বন্ধুত্বের প্রতিদান

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে হলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তথা স্বাধীনতা আন্দোলন ভাষাগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছিল। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে আমাদের পূর্ব বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতো। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ সম্ভাবনার বিপরীত ছিল।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি অবধি তদানীন্তন পাকিস্তানের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ এবং এর শেষ দিকে সূচিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র্রটির সৃষ্টি। সে যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে ভারত চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। তবে এর আগে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল তাতে কোন পক্ষ জয়ী হয়েছিল সে বিতর্কের অবসান হয়নি। এর বহু আগে, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ভারতভুক্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এ রাজ্যটির এক-তৃতীয়াংশ নিজ দখলে নেয়, যা বর্তমানে আজাদ কাশ্মির নামে খ্যাত।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার অধিকার অর্জন করে। সে নির্বাচনটির বিশেষত্ব হলো আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক ছিল এবং দলটি পশ্চিম পাকিস্তানে নগণ্যসংখ্যক আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও প্রতিটি প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। অনুরূপ পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে নগণ্যসংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলেও দলটির মনোনীত কোনো প্রার্থী এখানে জামানত রক্ষা করতে সমর্থ হয়নি।

সে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করায় আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সার্বিক অধিকার আদায়ে মুক্তি তথা স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয়। এ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে আওয়ামী লীগের এবং দলটির ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মোজাফফর আহম্মদের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী ন্যাপ এবং এ দল দু’টির ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেছিল। তা ছাড়া এ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের সেনা, নৌ, বিমান, রাইফেল, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা ছাড়াও অপর যারা অংশ নিয়েছিল তাদের বেশির ভাগই দেশের সাধারণ জনমানুষ, কৃষক, শ্রমিক এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগ বা ছাত্র লীগের নেতাকর্মী।

ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারতের এ সাহায্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা। সে সময় ভারতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী প্রদান করেছিল। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগানদাতা হিসেবে যে দু’টি দেশ উল্লেখযোগ্য, তারা হচ্ছে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের মানবিক দিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সহায়তার মাধ্যমে ভারতের দু’টি লক্ষ্য অর্জিত হয়। এর একটি হলো প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের অখণ্ডতা নস্যাতের মাধ্যমে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতিসাধন এবং অপরটি হলো, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিজস্ব পণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে স্বীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধকরণ। ভারত যে তার সে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে সে প্রশ্নে বিতর্ক নেই।

১৯৬৫ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো পণ্য আমদানি হতো না এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকেও ভারতে কোনো পণ্য রফতানি করা হতো না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তীকালে প্রতি বছরই বাংলাদেশে ভারতের রফতানি বৃদ্ধি ঘটছে; কিন্তু সে অনুপাতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিগত বছর ভারত বাংলাদেশে ৪৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করেছে। অপর দিকে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্রা চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ নামধারী যেসব ভারতীয় নিয়োজিত, তারা এ দেশ থেকে বিগত বছর যে পরিমাণ স্বদেশে অর্থ প্রেরণ করেছেন, এর পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকার অধিক। প্রতি বছর চোরাচালানের মাধ্যমে যে পরিমাণ ভারতীয় পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করে, গবেষকদের অভিমত, এর মূল্যমান দেশটির রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৪ গুণ। তা ছাড়া প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ, চিকিৎসা, কেনাকাটা ও শিক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থ এ দেশবাসী ভারতে গিয়ে ব্যয় করে থাকেন, তা ভারতের সামগ্রিক রফতানি আয়ের চেয়ে কম নয়।

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী এ দু’টি দেশ পরস্পরের অতিঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাথে ভারতের অনেকগুলো অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। যেমন, অভিন্ন নদীগুলোর পানির সুষম হিস্যা, সীমান্তে বৈরী কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও হত্যা, মাদক ব্যাপক বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও চোরাচালান, বাণিজ্য বৈষম্য, বৈধ প্রয়োজনে ভারত ভ্রমণে ভিসাপ্রাপ্তিতে জটিলতা, বাংলাদেশী পণ্য আমদানিতে ভারতের অনীহা প্রভৃতি।

ভারত সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শক্তিধর। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এখন বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান উপমহাদেশের এ দু’টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ লোক যখন স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করছে অথচ ভারতের ৬০ (ষাট) শতাংশ লোক উন্মুক্ত স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার কাজ সমাধা করছে আজো।

ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ৭টি রাজ্য সঙ্কীর্ণ চিকেন নেক করিডোর দ্বারা ভারতের মূল অংশের সাথে সংযুক্ত। ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোনো রাজ্য থেকে এ সাতটি রাজ্যে অথবা এ সাতটি রাজ্য থেকে ভারতের মূল অংশের কোনো রাজ্যে পণ্য আনা- নেয়া করতে হলে বিপুল ব্যয়ে, দীর্ঘ দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। পণ্য আনা-নেয়ার কাজটি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করা হলে তা ব্যয় ও সময় উভয় দিক থেকে ভারতের জন্য সাশ্রয়ী হয় বিপুলভাবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের নৌ ট্রানজিট স্বাধীনতা-পরবর্তী আমলে চালু হয় এবং তা বর্তমানেও অব্যাহত থাকলেও অধুনা নাব্যতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে বাংলাদেশ বন্ধুত্বের চরম উদারতায় বহমান তিতাস নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে ১০০ চাকাবিশিষ্ট ট্রেইলার চলার ব্যবস্থা করেছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রেরণ করা হয় এবং বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ, এ বাবদ কোনো ধরনের শুল্ক গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের খাদ্যাভাব মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে মূল ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চাল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপকোনো ধরনের শুল্ক গ্রহণ ব্যতিরেকেই নিজ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে চাল পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে।

বিগত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলে যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। চুক্তিটির বলে ভারত এ দু’টি বন্দর ব্যবহার করে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য আদান-প্রদান করতে পারবে।

স্থল, নৌ ও রেল ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্দর দু’টি ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পরিবহন করতে হলে যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তা নির্মাণের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ক্রেডিট সব সময় দাতারাষ্ট্রের স্বার্থ অধিক সুরক্ষা করায় তা গ্রহীতা রাষ্ট্রের জন্য খুব কমই ফলদায়ক হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ভারতের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রেল ও নৌ ট্রানজিট চালু ছিল। বাংলাদেশের দু’টি বন্দর ব্যবহার এবং ট্রানজিট সংশ্লেষে ভারত বাংলাদেশকে যুক্তিসঙ্গত মাশুল প্রদান করলে তা থেকে উপার্জন দ্বারা বাংলাদেশ অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করা ছাড়াও অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করতে পারে। কোনো দেশই বিনাশুল্কে এবং নিজের অবকাঠামোর ক্ষতি করে এক দেশ থেকে অপর দেশে পণ্য পরিবহনের অনুমোদন করে না। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চপর্যায়ে এমন দু-একজন ব্যক্তি রয়েছেন যাদের কাছে নিজ দেশের স্বার্থ পূরণের চেয়ে ভারতের স্বার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ব্যক্তির মুখ থেকে উচ্চারিত হয় ‘পণ্য পরিবহন বাবদ শুল্ক নেয়ার মতো অসভ্য আমরা নই’। তখন তাদের দেশপ্রেমের মাত্রা কত নি¤েœ কিংবা আদৌ তাদের দেশপ্রেম আছে কি না সে প্রশ্নটি এসে যায়। আর এ ধরনের বালখিল্য কথা বলে দেশবাসীর ওপর কালিমা লেপন করতে চান, সে কালিমা দেশবাসীর নাকি তাদের, তা বোধকরি দেশবাসী বুঝতে সক্ষম।

ভারতের সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশের পণ্যের বিপুল বাজার রয়েছে। ভারত বাংলাদেশ থেকে সেভেন সিস্টার্সে রফতানি পণ্যের অসংবেদনশীল তালিকা সম্প্রসারণ করে অশুল্ক বাধাগুলো পরিহার করলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানির মাধ্যমে বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস করে তা শূন্যের কোঠায় না হলেও বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের সে অগ্রযাত্রা ভারতের সেভেন সিস্টার্সের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও হবে সহায়ক। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব ভিন্ন। বাংলাদেশ অথনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে এতে ভারতের সেভেন সিস্টার্সসহ অপরাপর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কায় যখনই বাংলাদেশের এক বা একাধিক পণ্য ভারতের বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থান করে নেয় তখন দেখা যায়, অশুল্ক বাধা আরোপ করে এবং বিভিন্ন ধরনের মান যাচাই-পরীক্ষার কথা বলে পণ্যগুলোকে অপ্রতিযোগী করে তোলা হয়। তা ছাড়া, বাংলাদেশের একাধিক পণ্যের ব্যাপারে ভারতকে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কও আরোপ করতে দেখা গেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মতো বর্তমানে বাংলাদেশেও ক্রিকেট খুব জনপ্রিয় খেলা। সাম্প্রতিককালে ক্রিকেটে বাংলাদেশের অর্জন দেশ ও বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান কখনো প্রত্যাশা করে না, ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান তাদেরকে ছাড়িয়ে যাক। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলন, জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের কারণে যখন দেখা গেল ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থানে আমাদের দেশ পৌঁছে গেছে, তখন ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন আইসিসি বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে অভিনব ও অমূলক অভিযোগ তুলে অভিযুক্ত খেলোয়াড়দের এবং সামগ্রিকভাবে দলের মনোবল ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচিত যে দু’জন খেলোয়াড়ের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ভারতীয় বোলারদের বোলিং অ্যাকশন এর চেয়ে অধিক ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার খড়গ তাদের ওপর না পড়ে বাংলাদেশী বোলারদের ওপরই পড়েছে। নিষেধাজ্ঞাটি এমন সময় দেয়া হলো যাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলগত অবস্থান দুর্বলতর হয়।

এবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন মাঠে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলাকালীন দেখা গেল মাঠে উপস্থিত ভারতীয় দর্শকের সমর্থন বাংলাদেশের বিপক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে। যে ভারতীয়রা আমাদের পক্ষ হয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের ভূমিতে তাদের পরাজিত করেছিল, তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ এবং পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন আমাদের দেশবাসীকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে।

আমাদের দেশে যেকোনো ভারতীয়ের সরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে আগমন ঘটলে আমরা তাদের প্রতি সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই এবং এমন কোনো আচরণ করি না, যা তাদের মর্মবেদনার কারণ হতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের দেশের মিডিয়ার বেশ কিছু সংবাদকর্মী টি-টোয়েন্টি ফাইনাল খেলার সংবাদ সংগ্রহের জন্য কলকাতা থেকে দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টার যাত্রা সমাপনান্তে মুম্বাই পৌঁছলে তারা একটির পর একটি হোটেলে গিয়েও আবাসন পেতে ব্যর্থ হন। তাদের সাফ জানিয়ে দেয়া হয়, কোনো বাংলাদেশীকে হোটেলে স্থান দেয়ার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেক অনুসন্ধানের পর একটি মুসলিমপ্রধান এলাকায় হোটেলে আবাসন পেতে তারা সক্ষম হন। এ ধরনের আচরণ সুপ্রতিবেশীসুলভ হওয়া দূরের কথা, বরং বন্ধুত্বের চরম অবমাননা। সুতরাং যে বন্ধুত্ব সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে, তা কতটা প্রকৃত বন্ধুত্ব এ বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করার সময় এসেছে। আর অনুধাবন করে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্য স্থির করতে পারি সে ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রযাত্রা কোনোভাবে ব্যাহত হওয়ার নয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

পূর্ব প্রকাশিত: নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *