১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস এলেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের স্মৃতি ভেসে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ দিনের স্মৃতি খুব বেশি বেশি করে মনে আসে। রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রাসঙ্গিক একটি কথা এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ সন্ধ্যার আগেই আখাউড়া যুদ্ধের ফলাফল শতভাগ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আখাউড়া আমরা দখল করছি, পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হচ্ছে, পাকিস্তানি বাহিনী মারা যাচ্ছে, পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে- এই ছিল আমাদের সামনে দৃশ্যমান স্বপ্ন। ঘটনা ঘটে যাওয়ার জন্য কিছু ঘণ্টার অপেক্ষা। ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ ফজরের নামাজের পরপরই, আখাউড়াতে অবস্থানকারী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা মরিয়া হয়ে পলায়নের জন্য পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে দৌড়াতে থাকে। পলায়নপর কিছু পাকিস্তানি সৈনিক তিতাস নদীতে পড়ে ডুবে মারা যায়। পলায়নপর কিছু পাকিস্তানি সৈনিক আমাদের গুলিতে মারা যায়। পলায়নপর কিছু পাকিস্তানি সৈনিক আমাদের হাতে বন্দি হয়। কিছু সৈনিক অবশ্যই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেই সময় আমি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'সি' (সামরিক পরিভাষায় উচ্চারণ চার্লি) কম্পানির অধিনায়ক কমান্ডার ছিলাম। আমাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। ১ ডিসেম্বর অতি সকালেই আমরা আখাউড়ার উত্তরে আজমপুর রেলস্টেশনে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করেছিলাম। আজমপুর দখলের পর আমরা দক্ষিণ দিকে মুখ করে আখাউড়া আক্রমণ করি। আক্রমণের প্রথম ধাপে উত্তর দিক থেকে আখাউড়াকে বেড় দিয়ে দিই বা বন্ধনী দিয়ে দিই। দক্ষিণ দিক থেকে বেড় বা বন্ধনী দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩১১ ব্রিগেডের সৈনিকরা। পূর্ব দিক থেকে বেড় দিয়েছিল ৩ নম্বর সেক্টরের সৈনিকরা। আখাউড়ার পূর্ব দিকে ছিল তিতাস নদী। নদী পার হওয়ার একটাই মাত্র জায়গা ছিল, যথা নদীর ওপরে রেলওয়ে ব্রিজ। আখাউড়া যুদ্ধের সফল সমাপ্তির স্মরণে, আমি বা আমরা ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করি তখন ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ বেছে নিয়েছিলাম। আখাউড়া যুদ্ধের পর আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে ১৩ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত। ওই দিন আমরা ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণ-পূর্বে ডেমরার সন্নিকটে বালু নদের পূর্ব বা পূর্ব-দক্ষিণ পাড়ে এসে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিসেম্বর মাস এলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে যুদ্ধের কথা, যুদ্ধের মাঠের ত্যাগের কথা, চিরতরে হারিয়ে গেছেন যেসব সহযোদ্ধা, তাঁদের কথা। আজও মনে আসছে, সব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসব বাঙালি সদস্য বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের নামের তালিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে আছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দপ্তর দুটিতে মুক্তিযোদ্ধা বিমান ও নৌ সেনাদের বা অফিসারদের তালিকা আছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব ব্যাটালিয়ন মুক্তিযুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও বিশেষ ঝামেলা নেই। ঝামেলা অন্যত্র তথা দলীয় রাজনৈতিক কারণে অথবা দুর্নীতির কারণে তালিকাভুক্ত হওয়ার বা তালিকাভুক্ত করানোর বা তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা, অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের পারস্পরিক বৈরী সম্পর্কের কারণে কেউ কাউকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা, অথবা কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ভুলক্রমে বাদ যাওয়ায় সেই নামটিকে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টাকালে রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত বাধার সৃষ্টি ইত্যাদি। সুসংবাদ হলো, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার জন্য চেষ্টাও শুরু হয়েছে এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ বা কোটি কোটি বাঙালি প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রথম থেকে নিয়ে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত, মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যস্ত রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ভারতের মাটিতে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে করে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন এটা সত্য, তবে শুধু ওই অস্ত্র দিয়েই সর্বাঙ্গীণ যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। বিশেষত বিভিন্ন সেক্টরে ও ফোর্সগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, অস্ত্র, যানবাহন ইত্যাদি সরবরাহ করে ভারত সরকার। প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতের তিনটি প্রদেশ যথা- পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে, তাদের ভরণপোষণ দেয় ভারত সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের এ ধরনের উদার সহযোগিতা দেওয়া বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এ ধরনের অনুকূল অবস্থান গ্রহণ করা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বিরল। ভারত যদি বাংলাদেশকে তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা না দিত, তাহলে কী হতো? অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা তথা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চিন্তাক্লিষ্ট ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ কত দিন চলবে বা চালানো সম্ভব হবে? এই প্রেক্ষাপটে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তাই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে (৩ ডিসেম্বর) ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যেটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল, সেটাই তো ছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশকে পাকিস্তানি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করার নিমিত্তেই ভারত প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শুরু করে।
আমি একজন সৈনিক হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দান করেছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই; যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ইজ্জত হারিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ দান করেছেন। এই ৩০ লাখ শহীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। দুই লাখ বাঙালি মা-বোন তাঁদের ইজ্জত হারিয়েছেন হানাদার বাহিনী ও তাদের সঙ্গীদের হাতে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে যেসব ভারতীয় সৈনিক বাংলার মাটিতে রক্ত দান করেছেন সেসব সহযোদ্ধাকে অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর চার হাজার ৬১ জন কর্মকর্তা, জেসিও, সৈনিক যুদ্ধাহত হন এবং এক হাজার ৫২৫ জন কর্মকর্তা, জেসিও, সৈনিক নিহত হন। অপরপক্ষে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে যারা আত্মসমর্পণ করেছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তাদের মোট সংখ্যা হচ্ছে ৯১ হাজার, ৫৬ হাজার ৬৯৪ জন সামরিক ব্যক্তি, ১২ হাজার ১৯২ জন আধাসামরিক ব্যক্তি ও বাকিরা বেসামরিক ব্যক্তি। ভারতের ক্ষয়ক্ষতি ও পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের এই তথ্যগুলো দেওয়া আছে একটি গ্রন্থে, নাম : 'ইন্ডিয়ান আর্মি আফটার ইনডিপেনডেন্স' : লেখক মেজর কে সি প্রভাল, প্রকাশক লান্সার ইন্টারন্যাশনাল, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল।
যাহোক, বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের সীমান্তের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে ভারতের সঙ্গে এবং মাত্র ৫ শতাংশ হচ্ছে বার্মা বা মিয়ানমারের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিল অতি উষ্ণ, ভারতের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষার প্রধান উপাত্ত ছিলেন। মোশতাক, সায়েম ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সালের মে পর্যন্ত ছিল উষ্ণতা বহাল রেখে আনুষ্ঠানিক সম্মানজনক সম্পর্ক সৃষ্টির প্রয়াস। জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সম্পর্ক প্রকাশ্যে ছিল না অতি উষ্ণ না অতি শীতল; অপ্রকাশ্যে ভারতের ওপর ক্ষীণভাবে নির্ভরশীল। খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতের প্রতি শীতল বন্ধুত্বের সময়। শেখ হাসিনার আমলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছিল অতীতের উষ্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের কাল। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল ছিল ভারতের প্রতি শীতল বন্ধুত্ব ও ভারতনির্ভরতা কমিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে দৃষ্টি প্রশস্ত করার সময়। ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল ছিল নাতিশীতোষ্ণ; কিন্তু অপ্রকাশ্যে ভারতনির্ভর বা প্রকাশ্যেই ভারতের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমলে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পারস্পরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক আগ্রাসী পর্যায়ের; অর্থাৎ অ্যাগ্রেসিভ ফ্রেন্ডশিপ।
পূর্ব প্রকাশিত ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ দৈনিক কালের কণ্ঠ