মার্কিন হুঁশিয়ারি এবং ৫ জানুয়ারি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা

বিবর্তনবাদের জানাজা শেষে ডারউইনিজমের উল্টোরথে চড়ে এখন আমরা ফের মানুষ থেকে বহুরূপী বানর হতে চলেছি। বানরকে দিয়ে মজাদার খেলা দেখায় মানুষ, দর্শকেরা মজা পায়। আমাদেরকে দিয়েও খেলাচ্ছে কয়েকজন, মজা পাচ্ছে বিশ্ববাসী। গণতন্ত্রহীন দেশগুলোতে কী হচ্ছে জানি, কিন্তু গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে কী ঘটছে; সেটা কি জানি পরিণত বয়সে একটি শান্তিপূর্ণ দেশ থেকে আমেরিকায় এসেছিলাম, কিন্তু তখন থেকেই অঘটন যেন নিয়ম। শুরু জিয়াউর রহমান হত্যা দিয়ে, এরপর এরশাদ নামের স্বৈরশাসক, পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে উৎপীড়ন আজ অবধি অব্যাহত। ১/১১-কে কেন্দ্র করে যেসব অসম্ভব ঘটনা নিয়মে পরিণত হচ্ছে, সর্বশেষ প্রোপাগান্ডা, বাংলাদেশে ‘ইসলামিক স্টেট’ আছে বলে আওয়ামী লীগের দাবি। সন্দেহ নেই, জঙ্গিহীন দেশটাকে জঙ্গি বানিয়ে কিছু হাসিল করতে মরিয়া দলটি প্রায় ৫১ ভাগ সফল। তবে কূটনৈতিক জোনে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা নেপথ্যের বিষয়টি কোনোক্রমেই স্বাভাবিক নয়। সম্প্রতি ইয়েমেন ও নাইজেরিয়ার উদাহরণ টেনে মার্কিন দূতাবাস বলল, ‘আমরা ওয়াশিংটনের সাথে সার্বণিক যোগাযোগ রাখছি, আগামীকালের মধ্যে (১৮ ফেব্র“য়ারি) ডিপ্লোমেটিক জোনে মিছিল-সমাবেশ বন্ধ না হলে ওদের মতো উল্লেখযোগ্য হারে দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা হবে। আমরা আমাদের পরিবার-পরিজন, নাগরিক এবং আমেরিকান স্কুলের শিশুদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশে চলাচল, গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারি। আমাদেরকে এমন পদপে নিতে বাধ্য করা হলে অন্য অনেক মিশনও অনুরূপ পদপে গ্রহণ করতে পারে। সম্প্রতি ইয়েমেন ও নাইজেরিয়ায় এটা বাস্তবায়ন করা হয়েছেৃ’ Ñ মানবজমিন ২৩ মার্চ ২০১৫। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরল সমীকরণে দেখছি না। কারণ, এরপর থেকেই ডিপ্লোমেটিক জোনে মিছিল-মিটিংয়ে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করল সরকার। রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে প্রকৃত অর্থেই এটা কি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন হুঁশিয়ারি নয় আবারো প্রমাণ করল আওয়ামী লীগ, একমাত্র ডাণ্ডা খেলেই ঠাণ্ডা। তাদের এমন উদাহরণ বহু, যা মিডিয়ার রাডারে থাকে না।

বাংলাদেশকে নাইজেরিয়া ও ইয়েমেনের পরিস্থিতির সাথে তুলনার মধ্যে ‘অবরোধ’ নেই, আছে সরকারের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মার্কিন দূতাবাসের কঠিন বার্তা। আমার সমীকরণ, পশ্চিমাদের সন্দেহ, বিরোধী দল নির্মূলে এসবই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অংশ। বারবারই অবৈধ মন্ত্রীদের মন্তব্য থেকে অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। যেন তারা চাইছেন দেশটা সিরিয়া, ইয়েমেনের মতো হোক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন প্রত্যাখ্যান করল মানুষ, এর বহু তথ্যপ্রমাণ রাষ্ট্রদূতদের সংগ্রহে, ফুটেজগুলো ইউটিউবে; অবরোধ তো হবেই। তবে অবরোধের সাথে ইসলামিক স্টেটের তুলনা বনাম দূতাবাসের হুঁশিয়ারি প্রমাণ করল, আইএস প্রমাণে ব্যর্থ হলো সরকার।

মানবকল্যাণে কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরি। জঙ্গিবাদের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা নিয়ে প-েবিপে অনেক মতামত। সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলাদেশে ‘ইসলামিক স্টেট জঙ্গি’ রয়েছে প্রমাণ করতে পারলে যুগের পর যুগ মতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। সাধারণত জঙ্গিবাদবিরোধী সরকারকে পশ্চিমারা মতায় রাখে। সুতরাং যেকোনো মূল্যে ইসলামিক স্টেট প্রমাণে গুম-খুন-ক্রসফায়ারের মহোৎসবে এত বেশি লিপ্ত, যার প্রমাণ দিতে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আইএস কী ধরনের জঙ্গি, অবৈধ সরকার ভেবেচিন্তে বলে কি না জানা নেই; কিন্তু ৫ জানুয়ারি ঘটানো ভোটসন্ত্রাসীদের মুখে বারবার শব্দটি উচ্চারণ নিঃসন্দেহে উসকানিমূলক। হামেশাই র‌্যাব-পুলিশের হাতে জঙ্গি আবিষ্কার, অস্ত্র আবিষ্কার এবং স্বীকারোক্তির ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকর। আওয়ামী লীগ অবশ্য পাগলের মতো কাণ্ড এবং বাচালের মতো কথা বলার জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ নিশা দেসাই ‘দুই আনার মন্ত্রী’ অথবা ‘কাজের মেয়ে’ মর্জিনা।

আইএসের যুদ্ধ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে অবরোধ, ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার পে আন্দোলন। একে জঙ্গি বললে বিশ্বের অনেক নেতা, যারা ভোটাধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেছেন; তাদেরও জঙ্গি বলতে হবে। নিশ্চয়ই মার্টিন লুথার কিং, ম্যান্ডেলা কিংবা মুজিবকে জঙ্গি বলা ঠিক হবে না। বরং সরকারই জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে এমন সব অঘটন ঘটাচ্ছে, যার প্রমাণ প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায়। পেট্রলবোমা হাতে ধরা খাচ্ছে আওয়ামী কর্মীরাও। মিডিয়ার আতঙ্কের কারণে খুনের সঠিক সংখ্যা কিংবা পরিচয় কোনোটাই জানা যাচ্ছে না। কেউ চেষ্টা করলেই তার বিরুদ্ধে মামলা। ‘৭৩-’৭৪ সালেও একই নৈরাজ্য কিন্তু অ্যানালগ দুনিয়ায় তখন বেশির ভাগ লাশের খবর পাওয়া যেত।

প্রবাসী সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত দেশকাতর, কিন্তু গুম হওয়ার ঘটনায় ভীত। মানবাধিকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এমন জঙ্গি আচরণে নিজের দেশ আমার কাছে ইয়েমেনের মতোই অনিরাপদ। হঠাৎ গুম হয়ে যাওয়া যেন নিয়ম। ২৮ মার্চ প্রকাশিত, ‘চাপের মুখে গণমাধ্যম’ শিরোনামে সিপিজের প্রতিবেদনটি উপোর উপায় নেই। নিঃশর্ত বেঁচে থাকার অধিকার কি রূপকথার গল্পের মতো বুঝলাম, দূতাবাসের লোকজন নিরাপত্তা চায়, কিন্তু মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও অভিজিৎ খুন ওয়াশিংটনকে কী বার্তা দিলো আমাদের দেশে দূতাবাসের লোকেরা ভালো থাকবে আর আমরা গুম হয়ে যাবো, এটা কেমন কথা! এর আগে ব্রিটিশ নাগরিকও গুম হয়েছিলেন। সুতরাং মার্কিন নাগরিকেরা যাবে কী যাবে না, অভিজিতের ঘটনার পর অবিলম্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সঠিক নির্দেশনা জরুরি। ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা ঠেকাতে পদপে প্রয়োজন। অন্যথায় বাংলাদেশ হতে পারে দ্বিতীয় জিম্বাবুয়ে।

মুক্তচিন্তার অধিকার সংবিধানে থাকা সত্ত্বেও সরকার তা কিভাবে ভঙ্গ করছে, সারা দুনিয়া জানে। অভিজিতের খুনিরা পুলিশের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল, কিন্তু ওয়াশিকুরের খুনিরা সাথে সাথে ধরা পড়ে; এই ব্যত্যয় রাষ্ট্রের চেহারা কেমন দেশকে ভালোবাসার মূল্য দিয়ে কঠিন প্রশ্ন রাখল অভিজিৎ, প্রকৃত জঙ্গি কে আমাদের ভয় অন্য কোথাও। ‘প্রিয় দেশটি যেন নাইজেরিয়া, ইয়েমেনের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ না করে। কিছু ঘটিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রয়াস পাওয়া কি অসম্ভব, ৫ জানুয়ারি এবং জাতিসঙ্ঘ সবাই কি ভুলে গেছে, একমাত্র ভারত-ভুটান ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব পশ্চিমা পরিদর্শকই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন

কেন করেছিল প্রথম আলো ১ এপ্রিল সংখ্যায় ‘বন্দুকযুদ্ধে এগিয়ে পুলিশ’ শিরোনাম। আইন ও সালিস কেন্দ্র বলেছে, ‘এ বছরের প্রথম তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও বন্দুকযুদ্ধে ৬৪ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৪ জন নিহত হন পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধেৃ, ‘আসক’-এর বিবৃতি, র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ১৫ জন, র‌্যাব ও বিজিবির সাথে একজন, কোস্ট গার্ড ও আনসারের সাথে একজন, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাথে পাঁচজন নিহত হন। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের একজনের লাশ উদ্ধার হয়ৃ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫৫৬টি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে ১২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের ৬৯ জন পেট্রলবোমায় মারা গেছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, পুলিশের সাথে সঙ্ঘাতে তিন হাজার ৫১ জন আহতৃ।’ মানবজমিন এপ্রিল ২, শিরোনাম, ‘দিনে গড়ে ১৫ খুন।’ পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০ হাজার ৯৭৫ জন খুন। চলতি বছরে তিন মাসে অন্তত ১০০০ খুনের ঘটনা। এই হিসাবে গড়ে দিনে ১১ জন খুনৃ। বলছি, ১৫তম সংশোধনীকে কেন্দ্র করে আজ অবধি প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ৫ জানুয়ারির অবৈধ মতা দখলকারীরা। তারা এসব না করলে, কিছুই হতো না। সুতরাং একটি দুর্ঘটনার জন্যও খালেদাকে আসলে দায়ী করা চলে না।

নিউ ইয়র্ক টাইমস এলেনবেরি, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে নির্বাচন নিয়ে যে প্রতিবেদনটি লিখেছেন, গুগলে শিরোনাম ‘লো টার্নআউট ইন বাংলাদেশ ইলেকশন’। এই একটি প্রতিবেদনই অবৈধ সরকারের মৃত্যু ঘটিয়েছে। নির্বাচনী সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু এবং ৪৪০টি ভোটকেন্দ্র সংঘর্ষের আশঙ্কায় আগেই বন্ধ হয়ে যায়। টেলিভিশনগুলো দেখাচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে সন্দেহজনক পোশাকে কিছু লোকের উপস্থিতি। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেয়নি মতাসীন দল। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান পরিদর্শকেরা এই নির্বাচন পর্যবেণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচনটি ত্র“টিপূর্ণ, তাই তারা আসছেন না। ফলে একমাত্র ভারত আর ভুটান ছাড়া পরিদর্শক কেউ ছিলেন না। সকাল থেকেই গণ্ডগোলের শুরু। টেলিভিশনগুলো দেখাচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে মারাত্মক সংঘর্ষ চলছে। বিকেলে ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ বিরোধী দলের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেছে, যেন ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতে না পারে। এই ঘটনায় চারজন অ্যাক্টিভিস্ট মারা গেছে।’ প্রতিবেদনটির সারমর্ম এটাইÑ ভারত ও ভুটান ছাড়া ৫ জানুয়ারিতে অন্য কোনো পরিদর্শক ছিলেন না, ফলে ইচ্ছামতো ভোটডাকাতি হয়েছে। আওয়ামী লীগকে মতায় রাখতে ভারতের নির্লজ্জ ভূমিকা সারা দুনিয়া জানে। সুজাতা সিংকে পাঠিয়ে এরশাদকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা এবং মতা দখলের সব মহোৎসব সম্পন্ন করেছিল ‘সাউথব্লক’। প্রকৃত অর্থে ভুটান ভারতের বংশবদ। সুতরাং তাদের থাকা না থাকা মূলত সমান। পশ্চিমাদের পর্যবেণ প্রত্যাখ্যান একটি কথাই প্রমাণ করল, ‘ এ নির্বাচনে গঠিত সরকার বৈধ নয়। ফলে তাদের সব কর্মকাণ্ডই ভবিষ্যতে পতিত হতে পারে।’ মতা দখলে রাখতে বাংলাদেশেও আফ্রিকার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির লণগুলো স্পষ্ট। তবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের হাত ছাড়া এত গভীরে দলীয় নট-নটীরা কখনোই যেতে পারত না। বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কোনোই প্রয়োজন ছিল না কিন্তু জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা ১/১১ বা ৫ জানুয়ারিকে কিভাবে সম্ভব করল, জানা দরকার। অন্যত্র নির্বাচন নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে জাতিসঙ্ঘ হস্তপে করে কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় ব্যতিক্রম। অথচ তারা ৫ জানুয়ারি পর্যবেণ প্রত্যাখ্যান করেছিল।

মহাসচিবের অর্বাচীনতা এবং আওয়ামী লীগের গালিগালাজের মাত্রা এতটাই বেশি যে, প্রসঙ্গটি নম্র ভাষায় ব্যাখ্যা করতে না পারার জন্য নিজেই দুঃখিত। ষড়যন্ত্রের শুরু ১/১১ দিয়ে, দ্বিতীয় দফায় যা ১৫তম সংশোধনী, এরপর থেকেই অশান্ত দেশ এবং নীরব লড়াই। শেখ হাসিনার মুখেই বারবার শুনেছি, ‘মুই কার খালুরে’। সুতরাং তার ভাষাতেই এবার ‘খালু’ খুঁজতে জাতিসঙ্ঘে চলুন। বান কি মুন মতায় এলেন ১/১/২০০৭, ১০ দিন পরেই ১/১১। লণীয়, একমাত্র এই মহাসচিবের আমলেই জাতিসঙ্ঘের ওপর অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তারের ঘটনা প্রমাণের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। এই ল্েয যথেষ্ট লবির অর্থ জোগানের চিহ্নগুলো স্পষ্ট। প্রায় ২০০ সদস্য দেশের মধ্যে প্রোপাগাণ্ডার শীর্ষে স্থানীয় মিশনটির এজেন্ডার যেন শেষ নেই। ২০১৪ সালে বিতর্কিত এমডিজি পুরস্কার এবং বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে সেন্ট্রাল পার্কে মার্কিনিদের সংবর্ধনার নামে বাংলা মিডিয়াজুড়ে বিশাল বিজ্ঞাপন এবং হলুদ খবরের লবডঙ্কা কে না জানে মিশনে যার হাতে এত বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতা, উচ্চাভিলাষ নিয়ে স্থানীয় বাংলা মাধ্যমগুলো একাধিক প্রতিবেদন লিখেছে। উচ্চাভিলাষী মিশনের নেতৃত্বে ভুয়া সংবর্ধনার বিষয়টি আয়োজকদের কানে পৌঁছামাত্র বাংলাদেশকে অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেয়া হলো। এ সম্পর্কে স্থানীয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সরেজমিন যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছিল, নয়া দিগন্তে কিছুটা লিখেছিলাম তা নিয়ে। অতএব নির্বাচন জবরদখল এবং বিরোধী দল ঠেঙানোর মধ্যে জাতিসঙ্ঘের একটি যোগসূত্র আবিষ্কার করা যায়। এই দেশে আমি ৩৫ বছর, এমন হালকা মহাসচিব আগের কেউই নন।

সবাই জানে, ১/১১ নিয়ে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা, পরে ৫ জানুয়ারি ঠেকাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তারাই। তারানকোর দূতিয়ালির খবর সারা বিশ্ব জানে। কিন্তু তারপরও আবারো কী করে মতায় এলো একই দল, এই প্রশ্ন আমরা করতেই পারি (এবারো ১/১১ স্টাইলে)। তাহলে তারানকো দূতিয়ালি কি ১/১১-এর মতো আরেকটা অপকৌশল বিষয়টি সহজ সমীকরণে দেখার সুযোগ নেই। ঘটা করে বহু ঘণ্টা ধরে বহু আলোচনার পর নিজস্ব প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ সত্ত্বেও, চারটি পরামর্শের একটিও প্রয়োগ না করে বরং আজ অবধি নীরব কেন মহাসচিব মাঝে মধ্যে যা বলেন, ভবিষ্যতে নির্বাচন না হওয়ারই প্ররোচনা। নিরাপত্তা পরিষদের বাইরেও এককভাবে ৫ জানুয়ারি ঠেকানোর মতা তার ছিল। একই কাজ আফ্রিকাতে করা হয়। কিছু দিন আগে আফ্রিকার একাধিক দেশে নির্বাচন করল জাতিসঙ্ঘ। এসব উদাহরণ সামনে, কারসাজির তীর কার দিকে

‘আমার দেশ’ অনলাইন ২৮ মার্চ ‘নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসির যে প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরেছে, বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশন বহু আগেই জানত। ‘মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পরে অনেক সময় এদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়, দীর্ঘ দিন পর অনেককে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারও দেখানো হয়, আর অনেকের শেষ পর্যন্ত কোনো খোঁজও পাওয়া যায় নাৃ। উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বিএনপির আরেকজন শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যারই যে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে, তা নিয়ে তার সন্দেহ নেই। ভবনটির দারোয়ান, নিরাপত্তা প্রহরী সবাই বলেছে ডিবি-পুলিশের লোকজন, প্রশাসনের লোকজন আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছেৃ। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১১১ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়েছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে শুধু ২০১৩-১৪ সালে ১৬০ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। প্রথমে আটকের কথা অস্বীকার করলেও কাউকে আবার পরে থানায় বা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগেরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৃইলিয়াস আলীর বিষয়ে আমরা হাইকোর্টে মামলা করেছিলাম, কিন্তু রাষ্ট্রই যদি জড়িত থাকে, আদালত আর কী করতে পারে? বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর থানা-পুলিশও মামলা বা সাধারণ ডায়েরি নিতে চায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে গুম করার অভিযোগ করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের হিসাবে এ বছরেই ২১ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়েছে, পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে, ১০ জনকে থানায় সোপর্দ করেছেৃ।’

‘মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি সত্ত্বেও অবৈধ সরকারের পে অবস্থান, এই মর্মে সন্দিহান হয়; ১/১১ এবং ৫ জানুয়ারি কোনোটাই ঠেকায়নি জাতিসঙ্ঘ বরং উসকে দিয়েছে।’ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ রাজনৈতিক আলোচনায় আসা উচিত ছিল। একমাত্র বর্তমান আমলেই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় এমন সব ভৌতিক কাণ্ড ঘটে, জাতিসঙ্ঘের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব এবং প্রায় দুই শতাধিক সদস্য দেশের কেউই যা করে না। দুই শতাধিক সাঙ্গোপাঙ্গের বহর নিয়ে করের টাকায় নিউ ইয়র্কে আওয়ামী লীগের আসর বসে। সফরসঙ্গীদের কোনো কাজ না থাকায় কী করেন, তা সবাই জানে। লাখ লাখ ডলার খরচ করে কেউ আবার সংবর্ধনাও দেন, যা নিয়ে ভিন্নমতের প্রবাসীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জেএফকে থেকে হিল্টন হোটেল পর্যন্ত। যেখানেই প্রধানমন্ত্রী সেখানেই দুই পরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান, বিশ্রী পোস্টার আর জুতা প্রদর্শন, পুলিশের হস্তক্ষেপে। বাংলা মিডিয়া দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশের উদ্যোগেই কি সাধারণ পরিষদের বৈঠক বসে সেন্ট্রাল পার্কের ভুয়া সংবর্ধনার বিষয়টি এখন পর্যন্ত আলোচনায়, আমাদের মানসম্মান ধুলায়। মহাসচিবের মন্তব্যের সাথে প্রকৃত বাংলাদেশের মিল কোথায় যেমন এমডিজি, কমিউনিটি কিনিক, অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি। পুরস্কার, সংবর্ধনার মতো ভৌতিক ঘটনা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করে না। তার এই ভূমিকা নিজের, নাকি প্রভাবিত হয়ে!

এবার দেখা যাক জাতিসঙ্ঘ কিভাবে চলে। এটা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বরং সর্ববৃহৎ এনজিও, চাঁদার টাকাই ভরসা। আমেরিকা দেয় ২৫ শতাংশ, তাদের মতা সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি, ২০১৫ সালে ঘাটতি দেড় বিলিয়ন ডলার। যে বেশি দেয়, তারাই বেশি পায়। জেনে রাখা ভালো, কয়েকটি নির্বাচন পরিচালনাসহ কিছু রিলিফ বিতরণ এবং রিফিউজি সমস্যায় সাহায্য ছাড়া বেশি কর্মকাণ্ডই বিতর্কিত এবং দুর্ঘটনার কারণ। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকাতে শান্তিরী বাহিনীর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের অভিযোগ, পশ্চিমাদের অমূল্য খনিজসম্পদ নিশ্চিত করতেই আফ্রিকাতে এদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের রেজুলেশন পাসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উসকে দেয়ার জন্যও প্রশ্নবিদ্ধ জাতিসঙ্ঘৃ ইত্যাদি।

প্রশ্ন, দক্ষিণ সুদানে নির্বাচন করল, এখানে করল না কেন জাতিসঙ্ঘ এমন জায়গা, যেখানে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এলেই শত শত প্রতিনিধির নানা সমীকরণ চলে। সাম্প্রতিকালে মনমোহন-হাসিনা, মোদি-হাসিনা বৈঠক এর নজির। তারানকোর পরামর্শ প্রয়োগ না করার মাধ্যমে এই সত্য আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হলো। তা ছাড়া, ৯ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী বিদেশে প্রায় ৪৫টি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত, অথচ স্বদেশে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত বিতর্কিত। বিশেষ করে র‌্যাব-পুলিশের গুম-খুনের অভিযোগে মানবাধিকার কর্মীদের স্বস্তি নেই। এ দিকে, নাভিপিল্লাইয়ের পরামর্শের পরও নীরব বান কি মুন। বিশেষ করে ৭ মার্ডারের ঘটনা সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এত কিছু সত্ত্বেও মিশনে বিরাট উপস্থিতি ‘কনফিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ এবং মানবাধিকার সনদের পরিপন্থী বলা যায়। সুতরাং মুনের দুই টার্মেই একপেশে ভূমিকায় ভবিষ্যতে বৈধ নির্বাচন না হওয়ার মতো যথেষ্ট রেফারেন্স তৈরি হয়েছে। মুন জানেন, ১৫৪ জন জনপ্রতিনিধি ১০০ শতাংশ অনির্বাচিত যাদের অন্যতম হলেন স্পিকার, যাকে পীরগঞ্জ থেকে সরকারের ছেড়ে দেয়া একটি আসনে বিনা ভোটে সিলেকশন করে বসানো হয়েছে। অবৈধ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে জাতিসঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রশ্নবোধক। মুন ভালো করেই জানেন, কেন তারা নির্বাচন পর্যবেণ করেননি। অতএব অহেতুক মৃত্যুর মিছিলের জন্য যারা দায়ী তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।

বিষয়টি হলো, ৫ জানুয়ারি না ঘটালে বার্ন ইউনিটের মতো একটি ঘটনা ঘটত না। ২৫৮ বছর পর এই বাংলায় আবারো দেশী-বিদেশী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ না হলে সর্বনাশ হবেই। সামনেই সেপ্টেম্বর মাস, আবারো বসবে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন, এবার ‘খালু’র কঠিন পরীক্ষা। তখন অবৈধ সরকারের সাথে দহরমমহরম অণুবীণ যন্ত্রে দেখব।

সারমর্ম
১ : জিম্বাবুয়ের মতো পরিণতি থেকে বাংলাদেশকে রা করতে হলে পশ্চিমাদেরকে সংলাপের কম্বল ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে হবে।
২ : তারানকোর চারটি পরামর্শ নিয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে।

 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *