বাড়াবাড়ি ও কাড়াকাড়ির নির্বাচন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫ জানুয়ারি ২০১৪। জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্ট নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য নির্ধারিত হলেও, বাস্তবে এই মুহূর্তের পার্লামেন্ট নির্বাচিত, আধা-নির্বাচিত, অনির্বাচিত এবং মনোনীত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। ঐ সকল মাননীয় সংসদ সদস্যগণকে নির্বাচিত বলা যাবে যারা নিজ নিজ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে তথা নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হয়ে শেরে বাংলা নগরে এসেছেন। আধা-নির্বাচিত বলা যাবে ঐ সকল মাননীয় সংসদ সদস্যগণকে যারা নিজ নিজ আসনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু বিবিধ প্রকারের শক্তি প্রয়োগ করতঃ নির্বাচনী ফলাফলকে নিজের অনুকূলে এনে, ঐ ফলাফলের উসিলায় শেরেবাংলা নগরে এসেছেন। মনোনীত বা আধা নর্বাচিত বলা যাবে ওই সকল মাননীয় সংসদ সদস্যগণকে যারা নিজ নিজ আসনে কোনো প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হননি, বরং স্রোতের অনুকূলে ভাসিয়ে দিলে (বৈঠা ব্যবহার না করেই) নৌকা যেমন তরতর করে এগিয়ে যায়, তেমনিভাবে এই সকল ব্যক্তি রাজনৈতিক রাস্তা অতিক্রম করে, শেরেবাংলা নগরে পৌঁছেছেন। এছাড়াও, মনোনীত ও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বা আধা-নির্বাচিত হচ্ছেন ৫০ জন মহিলা সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়ায় একটি আনুষ্ঠানিক দিক আছে এবং একটি অনানুষ্ঠানিক দিক আছে। অপর ভাষায়, পর্দার সামনে আলোতে একটি দৃশ্য আছে আবার পর্দার পেছনে অন্ধকারে একটি দৃশ্য আছে। পর্দার সামনের দৃশ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে মনোনয়নপত্র ক্রয় করা, রাজনৈতিক দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সামনে উপস্থিত হয়ে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়া এবং সেই পরীক্ষায় পাস করা।
পর্দার পেছনের দৃশ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতাকে বা একাধিক নেত্রী ও নেতাকে অনির্দিষ্ট একটি অংকের টাকা উপহার দেওয়া, বিদেশ থেকে বাংলাদেশি বা বিদেশি কাউকে দিয়ে সুপারিশ করানো অথবা বাংলাদেশের ভেতরে কোনো বিদেশী দূতাবাস থেকে সুপারিশ করানো অথবা দেশের ভেতরে থেকেই এক বা একাধিক ধনী ব্যক্তিদেরকে দিয়ে সুপারিশ করানো। এখানে পরিচিত শব্দ হলো ইংরেজিতে বার্গেইনিং বাংলায় বাড়-বাড়ন্ত বা বাড়াবাড়ি। যে যত বেশি অংকের টাকা উপহার দিতে পারবেন বা যে যত বেশি সুপারিশ আনাতে পারবেন তার তত বেশি সুবিধা এবং সম্ভাবনা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার। তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল বাড়াবাড়ির নির্বাচন। আরও একটি কারণে, ৫ জানুয়ারির নির্র্বাচনকে বাড়াবাড়ির নির্বাচন বলছি। কথ্য বাংলায় বা সামাজিকভাবে বহুল পরিচিত বাংলা ভাষায়, বাড়াবাড়ি করা মানে হচ্ছে, নিষেধ করা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি কর্তৃক একটি কাজ করা। অথবা কাজ করতে গিয়ে যতটুকু করা প্রয়োজন তার থেকে নেতিবাচকভাবে বেশি করা। সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ব্যতিত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করার জন্য তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন করেছে ও আওয়ামী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করেছে এবং আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে-এটা বাড়াবাড়ি। আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্তের প্রতি ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যক্ষ এবং শতভাগ সমর্থন দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থনের সাথে সাথে রাশিয়া সরকার এই নির্বাচনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। ভারত এবং রাশিয়া ব্যতীত, পৃথিবীর আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরুত্বপূর্ণ দেশ, সার্কভুক্ত দেশ বা কমনওয়েলথভুক্ত দেশ বা ওআইসিভুক্ত দেশ বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ বা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ, এমনকি আমেরিকা বা বৃটেন নিজেরাও এই নির্বাচনের প্রতি সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থাকে। বহিঃবিশ্বের রাজনৈতিক সমর্থন দুইভাবে বিভক্ত ছিল। একদিকে, ভারত ও রাশিয়া এবং অপরদিকে বাকি বিশ্ব। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার যেহেতু সমগ্র বিশ্বকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত ও রাশিয়ার সমর্থনের ওপর নির্ভর করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করেই ফেলল, সেহেতু এটাকে অবশ্যই বলতে হবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি, ভারতের পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি। তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবশ্যই বাড়াবাড়ি’র নির্বাচন। সীমা লংঘনের নির্বাচন।
৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনকালে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। ঐ সকল আসনের আওয়ামী লীগ বা তার মিত্র দলীয় প্রার্থীগণ বিনা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, সংসদ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। অপরপক্ষে আরপিও নামক বিধিমালায় একটি ধারা আছে যেখানে বলা আছে যে, কোনো আসনে শুধুমাত্র একজন প্রার্থী থাকে এবং তার প্রার্থীতা বৈধ হয়ে থাকে অথবা অপর ভাষায় প্রার্থীদের বৈধতা যাচাইয়ের পর যদি মাত্র একজন প্রার্থী বৈধ পাওয়া যায়, তাহলে রিটার্নিং অফিসার সেই একমাত্র বৈধ প্রার্থীকে বিজয়ী বা নির্বাচিত ঘোষণা করতে পারে। এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। এখন থেকে ৭ বছর আগে এই প্রশ্নটির সমাধান সন্ধান করা হয়েছিল বাংলাদেশের তৎকালীন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক। কারণ, সংবিধানের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে, অপরদিকে কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী যদি না থাকে, সে সময় ইতিবাচকভাবে কী করণীয় তারও রাস্তা বের করতে হবে। এখন থেকে ৭ বছর আগে তৎকালীন নির্র্বাচন কমিশন ‘না’ ভোটের বিধান করেছিলেন। অর্থাৎ যে কোনো আসনে নির্বাচনের সময়ে, ঐ আসনের জন্য যে ব্যালট পেপার মুদ্রিত হবে, সেই ব্যালট পেপারে সকল প্রার্থীর মার্কার শেষে, আরেকটি মার্কা মুদ্রিত করা হয়েছিল। ঐ মার্কাটি ছিল বাংলা অক্ষর ‘না’। অর্থাৎ কোনো প্রার্থীকেই যদি ভোটারের পছন্দ না হতো তাহলে সেই ভোটার ‘না’ মার্কায় ভোট দিয়ে তার পছন্দের কথা জানাতে পারতেন। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচনের বেশ কিছুদিন পূর্বে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই ‘না’ ভোটের বিধান অবলুপ্ত করে দেয়। যদি অবলুপ্ত না হতো, তাহলে আলোচ্য ১৫৩টি আসনে ব্যালট পেপার মুদ্রণের সময় দুই মার্কা মুদ্রিত হতো। একটি মার্কা হতো ঐ প্রার্র্থীর মার্কা যথা নৌকা বা নাঙ্গল এবং আরেকটি মার্কা হতো বাংলা অক্ষর ‘না’। যদি ‘না’ ভোটের বিধান অবলুপ্ত না হতো, তাহলে ৫ জানুয়ারি ঐ ১৫৩টি আসনেও ভোট গ্রহণ করতেই হতো। ভোটারগণ ভোট কেন্দ্রে এসে হয় মার্কায় ভোট দিয়ে সমর্থন দিতেন অথবা ‘না’ মার্কায় ভোট দিয়ে সমর্থন দিতেন না। আমার মূল্যায়নে এই ব্যবস্থায়, ৫ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনে, ১৫৩টি আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনেই, ভোটারগণ ‘না’ ভোটে ভোট দিত বেশি। যেহেতু তৎকালীন আওয়ামী সরকারের প্ররোচনায়, আওয়ামী লীগের প্রতি আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, ‘না’ ভোটের বিধান বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন, সেহেতু ১৫৩টি আসনে একমাত্র প্রার্থীগণের প্রতি ভোটারগণের সমর্থন আছে কিনা সেটা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কোনো একটি নির্বাচনী আসনে একজনের বেশি প্রার্থী না পাওয়া এক জিনিস এবং ঐ একমাত্র প্রার্থীর প্রতি সমর্থন আছে কি নেই সেটা বিচার করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনগণকে ধোঁকা দেয়। তাই আমি ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনকে বাড়াবাড়ির নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করছি।
৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে, আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বের সামনে এবং দেশবাসীর সামনে যে বাস্তবতাটি উপস্থাপন করেছিলেন সেটাকে নির্লজ্জ, কলঙ্কজনক, প্রতারণামূলক, হায়া-বিহীন বলা যায়। এইরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য, আওয়ামী লীগের সামনে একটি সুযোগ এসেছিল। সেই সুযোগটি হলো, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া উপজেলা নির্বাচন। ঐ নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে মোটামুটিভাবে মোটামুটিভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এর কারণ এই নয় যে, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীগণ কম সংখ্যক জিতেছেন, বিএনপির তুলনায়। বরং গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হওয়ার কারণ এই যে, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ভোটারগণ খুশি মনে ভোট দিতে পেরেছেন, ভোট জালিয়াতি অতি-কম হয়েছে, বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি অতি-কম হয়েছে এবং ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা অবলম্বন করা হয়েছিল। উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপ থেকে শুরু হয় নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক কর্মকা-। এইরূপ আক্রমণাত্মক ঘৃন্য কর্মকা-ের মাত্রা তৃতীয় ধাপের তুলনায় চতুর্থ ধাপে বেশি ছিল এবং পঞ্চম ধাপে সবচেয়ে বেশি ছিল। আমার এই মন্তব্যগুলো, মিডিয়াতে প্রকাশিত তথ্য নির্ভর। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে কাড়াকাড়ি শব্দটি ছিল বহুল প্রচলিত। প্রার্থীগণ ভোটারগণের মধ্যে নতুন নতুন টাকার নোট ছড়াচ্ছেন এবং সেই টাকার নোট পাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি ছিল লক্ষণীয়। সরকারদলীয় প্রার্থীগণ, ভোট কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের নিকট থেকে ব্যালট পেপারের বান্ডেল কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, প্রিসাইডিং অফিসার বা সরকারি লোকজন দিতে চাচ্ছেন না, এই দৃশ্যের নাম হচ্ছে ব্যালট পেপারের কাড়াকাড়ি। সরকারদলীয় লোকগণ, ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্স ছিনতাই করে বা জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন এবং বিরোধী প্রার্থীর লোকেরা না দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, এটা হচ্ছে বাক্সের কাড়াকাড়ি। প্রচুর আসনে “সেইমসাইড” হয়েছে যথা বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অথবা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আরও একজন আওয়ামী লীগারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন যিনি বিদ্রোহী প্রার্থী, ইত্যাদি। এটা হচ্ছে উপজেলার চেয়ারের জন্য কাড়াকাড়ি।
আগেই বলেছি, উপজেলা নির্বাচনের ৫টি ধাপের মধ্যে, প্রথম দুইটি ধাপ তুলনামূলকভাবে ও উল্লেখযোগ্যভাবে স্বচ্ছ ছিল। সেই সকল স্বচ্ছ উপজেলাগুলোর নির্বাচিত চেয়ারম্যান, পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানবৃন্দকে আমি মোবারকবাদ জানাচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম ধাপে নির্বাচিত হয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার তিনজন। সকল বিজয়ীদের প্রতীক স্বরূপ আমি, হাটহাজারী উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চৌধুরী (বিএনপি), পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির (ইসলামী ঐক্যজোট) এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মনোয়ারা বেগম (জামায়াতে ইসলামী)-কে অভিনন্দন জানাচ্ছি। সেই প্রথম ধাপের পর থেকে নিয়ে দু’একদিন আগে পর্যন্ত, বহু সংখ্যক নব নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছি। এদের মধ্যে কোনো কোনো উপজেলা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের স্বচ্ছতায় উত্তীর্ণ আবার কোনো কোনো উপজেলা কাড়াকাড়ির কলঙ্কে জর্জরিত। সকল না বললেও, প্রায় সকল নির্বাচিত ব্যক্তিই কয়েকটি বিষয়ে তাদের প্রায় একইরকম বক্তব্য দিয়েছেন।
উপজেলা পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রচলিত বা প্রবর্তিত হয়েছিল বিগত আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেই সময় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, সামরিক শাসক হতে রূপান্তরিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। প্রেসিডেন্ট এরশাদের অন্যতম একটি ভালো উদ্যোগ ছিল উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করা। সেই সময়, প্রেসিডেন্ট এরশাদ এমন দুইটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা রাজনৈতিক রাস্তা চালু করেন যেগুলো ছিল সাংঘর্ষিক। টাকা-পয়সার উৎস যেখান থেকেই হোক না কেন, অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেই ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ৩০০টি আসনে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। আবার এরশাদ সরকারের আমলেই উপজেলা পদ্ধতি চালু হওয়া মাত্রই, প্রত্যেক উপজেলাতেই একাধিক প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখনকার আমলে ভাইস-চেয়ারম্যান পদ ছিল না। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারাও কমবেশি প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করেছিলেন নির্বাচনী কাজে। সব নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেখা গেল যে, সংসদ সদস্যগণের কাজের একটা অংশ উপজেলা চেয়ারম্যানগণের কাজের বৃহৎ অংশের সাথে ‘ওভারল্যাপ’ করে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার পদ্ধতিতে নি¤œতর স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। এর পরের স্তরকে প্রাণ দিয়েছেন বা দিয়েছিলেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। প্রথমত, থানাগুলোকে শুধুমাত্র আইন শৃংখলার ইউনিট হিসেবে পরিচিত করে, প্রশাসনিক পরিচয়ের জন্য উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন এরশাদ সাহেব। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সকল ইউনিয়নের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছিল (এবং এখনও গঠিত আছে) উপজেলা পরিষদ। জাতীয় পর্যায়ে উপজেলা পরিষদের বা উপজেলা চেয়ারম্যানের কোনো কাজ নেই। তাদের দায়িত্বের নিরানব্বই ভাগই নিজস্ব উপজেলা সীমার ভেতরে। অপরপক্ষে একজন সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকা, হুবহু একটি উপজেলার সাথে মিলেও যেতে পারে, আবার একটি উপজেলার অতিরিক্ত অন্য একটি উপজেলার কিছু অংশ বা পূর্ণ অংশকে ধারণ করতে পারে। সংসদ সদস্যের কাজ অর্ধেকের বেশি জাতীয় পর্যায়ে, অর্ধেকের কম নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায়। কিন্তু সেই এরশাদ-আমল থেকেই, উপজেলাগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে। সংসদ সদস্য এবং উপজেলা পরিষদগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের জন্য বাংলাদেশ সরকারই দায়ী। প্রথম পাঁচ বছরের ব্যবস্থাটি ছিল বিব্রতকর, বিড়ম্বনাপূর্ণ এবং গোঁজামিলের। ১৯৯১ সালে তৎকালীন নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ বা উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান রাখার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। চেয়ারম্যান ব্যতিত টিএনও বা ইউএনও-এর নেতৃত্বে উপজেলা ব্যবস্থা চালু থাকে।
২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তারা উদ্যোগ নিয়েছিল উপজেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য। তারা আইনের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের পদকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং অতিরিক্ত একটি পুরুষ ও একটি মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে। তারা চেয়েছিল, একইদিনে সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য; যাতে করে একজন আরেকজনকে প্রভাবান্বিত করতে না পারে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখের সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে, তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন আলাদা আলাদা তারিখে করতে সম্মত হয়েছিল। বাস্তবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুধুমাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং নতুনভাবে ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই, তিন সপ্তাহের মধ্যেই ১৯ জানুয়ারি ২০০৯ উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৯ সালসহ পরবর্তী দুই-তিন বছর, উপজেলা চেয়ারম্যানগণ এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানগণ সমিতির মাধ্যমে একতাবদ্ধ হয়ে উপজেলা পদ্ধতি বা উপজেলার নির্বাচিত নেতাদের কার্যবিধির প্রসঙ্গে অনেক বক্তব্য রেখেছেন, অনেক আন্দোলন করেছেন। জন্মলগ্নে যে অসঙ্গতি ছিল, আজ অবধি সেই অসঙ্গতি রয়েগেছে। একাধিক নির্বাচিত (বাংলাদেশ) সরকার এই অসঙ্গতি দূর করতে পারেনি বা দূর করতে চায়নি। এই কলামেই কিছু পূর্বে বলেছি, অসঙ্গতিটা কোন জায়গায়? একটি উপজেলার ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে, নিজস্ব অর্থায়নে বা ঢাকা থেকে প্রাপ্ত সরকারি অর্থায়নে, উন্নয়নমূলক কর্মকা-, পরিকল্পনা, পরিচালনা, প্রাসঙ্গিক সম্পদ বণ্টন ইত্যাদি কাজের পুরধা-ব্যক্তি বা মাধ্যম ব্যক্তি কে হবেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্য নাকি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান? সংসদ সদদ্যের সাথে কোনো প্রকারের প্রতিষ্ঠানে কাঠামোগতভাবে একতাবদ্ধ না হলেও, সংসদ সদস্যের মর্জি মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন নির্বাচিত সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। অপরপক্ষে উপজেলা পরিষদ নামক প্রতিষ্ঠানে, কাঠামোগতভাবে একতাবদ্ধ হলেও, সকল নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ, উপজেলা চেয়ারম্যানের সহকর্মী হতে পারছেন না। বাংলাদেশের বিগত রাজনৈতিক সরকার তথা আওয়ামী লীগ সরকার এই সাংঘর্ষিকতা বা গোঁজামিলকে সামলানোর জন্য বা বৈধতা দেওয়ার জন্য একটি আইনগত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। ব্যবস্থাটি হলো এই যে, নির্বাচিত সংসদ সদস্য হবেন উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। বহুল প্রচারিত ইনকিলাব পত্রিকায় আজকের এই কলামে স্থানের অভাবে, আমি আর অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারছি না। কিন্তু আমি আপাতত বলে রাখছি যে, বিদ্যমান ব্যবস্থা সংস্কারযোগ্য এবং সংস্কার করতেই হবে, দেশের ও জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে। আমি মনে করি যে, বাংলাদেশের সংবিধান স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। সংবিধানকে সমর্থন করা আমাদের কর্তব্য। অর্থাৎ উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা, উপজেলার অভ্যন্তরে উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য উপজেলাকে আইনগতভাবে দায়িত্ব প্রদান করা এবং সংসদ সদস্যের সংশ্লিষ্টতাকে সম্মানজনকভাবে কমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরেও, সাড়ে পাঁচ বছর আগে সৃষ্ট উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যানদ্বয়ের দায়িত্ব বা কর্তব্যপরিধি পরিপূর্ণভাবে নির্ধারিত নয় কিন্তু যেটা করা প্রয়োজন।
এ কলামে, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের ‘বাড়াবাড়ির’ সংসদ-নির্বাচন এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চের ‘কাড়াকাড়ির’ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সংসদ সদস্যের মধ্যে দায়িত্ব নির্ধারণের ভারসাম্যের কথা আলোচনা করেছি। বাড়াবাড়ি এবং কাড়াকাড়ির প্রতিবাদ করছি। কারণ, জনগণের ভোট ব্যতিত, আরপিও ধারার শুভংকরের ফাঁকিতে তথাকথিত নির্বাচিত সংসদ সদস্য, স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান বা উপজেলা পরিষদের উপর যেভাবে তদারকি বা আধিপত্য বিস্তার করছেন, সেটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র চাই।
পূর্ব প্রকাশিত: দৈনিক ইনকিলাব

www.generalibrahim.com

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *