার যে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ফলাফলই ছিল দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সূচনার পিছনের প্রত্যক্ষ কারণ।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ (First World War ) কখন শুরু হয় ?
মূলত ইউরোপ কেন্দ্রিক এ যুদ্ধ শুরু হয় ২৮ জুলাই ১৯১৪ এবং এর সমাপ্তি ঘটে ১১ নবেম্বর ১৯১৮ সনে । সামরিক ও বেসামরিক সহ ৭০ মিলিয়নের অধিক মানুষকে এ যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। মানব ইতিহাসে এত বৃহত্তম যুদ্ধের আয়োজন এটাই ছিল প্রথম। দীর্ঘ চার বছরের এ যুদ্ধে প্রায় ৯ মিলিয়ন সামরিক এবং ৭ মিলিয়ন বেসামরিক মিলিয়ে মোট ১৬ মিলিয়নের তথা ১ কুটি ৬০ লক্ষের অধিক মানুষ প্রাণ হারায় যার মাঝে ছিল অসংখ্য গণহত্যা। যখন এ যুদ্ধের ঘোষণা করা হয় তখন ইউরোপের অধিকাংশ রাজধানী শহরে মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস উদযাপন করছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে এ যুদ্ধ এত মর্মান্তিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। নিচের ডকুমেন্টারি ভিডিওটাতে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বিভিন্ন দেশ ভিত্তিক জানতে এখানে দেখুন।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণ
১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড এক সার্বিয়াবাসীর গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুন সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দুদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। উনিশ শতকে শিল্পে বিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা এবং আগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদিও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া। যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেনে, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও আমেরিকা। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি। আর মিত্র শক্তির তখন মূল শক্তি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, যাদের বিস্তৃতি ইউরোপ আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকাও তখন ব্রিটিশদের অধীনে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়াও ব্রিটিশদের থেকে ১০০% স্বাধীন না তখন, নিউজিল্যান্ডে তো এখনও ব্রিটিশ রাজা/রানী রাষ্ট্র প্রধান। বিশাল সাম্রাজ্যের কারনে ব্রিটিশদের সেনা প্রায় গোটা দুনিয়াতেই ছিল। ব্রিটিশদের এতো কলোনির কারনেই মূলত যুদ্ধ এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নিচের ভিডিওটা শুনতে পারেন।
এদিকে যদিও এ যুদ্ধ ছিল ইউরোপীয়, কিন্তু তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফত কেন এ যুদ্ধে জড়িয়ে গেল? তার পিছনেও অনেক কারণ ছিল।
উসমান (অটোমান) সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরী, রাশিয়ার ক্রাইমিয়া থেকে পূর্বে জোর্জিয়া পর্যন্ত। অন্যদিকে, মক্কা মদিনাসিহ এক্ববারে ইয়ামান পর্যন্ত। অর্থাৎ ইউরোপের অস্ট্রিয়ান বর্ডার ও এশিয়ায় রাশিয়া ও ইরান বর্ডার পর্যন্ত। উসমানী শাসন পদ্ধতি চলত “মিল্লাত” ব্যবস্থায়। এটা ছিল বহু ধর্ম, বহুবর্ণ এবং বহু ভাষার বিভিন্ন ধর্ম ও তাদের স্থানীয় কালচার প্রেক্ষিতগত করে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে কোন অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হত না। কাউকে জোডর পূর্বক ধর্মান্তরিত করা হত না। এই বিষয়টি ইউরোপিয়ান স্কলারও স্বীকার করে থাকেন। শরীয়া আইনের ভিত্তিতে বিচার ব্যবস্থা চলত। মুসলিমরা জাকাত দিত এবং বিধর্মীরাও নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদান করত।
উসমানী খেলাফতের শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে, তখন তুরস্কে তরুণদের মাঝে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে, একটি বিদ্রোহী গ্রুপ গোপনে সংঘটিত হতে থাকে। এরা রাজতন্ত্রের বিরোধী হয়ে পড়ে। এদেরকে “ইয়ং টার্ক” ( Young Turks ) বলা হত এবং এদের মধ্যে অমুসলিমরাও ছিল, এবং বলা হয় কিছু ইয়াহুদিও ছিল। এরা মূলত সমাজের অভিজাত মহলের ধনী পরিবারের তরুণ যারা ইউরোপে পড়াশুনা করে আসা সেকুল্যার চিন্তাধারার একটি প্রভাবশালী মহলের সদস্য। যারা ইসলামের চেয়ে তুরস্ক জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসে আসক্ত ছিল বেশী। এদের সাথে ইউরোপীয় মহলের সংযোগ ছিল এবং খলিফা এদের চাপেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এরাই খিলাফতের অবসান ঘটায়। এদেরই নেতৃত্বে ছিলেন মুস্তাফা কামাল পাশা আতাতুর্ক। এছাড়া এসবের পিছনে আরও কারণ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন এলাকার সুলতানী শাসনে বসবাসরত জনগণের এলাকায় খুবই দ্রুত ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। একদিকে প্রাচীন টেকনোলজি এবং ধর্মীয় গোড়ামী অর্থাৎ নতুন কোন কিছু জানা বা শিখার বা সংস্কার মানে যদি বেদাত হয়ে যায় সে ভয়ে কুসংস্কারে আচ্ছাদিত সমাজ নির্ভর ও ধারক উসমানী শাসন ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দিন দিন শক্তি হারাতে থাকে। তাই যুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই উসমানিয়ারা তাদের সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ইউরোপের বিভিন্ন এলাকার অনেক দেশ হারাতে হয় সে সব দেশের খৃষ্টিয়ান প্রজাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে। তুর্কিরা ভেবেছিল যুদ্ধে জয়ী হলে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এদিকে জার্মানির সঙ্গে তুর্কিদের ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আগে থেকেই গভীর ছিল। আজও লক্ষ লক্ষ তুর্কিরা জার্মানিতে আছেন।
তাই উসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে (জার্মান সাম্রাজ্যের পক্ষের দেশগুলো) ১৯১৪ সালের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। উসমানীরা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের প্রথমদিকে উসমানীরা বেশ কিছু বিজয় অর্জন করেছিল। এর মধ্যে গ্যালিপলির যুদ্ধ ও কুত অবরোধ অন্তর্গত।এসব যুদ্ধে মুস্তাফা কামাল পাশা নেতৃত্ব দিয়ে তুরষ্কের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তবে রুশদের বিরুদ্ধে ককেসাস অভিযানে ব্যর্থতার উদাহরণও রয়েছে। ১৯১৫ সালে রুশ ককেসাস সেনাবাহিনী পূর্ব আনাতোলিয়ায় অগ্রসর অব্যাহত রাখে।
এদিকে মিত্র শক্তিরা তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের উসকানি দিতে থাকে। আরবদের মাঝেও ইসলাম ছেড়ে ভৌগলিক আরব জাতীয়তাবাদের নেশা চড়ানো হয়। উসমানীদের অধীনে আরবের মক্কার আমির বা গভর্নরকে বলা হত শরিফে-মক্কা। তখন হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মি (Hussein ibn Ali al-Hashimi ) ছিলেন মক্কার শরিফ। তিনি রসুল (স:) এর বনি হাশেম বংশের ছিলেন বলে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব ছিলেন আরবদের মাঝে। তাই ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে তুরস্কের সুলতানের বিপক্ষে দাড় করায়। বিনিময়ে তারা তাকে গোটা আরব জাহানের বাদশাহ করবে -এই আশ্বাস দেয়। অথচ তুরস্কের সুলতানেরা এ পরিবারের হাতে মক্কার শাসনভার ৭ শত বৎসর ধরে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মি বাদশাহ হওয়ার লোভে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে ঢুকে পড়েন।
এ ষড়যন্ত্র মিশনে প্রত্নতত্ত্ববিদের বেশে জনৈক টি ই লরেন্স ( T. E. Lawrence) নামের এক বৃটিশ গুপ্তচরকে নিযুক্ত করা হয়। সে মক্কার আমীরকে দিয়ে আরবদেরকে তুরষ্কের বিপক্ষে সামরিক বিদ্রোহের ইন্দন জোগাতে থাকে। ইতিহাসে এই ব্যক্তি “লরেন্স অফ এরাবিয়া” নামে পরিচিত।
এখানে জেনে রাখা দরকার যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্র বাহিনী বিভিন্ন পক্ষের সাথে তিনটি প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা চুক্তি হয়েছিল।
১) আরবদের সাথে অর্থাৎ তাদের নেতা মক্কার আমীর শরিফ হুসেইন বিন আলীকে বলেছিল যে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তাকে অখণ্ড আরবের (Independent United Arab land) স্বাধীন বাদশাহ করা হবে।
2) গোপন চুক্তি। যা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজিত করার পর আরব দেশ সহ তুরষ্ক সাম্রাজ্যের সকল ভূখণ্ডকে কিভাবে মিত্র শক্তি (Allied Force) তাদের নিজেদের মধ্যে বণ্টন করবে তা নির্দারন। তখন রাশিয়া চেয়েছে তুরস্ক, ফ্রান্স চেয়েছে সিরিয়া ও লেবানন অঞ্চল ব্রিটিশরা নিয়েছে হেজাজ, জর্ডান এবং ইরাক ।
৩) ইহুদীদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির ওয়াদা ।
এদিকে মিত্রশক্তির তাদের নিজেদের মধ্যকার গোপন চুক্তিতে হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মিকে যুক্ত আরব বিশ্বের কোন খলিফা বা শাসক করার কোন পরিকল্পনাই রাখে নি। বরং তারা এক সন্ধ্যাকালীন বৈঠকে কলমের খোঁচায় আরব ভুখন্ডকে তাদের মধ্যে পিঠা ভাগ করে নেয়। নিচের মানচিত্রে A & B এর মাঝে সে্ রেখাটি দেখতে পাবেন।
এ চুক্তির খবর তখন আরবদের কানে আসলেও তাদেরকে মিত্রশক্তি বিশেষ করে ব্রিটিশরা বোকা বানাতে সমর্থ হয় এবং উসমানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়।
তাই ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে উসমানীয়দের স্রোতকে উল্টে দেয়। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর মুড্রোসের যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ের অবসান ঘটায় এবং এরপর কনস্টান্টিনোপল দখল ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভাজনের ঘটনা ঘটে। ১৯ শতকের শেষ চতুর্থাংশ ও ২০ শতকের প্রথম অংশে প্রায় ৭-৯ মিলিয়ন তুর্কি মুসলিম উদ্বাস্তু হাতছাড়া হওয়া ককেসাস, ক্রিমিয়া, বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রেসে চলে আসে।[৯১]
কনস্টান্টিনোপল ও ইজমির দখলের ঘটনার কারণে তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুর্কিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এসময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খিলাফত বিলুপ্ত করা হলে[৯২] সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ দেশত্যাগ করেন। শেষ হয় মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের শেষ নিশান!
তার পরের ইতিহাস হুসেন বিন আলী আল্ হাস্মির বংশের কারো পক্ষে একমাত্র জর্ডান ছাড়া আরবের কোথায়ও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় নি। এদিকে ব্রিটিশরা আল-সাউদ নামের আরেক পরিবারকে সহযোগিতা করতে থাকে যারা বর্তমান সৌদি আরবের রাজ পরিবার। বিশ্ব মুসলিম ঐক্যে এই শাসক গোষ্ঠীর ভূমিকা যে কী তা সবাই জানেন। মিত্রশক্তি তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আরব ভূখণ্ডকে বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করে অনৈক্যের বীজ বপন করতে সফল হয়। যার ফলে আরবরা আজও গোলামীর শিকলে আবদ্ধ হয়ে আছে। আরব শাসকের কাছে ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যামে সমাজে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, তাদের দেশের মানুষের স্বার্থ ও বিশ্ব মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করার কোন উদাহরন নাই! মুসলিম হত্যার রক্তের দাগ যাদের হাতে তাদেরকেও তারা সর্বোচ্চ পদবীতে ভুষিত করতে দ্বিধাবোধ করে না!
ইতিহাসের শিক্ষা:
মজার ব্যাপার হল, ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মাঝে বিভিন্ন যুদ্ধ করলেও আজ তারা একতাবদ্ধ এবং প্রযুক্তি ও টেকনোলজিতে অগ্রগামী। কিন্তু মুসলমানেরা আজও ঐক্যবদ্ধ হওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি ও অনৈক্য যাতে আরও শত শত বছর চলতে পারে সেই পন্থা খুঁজতেই ব্যস্ত। আর ধর্মীয় নেতারাও সমাজকে পিছনে নিয়ে যেতে একে অন্যের সাথে সমালোচনা ও বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। নিজেদেরকে আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে রেখে ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযুগী না করে সেই মান্ধাতা আমলের সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে তাঁরা বাহির হতে চান না।
উপসংহারে, খিলাফত সম্পর্কে আমার এক বন্ধুর একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, “রাসুল (স:) ওফাতের পর ইসলামের প্রাথমিক যুগে আমাদের মহান চার খলিফারা তাঁদের শাসন আমলে, তাঁদের প্রথম এবং প্রধান যে দায়িত্ব মনে করতেন তা ছিল ইসলামের আদর্শ তথা শরিয়াকে রক্ষা করা। অর্থাৎ সে আদর্শকে সর্বোচ্চ আসনে রাখা ছিল তাদের প্রথম কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে তারা এক মিনিটের জন্যও জনগণের কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না। আর পরবর্তীকালের রাজা বাদশাহ ও সুলতানেরা ক্ষমতায় গিয়ে মনে করতেন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের দৌরাত্ম, শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করাটাই ছিল প্রাইম ও প্রধান লক্ষ্য। তাদের কাছে ইসলামী আদর্শ বা শরিয়া রক্ষা করা হচ্ছে পরের ব্যাপার। মুসলিম শাসকদের মাঝে যেদিন থেকে এই মনোবৃত্তি ও প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই তারা ইসলাম থেকে ধীরে ধীরে বহু দূরে সরে গিয়েছেন। তাই তুরস্কের সুলতানরাও তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে বাড়াবাড়ির উদাহরণ স্থাপনের উদাহরণ রেখে গেছেন? যা ছিল ইসলামী শরিয়া পরিপন্থী।
এসবের পরিণতিতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ এই বিশ্বে অবিশ্বাসীদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। আর এই সাথে মুসলিম সমাজও ধর্মীয় গোড়ামী ও মূর্খতার কবলে নিমজ্জিত হওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
আসলে ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সাজাতে পারলে যে কোন জাতির জন্য বয়ে আনে অশেষ কল্যাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল মানুষ অতীত কিংবা নিকট কোন ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নিতে চায় না। আর মুসলিমদের বেলায় তো এই নজির একেবারেই কম। অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে অবস্থার উন্নতি যে সম্ভব নয় এই কথাটি তাদের মাথায় ঢুকছে না।
অতএব সুরঙ্গের অপর প্রান্তে আজ কোন আলোর আশা করা বাতুলতা মাত্র। কেননা মহান আল্লাহ বলেই দিয়েছেন যারা নিজেদেরকে নিজেরা সাহায্য করতে চাইবে না তাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন না।
রেফারেন্স:
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে http://theislamicmonthly.com/syrian-alawites-their-history-their-future/ http://www.danielpipes.org/191/the-alawi-capture-of-power-in-syria http://www.npr.org/2012/06/13/154904208/in-syrias-sectarian-battle-who-are-the-alawites |