বিচারহীনতা এবং অভিশংসন দেশে-বিদেশে

‘যেকোনো একটি বিচারের প্রতি অবিচার মানেই প্রত্যেকটি বিচারের বিরুদ্ধে হুমকি ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের উক্তিটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিশংসন বিষয়ে লেখা। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি ত্রই বিচারের প্রতি আঘাতগুলো ১৬ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুশাসন কেড়ে নিলে একটি জাতির জন্য মৃত্যুই উত্তম।

প্রাণিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই আছে সর্বোচ্চ বুদ্ধি ও বিবেক প্রয়োগের সমতা। মানুষ মরে গেলেও সময় তাকে স্মরণ করে কর্ম দিয়ে। তবে আমরা হলাম কুকর্মের ওস্তাদ। প্রশ্ন উঠেছে, অভিশংসন আইনটির উদ্দেশ্য এবং প্রয়োগ নিয়ে। যুগে যুগে কিছু মনুষ্যরূপী দানবের কথা জানি, নিজেদের যারা সৃষ্টিকর্তার সমান বানিয়ে নিজেকে অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে, যখন নিজের এবং বাবা ও মায়ের নাম ভুলে যায়। এ দিক দিয়ে ইতিহাসের নিকৃষ্ট উদাহরণটির নাম জর্জটাউন গায়ানার জিম জোন্স, যে দানব শিষ্যদের বোঝাল ‘বেহেশতে যেতে চাইলে আমার সাথে বিষ খাও।’ ১ ঘণ্টায় ৯১০ জনের মৃত্যু হলে এটাই ‘জর্জটাউন গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ১৮০০ শতাব্দীর বিখ্যাত দার্শনিক হেগেল বলেছেন, ‘রাষ্ট্র গঠন শেষ হয়ে গেলে আর কোনো হিরোর প্রয়োজন নেই। কারণ এরপর এসে তারা অসভ্য আচরণে লিপ্ত হয়।’ পশ্চিমা দর্শনের পুরোধা, নোবেল লরিয়েট স্যার বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘আধুনিক বিশ্বের মৌলিক সমস্যা হলো, গর্দভেরা ওভার কনফিডেন্ট অ্যান্ড অ্যারোগেন্ট (অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ও উদ্ধত), আর বুদ্ধিজীবীরা ফুল অব ডাউট (সন্দেহে ভোগেন)।’ যে রাষ্ট্র দাউদ ইব্রাহিমতুল্য অপরাধীদের পাইকারি হারে মুক্তি দেয়, সে দেশের জন্য ১৬তম সংশোধনীর পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ! আইনের বদলে রাজত্ব করছে এক ব্যক্তির অ্যারোগেন্স আর ওভার কনফিডেন্স। এসব কোড ভাঙতেই উক্তি দুটোর প্রয়োজন।

প্রশ্ন উঠেছে ১৬তম সংশোধন নিয়ে। বিচারকেরাও মানুষ, তাই সর্বোচ্চ মতা প্রয়োগে তাদের কখনো কখনো ভুল হলেও পাইকারি হারে নয়। জর্জ বুশের নির্বাচনটি সিলেকশন না ইলেকশন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ১৪ বছর পরও সে বিতর্ক অব্যাহত। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় বিচার বিভাগের ব্যাপারে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব এতটাই বেশি যে, শুধু দেশবাসীই নয়, সারা বিশ্বই উদ্বিগ্ন; যাদের অন্যতম ‘বিশ্ব মানবাধিকার’ সংস্থা। র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু হয়ে লিমন তো সারা বিশ্বকেই জানিয়ে দিলো, এ দেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত দুদক দেখিয়েছে, দুর্নীতি শিখতে হলে সবার আগে সে অফিসে যেতে হবে। (দেখুন : প্রথম আলো, অক্টোবর ২৩, দায়মুক্তি পাচ্ছেন মতাসীনরা, ছাড় পাচ্ছে না বিরোধী দল, ১৫৯৮ জনের দায়মুক্তি মাত্র ৮ মাসে)। সংসদে এবং বাইরে, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ট্রাইব্যুনালকে প্রভাবিত করার মতো সরাসরি বক্তব্যগুলো এখন আর্কাইভে; আইন ভঙ্গের চরম দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও নীরব আদালত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলকে এই পর্যায়ে হেনস্তা করা সত্ত্বেও মিথ্যা মামলার বিচারকাজ নিয়ে বিব্রতবোধ না করার বিষয় নিরপেতা প্রশ্নবিদ্ধ। বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য না করার আইন সত্ত্বেও বারবার ট্রাইব্যুনালকে প্রভাবিত করার পরও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সীমালক্সঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া আদালতের সীমাবদ্ধতারই প্রমাণ। ডেভিড বার্গম্যান বনাম ইমরান সরকারের জন্য আইন দু’রকম হওয়ায় প্রমাণ হলো আইনের শাসনের মৃত্যু হয়েছে (ইমরান সরকারদের আন্দোলনেই সংসদে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসির ব্যবস্থা, যা সরাসরি সংবিধানের অবমাননা)। এসব দৃষ্টান্ত সামনে রেখে বলা যায়, বারবার সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্য অবশ্যই সুশাসনের জন্য নয়। ইতোমধ্যেই নিরপেতা, লবি, প-বিপ নিয়ে বহু প্রশ্ন। এমনকি আইন কমিশনার পর্যন্ত একই প্রশ্ন কেন তুললেন, জানি না। তবে পক্ষ বিপক্ষের প্রশ্নে বিভক্ত মাননীয় বিচারপতিরাও হয়তো কঠিন সময় পার করছেন। তারেকের পক্ষে রায় দিলে পালিয়ে বাঁচতে হলো বিচারককে, শোনা যাচ্ছে তিনি কানাডায়। এই পরিস্থিতিতে সংবিধানের যেকোনো সংশোধনীই উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করা যায় না কি?

উন্নতির প্রথম শর্ত সুশাসন। সুশাসন ছাড়া ২৫ শতাংশ জিডিপিও ধসে পড়বে। একমাত্র সুশাসনের অভাবেই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সোমালিয়ার অবস্থার কথা সবাই জানে। এখানে এসেই উন্নত বিশ্বের সুশাসনের কাছে ধরাশায়ী অনুন্নত বিশ্বের দুঃশাসন। এমনকি অতীতে স্বৈরশাসকেরাও সুশাসন দেখিয়েছেন। ‘৬৮এর স্বৈরশাসক আইনের শাসন না দেখালে রাতারাতি কার ফাঁসি হয়ে যেত জানি না বললে চলবে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যে সত্য ঘটনা ভিত্তিক, পরবর্তীকালে বইপত্রের মাধ্যমে নিজেরাই স্বীকার করেছেন। বলছি, বৈধতার প্রশ্নে যারা নিজেরাই জনতার কাঠগড়ায়, তাদের হাতে অভিশংসনের মতা! ৩২৭-০ ভোটে যে দেশে আইন পাস হয়, সে দেশ সুশাসনের যোগ্য বলা যায় না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবৈধ হওয়ায় শুধু সংসদ কেন, প্রতিটি পাসপোর্ট ইস্যু থেকে শুরু করে রায়ৃ ভবিষ্যতে সরকার বদল হলে সব কর্মকা-ই অবৈধ বলে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। সুতরাং যেকোনো ফাঁকফোকর বন্ধ করতে আইন নিয়ে টানাহেঁচড়া।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্তে বারবারই প্রমাণিত হচ্ছে, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাজার হাজার দাউদ ইব্রাহিমতুল্য ব্যক্তি, যাদের একাংশ সংসদে আইন পাস করার দায়িত্বে। যখন ৩২৭-০ ভোটে আইন পাস করা হয়, কিভাবে বিশ্বাস করি আইন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা আছে! সরকার বৈধ হলে এমন হতো না। পাবলিকের রাস্তা দখলে রাখা এত পুলিশ, এত বন্দুক, এত জলকামান ইত্যাদি ‘৭১-এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এ দিকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৩৪ হাজারের অধিক মিথ্যা মামলার স্তূপে ভেঙেচুড়ে পড়ছে সংশ্লিষ্ট দফতরের শৃক্সখলা (দেখুন : দ্য রিপোর্ট.কম, ২১ অক্টোবর, মামলার বেড়াজালে বিএনপি)। পাবলিকের অনেক মামলাই ১০০ বছরেও শেষ হবে না। এসব দৃষ্টান্ত সামনে হিরোবেশী দানবেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রশাসনের সর্বত্রই। ত্বকীর ও সাত মার্ডারের তদন্ত শেষ হলেও রিপোর্ট দাখিলের অনুমতি না পাওয়ার একমাত্র কারণ অপরাধের সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততা, যার অন্তরালে নির্বাহী বিভাগের বহু তথ্য-প্রমাণ মিডিয়ায়। বিডিআর হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে সাত মার্ডার; নাটের গুরু ওই কর্নেলকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখে দেশজুড়ে কারা এত খুনখারাবি চালাচ্ছে সবাই জানে। ওই কর্নেল এবং তার বাহিনীর মাধ্যমে আইনহীনতা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে বলে প্রমাণ সর্বত্রই। একই সন্দেহ সাগর-রুনির বেলায়। ৭ মার্ডারের ঘটনায় যা দেখলাম, আইনের দেশ হলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি করা নিক্সনের মতো সরকারের বহু আগেই বিদায় নিতে হতো। ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটি আমার’। সংবিধানের কামান হাতে অবৈধ সরকার এখন আর পৈতা নিয়ে ভাবছে না বরং উন্নতির ট্রেন নিয়ে মহাব্যস্ত। আমরা জানি, ইঞ্জিন এবং বগি দুটোই অগ্রহণীয়। আইনভঙ্গের জন্য আইন বানানোই যখন নিয়ম, তখন বিশ্ববিখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা জর্জ বার্নাড শ’র উক্তিটি লণীয়, ‘নির্বোধেরা বলে, হে পৃথিবী আমার কাছে শেখো, বুদ্ধিমানেরা পৃথিবীর কাছে শিখতে যায়। কখনো কখনো পৃথিবী একজন বুদ্ধিহীনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে।’

“প্রেসিডেন্ট ওবামার অভিশংসন হবে কি না, মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর এই সম্ভাবনা আবারো মাথাচাড়া দিলো। রিপাবলিকান স্পিকার ওবামাকে হুঁশিয়ারি দিলেন, আমাদের এড়িয়ে আগুন নিয়ে খেলবেন না, তাহলে নিজেরাই পুড়ে যাবেন। এক্সিকিউটিভ মতার অপব্যবহার করবেন না, আমাদের বাদ দিয়ে ইমিগ্রেশন আইনে সই করা যাবে না। আইন যদি পরিবর্তন করতেও না পারি, এমন অবস্থা করব যেন ‘ওবামাকেয়ার’ মূল্যহীন হয়ে যায়।” বলছি, এ ধরনের উদাহরণ যে দিন স্থাপন করবে দলগুলো, একমাত্র তখনই রাজনীতির অভিশাপমুক্ত হবে বাংলাদেশ। অভিশংসন বুঝি, তবে প্রশ্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। ৩৮ বছর পর হঠাৎ এমন কী হলো যে, অভিশংসনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিকে সার্বিক যোগ্য ব্যক্তিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিতে হলো, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার ন্যূনতম মতাও যাদের নেই! এই একটি আইনই সুশাসন ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। সুপ্রিম জুডিশিয়ারি কাউন্সিলের সাথে ব্যবসায়ীদের ভারে জর্জরিত সংসদের তুলনা থাকলে, পরাজয় মানি, কিন্তু বাস্তব কী বলে? (দেখুন : টিআইবি রিপোর্ট নবম পার্লামেন্ট, কিভাবে রাজত্ব করছে নব্য দাউদ ইব্রাহিমতুল্য ব্যক্তিরা, একুশের চোখ ৩০ অক্টোবর; সংসদ সদস্য চাঁদপুর-২ এর কা-)। টিআইবি রিপোর্ট, ৯৭ শতাংশ আইনপ্রণেতাই অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত। মানুষ বলছে, দশম সংসদের নাম ৫% সরকার, প্রহসনের সরকার। সব দোষ কেন কার্টুনিস্টদের? আসলে দশম সংসদের ১৫৪ জনের একজনও একটি ভোটেও নির্বাচিত না হওয়ায় কার্টুনিস্টরাই সঠিক এবং সরকার ভুল। কার্টুন অ্যাক্টিভিজমের বিরুদ্ধে অবিচার বন্ধ করে অধিকার সুরা করতে হবে। বরং চাইলে কার্টুন দেখে সংশোধনের পথে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তা না করে, গৃহপালিত সাংবাদিকদের কণ্ঠে বন্দুকের পর এবার দৃষ্টি আদালতের দিকে। এই বাস্তবতায়, কেউ যদি আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে এনে আমার হাতে দিয়ে বিশ্বাস করতে বলে, তার পরেও সারা বিশ্ব অবৈধ সরকারকে বৈধ বললে, আমি বিপরীতটা বলব। তেমনি বুদ্ধিবিবেক ব্যবহার করে বলব, ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্য মোটেও গণতন্ত্র রা নয়, বরং বিদায় করা। যদি কেউ ওই দিনের প্রেস কনফারেন্সের ভিডিও ফুটেজটি ল করেন, সরকারপ্রধানের বডি ল্যাংগুয়েজ, বলার ধরন, অস্থিরতা, তাড়াহুড়ো, চোখের ভাষা, সর্বোপরি কথার মধ্যে অসংলগ্নতা, যেন আকাশ থেকে পড়ার মতো আচমকা। যেন তিনি নিজেও জানেন না কিংবা বিব্রত হতে বাধ্য হচ্ছেন। নেপোলিয়ানের ভাষায়, ‘তখনই দুর্যোগ নামে, যখন বুদ্ধিমানেরা ঘর অন্ধকার করে লুকিয়ে থাকে।’ স্পষ্ট মনে আছে, উল্লিখিত প্রেস কনফারেন্সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের ঘোষণাটির গর্জন বর্ষণ এবং ব্যাখ্যা, জুরিপ্র“ডেন্সের ভাষায় অবশ্যই অস্বাভাবিক। আগামীর সংসদ দখলের পাকাপোক্ত বন্দোবস্তের নীলনকশার ইঙ্গিত ২০১৩ সালে প্রথম দিয়েছিলেন তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা। তারও আগে সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ১৫তম সংশোধনী তৈরির নেপথ্য কারসাজি নিয়ে কতটুকু আলোচনা করেন বিশ্লেষকেরা? অনেকেই সত্য ধামাচাপা দিতে টকশোতে আসেন। মধ্যরাত হলেই কারো কারো শূন্য কলস প্রচ- শব্দে বেজে ওঠে, মানুষ তখন আরো বেশি বিভ্রান্ত হতে পারে। সরকারের অনুগত বিশ্লেষকদের কাজ একটাই, পারলে ২৪ ঘণ্টাই জিয়া পরিবারের লেজে আগুন দেয়া। বাস্তবতা এই, নিন্দিত, সমালোচিত জনাব হক নাকি প্রধান আইন কমিশনার। এসব দৃষ্টান্তের ভবিষ্যৎ কী? প্রথমে সিমেন্ট দিয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এরপর ক্রমেই মতার বহুতল ভবনটি নির্মাণ করে ২০৪১ সাল পেরিয়ে গণতন্ত্রের বাতাসটুকুও ঢুকতে না দেয়ার পাকা বন্দোবস্ত। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা যতই যুক্তি দিন, সে দিনের প্রেস কনফারেন্স থেকে অনেকের উপলব্ধি খুব খারাপ। বলছি, নিজেদের প্রয়োজনে আইন সৃষ্টি করে, আইন ভঙ্গের সাথে অভিশংসনের প্রয়োজনীয়তার যোগসূত্র এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। রিট পিটিশনকারীদের দাবির মুখে উন্নত বিশ্বে আদালত এগিয়ে এসে হস্েেতপর দৃষ্টান্ত বহু। বাংলাদেশের বেলায় সরকারের বিপে গেলেই তাৎণিক রিট খারিজের দৃষ্টান্তগুলো আদালতের সীমাবদ্ধতার প্রমাণ এবং এখানেই আমাদের আপত্তি। সরকারের কর্মকা-ে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, সংশোধনীগুলোর উদ্দেশ্য খুব খারাপ না হলে ৫ জানুয়ারি অন্তত এই দেশের মাটিতে কখনোই ঘটত না কিংবা ঘটলেও এক মাসের বেশি টিকত না, যেমন টেকেনি খালেদার বেলায়। সরকার নিজেই প্রমাণ করল, তারা এতটাই বেপরোয়া ও অস্বাভাবিক যে, বারবার সংশোধনী আসবে।

তথ্য ও প্রমাণ সত্ত্বেও দুর্নীতির প্রশ্ন তোলামাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে সরকার। নিজেদের ফেরেশতা প্রমাণে উন্নত দেশের উদাহরণ বারবারই দেন। অভিশংসন বিষয়ে আমরাও দেবো। প্রমাণ করব, ১৬তম সংশোধনী কেন অবৈধ। ১৭৯৭-২০১৩, অভিশংসনের দীর্ঘ ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে অভিযোগ গঠন করে শুনানি হয় কংগ্রেসে, মেজরিটি ভোটে অভিযোগটি পাস হলেই যায় সিনেটে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট ছাড়া কাউকেই অভিশংসন করা যায় না এবং এই দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের বিষয়টিই সবচেয়ে জটিল। এখানে এন্ড্রু জনসন এবং বিল কিনটনের অভিশংসন তুলে ধরব (বিস্তারিত পড়ার সুযোগ ইন্টারনেটে)। কট্টর রিপাবলিকান এন্ড্রু জনসনের বেলায় মাত্র একটি ভোটের জন্য খালাস, অর্থাৎ একজন হলেও দলের বিরুদ্ধে দ্বিমত পোষণের উদাহরণ। বিল কিনটনের অভিশংসনটি আমাদের জন্য শিকের কাজ করবে। এই নজির দেখানোর মুরোদ আমাদের সংসদগুলোর কখনোই হয়নি বলেই অভিশংসন হতে পারে অভিশাপ, যার উদাহরণ কিছুটা দিয়েছি। অনেকেই মনে করত, নারীজনিত বিষয়টি পুঁজি করে এটি রিপাবলিকানদের রাজনৈতিক হয়রানি। অভিশংসনের শুনানিতে বিল কিনটনের উচ্চারিত লাইনটি বারবার মিডিয়ায় আসে, ‘না, আমি ওই মহিলার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করিনি।’ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, মনিকা লিউনস্কির রজঃস্রাবের রক্তে চুরুট ভিজিয়ে তিনি সেই চুরুটটি উপভোগ করেছিলেন (কিনটনও মানুষ, মধ্যবয়সের সঙ্কট হতেই পারে)। হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটিতে ১১টি অভিযোগের মধ্যে চারটি বিচারযোগ্য অপরাধ পাস হলে অভিযোগটি গেল সিনেটে, কিন্তু সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পাওয়ায় ‘৯৯ সালের ১২ জানুয়ারি খালাস। যা বলতে চাইছি, ৫৫-৪৫ ভোটের ১০টি ভোট রিপালিকানদের, যা হওয়ার কথা নয়। কারণ মামলাটি ছিল বিরোধী দলেরই। ১০টির মধ্যে ছয়টি বিরোধীদলীয় ভোটের কারণেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের গদি হারানো থেকে বেঁচে গেলেন কিনটন। মাননীয় বিচারপতিগণ! এই দৃষ্টান্ত আমরা রাখতে পারলে অভিশংসনে আপত্তি নেই; কিন্তু যে সংসদ সদস্যদের পার্টিলাইনের বাইরে ভোট দেয়ার সব মতাই কেড়ে নেয়া হয়েছে, তাদের হাতে অভিশংসনের মতা গেলে অপব্যবহারের মাত্রা কী হতে পারে, না বলাই ভালো। এমনিতেই জোট সরকারের দফারফা করেছে আওয়ামী লীগ, বাকি শুধু দাফন-কাফন। সংসদ নয়, যেন রাজনৈতিক মাদরাসার এতিম। পার্টিগুলোর গঠনতন্ত্রও লেনিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে মারাত্মক। বরং উত্তর কোরিয়া বললেই ভালো (এরা নাটক দেখার অপরাধে ফাঁসি দেয়, আমরা কার্টুন আঁকার অপরাধে কারাগারে দেই)। গঠনতন্ত্রের বাই-ল’গুলো দিয়ে সংসদকে এমন করা হয়েছে, যখন তুলনামূলকভাবে ১৯৬৫-এর পার্লামেন্টকেও অধিক গণতান্ত্রিক মনে হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ সরকার অবৈধ বলেই ১৬তম সংশোধনীর মতো বিষয়ও এক শ’ ভাগ ভোটে সংসদে পাস হয়ে যায়। 

কিনটনের অভিশংসনের সাথে আরেকটি উদাহরণ। রয়টার ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে লিখেছে, ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট সিনেটরকে ভোটারকে প্রতারণার অভিযোগে জেলে পাঠিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেস কোর্ট। তার অপরাধ, ইচ্ছা করে ভুল ঠিকানা দেয়া। বিচারক কেনেডি এমনকি তার সুপ্রিম কোর্টে আপিলের সুযোগ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, শুধু তার দলই মতায় নয়, এমনকি গোটা ক্যালিফোর্নিয়াই ডেমোক্র্যাটদের দখলে। তারপরও জেল? বিচারপতিগণ! ইয়াবাসম্রাট বদিকে জামিন দেয়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করল, এই রাষ্ট্র এখন মহাসঙ্কটে। এসব দৃষ্টান্ত বিচারপতিদের নিজস্ব বলে মনে হওয়ার সুযোগ কম। কিনটনের অভিশংসনে ৫৫-৪৫ ভোট, এখানেই সব প্রশ্নের উত্তর নিহিত। আমাদের পার্লামেন্টে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেয়ার মতো দুটো মাথা কার ঘাড়ে? বরং এরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মালিক, অর্থাৎ অভিশংসন হলে বদি আর শামীম ওসমানদের মতো লোকেরাই বিচারকদের বিচার করবেন। এবার যাই কোথায়!
 
অভিশংসনের মতা পেতে হলে ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে। যারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব ছিনিয়ে নিতে আদাজল খেয়ে লেগেছে, সংসদে তাদের মধ্যে রাজাকারের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। লুঙ্গি আর কান ধরে গদি থেকে টেনে নামানো হয়েছিল যাদের, এরশাদের সেই দল এখন মহাজোটের প্রধান শরিক এবং বিরোধী দল দুটোই। বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে লটকিয়ে রাজাকারও এখন অন্য রাজাকারদের বিচার চায়। এসব খতিয়ান হাতে, হাউজ জুডিশিয়ারির কাছে বিনীত প্রশ্ন, যে সরকার কার্যত অবৈধ এবং তাই নিজেরাই অভিশংসনযোগ্য, তাদের হাতে কেন অভিশংসনের মতা! রাষ্ট্র চালানোর অধিকার দশম সংসদকে দেয়নি ভোটাররা। মাননীয় বিচারপতিগণ! কুশাসনের দুর্গন্ধে ছেয়ে গেছে দেশ। আর এই বাস্তবতায় বাকশালের সরব প্রত্যাবর্তনকে সানন্দে গ্রহণ করার অর্থ, জাতির বুদ্ধিজগতে বোমা পড়েছে। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলির দৃষ্টান্ত ক’টা দেবো। স্কাইপ কেলেঙ্কারির কথা কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বরং নিক্সনের ওয়াটারগেটের মতো অভিশংসন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু না হওয়ার মূলে আবারো আঙুল নির্বাহী বিভাগের দিকেই। বিচারক নিজামুল হক আর জিয়াউদ্দিনের ফাঁস হয়ে যাওয়া কথোপকথন ‘সরকার গেছে পাগল হইয়া; তারা একটা রায় চায়’ এই একটি উক্তিই প্রমাণ করল আসলে ঘটনা কী। সাঈদীর রায় লেখা নিয়ে আট হাজার মাইল দূরত্বে স্কাইপের মাধ্যমে প্রবাসী পাবলিক এবং ট্রাইব্যুনাল নিয়োজিত বিচারকের মধ্যে ওই কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালেরই গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এক সপ্তাহে তিনটি মৃত্যুদ- ঘোষণাকে ‘ফাঁসির উৎসব’ বলে চিহ্নিত করেছে কেউ কেউ। একটি রায় নিয়ে রাষ্ট্রপরে খামখেয়ালি বক্তব্যে রায়ের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি। বক্তব্যগুলো সারা বিশ্বের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছে। অন্তত আইনের দেশে থেকে অবাক না হয়ে পারছি না। বলছি, ফাঁসিতে ঝোলানো নিয়ে রাষ্ট্রপরে তাড়াহুড়ো অনভিপ্রেত। এতে তারাই বিতর্কিত হচ্ছে। ফাঁসির আসামি তো অনেক; কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষকে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা মাত্রই ঝোলাতে হবে, এর পেছনে আইন না ব্যক্তি বড়, সন্দেহ অনেকেরই। কাদের মোল্লার বেলায় জেলকোড মানা হয়নি, বরং নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছিল। পাবলিকের শঙ্কিত হওয়ার কারণ বহু। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ মৃত্যুদন্ডই পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বচ্ছতা নিয়ে যেভাবে প্রশ্নের তীর ছুটে আসছে, সেই পরিপেক্ষিতে রয়েসয়ে চলাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। নানা মুনির নানা মতে সন্দেহ হচ্ছে, মৃত্যুদ-কে বিতর্কিত করা ছাড়া কাজ নেই। শ্রদ্ধেয় আইনমন্ত্রীর মুখ থেকে এহেন বক্তব্যগুলো সুশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থানের মতো লেগেছে। স্কাইপ টেক্স আমার নখদর্পণে। এই কথোপকথন আমলে নিলে অন্তত আইনের দৃষ্টিতে যেকোনো রায় ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। অন্যায়ভাবে কার্যকর হলে যেকোনো মৃত্যুদ- হত্যা বলে গণ্য হতে পারে। আইন তো কারো ক্রীতদাস নয়; ৪০ বছর পর মুজিব হত্যার বিচার হয়েছে। অপর দিকে, ১৬ ডিসেম্বরের আগে বারবার রায় কার্যকর করার ঘোষণা একজন মূর্খকেও ভাবতে বাধ্য করবে। তারেক রহমানকে নির্দোষ বলায় সংশ্লিষ্ট বিচারককে কি দেশ থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে হয়নি? সুখরঞ্জন বালির ঘটনা সারা দুনিয়া জানে। রেকর্ডসংখ্যক ফাঁসির আসামিকে মা করে দিয়ে নিজেই রেকর্ড হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। ধর্মদ্রোহী লতিফ সিদ্দিকীর বেলায় সব রকমের দুঃশাসন নিশ্চিত করল রাষ্ট্র! বদির জামিন এবং তার সংসদ সদস্য পদ বহাল, এসব উদাহরণ সামনে রেখে ১৬তম সংশোধনী হতে পারে একনায়কত্ব কায়েমে এগিয়ে এসে কাউকে লালগালিচা বিছিয়ে দেয়া, যা কোনো ভালো নজির নয়। স্কাইপ কেলেঙ্কারিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা ঠিক হবে না। ব্যক্তিবিশেষের বেলায় আইন দু’রকম হলে নিক্সনের ওয়াটারগেট মামলা ফালতু বলে গণ্য হতো। কখনো যুদ্ধাপরাধীদের প নিইনি, বরং সুবিচার দেখতে চেয়েছি। বিচার শুধু স্বচ্ছই নয়, এক শ’ ভাগ সন্দেহাতীত হতে হবে এবং যত দিন না হবে, তত দিন পর্যন্ত অপোর বিকল্প নেই। ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত হওয়া কারোই কাম্য নয়। বহু আগেই ব্যক্তিগত প্রতিশোধের স্পৃহার বিরুদ্ধে লিখেছি।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *