অনেক দিন আগে বিশ্বজিৎকে যখন নৃশংসভাবে কুপিয়ে একদল খুনি হত্যা করেছিল তখন লিখেছিলাম বিশ্বজিতের রক্ত নিয়ে খুনিদের হোলিখেলা। খুনিদের হাত থেকে রক্তাক্ত বিশ্বজিতের বাঁচার প্রাণপণ প্রচেষ্টা আমাকে ভীষণ আলোড়িত করেছিল। সেদিনও দেখেছিলাম, যখন একজন মানুষকে একদল লোক কুপিয়ে খুন করছে তখন আমার মতো মেরুদণ্ডহীন কিছু মানুষ সেই দৃশ্য ধারণ করছে আর আরেকদল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জানি, কিই বা করার ছিল সেই সব সাধারণ মানুষের রক্তের নেশায় উন্মত্ত খুনিদের অস্ত্রের কাছে?
একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেল একজন মেধাবী মানুষ, যার নাম অভিজিৎ রায়। কীভাবে? প্রকাশিত ছবিতে যা দেখলাম, সেটি হলো অভিজিৎ যখন খুনিদের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন আর খুনিদের আঘাতে আহত তার স্ত্রী যখন চিৎকার করছে মানুষের সাহায্য পাওয়ার আশায়, ঠিক তখনই আশপাশে দেখা গেল কিছু মানুষের ছবি। যারা খুবই মনোযোগ সহকারে অভিজিতের শবদেহ দেখছেন এবং তার স্ত্রীর আর্তনাদ শুনছেন। কীভাবে সম্ভব? সব সম্ভবের এই দেশে আমরা এই দৃশ্য দেখার জন্যই যেন সদা প্রস্তুত! ঘৃণায়-লজ্জায়-দুঃখে কেবল আর্তনাদই করতে ইচ্ছা করেছে। কিন্তু সেটিও পারছি না। কে আমাদের কণ্ঠরোধ করে বসে আছে? খুনিরা? নাকি সিস্টেম?
একটি দেশের ‘রুল অব ল’ বা ‘আইনের শাসন’ প্রয়োগের মাত্রা দেখেই নাকি সেই দেশের উন্নতি বা অবনতির চেহারা দৃশ্যমান হয় কিছুটা। আমাদের দেশে কী তাহলে সেটি নেই? আছে বৈকি। নইলে আমরা যারা এই পেশায় আছি তারা কীভাবে টিকে আছি? দেশে আইন আছে, শাসনও আছে। কিন্তু আইনের শাসন আদৌ আছে কী?
একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মেনেই নিচ্ছি আইনের শাসন আছে। সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন, তাহলে এত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বিশ্বজিৎ নৃশংসভাবে খুন হলেন কীভাবে? কীভাবেই বা এই জমজমাট বইমেলায় অভিজিৎ খুন হলেন? যেখানে অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা অবিরত ঘুরেছে, সেখানে খুনিদের সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতারের কোনোই সুযোগ আছে কি? তাহলে এই নিরাপত্তা বলয়ের কী মানে বা কোথায় আইনের শাসন?
বিশ্বজিৎ বা অভিজিৎ কেবল নয়, দিন-রাত এই দেশ পাড়ি দিচ্ছে লাশের সংবাদের মধ্যে দিয়ে। কেউ হত্যা, কেউ বা আত্মহত্যা, কেউ খুন, কেউ বা জখম বা গুম। কারো বিদায় পেট্রল বোমায়, কেউ আবার কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুনের শিকার। এছাড়াও তো রয়েছে বাস পুড়িয়ে, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে বা লঞ্চডুবি, ট্রাক বা নসিমন-করিমনের ধাক্কায় মানুষের খুনের নমুনা যা ভয়াবহ ইংরেজি সিনেমা বা দুর্র্ধর্ষ হিন্দি সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে। বরং সিনেমার প্লট আর মগজ খুইয়ে কোনো লেখককে কষ্ট করে লিখতে হচ্ছে না। স্বাভাবিক জীবন যেখানে নেই, সেখানে স্বাভাবিক মরণ আশা করি কীভাবে?
এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। এর থেকে আমরা নিস্তার চাই, পরিত্রাণ চাই। আমরা আমাদের উন্নয়নের মাপকাঠি ফসল উৎপাদন বা রপ্তানি বাণিজ্যের মধ্যে আর রাখতে চাই না। আমরা চাই না আমাদের উন্নয়নের মাপকাঠি কোনো ভিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির মধ্যে দিয়েই পরিমাপ করা হোক। আমরা চাই আমাদের উন্নয়নের মাপকাঠি দেশে, সমাজে, সংসারে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় আছে কি না সেটি দেখতে। আমরা মানবিক গুণাবলীর প্রসারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চাই। মানুষ যেখানে নিশ্চিন্তে ঘরে থাকতে পারে না, জীবন ও জীবিকার তাগিদে নির্ভয়ে বাইরে বের হতে পারে না, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে গিয়ে মানুষ যখন সুদূর ভিন দেশ থেকে এসে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকে, আমরা সেই ছবি ফ্রেমে বন্দি করে ও শেয়ার করে পুলকিত হতে চাই না ।
আমরা বিচার চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা চাই। খুনিরা সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা পড়ে আইনের ফাঁক দিয়ে জামিন নিয়ে আবারো খুনের বন্যায় ভাসিয়ে দিক এটা চাই না। আজো আমরা অসংখ্য মানুষ হত্যার বিচার পাইনি। তবে পাব না এই দুরাশা আমি করি না। কারণ যখন দেশের কিছু কাঠামো ভেঙে পড়ে তখন মানুষ ঠিকই জেগে ওঠে।
মানুষ জাগছে। মানুষ জাগবেই। সেদিন মানুষ আর কারো নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। সে দিনটি কী খুব বেশি দূরে বা সে দিনটি কী একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য বা রাজনীতিবিদদের জন্য মঙ্গলবারতা বহন করে আনবে? পুলিশ প্রশাসন এ সব খুনিকে চিনে না? খুব কী অপরিচিত কেউ? খুনের হিসাবটা যদি কমিয়েও আনি ‘বিশ্বজিৎ টু অভিজিৎ’, তারপর কার পালা? কোন জিৎ? কার জিৎ? এভাবে নৃশংস খুনের পর আর কারো জিৎ থাকে কী?
লেখক : আইনজীবী ও মানিবাধিকারকর্মী